শাওন শায়লা পিপিএম
১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এখন এই দিবসটিকে বৈশ্বিক পর্যায়ে নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের একটি তাৎপর্যপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নারী-পুরুষের সমতা ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আদর্শ বাস্তবায়নে সরকার ও নাগরিক সমাজের দায়বদ্ধতা পুনর্ব্যক্ত করার অবকাশ সৃষ্টি করে ৮ মার্চ।
প্রায় ৯ দশক আগে ‘অবরোধবাসিনী’দের দুঃখগাথা রচনা করেছিলেন নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া। সেই অন্ধকার ইতিহাস পেছনে ফেলে বেগম রোকেয়ারই ‘সুলতানার স্বপ্ন’র পথে হাঁটছে নারী, নেতৃত্ব দিচ্ছে রাজনীতি, প্রশাসনসহ সব অঙ্গনে।
বাংলাদেশের প্রশাসন, পুলিশ ও বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে সরকারি চাকরিতে নারীদের অবস্থান সুসংহত হচ্ছে। নারীরা তৃণমূলে যেমন কাজ করছেন, তেমনি রয়েছেন শীর্ষ পদে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বাংলাদেশ পুলিশে মোট নারী সদস্যের সংখ্যা ১৫ হাজার ১৬৩। তাদের মধ্যে ডিআইজি দুজন, অ্যাডিশনাল ডিআইজি তিনজন, পুলিশ সুপার ৭১ জন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ১০৯ জন ও সহকারি পুলিশ সুপার ১০০ জন। ইন্সপেক্টর ১০৯, এসআই ৭৯৭, সার্জেন্ট ৫৮, এএসআই এক হাজার ১০৯, নায়েক ২১১ এবং কনস্টেবল ১২ হাজার ৫৯৪ জন।
জেলায় পুলিশ সুপার হিসেবে পাঁচ জেলায় নারী পুলিশ কর্মকর্তা কাজ করছেন। কাজ করছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে।
দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে নারীদের অবস্থান ভালো। বাধা আছে, তবে তার মধ্যে নারী এগিয়ে চলেছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। নারীর অগ্রযাত্রার একেকটি ধাপ। রাজনৈতিক লড়াইয়ে যেমন ছিল নারীর অংশগ্রহণ। আবার সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে এ দেশের নারীরা খুলে দিয়েছে আলোর উৎস-দ্বার। এভারেষ্ট্রের চূড়ায় বাংলাদেশের নারীরা এঁকেছেন বিজয়গাথা। খেলার মাঠেও নারীদের অগ্রযাত্রা সমতার সমাজ নির্মাণের পথকে সুগম করছে। বিগত চার দশকে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশের পথে এগিয়ে নিতে আমাদের নারীর অবদান অনস্বীকার্য।
নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক সমাজ নির্মাণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নির্দেশনায় সরকার বেশকিছু কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এগুলো আন্তর্জাতিকভাবেও প্রশংসিত হচ্ছে। সার্বিক মূল্যায়নে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় নারীর বিরাট অবদান রয়েছে। চরম দারিদ্র্য হ্রাস ও ক্ষুধা নির্মূলের একটি মূল কারণ উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদন, যা প্রায় তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিবিএসের জরিপে দেখা যায়, বর্তমানে কৃষি খাতে ৯০ লাখ ১১ হাজার নারী নিয়োজিত, যার বিরাট অংশ মজুরিবিহীন শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। রপ্তানি খাতের সিংহভাগ রেমিট্যান্স আসছে নারী শ্রমিকের মাধ্যমে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুসারে, পাঁচ বছর আগে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ছিল এক কোটি ৬০ লাখ। সেটি বেড়ে হয়েছে এক কোটি ৮৩ লাখ।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের ৬২ শতাংশ নারী আয়বর্ধক কাজে যুক্ত। দক্ষিণ এশিয়ায় এটি সর্বোচ্চ হার। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডাব্লিউইএফ) ২০২০ সালের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চারটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এক নম্বর অবস্থানে আছে। এগুলো হচ্ছে মেয়েদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় তালিকাভুক্তি, জন্মের সময় ছেলে ও মেয়ে শিশুর সংখ্যাগত সমতা এবং রাষ্ট্রের নেতৃত্বে নারী। উল্লেখ্য, নারীশিক্ষার প্রসার, পারিবারিক স্যানিটেশন স্বাস্থ্যসম্মত করা, নারীর প্রজনন হার ও শিশুমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস, উদরাময় নির্মূল ও পুরুষের তুলনায় নারীর গড় আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি ইত্যাদিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন নারীরাই, যা পরোক্ষভাবে কর্মক্ষম জনশক্তি সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে।
নারী উন্নয়নের মডেল অনুযায়ী নারীর ক্ষমতায়নের জন্য প্রথমত, ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নারীর মালিকানা স্থাপন। দ্বিতীয়ত, মানসম্মত কাজের পরিবেশ এবং মজুরি। তৃতীয়ত, শান্ত ও ন্যায় বিচার বা নায্যতা। এবং চতুর্থত, সবস্তরে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
যেকোনো সমাজে প্রবৃদ্ধি অর্জনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য যদি বর্ধিত সম্পদে প্রবেশগম্যতা সৃষ্টি না হয়, তাহলে নারীর ক্ষমতায়ন তুলনামূলকভাবে আরও সংকুচিত হয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সম্পদের মালিকানার ক্ষেত্রে শ্রেণিবৈষম্যের সঙ্গে লিঙ্গবৈষম্য যোগে নারী তুলনামূলকভাবে অধিক দারিদ্র্য ও ক্ষমতাহীনতার শিকার। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় প্রতীয়মান হয় যে বাংলাদেশে ৭০ শতাংশ নারী ভূমিজ ও আর্থিক সম্পদ থেকে বঞ্চিত।
পারিবারিক শ্রমের ব্যবহারিক মূল্য দেওয়া হলেও অর্থনৈতিক মূল্য এখনো স্বীকৃত নয়। মোট দেশজ উৎপাদনেও (জিডিপি) তা ধরা হয় না। বর্তমানে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক গতিধারায় সম্পদ কেন্দ্রীকরণের প্রবণতার কারণে নারী-পুরুষ সমতা অর্জন ও নারীর ক্ষমতায়ন আরও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে, যদি আশু পদক্ষেপ গৃহীত না হয়।
বিভিন্ন গবেষণায় নারীর ক্ষমতায়নে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে পাঁচ ধরনের বাধার কথা বলা হয়েছে।
১. নারীর অংশগ্রহণ প্রক্রিয়ায় পরিবারের সমর্থনের অভাব এবং নিষেধ
২. নারী নের্তৃত্ব মেনে নেওয়ার জন্য সামাজিক অনীহা
৩. পরিবারের পুরুষ সদস্যের ওপর নির্ভরতা বা নারীদের চলাচলের ওপর বাধা-নিষেধ আরোপ
৪. অর্থনৈতিক সম্পদের অভাব
৫. শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাব
আমাদের গণমাধ্যমকে আরও নারীবান্ধব হতে হবে এবং সব পরিসংখ্যানে নারীর অবদানকে দৃশ্যমান এবং প্রচারমুখর করতে হবে। আমাদের উন্নয়ন এজেন্ডায় কৌশলগত পরিবর্তনের মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, মানবিক ও সাংস্কৃতিক- প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের ৫০: ৫০ সম-অংশীদারত্ব নিশ্চিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নারীর প্রতি বৈষম্য নিরসনে সরকারের যে দায়বদ্ধতা রয়েছে, তার অঙ্গীকারস্বরূপ সিডও সনদের ধারা ২ ও ১৬ (চ) থেকে সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে সনদকে কার্যকর করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে দেশের অগ্রগতিতে নারীর অবদানকে দৃশ্যমান করতে হবে, পারিবারিক মূল্যবোধ ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি মানবিক করতে হবে।
জাতীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে এসডিজি তথা টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার আর কোনো বিকল্প নেই। সামাজিকভাবে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমাজের বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছেন নারীরা। কখনো আবার যোগ্যতার বলে পুরুষদের নেতৃত্বও দিচ্ছেন নারী। নারী-পুরুষের এই সমতার চর্চা ভবিষ্যতের সুন্দর মানবিক পৃথিবী গড়ে তুলবে। সমতার পৃথিবী সুন্দর পৃথিবী।
লেখক : অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন শেষে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে সংযুক্ত।
0 Comments