সাইফুল ইসলাম সান্তু
স্যারের গর্বিত ছাত্রদের মধ্যে আমিও একজন।
সারদায় প্রতিদিন ভোরে পিটিতে যাওয়ার সময় স্যারকে পেতাম ফজরের নামাজে যাওয়ার সময়। মাঝে মাঝে পিটি থেকে ফেরার সময়ও পেতাম। স্যারের একটা করোলা গাড়ি ছিল। যেখানে এসপিরা পাজেরো গাড়ি চালাতেন সেখানে তিনি এডি. আইজিপি করোলা গাড়ি! ড্রাইভার ছিল না। স্যারকে নিজেই ড্রাইভ করতে দেখতাম। হাত উঁচু করে প্রত্যেকের সালাম নিতেন। মুখে থাকতো মুচকি হাসি। ওহ কি অমায়িক মানুষ রে বাবা!!
একাডেমিতে প্রিন্সিপালের বাসভবন সেই ঐতিহাসিক ছোট কুঠিতে তিনি বাস করতেন না। নিজের মায়ের কাপড় তিনি নিজেই ধুয়ে দিতেন। কোন গৃহকর্মীও নাকি তিনি রাখতেন না। পাবলিক পরিবহন ব্যবহার করতেন। ট্রেনে করে যাতায়াত করতেন। আমাদের ক্যাডেটরা ট্রেনিংয়ে থাকা অবস্থাতেই ছুটি থেকে আসার সময় স্যারকে ট্রেন জার্নিতে পেত। সেল্ফি তুলতো। কী মানুষ রে বাবা! স্যার অভিবাদন নেওয়ার জন্য যখন ডায়েচে আসতেন সিনা তিন ইঞ্চি বড় হয়ে যেত! স্যারকে স্যালুট দিতে পেরে গর্ব হত। স্যার যখন প্যারেড মাঠে আসতেন সারদার ৪৩০ তাপমাত্রা কিছুই মনে হত না। স্যার যখন ডায়েচে দাড়িয়ে আদিকালের গল্প বলতেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম। স্যার সবসময় একটা ডায়ালগ বলতেন- ‘পুলিশ হচ্ছে শ্রেষ্ঠ মানুষ, পুলিশিং শ্রেষ্ঠ পেশা’। একাডেমিতে আরেকজন স্যারকে পেয়েছিলাম। প্রিয় ডিআইজি বাসুদেব বনিক স্যার। এই দুজন স্যার আজীবন শিক্ষক হিসেবে শ্রদ্ধায় থাকবেন।
স্যার তখন বান্দরবান জেলার এসপি। নগরের কোলাহলমুক্ত, প্রাকৃতিক দৃশ্য আর হরেক রকমের বাহারি ফলের সমারোহ সে জেলাটি। পুলিশ লাইনস্ও তার ব্যতিক্রম নয়। ছোট-বড় নারিকেল গাছে প্রচুর নারিকেল ধরেছে।
একদিন লোক দিয়ে গাছের সমস্ত পাকা নারিকেল পাড়লেন। স্যার বললেন; দেখি আমাকে দু’টা নারিকেল দাও। জেলার পুলিশ সুপার নারিকেল খেতে চেয়েছে শুনে সবাইতো চরম খুশি।
পরে স্যার দু’টা নারিকেল নিলেন এবং তার সমমূল্য পরিশোধ করলেন এবং বাকি নারিকেল বিক্রি করে সমস্ত টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিলেন।
ঘটনা-২
বান্দরবান জেলার এসপি থাকাকালীন সময়ে একদিন তিনি দেখলেন তাঁর দুপুরের খাবারের বাটিতে দু’টুকরা মাংস বেশি। জেলার এসপি বলে দু’টুকরো মাংস বেশি খেতে হবে এ বৈষম্যটা তিনি মানতে নারাজ।
তাৎক্ষণিক বাবুর্চিকে ডাকলেন,
-কী ব্যাপার, আমার প্লেটে মাংস বেশি মনে হচ্ছে কেন?
বাবুর্চিঃ না স্যার, আজ সবার ভাগেই একটু বেশি করে পড়েছে।
-ওকে, তাহলে আরেকটা বাটি আমার কাছে নিয়ে আসো।
বাবুর্চি আরেকটা বাটি নিয়ে আসলেন।
স্যারঃ একি এ বাটিতেতো দু’টুকরা মাংস, তাহলে আমার বাটিতে চার টুকরা কেন?
বাবুর্চি তখন মাথা নিচু করে ভড়কে গেলেন। আজ জানি কী হয়!
স্যারঃ আমার বাটি থেকে দু’টুকরা নিয়ে যাও। আর কোনদিন বেশি দিবা না। একজন কনস্টেবলকে যতটুকু দিবে, আমাকে ঠিক ততটুকু দিবে।
ঘটনা-৩
স্যার যখন ছুটিতে বাড়ি যেতেন, সরকারি কোন প্রটোকল নিতেন না। একবার বাড়িতে যাওয়ার সময় বাস স্টপেজ পর্যন্ত এগিয়ে দেওয়ার জন্য স্যারের ড্রাইভার রিকোয়েস্ট করলেন। স্যার বললেন, এ গাড়িটা সরকার আমাকে সরকারি কাজের জন্য দিয়েছে, ব্যক্তিগত কাজের জন্য নয়। পরে বাস স্টপেজ পর্যন্ত স্যার সিএনজিতে করে গেলেন।
বলছিলাম, বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি নাজিবুর রহমান, এনডিসি, পিএইচডি স্যারের কথা। একজন মানুষ কতটা সৎ, বিনয়ী আর আদর্শবান হতে পারে তাঁর সাথে কথা না বললে বুঝা যাবে না।
সারদা পুলিশ একাডেমিতে স্যার যখন প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন, স্যারের আপ্যায়ন বিলের লক্ষাধিক টাকা নিম্নপদস্থ সকল পুলিশের মধ্যে বন্টন করে দিতেন।
সাদাসিধে জীবন যাপন করা এ মানুষটা আজ অবসরে চলে গেলেন। সত্যি মিস করবো স্যার আপনাকে, মিস করবো সারদা একাডেমির মাস্টার প্যারডে ‘আমার সন্তানেরা’ বলে ডাকা সম্বোধনকে।
নিশ্চয়ই আপনি পুলিশ বাহিনীর জন্য এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।
লেখক : পুলিশ সুপার, কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল, রাজারবাগ, ঢাকা।