দেওয়ান লালন আহমেদ
তোমার সন্তানদের সেভাবে বড় করো না, যেভাবে তোমার বাবা-মা তোমাকে বড় করেছেন। কেননা তারা ভিন্ন সময়ের জন্য জন্মগ্রহণ করেছে।
– হযরত আলী (রা.)
আমার সঙ্গে আমার বাবার সম্পর্ক ছিল -বন্ধুত্বপূর্ণ, শ্রদ্ধার, ভয়ের আবার গভীর মায়ার। আমার বাবার সঙ্গে আমার এবং আমার সঙ্গে আমার ছেলের সম্পর্কের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যগুলো নিরূপণ করলে তাতে যা উঠে আসে, তা শুধুই কষ্টের ও হতাশার। এটা যুগ পরিবর্তনের প্রাথমিক বহিঃপ্রকাশ। বাবা কে যেমন ভয় পেতাম তেমনি বাবার প্রতি ছিল আমাদের প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ও বাবা ছিলেন আমার শৈশবের নায়ক। কিন্তু আমার ছেলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অম্ল মধুর আর তিক্ততার।
পুলিশের ব্যস্ততার চাকরির জন্য ছেলেকে জন্মের তিন থেকে চার বছর পর্যন্ত তেমন সময় দিতে পারিনি কিন্তু তাই বলে ভালোবাসা আর মমতার কোনো কমতি কখনও ছিল না।
হয়ত সেই থেকে কিছুটা শূন্যতা বিরাজ করছিল তার সঙ্গে যোগ হয়েছে পারিপার্শ্বিক কিছু মানুষের অমানবিক উদ্ধতপূর্ণ আচরণ আমার ছেলের উপর অনাকাক্সিক্ষত ভাবে একটি বিশাল নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর ফলে সে অসামাজিক ও রুক্ষ্ম আচরণ ধারণ করেছে। ইন্টারনেট আসক্তি তৈরি হয়েছে পাবজির মতো একটি চরম প্রতিক্রিয়াশীল অস্ত্রবাজি মানুষ খুনের মানসিকতার খেলা আমার ছেলের সঙ্গে আমার সম্পর্ককে কালিমা লিপ্ত করেছে।
আমার বাবা জীবনে বহুবার আমাকে মেরেছেন, বকাও দিয়েছেন, আমার সামনে আমাদের মায়ের সঙ্গে ঝগড়া ঝাটি করেছেন যা অনেক সময় খুব খারাপভাবে শেষ হতো। এরপরেও বাবার সঙ্গে কখনও আমাদের সম্পর্কের অবনতি হয় নি। অথচ মাত্র কয়েকবার তাকে বকা দেয়া এবং তার মায়ের সঙ্গে তাকে নিয়ে অল্প বিস্তর ঝগড়া করা ছাড়া তাকে আমি কখনই কোনো খারাপ কিছু বলি নি।
রাত চার-পাঁচটা পর্যন্ত পাবজি খেলে বকাবকি করলেও একটু থামে না। ১২ বছরের একটা ছেলে সারারাত গেমস খেলে ভোরে ঘুমায়। ঘুম ভাঙে বিকেলে। এমন অভ্যস্ততা থেকে তাকে কীভাবে বের করব ? আমি ভাষাহীন হয়ে যাচ্ছি।
এই সংস্কৃতি, পারিবারিক অনুশাসন সামাজিক মূল্যবোধ আমাদের নয় এটা কুসংস্কৃতি আর মূল্যবোধের ভয়ংকর সঙ্কট।
গতকাল রাতে আমার ছেলে আমাকে ইংরেজিতে মেসেজ দেয়, আমি বলি বাক্যের মধ্যে ক্যাপিটাল লেটার দেওয়া যাবে না। এটা বলার পর সে আমাকে বলে এই জেনারেশনে আমার বন্ধুরা কেউ এটা ফলো করে না। আমি বললাম যে আমি চাই জ্ঞানগরিমায় তুমি আমাকে ছাড়িয়ে যাও কিন্তু তোমার বয়স অনুযায়ী তুমি এখন সেটা অর্জন করতে পার নি। তোমার চেয়ে আমি বেশি জানি এটা তো মানো?
সে আমাকে লিখল যে -আমি তোমার মতো হতে চাই না, তখন আমি তাকে লিখলাম যে – বাবার সঙ্গে এমন করে কখনও কথা বলবে না।
তখন সে আমাকে মেসেজ দেয় – আইডিসি, যার মানে- আই ডোন্ট কেয়ার! বাবা হিসেবে সে আমার কোনো কথা মানে না?
এরপরে আমি আমার টেমপার হারিয়ে ফেলি আমার মাত্র ১২ বছর বয়সের ছেলের এমন আচরণ। প্রায় ২৪ ঘণ্টা পার হলেও বিষয়টা আমার মাথা থেকে বের হচ্ছে না।
‘Your children are not your children. They are the sons and daughters of Life’s longing for itself You may give them your love but not your thoughts, for they have their own thoughts. You may house their bodies but not their souls, for their souls dwell in the house of tomorrow…’ [Kahlil Gibran]
পাবজি, ফ্রি ফায়ারসহ নানা গেইম এবং যান্ত্রিকতার এই যুগের কালো প্রভাব ক্রমেই আমাদের মায়া-মমতাহীন শ্রদ্ধা-ভালোবাসা বিহীন প্রজন্ম কে তৈরি করে দিচ্ছে, যা আমাদের খুব খুব ভাবিয়ে তুলছে। সে তো মাঠের সবুজ ঘাস ছুঁয়ে হাঁটে নি, পুকুরে নদীতে ঝাঁপিয়ে গোসল করে নি বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ফুটবল খেলে নি, মামা-খালা, ফুফু দের বাসায় আম কাঁঠালের সময় বেড়াতে যান নি। কিংবা বাসায় কখনও আত্মীয়স্বজনদের বেড়াতে ও থাকতে দেখেন নি। এই সব কিছুই তাকে এমন যান্ত্রিক ও ঔদ্ধতপূর্ণ আচরনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। মাত্র ১২ বছর আমার ছেলের বয়স এই অল্প বয়সেই সে আমার মাথা ব্যথার কারণ হয়ে গেছে, যা খুব খুব অনভিপ্রেত।
আসুন আমরা সবাই মিলে আমাদের যার যার সন্তানকে গেমিং ও ইন্টারনেট নির্ভরতাকে সমূলে উৎখাত করে এর কবল থেকে আগামী প্রজন্মকে বাঁচাই।
লেখক : পুলিশ সুপার, ট্যুরিস্ট পুলিশ।