মোঃ আবু জাফর
লোকটির নাম রাজীব। ৫৩ বা ৫৪ বছর বয়স। বয়সটা তেমন বেশি না হলেও শারিরীক ও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ার কারণে যে কেউ তাকে দেখে ৭০ বছরের বৃদ্ধ বলে ভেবে নিলে মোটেও ভুল হবে না। একটি কাঠের চেয়ার পেতে বাড়ির সামনে একটি আম গাছের ছায়ায় সে বসে আছে। পায়ের কাছে পরে আছে কয়েকটি শুকনো পাতা। আম গাছের ঝরা পাতা। একটু দূরে কয়েকটি পিঁপড়া কোন একটি খাবার টেনে নিয়ে গর্তে ঢোকার চেষ্টা করছে। এটা তার পৈতৃক বাড়ি। এই বাড়িতেই তার জন্ম। এই গ্রামের নদি, খাল, পুকুর আর মাঠে ঘাটেই কেটেছে তার শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের অনেকটা সময়। তারপর এক সময় জীবীকার টানে ঢাকায় গিয়ে নানা ধরনের ব্যবসা বাণিজ্য ও কর্ম করার চেষ্টা করেছে। কোনটায়ই সফলতা অর্জন করতে পারেনি। করতে পারেনি, না বলে অবশ্য বলা যায় করার চেষ্টাও তেমন করেনি। সব সময়ই একটা উদাসীনতা ও গাছাড়া ভাব ছিল তার মধ্যে। তার প্রধান কারণ, বাবার একমাত্র সন্তান ছিল সে। কখনও ব্যবসার কথা বলে, কখনও অন্য কোন উপায়ে বাবার কাছ থেকে বহুবার টাকা পয়াসা নিয়ে বেশ কয়েক লক্ষ টাকা বন্ধু বান্ধবের পিছনে নষ্ট করেছে।
তার নিজেরও একটি মাত্র ছেলে। ছেলেটির বয়স প্রায় ১৯ বছর। লেখাপড়ায় অনেকটা উদাসীন। বেশ কয়েকবার ক্লাশে ফেল করেও শেষ পর্যন্ত কোনমতে এসএসসিটা অতিক্রম করলেও এরপর আর এগুতে পারেনি। কারো কোন কথাই শোনে না। যা মন চায় তাই করে বেড়ায়। আর সব সময় একা একা কি যেন চিন্তা করে। বাবার সাথে একটা বড় ধরনের দুরত্ব। তাই ছেলের মনের কথা কোন কিছুই জানতে বা বুঝতে পারে না রাজীব। ছেলেটিও সব সময় বাবাকে এড়িয়ে চলে। স্ত্রী শামীরা চুপচাপ একা একাই বেশির ভাগ সময় কাটায়। কারণ, সংসার জীবনের শুরু থেকেই সে কোন কাজে তেমন কোন অংশগ্রহণ করেনি আর আজও করছে না, অথবা বলা যায় করার দরকার মনে করছে না। মাত্র বছর খানেক আগে রাজীবের মা মারা যায়। তারপর থেকেই রাজীব আরও বেশি নিজের মধ্যে গুটিয়ে যায়। ধীরে ধীরে চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসে। একটা অপরাধবোধ ও হতাশা তাকে একটু একটু করে গ্রাস করতে থাকে। মনে মনে ভাবে, বাবা পাশে থাকলে হয়তো আজ এমনটি হতো না। বাবার কথা মনে হতেই চোখের কোনে দু’ফোটা অশ্রু দেখা দেয়। দুর্বল হাতে অথচ পরম মমতায় অশ্রুবিন্দুগুলো মুছে নেয় রাজীব। এ তো অশ্রু নয়, যেন বাবাকেই স্পর্শ করছে।
স্মৃতিতে ভেসে ওঠে কত কথা। মাত্র কয়েক বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ছবির মত দেখতে পায় রাজীব। বাবা ছিলেন পুলিশ অফিসার। কনস্টবল হিসাবে পুলিশে যোগদান করে অনেক কষ্ট আর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণ চাকুরী করে ইন্সপেক্টর হিসাবে অবসর গ্রহণ করেছিলেন। অবসরের পরেও বছর পাঁচেক বেঁচে ছিলেন। তারপর একদিন এ পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যান না ফেরার দেশে। মৃত্যুর সময় অন্য কোন কষ্ট তার মধ্যে ছিল কিনা জানা যায়নি। শুধু একমাত্র সন্তানকে সঠিক পথে আনতে পারেননি এবং কোন দিনও সন্তানের ভালবাসা পাননি এ কষ্টটা বুকে নিয়েই বোধ হয় তিনি চলে গেলেন। কথাগুলো ভাবতেই রাজীবের বুকের ভিতরটা ভারি হয়ে ওঠে। সে আবারও ভাবতে থাকে- যখন তার বয়স ১৩/১৪ বছর তখন বাবা ছিলেন এএসআই। পুলিশের কোন একটা অফিসে ডিউটিরত ছিলেন। বেতনের টাকা দিয়ে স্ত্রী সন্তান, তার মা ভাই ও মা মারা যাওয়া খুবই কাছের, রক্তের সম্পর্কের একটি মেয়ের দায়িত্ব ও লেখাপড়া সহ সংসারের যাবতীয় চাহিদা মেটাতে গিয়ে হিমসিম খেতেন। তারপরেও কারো কোন চাহিদা অপূর্ণ রাখেননি। প্রথম যেবার রাজীব এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সে বছর ফল প্রকাশের দিন বাবা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিলেন। অবশেষে ফেল করার সংবাদটি যখন জানতে পারেন তখন বুকের ভিতরটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলেও রাজীবকে একটি কটু কথাও বলেনি, বরং ব্যর্থতা থেকেই আগামী দিনের শিক্ষা নিয়ে আবার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু লাভ কিছুই হয়নি। কোন দিনই সে একটি ভাল ফলাফলের সংবাদ দিয়ে বাবাকে একটু আনন্দ দিতে পারেনি। তার পর কত ভাবে কত টাকাই না বাবার কাছ থেকে নিয়েছে ও নষ্ট করেছে। বাবা তার প্রতিটি কষ্টার্জিত টাকা নিজের রক্তসম দামী জেনেও সন্তানকে নানাভাবে সহযোগিতা করে একটা পথে দাঁড়ানোর সব রকম সহযোগিতা করে গেছেন। কিন্তু সফলতার মুখ রাজীব কোনদিনও তার বাবাকে দেখাতে পারেনি। তারপর যখন বয়স ২৮ বছর তখন বাবা সাধ্যমত চেষ্টা করে তাকে বিবাহ করিয়ে দিয়েছে। মেয়েটি বাবার পরিচিত হলেও রাজীবের পূর্ণ পছন্দ ছিল। বিবাহের পরেও ছেলের সংসারের যাবতীয় জিনিসপত্রই শুধু নয়, চাল ডাল থেকে শুরু করে যাবতীয় বাজার সওদা নিজেই করে দিয়েছেন। আলাদা বাসায় থাকার কারণে বাসা ভাড়া, গ্যাস বিল বিদুৎ বিল সহ যাবতীয় খরচ বাবা নিজেই বহন করেছেন। বিনিময় দুঃখ ছাড়া বাবাকে আর কিছুই সে দিতে পারেনি। ব্যবসার নাম করে টাকা পয়সা নিলেও সেই ব্যবসা থেকে বাবাকে সে কোন দিন ঈদ বা অন্য কোন আনন্দ উপলক্ষে একটি টাকার জিনিসও বাবার হাতে তুলে দিতে পারেনি। আর বাবাও বোধ হয় এতগুলো ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে অনেকটা অভিমান করে কোন দিন ছেলের বাসায় কোন কিছুই মুখে দিতেন না। পেনসনের পরেও প্রাপ্য অনেকটাই রাজীবের হাতে তুলে দিয়ে সেই যে একাকীত্ব জীবন যাপন করা শুরু করেছিলেন মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত আর কারো সাথে আপোষ করেননি। সাধ্যমাতো প্রচেষ্টায় সবাইকে গুছিয়ে দিয়ে নিজে নিজের মধ্যে ডুব দিয়ে একা একাই সময় কাটাতেন। সে যে কত বড় কষ্টের ও বেদনার তা সেদিন না বুঝলেও রাজীব আজ সব কিছুই অনুভব করতে পারে। ছেলে হয়ে যা কোন দিনও বোঝার দরাকার মনে করেনি আজ বাবা হয়ে সে বিষয়টা কত অনায়াসেই উপলব্ধি করতে পারছে। এভাবেই চলে গেল কতটা বছর।
আজ সেই বাবা নাই। ইচ্ছে থাকলেও বাবার জন্য আজ আর কিছুই করার নাই। মাঝে মাঝে একা একা ভাবে আর মনে মনে বলে, বাবা একবার ফিরে এসো, মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য হলেও ফিরে এসো, আমি আমার ভুলগুলোকে শুধরে নেব বাবা, তুমি দেখো। কিন্তু বাবা ফিরে আসে না। আসতে পারে না। কারণ মস্ত বড় ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ প্রকৃতির নিয়ম ভেঙ্গে কাউকে করতে দেয়া হয় না। এ সব ভাবতে ভাবতে কখন যেন সন্ধ্যা নেমে এসেছে খেয়াল করেনি রাজীব। পশ্চিম দিগন্তে আকাশে কয়েকটি টুকরা টুকরা মেঘ জমে আছে। কয়েকটি কালো মেঘের পাশেই এক টুকরা সাদা মেঘ। ভাল করে তাকাতেই রাজীব ঐ সাদা মেঘের ভিতরে স্পষ্ট তার বাবার মুখটি দেখতে পায়। বাবা কি তবে ঐ দূরের আকাশে বসে আজও তার কর্মকান্ড লক্ষ্য করে যাচ্ছে। বাবা, বাবা বলে ডেকে ওঠে রাজীব। এমন সময় কারো পায়ের শব্দে ডান দিকে তাকাতেই দেখতে পায় আবছা অন্ধকারে তার ছেলেটি বাড়ি থেকে বাহির হয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে। নাম ধরে দুই তিন বার ডাক দেয় রাজীব। ছেলেটি শোনে না, নাকি শুনতে পেয়েও কোন জবাব দেয় না রাজীব বুঝতে পারে না। শুধু মাত্র ছেলের গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। মাত্র কয়েকটি মুহুর্ত, তার পরেই ছেলেটি হারিয়ে যায় আবছা অন্ধকার থেকে আরও গভীর অন্ধকারের দিকে। চলে যায় দৃষ্টির বাহিরে। তবুও ছেলেকে দেখার আগ্রহ নিয়ে রাজীব বোকার মত অন্ধকারের দিকে তাকিয়েই থাকে। কেটে যায় অনেক সময়। ছেলে তার ফিরে আসেনা। একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে একা একাই ঘরের দিকে পা ফেলে রাজীব। কিন্তু অন্ধকারটা এত বেশি যে, ঘর অথবা ঘরে যাবার পথ কোনটাই ভালভাবে দেখতে পাচ্ছে না রাজীব ॥
লেখক : ইন্সপেক্টর, স্কুল অব ইন্টেলিজেন্স, স্পেশাল ব্রাঞ্চ, উত্তরা, ঢাকা।