ইমদাদুল হক মিলন
তাগড়া জোয়ান লোকটা খুবই আয়েশি ভঙ্গিতে সিগ্রেট টানতে টানতে হাঁটছে। পরনে ময়লা প্যান্ট আর টি-শার্ট। সঙ্গের বাচ্চা ছেলেটির বয়স দশ-এগারো। তার মাথায় বেশ ভারী একটা বোঝা। বোঝার ভারে সে বাঁকা হয়ে গেছে। রাত সাড়ে আটটা বাজে। তাগড়া জোয়ান লোকটি শিশুটিকে তাড়া দিচ্ছে, এই তাড়াতাড়ি হাঁট।
আমি ওষুধের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখছি। দুজন পুলিশ কনস্টেবল দাঁড়িয়ে আছেন রাস্তার পাশে। দুজনেই এগিয়ে এলেন। তাগড়া জোয়ান লোকটি আর শিশুটিকে থামালেন। শিশুটির মাথা থেকে দুজনে ধরে বোঝাটি নামিয়ে রাখলেন। লোকটিকে জেরা করতে লাগলেন।
এই বাচ্চাটি কে?
আমার ভাইগনা
আপন ভাগনে?
জি, আমার ছোট বইনের পোলা।
এত ভারী বোঝা বাচ্চাটির মাথায় আপনি দিয়েছেন কেন?
লোকটা ভড়কে গেল। না, মানে আমি সিগারেট খাইতেছিলাম তো। এর লাইগা ভাইগনার মাথায় দিছি।
ভাগনে না হয়ে আপনার ছেলে যদি হতো আপনি কি এই কাজটি করতেন?
লোকটা ততক্ষণে সিগারেট ফেলে দিয়েছে। একটু ভয়ও পেয়েছে। কনস্টেবলদের কথায় আমতা আমতা করতে লাগল।
এই বোঝা নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?
এইতো এই গলির ভিতরেই আমার বাসা। বইন গ্রামে থাকে। ভাইগনা থাকে আমার কাছে। আমিই পালি। বাড়ির কামকাইজ করে আবার স্কুলেও যায়।
কনস্টেবল দুজন তারপর বোঝাটা সেই লোকটির মাথায় তুলে দিলেন। চলুন, আপনার বাসাটা চিনে আসি।
লোকটা বোঝা মাথায় নিয়ে ভয়ে ভয়ে হাঁটতে লাগল। বাচ্চা ছেলেটা তখন নিজের ঘাড় ঢলছে অর্থাৎ ভারী বোঝা টানার ফলে ঘাড় ব্যথা করছে।
একজন কনস্টেবল বললেন, তুমি ভয় পেয়ো না বাবা। তোমার মামা যাতে তোমার সঙ্গে এমন ব্যবহার আর না করে সেই জন্য আমরা তার বাসাটা চিনে আসব। থানার কাছেই যেহেতু বাসা, মাঝে মাঝে গিয়ে তোমার খবর নিয়ে আসব।
বাচ্চা ছেলেটি খুব খুশি।
এই ছেলেটির নাম বাচ্চু। কয়েক দিন পর এক সকালে ছেলেটির সঙ্গে আমার দেখা। সে স্কুল থেকে ফিরছিল। ডেকে সেদিনকার কথা জিজ্ঞেস করলাম। বাচ্চু বলল, পুলিশ আংকেলরা মামার মাথায় বোঝা উঠাইয়া দেওয়ার পর থেকে মামা একদম বদলাইয়া গেছে। সে আমার সঙ্গে আর কোনো খারাপ ব্যবহার করে না। বাড়ির কেউ বেশি কাজ করায় না। আমি এখন খুব ভালো আছি।
হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করলাম, বাচ্চু, বড় হয়ে তুমি কী হতে চাও?
বাচ্চু সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমি পুলিশ হবো।
বাচ্চুর সঙ্গে ওটুকুই আমার কথা হয়েছিল। সে কেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা অন্য কিছু না হয়ে পুলিশ হতে চায়? এ বিষয়টি নিয়ে আমি ভেবেছি। নিশ্চয়ই সে পুলিশের ক্ষমতা নিয়ে ভেবেছে। পুলিশকে মানুষ ভয় পায় কিংবা পুলিশের কথা মানুষ শোনে-এটা সে বুঝেছে। অন্যদিকে পুলিশের মানবিকতার দিকটাও তার মনে দাগ কেটেছে। অর্থাৎ সে ক্ষমতাবান হতে চায় ভবিষ্যতে। একাধারে মানবিক হতে চায়, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে চায়। একজন হৃদয়বান ভালো মানুষ সে হতে চায়। মানুষের সেবক হতে চায়।
পুলিশদের নিয়ে সাধারণ মানুষের ধারণা উঁচু স্তরের নয়। মানুষ মনে করে পুলিশ মানেই নির্দয় এক শ্রেণির মানুষ। যাদের মানবিক গুণাবলি বলতে গেলে নেই। যাদের অনেকেই দুর্নীতিপরায়ণ ইত্যাদি ইত্যাদি।
এবারের এই করোনাকালে পুলিশদের নিয়ে সাধারণ মানুষের পুরনো সব ধারণা একেবারেই বদলে গেছে। এবার আমরা দেখেছি অসাধারণ এক পুলিশ বাহিনী। মানবিকতায় অনন্য এক পুলিশ বাহিনী। দেশের মানুষ এই পুলিশ দেখে মুগ্ধ হয়েছে যেমন, তেমন বিস্মিতও হয়েছে। পত্রপত্রিকাগুলোতে একের পর এক রিপোর্ট বেরিয়েছে এই মানবিক পুলিশ বাহিনী নিয়ে। আমাদের ‘কালের কণ্ঠ’ পত্রিকায় ৩ মে ২০২০ তারিখে লেখা হয়েছে ‘করোনায় পাঁচজনের মৃত্যু, আক্রান্ত ৭৪১, তবু সেবায় অনড় ‘যোদ্ধা পুলিশ’। জনকণ্ঠ ৩ মে ২০২০ ‘করোনা সংকট : মানবিক এক পুলিশ বাহিনী’। চ্যানেল আই অনলাইন ২১ এপ্রিল ২০২০ ‘বাংলাদেশ পুলিশ দারুণ সাহসী ও মানবিক ভূমিকা পালন করছে’। প্রথম আলো ১৯ জুন ২০২০ ‘করোনাকালের মানবিক পুলিশ’। সমকাল ১৬ মে ২০২০ ‘মানুষের পাশেই আছে মানবিক পুলিশ’। দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডস বাংলা ২৪ এপ্রিল ২০২০ ‘স্যালুট মানবিক পুলিশ’।
কেন পত্রপত্রিকাগুলো পুলিশ বাহিনীর এ রকম জয়গান গেয়েছে, গেয়ে চলেছে? কারণটা কী? কারণ হলো, করোনার এই দুঃসময়ে পুলিশ বাহিনী নানামাত্রিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। লকডাউন যেন সবাই মানে আমাদের পুলিশ বাহিনী অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তার দেখভাল করেছে। মানুষের সঙ্গে মোটেই দুর্ব্যবহার করেনি। বরং মানুষকে বুঝিয়েছে। লকডাউন না মানলে কী কী ক্ষতি হতে পারে, মাস্ক ব্যবহার না করলে কী কী ক্ষতি হতে পারে সুন্দরভাবে সেসব বুঝিয়ে মানুষকে ঘরে ফেরত পাঠিয়েছে। ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা পালন করেছে পুলিশ। সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে মানুষকে সচেতন করেছে। করোনা রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছে। করোনায় মৃত মানুষের কাছে তার আত্মীয়-স্বজন অনেকেই এগিয়ে আসেনি। পুলিশ এগিয়ে গেছে। মৃতের সৎকার করেছে। এতসব কাজে জড়িত থাকার ফলে আমাদের পুলিশ ভাইয়েরা করোনায় বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। অনেকেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আমি সেই বীর পুলিশ ভাইদের উদ্দেশে আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
আরেকটি দৃশ্যের কথা মনে পড়ে।
বছরখানেক আগের ঘটনা। রাস্তার পাশে গাড়িতে বসে আছি। ড্রাইভারকে দোকানে পাঠিয়েছি এক বোতল পানি আনার জন্য। দৃশ্যটা চোখে পড়ল এই সময়। অতিরিক্ত মাল বোঝাই করা হয়েছে একটা ভ্যানে। অতিকষ্টে সেই ভ্যান চালিয়ে নিচ্ছে ভাঙাচোরা শরীরের চালক। ভ্যানের চাকা পড়ে গেল রাস্তার ধারের খাদে। চালক লোকটা হাঁচড় পাঁচড় করছে টেনে তুলবার জন্য। কিছুতেই পারছে না। পাশ দিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে মানুষ। কেউ তাকিয়েও দেখছে না। তরুণ পুলিশ সার্জেন্ট দাঁড়িয়েছিলেন। দৃশ্যটা দেখেই তিনি এগিয়ে এলেন। বেশ কষ্ট করে, ঘেমে নেয়ে উঠতে উঠতে খাদ থেকে তুলে দিলেন ভ্যান গাড়িটি। চালক লোকটির চোখে-মুখে তখন যে কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠতে দেখলাম, ওরকম দৃশ্য দেখলে মন ভালো হয়ে যায়। পুলিশ সার্জেন্টের মুখেও তখন অনাবিল এক প্রশান্তির আলো। মুখটা ঝলমল ঝলমল করছে তাঁর।
আমরা এ রকম পুলিশই চাই। মানবিক, দয়ালু। মানুষের প্রকৃত বন্ধু পুলিশ।
লেখক : বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও
সম্পাদক, কালেরকণ্ঠ।
0 Comments