খন্দকার লেনিন
এলোমেলো মনে একটি উদাসী পাখি…
ডেকে যায় শিউলি ডালের ফাঁকে ফাঁকে…
কোন বিস্ময়ে আকাশের নীল এ প্রান্তরে
এসে থেমে আছে আজ ভোর হতে…?
অনবরত আমাদের অদেখা পূর্বপুরুষদের
লুণ্ঠিত কণ্ঠের চিৎকার আর অপূর্ণ ইচ্ছার
পরাজিত জীবনের…হাহাকারের
স্ফুরণ ঘটছে মুহূর্তে মুহূর্তে।
গ্রামের পর গ্রাম শুধিয়ে…
বাতাসে দুলছে ধানখেত
বিবর্ণ জীবনের আকুতি নিয়ে…
সব নদীর জোয়ার ফুসলে উঠেছে…
কোথাও যেন দাঁড়িয়ে আছি আজ…
শত পৌষ, মাঘ আর বর্ষা পেরিয়ে…
এসেছি এখানে বুকে পাথর বেঁধে…
কলঙ্কিত শোষণের দুঃখ ঘোচাতে…
চারদিক থেমে আছে…নীরবে…থমথমে…
মধ্যদুপুর…
লাঠি ভর করা বৃদ্ধ বা সবুজে ঠাসা
প্রাণময়ী যুবক-যুবতী বা প্রেমিক-প্রেমিকা…
ডোম কি জমিদার…
বহু চরমপত্রের ফেরারি চরিত্র…
সবাই আছে উপস্থিত।
সবার সম্মিলন আজ এ প্রান্তে, এখানে
অভূতপূর্ব আরণ্যকের মতো সারি সারি জনতার
সব চোখ, আজ একটি চোখ হয়ে
সব কথা আজ একটি কথা হয়ে
সব ইচ্ছা আজ একটি ইচ্ছা হয়ে…
ধনুকের ফলার মতো সব মন…একটি লক্ষ্যে
স্থির হয়ে তাকিয়ে…
আহা কি রৌদ্র কি ঘাম…
কি কষ্ট, কি ক্লেশ…
অশেষ মাধুর্যে কী তীব্র আকুতি…
কি কৌলীন্য, কি প্রথা, কি জাত, কি জ্ঞানী, কি মূর্খ…
এর আগে এমন সম্মিলন আর কোথাও ঘটেনি।
বখতিয়ারের আঁধার রাতের ঘোড়ার লাগাম…
হোসেন শাহীর মসনদের হাতল, টিপু সুলতানের চিকচিকে তরবারির খাপ অথবা
পরাজিত সিরাজউদ্দৌলার পালানো নৌকার বৈঠা…
সবই ঊর্ধ্বমান আজ জনতার হাতে হাতে…
অবশেষে অপলক চোখে
তাকিয়ে দেখি বিস্ময়…
মহাকালের দীর্ঘ নিপীড়ন মড় মড় ভাঙে
তাঁর বীরোচিত পদে পদে…
প্রলয়ের মহানায়ক এসে দাঁড়ালেন আমাদের মাঝে
সদা সভ্য নীতিতে…
চোখ তাঁর নির্ঘুম, চশমার কাঁচে ভেসে ওঠে
সাত কোটি বাঙালির অসহায় মুখ…
কপালের ভাঁজে তাঁর বাংলার মানচিত্র এঁকেছে
কোন বিরহী শিল্পী এত দিন নীরবে…?
উদার বক্ষে তিনিই আজ প্রমিথিউস।
অতঃপর এ বিকেলের আকাশ ঘনিয়ে
আমাদের এতদিনের সব শোক আর শোধের
কান্ডারি হয়ে…
বলে গেলেন ভয়হীন বীরের কণ্ঠে…
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’
মুহূর্তেই ঝলসে জনতা, বদলে গেল কণ্ঠ।
চকচক চোখে দেহ-মন হলো উত্তাল ঢেউ
সব চাপা কান্নার বাঁধ গেল খুলে…
বুঝিয়ে দিলেন পিতা নতুন এক লিপির অক্ষর দিয়ে
শোষিত বাংলার মুক্তির পথ কোথায় লুকিয়ে?
দীর্ঘ প্রতীক্ষার সে অপার আহ্বানে…
বারুদের মতো আমরা যার যা কিছু আছে
তা-ই নিয়ে গেলাম ছুটে…
শুরু হলো শত্রু দমন
ছিনিয়ে নিতে বাংলার সবুজ জীবন।
তারপর বহুদিন পরে
একটি বিজয়ী পতাকা হাতে
আমরা যখন দাঁড়িয়ে গেলাম
শোষিতদের দরবার ভেঙে স্বাধীন দেশে
নিজ ভূমে…সেই পিতার কাঁধে ভর করে…
তাঁর স্বপ্নে…স্বপ্ন দেখে…
তখন তোরা কীভাবে পারলি? কীভাবে পারলি?
বাংলাদেশ হয়ে আছে যে বুক
মায়ের কোমল কোলের মতো যে বুক
যে বুকে মাথা পেতে ঘুমাতি প্রতিদিন,
কীভাবে পারলি তোরা… কিভাবে?
অন্ধকার সিঁড়িপথে
সে বুকে রক্ত ঝরাতে…?
অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার, সিটিটিসি, ডিএমপি, ঢাকা