বিনয় দত্ত
১.
আত্মসংবৃতি বা Autism কোনো রোগ নয়। কিন্তু সবাই একে রোগ হিসেবে দেখেন। অটিজম একটি নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার। শিশুর তিন বছরের বয়সের আগে যা প্রকাশ পায়। আত্মসংবৃতির শিশুরা সামাজিক আচরণে দুর্বল হয়, পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে কম সক্ষম হয়। মানসিক সীমাবদ্ধতা থাকে। একই কাজ বারবার করার প্রবণতা থেকে এদের শনাক্ত করা যায়।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ জরিপের তথ্যানুযায়ী, ২০১৩-২০১৬ সালে দেশে অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা ছিল ৪১ হাজার ৩২৯। ২০২০ সালে তা আরও বেড়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক জরিপের তথ্যানুযায়ী, ঢাকা শহরে অটিস্টিক শিশুর হার ৩ শতাংশ আর ঢাকার বাইরে দশমিক ৭ শতাংশ। (বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম, ২/৪/২০২০)
বাংলাদেশে দিন দিন অটিজম আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। তবে যে হারে বাড়ছে, সেই অনুপাতে তাদের জন্য স্কুলের সংখ্যা অপর্যাপ্ত। ঢাকার বাইরের জেলা শহরগুলোতে শিশুদের শিক্ষার কোনো সুযোগ নেই বললেই চলে। গুটিকয়েক স্কুলের শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তাহলে এতো এতো অটিস্টিক শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম কিভাবে পরিচালিত হচ্ছে? দেশের সকল সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয়ে অটিস্টিক শিশুদের পড়ার সুযোগ দেওয়ার কথা সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হলেও বাস্তবতা একদমই ভিন্ন।
ঢাকার উত্তরা নিবাসী ফাইজা করিম। বিয়ের তিন বছর পর তাদের সংসারে একটি ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। বাচ্চাটি সাধারণ বাচ্চাদের মতো নয়। ফাইজা বাচ্চার লক্ষণ দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েন। কথা বলেন একাধিক আত্মীয়স্বজনদের সাথে। ফাইজার স্বামী তারেকও এই বিষয় নিরূপণের চেষ্টা করেন। ধীরে ধীরে তারা বুঝতে পারেন তাদের বাচ্চাটি সাধারণ বাচ্চাদের মতো নয়। বাচ্চাটি অটিজমে আক্রান্ত। শুরু হয় তাদের নতুন যুদ্ধ।
বাচ্চা হওয়ার আগে ফাইজা একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করতেন। তাদেরকে মৌখিকভাবে কথা দিয়েছিলেন বাচ্চাকে একটু বড় করে আবার চাকরিতে ফিরবেন। সেই সিদ্ধান্ত থেকে ফাইজা সরে যান। নিজের সন্তান যেহেতু অটিজমে আক্রান্ত তাই এই সম্পর্কে তারা জানতে শুরু করেন। ডাক্তারের সাথে প্রতিনিয়ত এই বিষয়ে করেন আলোচনা।
সময় গড়াতে থাকে। ফাইজার সন্তান বড় হতে থাকে। সন্তান স্কুলে দেওয়ার সময় শুরু হয় আসল বিড়ম্বনা। দেশের সকল সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয়ে অটিস্টিক শিশুদের পড়াশোনার সুযোগ দেওয়ার কথা বললেও তাদের সন্তানকে বেসরকারি স্কুলে ভর্তি নিতে চায় না। স্কুল কর্তৃপক্ষ অটিস্টিক শিশুদের বিশেষ স্কুলে পড়ানোর নির্দেশ দেন। উত্তরার প্রায় সকল স্কুলে ঘুরে ঘুরে তাদের সন্তানকে তারা ভর্তি করাতে পারেননি। শেষমেষ বাধ্য হয়ে তারা অটিস্টিক শিশুদের বিশেষ স্কুলে ছেলেকে ভর্তি করান। এই অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে ফাইজা বলেন, ‘সবকিছু শোনার পর যখনই শুনে আমার বাচ্চা অটিস্টিক। তখন তাদের আচরণ চেঞ্জ হয়ে যায়। মনে হয় আমার ছেলে অচ্ছ্যুত। আমাদের বিদায় দিতে পারলে তারা বেঁচে যান। সরকার কি বলছে আর বাস্তবতা কি তা আমরা হারে হারে টের পাচ্ছি।’
২.
আইসিডিডিআর’বি ২০১৫ সালের মে-ডিসেম্বর পর্যন্ত একটি জরিপ চালায়। তাতে ৩৮৮টি অটিস্টিক শিশুর মায়েরা অংশ নেন। ১৪ পৃষ্ঠার এই গবেষণা প্রবন্ধ ২০১৯ সালের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে অটিজম রিসার্চ সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। তাদের তথ্যানুযায়ী, রাজধানী ঢাকায় অটিস্টিক শিশুদের জন্য প্রায় ১০০টি বিশেষ স্কুল আছে। অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের মায়েদের ৭৭ শতাংশ ঘরে ছাড়া অন্য কোথাও কাজ করেন না। ৫ শতাংশের স্বামী নেই, ১ শতাংশ বিধবা। ৪১ শতাংশ মা একাই অটিস্টিক শিশুর দেখাশোনা করেন। ৫৯ শতাংশ মাকে সহায়তা করেন গৃহকর্মী, স্বামী, পরিবারের অন্যান্য সদস্য, অন্য সন্তান এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রতিবেশী।
একতৃতীয়াংশ মায়ের অভিযোগ, প্রতিবেশীরা অটিস্টিক শিশুদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। অনেকে পাগল বলে, তাচ্ছিল্য করে। অনেকে আবার এসব শিশু দেখে ভয় পায়। (প্রথম আলো, ৫/১২/১৯)
আইসিডিডিআর’বি জরিপের প্রধান সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, জরিপটি শহর কেন্দ্রিক। এতে গ্রামের মায়েদের সমস্যা তুলে ধরা হয়নি। শহরের মায়েদের তুলনায় গ্রামের মায়েদের অবস্থা যে আরো শোচনীয় তা সহজেই অনুমান করা যায়। তবে এই সংকট সমাধান যেভাবে কাজ করা প্রয়োজন সেই তুলনায় কাজ কম হচ্ছে বলে মনে করে ভুক্তভোগী মায়েরা। সরকারের আন্তরিকতার কমতি নেই, তবে মাঠপর্যায়ে আন্তরিকতার ঘাটতিসহ উদাসীনতা রয়েছে।
একজন অটিস্টিক শিশুর মা প্রচন্ড মানসিক চাপ সহ্য করেন। ফলে তারা সবচেয়ে বেশি বিষণ্নতায় ভোগেন। আইসিডিডিআর’বি জরিপের তথ্যানুযায়ী, ৪৫ শতাংশ অটিস্টিক শিশুদের মায়েরা বিষণ্নতায় আক্রান্ত। ফলে ৬০ শতাংশ মা ডায়াবেটিসসহ একাধিক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। (প্রথম আলো, ৫/১২/১৯)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরো ডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ইপনা)র পরিচালক অধ্যাপক শাহীন আখতার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘শিশু অটিস্টিক হলে পরিবারের সবার ওপরই চাপ পড়ে, সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন মা। সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য সমাজ মাকে দোষ দেয়। শিশুর লালনপালনের জন্য মা চাকরি ছেড়ে দেন। অনেকের সংসার ভেঙে যায়। শিশুকে আঁকড়ে থাকেন মা। এত চাপে মায়ের ঠিকমতো ঘুম হয় না, অধিকাংশের শরীর ভেঙে যায়।’
৩.
অটিজম বা অটিস্টিক শিশুদের সংকট ও সমস্যা নিয়ে আগে যেভাবে মানুষ মুখ লুকাতো এখন তা করে না। এখন সবাই এই বিষয় সম্পর্কে জানতে চাই, জানাতে চাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল অটিজম নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন। ফলে এখন জনসচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে জনসচেতনতা বৃদ্ধিই কি একমাত্র উপায়? অবশ্যই নয়। দেশের সকল স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যেন অটিস্টিক শিশুরা পড়াশোনা করতে পারে সেই ব্যাপারে আরো গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম গ্রহণ করা উচিত। শুধু অটিস্টিক শিশুই নয়, তাদের মায়েদের মানসিক অবস্থার উন্নতির জন্য সরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগও নেওয়া উচিত। এতে করে অটিস্টিক শিশুরা আরো কর্মক্ষম ও দক্ষ নাগরিক হয়ে উঠবে এবং তাদের মায়েদের মানসিক প্রশান্তি বৃদ্ধি পাবে। সর্বোপরি সকলের সার্বিক প্রচেষ্টায় অটিজমকে জয় করা সম্ভব।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
0 Comments