পান্না আক্তার
আমি পান্না আক্তার। প্রথমে কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর প্রতি, যিনি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছেন, যাঁর জন্য আমরা স্বাধীনভাবে বাস করার অধিকার পেয়েছি। আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে, যিনি বাংলাদেশের কর্মপরিসরে অগ্রাধিকার দিয়ে আমার মতো হাজার হাজার নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন।
আমার জন্ম নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া থানার প্রত্যন্ত একটি গ্রামে। নিম্নবিত্ত এক কৃষক বাবার মেয়ে আমি। তিন বোন, তিন ভাইয়ের মধ্যে আমি পঞ্চম। টানাপোড়নের সংসারে বড় ভাই ছোটবেলায়ই পড়ালেখা না করে বাবার সঙ্গে আর্থিক উপার্জনে যোগ দেন। বড় দুই বোনকে প্রাইমারি শেষ করার পর পড়ালেখা করার খুব ইচ্ছে থাকার পরও আর্থিক অভাবের কারণে বিয়ে দিয়ে দেন। আমি প্রাইমারি শেষ করার পর আম্মা-আব্বাকে অনুরোধ করি নিজ গ্রামের উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করার জন্য। তাঁরা আমার অনুরোধ রাখেন। অনেক কষ্টে কোনোরকম পড়ালেখা চালিয়ে গেলেও আমার দুর্ভাগ্য যে প্রথমবার এসএসসি পরীক্ষায় ফেল করি। এইবার আত্মীয়-স্বজন অনেকেই আম্মা-আব্বাকে উপহাস করতে থাকে, বলে মেয়েকে শিক্ষিত বানাবে! পরিবারের অন্য সদস্যরা বিয়ের জন্য কথা বলতে থাকে। আমি আবারো আম্মার কাছে কান্নাকাটি করি, আমাকে আর একবার ফরম পূরণের সুযোগ করে দাও। আমি আম্মাকে কথা দিই যে, আমাকে পড়ালেখা করার সুযোগ দিলে খুব ভালো করে পড়ালেখা করবো এবং সবসময় প্রথম হওয়ার চেষ্টা করবো। আম্মা আমার অনুরোধ রাখেন এবং আমি ২০০৪ সালে এসএসসি পাস করি।
এসএসসি পাস করার পর বাড়ি থেকে চার-পাঁচ মাইল দূরে মোহনগঞ্জ মহিলা কলজে ভর্তি হলাম। শুরু হলো আমার আরেক যুদ্ধ। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে হেঁটে অর্ধেক রাস্তা, বাসে বাঁদুড়ঝোলা হয়ে বাকি রাস্তা গিয়ে ক্লাস করি। কখনো পাড়ার এর- তার সাইকেল নিয়ে আসা-যাওয়া করি। যেহেতু ছেলেদের সাইকেল অনেক উঁচু, তাই চালাতে খুব কষ্ট হয়। অন্যদিকে এলাকায় যেহেতু মেয়েদের মধ্যে আমি একাই সাইকেল চালাই, তাই নানা লোকের নানান কথা প্রতিদিন শুনতে হয়। শীতের দিনে অনেক সকালে প্রাইভেট পড়তে যেতে হয়, যতক্ষণ রাস্তা অন্ধকার থাকে, আম্মা আমার সঙ্গে সঙ্গে যায়। একটু আলো ফুটলে আম্মা বাড়ির দিকে আসে, আমি কলেজের দিকে যাই।
এইচএসসি পরীক্ষার আগে আগে এক আত্মীয়ের বাসায় থাকার সুযোগ পাই, এইটুকু দূরত্বে পাঠিয়ে বাবা কান্না শুরু করে দেন। কিন্তু নানান অসুবিধার কারণে আবার বাড়ি চলে আসি। বাড়ি থেকে গিয়ে পরীক্ষা দিতে থাকি। পরীক্ষা শেষে দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করতে থাকি কারণ মাথার মধ্যে সবসময় একটা চাপ কাজ করে যে, পরীক্ষায় ভালো করতে না পারলে বিয়ে দিয়ে দেবে। আল্লাহর অশেষ রহমতে ২০০৬ সালে মানবিক বিভাগ থেকে আমার কলেজে প্রথম হই।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিবো কিন্তু নিয়ে যাবে কে? থাকবো কোথায়? টাকার ব্যবস্থা করতে হিমশিম খেতে হবে। পার্শ্ববর্তী এলাকার এক বড় বোনের সহায়তায় জীবনের প্রথম ঢাকায় এসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। ফলাফল জানাবে এমন কেউ ছিল না। শেষে আনন্দমোহন কলেজে ভর্তির সুযোগ পেলাম এবং ভর্তি হওয়ার পরে জানতে পারলাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ভর্তি পরীক্ষায় পাস করেছি। এত টাকা দিয়ে ভর্তি হওয়ার পরে আবার টাকা দিয়ে অন্য কোথাও ভর্তি হবো, এত টাকা তো আমাদের নেই!
টিউশনির টাকা, বাড়ি থেকে কিছু টাকা নিয়ে মেসে থাকি আর একটা চাকরির সন্ধান করতে থাকি। ২০০৮ সালে দুই হাজার ৮০০ টাকা মাসিক বেতনে পুলিশে কাজ করার সুযোগ পাই। সবকিছু মিলিয়ে তিন হাজার ৮০০ টাকা বেতন পাই। কি কষ্টের ছিলো সেই দিনগুলো! পড়ালেখার খরচ শেষে হাতে কোনো টাকা থাকতো না। যাতায়াত খরচের জন্য বাড়ি যেতে ইচ্ছে করতো না। আম্মা-আব্বাজান খুব মন খারাপ করতো, আমি জবাব দিতে পারতাম না।
একবার বাড়ি গিয়ে ফেরার সময় মহাখালীতে বাস থেকে নামলাম। বলাকা বাসে মালিবাগ আসবো, ভাড়া সাত টাকা। আমার কাছে আর মাত্র ১০ টাকা আছে। আম্মা অনেক পিঠা আর শালুক দিয়েছিল, সঙ্গে আমার অনেক বই ছিল। সবকিছু মিলিয়ে আমার ব্যাগটা বেশ ভারী ছিল। বলাকা বাসে এত ভিড় যে অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে কিন্তু কোনো বাসেই উঠতে পারছি না। শেষে হাঁটতে শুরু করলাম। সাতরাস্তা পর্যন্ত এসে আর পারছিলাম না। একজন রিকশাওয়ালাকে বললাম আমার কাছে ১০ টাকা আছে আর মায়ের দেওয়া পিঠা এবং শালুক আছে, আমাকে মালিবাগ মোড়ে নিয়ে যাবেন? তিনি রাজি হলেন। পরে অবশ্য পিঠা আর শালুক জোর করে দিয়েছি, তিনি নিতে চান নি।
২০০৯ সালে আমার বাবা বিভিন্ন রোগে ভুগে মারা যান, ভালো কোথাও চিকিৎসা করাতে পারেননি। আব্বাজানকে চিকিৎসা না করাতে পারার কষ্ট আমি কোনোকিছুই দিয়ে মুছতে পারবো না।
রাজারবাগ মেসবয় স্কুলে চাকরি করি তিন বছর। এর মধ্যে গাড়ি চালানো শিখি এবং এক বছর বিভিন্ন অফিসে ড্রাইভিং করি। ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাই। আমি বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই প্রয়াত প্রসিকিউটর শ্রদ্ধেয় জেয়াদ-আল-মালুম স্যারকে, যিনি আমার পড়ালেখার জন্য অনেক সুযোগ দিতেন। এর মধ্যে আমি সমাজকর্ম নিয়ে অনার্স এবং মাস্টার্স দুটোতেই প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হই।
শুরু হয় বিসিএস এবং অন্যান্য চাকরির পরীক্ষা। একটার পর একটা দিতে থাকি। ৩৪তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষা দিই। এর পরই ২০১৫ সালে বাংলাদেশ পুলিশে প্রথম নারী সার্জেন্ট নিয়োগ দেয়। সার্জেন্ট নিয়োগ পরীক্ষায় আমি নারীদের মধ্যে প্রথম হই। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমার চাকরি হয়ে যায়। চাকরিতে যোগদান করেও বেশ কয়েকবার বিসিএসএ চেষ্টা করি, কিন্তু হয়নি।
আমি ২০১৬ সালে বিয়ে করি। আমার স্বামী একজন শিক্ষক। আমি খুব ভাগ্যবতী যে তার মতো একজন মানুষ পেয়েছি। আল্লাহ দয়া করে আমাদের একজন মেয়ে উপহার দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ। জীবনে এত চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এতটুকু পথ আসতে পারার জন্য আল্লাহকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
লেখক : সার্জেন্ট, ট্রাফিক তেজগাঁও বিভাগ।
0 Comments