হোসনে আরা
আমি হোসনে আরা, সহকারী পুলিশ কমিশনার হিসেবে অবসরে যাই। কিন্তু আমাদের পুলিশে আসাটা এতো সহজসাধ্য ছিলো না। একেই তো মেয়ে, মাস্টারি করবে, পুলিশে কেন? কিন্তু আমি ছিলাম দৃঢ়চেতনার। আমার বাবা ছিলেন ফরেস্ট অফিসার। বাবা উৎসাহ দিলো। খেলাধুলা, সাঁতারে পারদর্শী ছিলাম। ১৯৮১ সালে স্নাতক শেষ করে সবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইব্রেরি সাইন্সে এম.এ ক্লাসে ভর্তি হই। এমন অবস্থায় আমি বাংলাদেশ পুলিশে সাব ইন্সপেক্টর পদে জয়েন করি। কিন্তু একজন নারী পুলিশের সমাজে গ্রহণযোগ্যতা ছিলো না। আমরা প্রকাশ্যে বলতে পারতামনা। কিন্তু কর্মজীবনে যখন জাতিসংঘ মিশনে গেলাম তখন আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে শুরু করে।
আমার কর্ম জীবনের একটা দীর্ঘ সময় কেটেছে সিলেটের কোতোয়ালী থানায়। সেই সময় ঘটে যায় একাধিক ঘটনা। তারই একটি বেদনা বিধূর দুর্ঘটনা তুলে ধরলাম নবীন সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে। সিলেটের গোলাপগঞ্জ থানা হতে আসামি গ্রেফতারের জন্য রাতে অভিযান চালাই। হাওড় অঞ্চলে। আসামি গ্রেফতার করে নৌকায় ওঠি। নৌকা ছাড়ার পর কিছুদূর যেতে স্রোতের টানে নৌকা বহুদূর চলে যায়। নৌকার তলা ফেটে যায় এবং নৌকা ডুবে যায়। ভারী বুট আর থ্রি নট থ্রি ভারী রাইফেলের ওজনের কারণে দক্ষ সাতারু অফিসার হয়েও একজন ছাড়া সকলে তলিয়ে যায়। কুশিয়ারা নদীতে এই অভিযানে শহীদ হন এস.আই আব্বাস, এ.এস.আই মোঃ ইসরাইল হোসেন, কনস্টেবল মোঃ জহিরুল ইসলাম, কনস্টেবল মোঃ শাহ আলম এবং কনস্টেবল মোঃ আব্দুল লতিফ। এ.এস.আই মোঃ ইসরাইল হোসেন এর স্ত্রী আমার থানার মেয়ে এ.এস.আই স্বপ্না। ওসি জহুরুল স্যার আমাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বলেন আপনি হাসপাতাল চলে যান, স্বপ্নাকে টাকা দিবেন ও সান্তনা দিন এবং আজ অফিস করতে হবে না। আমি এবং আমার সাথে এ.এস.আই স্বপ্না তার ছোট বোন শিপ্রা ও এ.এস.আই শাহনাজ, এ.এস.আই শাহীন পারভিন এবং কং মৃদুল কান্তি হাসপাতালে চলে যাই। সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। নিজ হাতে সহকর্মীর বডি থেকে নেম প্লেট, হাতের আংটি, মানিব্যাগ তুলতে হয়। পোস্টমোর্টেমএও থাকি। এ এক মর্মান্তিক দৃশ্য। ঢাকা থেকে আই.জি স্যার এলেন। সিলেট রিকাবি বাজার পুলিশ লাইনে জানাজা হলো। পরিবারের কাছে মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয় ও যার যার গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হলো। গোলাপগঞ্জ থানায় একটি স্মৃতিসৌধ করা হলো। পরবর্তীতে সেই সৌধটি ভেঙে ফেলা হয়। তবে স্মৃতিসৌধের নাম ফলকটি আজো গোলাপগঞ্জ থানায় সংরক্ষিত আছে বলে জানা যায়।
কর্মজীবনে অনেক সুখস্মৃতি যেমন আছে, তেমনি এমন বেদনা বিধূর শোকগাঁথা রয়েছে। আমরা কর্মজীবনে প্রাণ উৎসর্গ করার শপথ নিয়েই কাজে যোগদান করি। জয় আমার পুলিশ বাহিনীর। জয় বাংলা।
কোতোয়ালি থানায় থাকাকালীন আরেকটি ঘটনা।
প্রত্যেক মানুষের জীবনেই প্রেম ভালোবাসা এবং জীবনকে উপভোগ করার প্রবৃত্তি বিদ্যমান থাকে। কেউ এই প্রেমপ্রীতি বিভিন্নভাবে এই ধরাধামে প্রকাশ করে থাকে যেহেতু জীবনটা অনেক সংকীর্ণ এবং সময়ে সীমাবদ্ধ।
আমার কর্মজীবনে বাংলাদেশে বিভিন্ন থানায় কাজ করার সুযোগ হয়েছে। সেই হিসেবে আমি বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। কাজ অনেক ক্ষেত্রে সমস্যার সমাধান করে। জীবনকে উপভোগ করেছি। কতটা সফলকাম হয়েছি একমাত্র আল্লাহই জানেন।
সিলেট সদর থানায় কর্মরত অবস্থায় একটি বিয়োগান্তক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলাম। যা এখনও হৃদয়কে আন্দোলিত অনুতপ্ত করে তোলে। সদর থানায় কাজলশা এলাকায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবার বসবাস করতেন। পরিবারটি ছিল ছিমছাম ও শিক্ষিত পরিবার। ঐ পরিবারে শ্বশুর-শাশুড়ি ও দেবরসহ আছিয়া বেগম নামে এক ভদ্র মহিলা সবার সঙ্গে সুখে শান্তিতেই বসবাস করছিলেন। তার স্বামী কার্য উপলক্ষ্যে লন্ডনে বসবাস করেন। বিবাহের পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কথা ছিল যে, কিছুদিন পরে স্ত্রীকে তিনি লন্ডনে নিয়ে যাবেন। ভদ্র মহিলা স্বামীর সঙ্গে বসবাস করার জন্য এবং লন্ডনে যাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। সুনামগঞ্জ বাপের বাড়ি হওয়ায় মহিলার বাবা, মা, ভাই-বোন সবাই তার খোঁজ খবর নিতেন। এই হিসাবে তার মধুময় জীবনগুলো খুবই আনন্দেই কাটছিল। সংসারে ছিল দেবর, যৌবন উদ্দীপ্ত চেহারা, সু-পুরুষ। দেখলে যে কোনো যৌবনবতি মহিলার প্রাণে দাগ কাটে। দেবর ভাবির সঙ্গে মনে মনে প্রণয়ের ভাব নিয়ে আগায়। কিন্তু ভাবি তার এই আবেদনে কোনো সাড়া প্রদান করতো না। কিন্তু দেবরের এই প্রচেষ্টা অব্যহত থাকে। ভাবিকে কিভাবে সুখি ও সন্তুষ্ট করা যায় এটাই ছিল তার একমাত্র লক্ষ্য।
বারবার চেষ্টা করার পরও ভাবিকে আয়ত্তে না পেয়ে তার মনে পশুত্ব ভাব প্রকাশ পেতে থাকে। কিন্তু বৃদ্ধ শ্বশুর-শ্বশুড়ি এ বিষয়ে কোনো কিছু জানতে পারেনি। ভাবিকে অনুরোধ, আবেদন, প্রেম নিবেদন করার পরও তাকে না পেয়ে গভীর রাতে ঐ দেবর ভাবিকে গুলি করে হত্যা করে। ভাবির মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরে দেবর কৌশলে তাকে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেয় এবং ক্ষতস্থান মোমের দ্বারা বন্ধ করে দেয়। এরপরও ক্ষতস্থান হতে রক্ত ঝরতে দেখা যায়। পরের দিন সকালে সংশ্লিষ্ট পরিবার হতে থানাকে টেলিফোনযোগে অবহিত করা হয়। ফোন পাওয়ার পরে থানার প্রধান কর্মকর্তার নির্দেশে আমি ঘটনাস্থলে মোবাইল টিম প্রেরণ করি। মোবাইল টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছার পর থানাকে জানানো হয় যে, একজন কর্মকর্তার উপস্থিতি ঘটনাস্থলে একান্ত প্রয়োজন। ইতোমধ্যেও মৃতের আত্মীয়-স্বজন সুনামগঞ্জ থেকে কাজলশায় এসে পৌঁছেছেন এবং আত্মীয়-স্বজন দাবি করেন যে, মেয়েটিকে হত্যা করে ফাসিতে ঝুলানো হয়েছে। যার প্রমাণস্বরূপ রক্তাক্ত অবস্থা এখনো দেহে বিদ্যমান। মোবাইল টিমের সংবাদ পাওয়ার পরে ওদিকে ওসি ও আমি এবং কয়েকজন মহিলা কনস্টেবল শাহানা, শিপ্রা ও স্বপ্না বড়ুয়াসহ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হই। ওসি হালিম খান সাহেবের নির্দেশে লাশটির বিভিন্ন অংশের ক্ষতবিক্ষত অংশসমূহ উল্টাপাল্টা করে প্রত্যক্ষ করি এবং ওসিকে জানাই। মোবাইল টিম এর কর্মকর্তার আদেশে সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করা হয়। উক্ত রিপোর্ট ওসি হালিম খান সাহেবকে প্রদর্শনের পর সুরতহাল রিপোর্টটি মেডিক্যাল কর্মকর্তার কাছে লাশসহ প্রেরণ করেন। আশ্চর্যের বিষয় যে, অতিদ্রুত মেডিকেল অফিসার তার (পোস্টমর্টেম) রিপোর্ট এর কপি থানায় প্রেরণ করেন এবং যেখানে প্রযোজ্য সেখানে তার কপি প্রেরণ করেন। সংশ্লিষ্ট ডাক্তার তার রিপোর্টে উল্লেখ করেন যে, মহিলা আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু পুলিশের পক্ষ হতে এটি অবিশ্বাস্য ঘটনা বলে প্রতীয়মান হয়। মৃতার ভাই মুকিত ও আত্মীয়-স্বজন জোরালো প্রতিবাদ জানায়। মেডিকেল হইতে লাশ গ্রহণ করার পরে তার লাশ বাপের বাড়ি সুনামগঞ্জ নেয়ার পরে ওখানে সমাহিত করা হয়। ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ শোনার পর মৃতার বড় বোন লন্ডন হতে হাই কমিশন অফিসের মাধ্যমে লাশ উঠিয়ে ঘটনার প্রকৃত ব্যাখ্যা ও পূর্ণ তদন্তের দাবি করেন। যথারীতি নিয়মমাফিক পূর্ণ তদন্ত এবং কবর হতে ম্যাজিষ্ট্রেটের উপস্থিতিতে লাশ উত্তোলন করা হয়। অনেকদিন হওয়ায় লাশের শরীরে পচন ধরে গিয়েছে। ২য় তদন্তকারী অফিসার হিসেবে ওসি সাহেব আমাকে নির্দেশ দিলে আমি লাশের পচনশীল দেহটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রত্যক্ষ করি। তখনও পচনশীল দেহে হাঁটুর হাড়ভাঙ্গা এবং এক হাঁটুর সঙ্গে অন্য হাঁটুর মিল ছিল না উপরন্তু চক্ষুর উপর কপালের নিচে হাড় ভাঙ্গা দেখা যায়। ম্যাজিষ্ট্রেট যথাযথভাবে রিপোর্টটি পর্যালোচনা ও প্রত্যক্ষ করেন এবং উক্ত রিপোর্টে স্বাক্ষর প্রদান করেন। পরবর্তী পর্যায়ে পুনরায় লাশ মর্গে পাঠানো হয় এবং সাথে আমার দ্বারা তৈরি লাশের সুরতহাল রিপোর্টও মেডিকেল বোর্ড গঠন করে প্রকৃত মতামত প্রেরণের জন্য অনুরোধ করা হয় ঘটনার সত্যতা উদঘাটনের জন্য।
পৃথিবীতে মৃত্যু একটি নির্মোহ সত্য। কিন্তু কেউ নীরবে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় এবং আবার কেউ লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ও অকথ্য অত্যাচার এবং আঘাতে জর্জরিত হয়ে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়। উক্ত মৃতা আছিয়া সুন্দরভাবে বেঁচে থাকবার ইচ্ছা থাকলেও নিয়তির নিষ্ঠুর আচরণে তা সম্ভব হয় নাই। এ ক্ষেত্রে পুলিশের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করা সম্ভব হয় নাই এবং ঘাতকের প্রকৃত বিচার করা সম্পূর্ণ সম্ভব হয় নাই। এক্ষেত্রে আছিয়াও নির্মম পরিস্থিতির শিকার। উক্ত ডাক্তারের ভূমিকা জোড়ালো হলে এবং মৃত্যু ঘটনার সঠিক রিপোর্ট প্রদর্শন করা হলে আছিয়ার মত ভাগ্যবিড়ম্বিত এবং ধনী পরিবারের অনেক মেয়ে পৃথিবীর বুকে সুন্দরভাবে জীবন যাপন করত। ডাক্তারের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, লাশের অধিকতর পচন ধরার কারণে হত্যার বিষয়ে কোনো যৌক্তিক সিদ্ধান্ত দেয়া সম্ভব নয়।
পাদটিকা:
প্রায় দুই যুগ আগের কথা। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা এতো উন্নত ছিলো না। তথ্য প্রযুক্তিরও আজকের মতো অবস্থা ছিলো না। আমার আজকের সহকর্মীরা সৌভাগ্যবান তাদের মেধার সাথে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে অভিযান পরিচালনা করবেন। প্রতিটি প্রাণই মহামূল্যবান। পুলিশ বাহিনীর গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে, ৭১’র পাক বাহিনীর সাথে পুলিশ ও ইপিআর প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে শত শত পুলিশ সদস্য শহীদ হন। সেই গৌরবান্বিত ইতিহাসের উত্তরসূরি আজকের পুলিশ বাহিনী। নতুন-প্রজন্মের সহকর্মীদের প্রতি অফুরান ভালোবাসা ও দোয়া।
লেখক : সাবেক সহকারী পুলিশ কমিশনার, ডিএমপি
0 Comments