আ ফ ম নিজাম উদ্দিন পিপিএম (বার)
করোনা ভাইরাস সারা বিশ্বকে পর্যুদস্ত করেছে-এটা এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। কোথাও এটা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে ইতোমধ্যে মৃত্যুর মিছিলের মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছে; কোথাও বা এখনো বাঘের থাবার মতো ওঁত পেতে আছে। সারা বিশ্বের দিকে একনজর চোখ বুলিয়ে নিলে আমরা অঞ্চল হিসেবে ইউরোপে এর ভয়ঙ্কর রূপটা সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাই। কিন্তু ইউরোপের সব দেশে ভাইরাসটির আঘাত একই রকম নয়; কিংবা বলা যায়, দেশগুলোর প্রতিরোধের কৌশল ভিন্ন ছিলো বলেই আক্রান্ত আর মৃত্যু হারের পার্থক্য দেখা যায়। এই লেখার উদ্দেশ্য জার্মানদের তুলনামূলক পার্থক্যের বিষয়টি খতিয়ে দেখা।
ইউরোপের এই ৫ টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশী মানুষের বাস, জনবসতির ঘনত্বের দিক থেকে দ্বিতীয়, আয়তনে সর্ব-বৃহৎ নয়; তবুও জার্মানির আক্রান্ত অনেক কম। মৃত্যু সবচেয়ে কমতো বটেই, পরিসংখ্যানটা বিস্মিত হওয়ার মতো। ৫ টি দেশের মধ্যে জার্মানির তুলনায় অন্যান্য যে কোন দেশের মৃত্যু কয়েক গুণ বেশী, যেমন যুক্তরাজ্যে মোট মৃত্যু জার্মানির ৪ গুণের চেয়েও বেশী; ফ্রান্সের মৃত্যু জার্মানির প্রায় ৪ গুণের কাছাকাছি।
বিস্মিত হওয়ার মতো এই পরিসংখ্যানের কারণ খুঁজতে আগ্রহী হলাম। জানাটা জরুরী মনে হলো- কি এমন বিশেষত্ব তাদের আছে যার কারণে জার্মানিতে মৃত্যুর সংখ্যা অন্য দেশের সাপেক্ষে এতো কম? খুঁজতে খুঁজতে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের একটা অনুসন্ধান প্রতিবেদনসহ আরও কিছু বিশ্লেষণধর্মী লেখা বেশ সাহায্য করেছে। বিশেষজ্ঞরা নিশ্চয়ই এর অনেক ভালো ব্যখ্যা বিশ্লেষণ করতে পারবেন। তবুও আমার সীমিত জ্ঞানে যা যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে তা উপস্থাপন করলাম। সীমাবদ্ধতাগুলো পাঠক অবশ্যই এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন।
জার্মানিতে মৃত্যুর সংখ্যা এত কম হওয়ার কারণ
নিশ্চিতভাবে কেউ এখনো বলতে পারছেন না, আসলে ঠিক কি কারণে জার্মানি মৃত্যুর সংখ্যা অন্য দেশের তুলনায় এতো কম। তারপরও যেটুকু জানা যায়, এবং সংশ্লিষ্ট কিছু বিশেষজ্ঞের মতামত থেকে যা অনুমান করা যায়, আগ্রহী পাঠকের জন্য নিম্নে তা উল্লেখ করা হলোঃ
জার্মানিতে মৃত্যুর সংখ্যা এত কম হওয়ার পিছনে নানা জন নানা মত দিয়েছেন। বেশিরভাগের মতামত হলো খুব দ্রুত পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে পারা, অনেক আগেই টেস্টের উপর জোর দেয়া এবং পার্শ্বে বর্ণিত ডাঃ সুবিলের মতো আরও অনেকের সরকারের কেন্দ্রীয় নির্দেশের অপেক্ষায় না থেকে নিজের নিজের জায়গা থেকে কাজ শুরু করে দেয়া, পরিস্থিতির সাথে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিয়ে নিজেদের সক্ষমতার ক্রম উন্নতি করা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। অনেকে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলো মার্কেলের নেতৃত্ব ও দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়াকেও একটা কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলো মার্কেল নিজেই একজন বিজ্ঞানী। তারপরও মৃত্যুর সংখ্যা এত কম হওয়াটা পরিপূর্ণভাবে ব্যখ্যা করা যায় না। জার্মানির অনেক বিশেষজ্ঞরাও একে ব্যখ্যাতীত (Unspeakable) বলে মন্তব্য করেছেন।
মার্চের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিটি দেশে প্রতিটি দেশে টেস্ট করার উপর জোর দেন। স্লোগানটা ছিলোঃ টেস্ট- টেস্ট- টেস্ট। কিন্তু জার্মানরা ততদিন অপেক্ষা করেনি, তারা কাজ শুরু করে দিয়েছিলো আগেই। স্টুটগার্ডের প্রধান হাসপাতালের ‘ইন্সটিটিউট ফর লিবারেশন মেডিসিনের’ প্রধান ডাঃ মিচেল স্কটের উদাহরণটা বিশ্লেষণ করলে জার্মানি কেন অন্য দেশের চেয়ে মৃত্যুর হার এতো কম রাখতে পেরেছে সে বিষয়ে একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে।
ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে নর্দান ইতালি, অসিট্রয়া এসব অঞ্চল থেকে স্কি’ করতে যাওয়া লোকজন ফেরত আসতে থাকে। স্টুটগার্ড জার্মানির দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত এবং সেই সময় করোনাভাইরাসে সর্বাধিক সংক্রমণ এখানেই হচ্ছিল। ডাঃ মিচেল তার হাসপাতালে টেস্ট সেট-আপ করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। জার্মানির ‘রোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা’- রবার্ট কুক ইন্সটিটিউট সেই সময় ব্যপক হারে টেস্ট করা জরুরী বলে সংশ্লিষ্ট সকলকে পরামর্শ দেয়।
স্টুটগার্ডে তখনো করোনা ভাইরাসের পরীক্ষা করার মতো ব্যবস্থা ছিলনা। ডাঃ মিচেল এবং তার সহকর্মীরা স্যাম্পল সংগ্রহ করা অব্যাহত রাখলেন এবং ফলাফলের জন্য বার্লিনে পাঠাতেন। পরীক্ষার ফলাফল পেতে তখন প্রায় ৬-৭ দিন সময় লাগতো। এই শহরে ৪ টি বড় প্যাথলজি ল্যাব ছিল, যার একটা চালাতেন ডাঃ মিচেল। স্যাম্পল সংগ্রহ অব্যাহত রেখে ৪ টি ল্যাবের প্রধানগণ তাদের নিজ নিজ ভেন্ডরের কাছে টেস্ট-কিট সরবরাহের জন্য বলে। মার্চের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই স্টুটগার্ডের ল্যাবগুলো নিজেরা কোভিড-১৯ পরীক্ষা করার সামর্থ্য অর্জন করলো।
ডাঃ মিচেল দ্রুত হাসপাতালের সামনে একটা বড় তাঁবু টাঙিয়ে স্যাম্পল সংগ্রহ জোরদার করলেন। মার্চের ২য় সপ্তাহের শুরুতেই তাদের স্যম্পল সংগ্রহ করে ফলাফল হাতে পাওয়ার সময় নেমে আসলো ৪-৫ ঘণ্টায়। তারা শুধুমাত্র উপসর্গ আছে এমন ব্যক্তিদের পরীক্ষা করে শেষ করতেন না, কোভিড-১৯ এ আক্রান্তদের সকল কন্টাক্টকে টেস্টের আওতায় নিয়ে আসতেন। কখনো কখনো একজন রোগীর কন্টাক্ট ৮০-১০০ জনও হতো। ডাঃ মিচেল বলেন, সংক্রমণের চেইন পুরোটা কাভার করেই তারা একজন পজিটিভ রোগীর কাজ শেষ করতেন। কন্টাক্টদের মধ্যে যাদের পজিটিভ আসতো, তাদেরকে বাধ্যতামূলক ১৪ দিন কোয়ারান্টাইনে থাকতে হতো।
মধ্য মার্চে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যখন আক্রান্ত দেশগুলোতে টেস্ট করার উপর জোর গুরুত্ব দেন, সেই সময় পুরো জার্মানিতে ১৭০ টি এই ভাইরাস পরীক্ষায় সক্ষম ল্যাব প্রতিদিন ১৫ হাজারের বেশী টেস্ট করতে সক্ষম ছিলো।২৬ মার্চ যেদিন জার্মানি-ইংল্যান্ড ২ দেশেই লক-ডাউন আরোপ করা হয় তখন ইংল্যান্ডে করোনায় মৃতের সংখ্যা জার্মানির ৩ গুণ ছিলো।
শুধুমাত্র পরীক্ষার/টেস্টের উপর এত জোর দিয়েই জার্মানি এমন সাফল্য অর্জন করেনি। জার্মানির স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থাও এই অর্জনের পিছনে কাজ করে বলে বার্লিনে বসবাসকারী এবং স্বাস্থ্য সেবা বিশেষজ্ঞ মারটিনা মার্টিন মন্তব্য করেছেন। জার্মানি তার বাৎসরিক জিডিপির ১১.২% স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করে যা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। এখাতে জার্মানি প্রতি বছর প্রায় ৪৫০০ ডলার/কেপিটা খরচ করে যেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর গড় ব্যয় প্রায় ৩০০০ ডলার। জনসংখ্যা অনুপাতে ডাক্তারের হারও জার্মানিতে অনেক বেশী। করোনা আক্রমণের শুরু থেকে জার্মানি তাদের আইসিইউ’র সক্ষমতা বাড়াতে থাকে। স্বাস্থ্য সেবা বিশেষজ্ঞ মারটিনার মতে, বর্তমানে জার্মানিতে ৩৩০০০ আইসিইউ বেড আছে যার প্রায় ১২০০০ এখনো খালি।
জার্মানির স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের কাঠামোও তাদের এমন সফলতার পিছনে কাজ করেছে। এর একদিকে ফেডারেল ব্যবস্থা, অন্যদিকে আবার স্থানীয় পর্যায়ের কাঠামোগুলোকে বিশেষ পরিস্থিতির জন্য অনেক বেশী ক্ষমতায়ণ করা আছে। স্টুটগার্ড হাসপাতালের ডাঃ মিচেলের কথা আগেই বলা হয়েছে। তিনি ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহেই যে তার হাসপাতাল সহ আরো ৩ টি হাসপাতালের জন্য সুরক্ষা সামগ্রী এবং পরীক্ষা করার উপকরণের ক্রয়াদেশ দিয়েছেন তা এই ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের কারণেই।
জার্মান স্বাস্থ্য সেবা কাঠামোর আর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো তাদের আবশ্যিক ‘হেলথ ইনস্যুরেন্স পলিসি’ বাস্তবায়ন। প্রত্যেক নাগরিককে (যারা আয় করেন না/বা চাকুরীরত নন- তারা বাদে) প্রত্যেককে প্রতিমাসে ইনস্যুরেন্স বাবদ অর্থ জমা করতে হয়। এই ইনস্যুরেন্স ব্যবস্থা আমার ‘কন্ট্রিবিউটরি’ অর্থাৎ চাকুরে যে টাকা জমা করবেন, চাকুরিদাতা সমপরিমাণ অর্থ জমা করবেন। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জার্মানির মোট জনগণের প্রায় ৮৭ শতাংশ মানুষ এই ইনস্যুরেন্স পলিসির আওতায় আছেন। দ্রষ্টব্য বিষয় হলো এর সুফল ভোগ করবেন দেশের সকল নাগরিক। এর ফলে, জার্মানির বৃদ্ধরা অনেক ভালো সেবা পেয়ে থাকে। এই দেশের করোনা পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেয়া যায়, মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে বয়স্ক বা বৃদ্ধরা যে সংখ্যায় অনেক বেশী- তা নয়। বরং ডাঃ সুবিল দাবী করেছেন, জার্মানির বৃদ্ধরা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী স্বাস্থ্যবান।
করোনা মোকাবেলায় জার্মানি ভেন্টিলেটরের উপর সবচেয়ে বেশী জোর না দিয়ে, ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই তাদের নিজস্ব ফেস মাস্কের উৎপাদন এবং এর গুনমান বৃদ্ধির উপর জোর দেয়। একই সাথে পিপিই সহ অন্যান্য সুরক্ষা সামগ্রী উৎপাদনের পাশাপাশি ব্যপকহারে আমদানি শুরু করে। ফলে অন্যান্য দেশের মতো জার্মানরা গুণগত মানসম্পন্ন ফেস-মাস্ক ও অন্যান্য সুরক্ষা সামগ্রীর অভাব বোধ করেনি।
জার্মানির বিখ্যাত ডাক্তার স্টিফেন ব্লুমস্টেইন মৃত্যুহার এতো কম হওয়ার পিছনে কেবল আগে ভাগে টেস্ট করা, মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে পারা, হাসপাতাল সমূহের সক্ষমতা ছাড়াও আরও কিছু উপাদান কাজ করেছে বলে মনে করেন। তিনি বিশেষভাবে কয়েকটি বিষয়ের উপর জোর দেনঃ
- জার্মান জনগণ সাধারণভাবে উন্মত্ত নয়, যে কোন পরিবেশে তারা শান্ত থাকে
- জার্মান চ্যান্সেলরের ভূমিকা ও নেতৃত্ব
- জার্মানি ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় শহর-কেন্দ্রিক নয়। জার্মানিতে লন্ডন, প্যারিস, নিউইয়র্ক, রোম ইত্যাদির মতো বড় শহর নেই। বার্লিনের বাইরে অন্য শহরগুলো ছোট তবে সেসব শহরে অত্যাবশ্যকীয় সেবা খাত গুলো নিশ্চিতভাবেই আছে।
এসবের বাইরেও জার্মানির এমন সফলতার পিছনে তাদের কিছু বৈশিষ্ট্যও কাজ করেছে বলে অনেকে মনে করেন। জার্মানির জনগণ নিজেরাই অনেক সচেতন, এমনকি লক-ডাউনের আগেই এখানকার মানুষজন শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা শুরু করে। জার্মানদের দ্রুত শিক্ষা গ্রহণের ক্ষমতাকেও অনেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। ইতালিতে যখন মৃত্যুর মিছিলের মধ্যেও মানুষ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ অন্যান্য নির্দেশাবলী মানছিলোনা, জার্মানরা টেলিভিশনে এসব দেখেই নিজেদের করনীয় ঠিক করে নেয়। লক-ডাউন শিথিল করে জার্মানি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার দিকে ফিরছে। অনেকে এতে জার্মানিতে করোনাভাইরাসের ২য় দফা সংক্রমণের আশংকা করছেন। তারপরও বলা যায়, প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রথম দফায় জার্মানির জয় হয়েছে, এবং এই জয়ের কারণগুলো বিশ্লেষণ করে আমাদের জন্যও শিক্ষণীয় অনেক উপাদান আছে বলে মনে হয়।
তথ্যসূত্রঃ
১) বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস ওয়েবসাইট
২) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইট
৩) ওয়ার্ল্ডোমিটার ওয়েবসাইট (জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিষয়ক তথ্য হালনাগাদ করে থাকে)
লেখক : স্টাফ অফিসার টু ডিআইজি, ঢাকা রেঞ্জ।
0 Comments