ই-পেপার

নিউজ স্ক্রল

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ

হাসান মতিউর রহমানের লেখা, মলয় কুমার গাঙ্গুলীর সুর করা এবং সাবিনা ইয়াসমীনের কন্ঠে গাওয়া এই গানটি যেন শুধু একটি গান নয়, কোটি কোটি বাঙালি এবং সমগ্র বিশ্ববাসীর মনের কথা। আজ থেকে ৪৬ বছর আগের এই দিনে শেষ রাতের দিকে বাঙালি জাতিকে মুক্তির আলো দেখানো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল মানুষ নামের কীট্, ক্ষমতালোভী, চক্রান্তকারী কিছু বিপথগামী সেনাসদস্য। ঘাতকেরা ঐ দিনে নিরীহ নারী ও শিশুদেরও রেহাই দেয়নি, যা ইতিহাসের এক কলঙ্কময় অধ্যায়। সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যার করার পর বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে নেমে আসে তীব্র শোকের ছায়া এবং ছড়িয়ে পড়ে ঘৃণার বিষবাস্প। শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়ে পুরো বাঙালি জাতি।

১৯৪৭, ১৯৪৮, ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭০ সহ বিভিন্ন সময়ে মৃত্যুর খুব কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু বার বার ফিরে এসেছিলেন, ১৯৭১-এ পাকিস্তানী হায়েনারা যা করতে পারে নাই, সেই কাজটিই অত্যান্ত ঠান্ডা মাথায় ও পূর্ব পরিকল্পিতভাবে সম্পাদন করে পাপিষ্ঠ বাঙালি ঘাতকরা। ওরা মানুষ নামের হায়েনার দল, ওরা শয়তানের প্রেতাত্মা, ওরা জঘন্য,ওরা হিংস্র জানোয়ারের দল।

একদিন যে আঙ্গুলি উচিয়ে বাঙালি জাতিকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ভাবতে অবাক লাগে সেই স্বাধীন দেশের মানুষই তার অঙ্গুলি চিরদিনের জন্য নিস্তেজ করে দেয়। আর কোন দিন ঐ অঙ্গুলি আমাদের প্রেরণা দিতে আসবেনা, দেবেনা মুক্তির বারতা। মানুষ মরণশীল বলেই সবার মৃত্যু হয়। তবে কোন কোন মানুষের শুধু দেহাবসানই ঘটে, মৃত্যু হয় না। তারা থাকে মৃত্যুহীন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তেমনি একজন মানুষ। তিনি মৃত্যুহীন, তিনি অমর।

১৯৭৫ সালের এই দিনে ঘাতকরা জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডি-৩২ নম্বরের বাসায় নৃশংসভাবে হত্যা করে। তাঁকে সপরিবারে নিঃশেষ করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, জেষ্ট্য পুত্র মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, দ্বিতীয় পুত্র মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, কনিষ্ট পুত্র শিশু শেখ রাসেল, সদ্য বিবাহিত পুত্রবধু সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসেরকে হত্যা করা হয়।

মিন্টো রোডে সরকারী বাসভবনে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি এবং তৎকালীন মন্ত্রী অবিসংবাদিত কৃষকনেতা আব্দুর রব সেরনিয়াবাতকে, তার একমাত্র মেয়ে বেবি সেরনিয়াবাত, কনিষ্ট পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, দৌহিত্র সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু, ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত এবং আত্মীয় আব্দুল নঈম খান রিন্টুকে।

আরেক বাসায় হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মনি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মনিকে। তারা বর্তমান যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস্ পরশ এবং ঢাকা দক্ষিন সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ফজলে নূর তাপসের বাবা-মা।

বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আক্রমণ হয়েছে শুনে সেখানে যাওয়ার জন্য রওনা দেন বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ। তাকে ৩২ নম্বরের সামনে হত্যা করা হয়। এছাড়া ঐ দিন ৩২ নম্বরের বাড়িতে কর্তব্যরত অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকেও হত্যা করা হয়।

সেদিন সৌভাগ্যক্রমে শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা, শেখ হাসিনার স্বামী প্রখ্যাত পরমানু বিজ্ঞানী প্রয়াত ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার কর্মস্থল পশ্চিম জার্মানিতে থাকায় বেঁচে যান।

সেই নারকীয় হামলার পর দেখা গেছে, ভবনটির প্রতিটি তলার দেয়াল, জানালার কাঁচ, মেঝে ও ছাদে রক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গুলির আঘাতে দেয়াল গুলোও ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। চারপাশে রক্তের সাগরের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল ঘরের জিনিসপত্র। প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে নিথর পড়ে আছেন চেক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ। তাঁর তলপেটে ও বুকে ছিল বুলেটে ঝাঝরা। পাশেই পড়ে ছিল তার ভাঙ্গা চশমা ও অতিপ্রিয় তামাকের পাইপটি। অভ্যর্থনা কক্ষে শেখ কামাল, মূল বেড রুমের সামনে বেগম মুজিব, বেডরুমে সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, রোজী জামাল, নীচ তলার সিঁড়ি সংলগ্ন বাথরুমের পাশে শেখ নাসের এবং মূল বেড রুমে দুই ভাবির ঠিক মাঝখানে বুলেটে ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত অবস্থায় পড়েছিল ছোট শিশু শেখ রাসেলের লাশ। রক্ত ভেজা লাশ দেখে খুনিদের প্রতি চরম ঘৃণা-ধিক্কার জানানোর ভাষা খুঁজে পান না মানবতাবাদী বিশ্বের কোন মানুষ।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পরই খন্দকার মোশতাক আহমেদ যে কিনা বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন, সে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দেন। এবং খুনিদের বাঁচানোর জন্য ২৬ সেপ্টেম্বর ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন। ‘দি বাংলাদেশ গেজেট পাবলিশড বাই অথরিটি’ লেখা অধ্যাদেশটিতে খন্দকার মোস্তাক আহমেদের স্বাক্ষর আছে।

অধ্যাদেশটিতে দুটি ভাগ আছে। প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বল্বত আইনের পরিপন্থি যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোন আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোন আইন প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় অংশে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সংগে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো, অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোন আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোন আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।

এরপর ক্ষমতায় আসে আর এক সামরিক শাসক মেজর জিয়া। তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ সহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনে বৈধতা দেন।

এরপর দীর্ঘ ২১ বছর সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার আইনি বাধা অপসারনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ (রহিতকরণ) বিল, ১৯৯৬ সালে সপ্তম সংসদে উত্থাপন করা হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর আইনটি সংসদে পাশ হয়। ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর এটি পরিপূর্ণভাবে আইনে পরিণত হয়। ফলে মোশতাকের জারি করা এবং জিয়াউর রহমানের সময় বৈধতা পাওয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বিলুপ্ত বলে গণ্য হয়। এরপর শুরু হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কাজ।

বিচারে নি¤œ আদালত ঘাতকদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন। পরবর্তীতে নিম্ন আদালতের এ রায় হাইকোর্টেও বহাল রাখেন। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগ না দেওয়াসহ নানা কারণে বিচারের পথে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। ফলে রায় কার্যকরে বিলম্ব হতে থাকে। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠনের পর উচ্চ আদালত পর্যায়ের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেয়। সুপ্রিম কোর্টেও আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে। অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি পাঁচ খুনিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রায় কার্যকর করা হয়। পাঁচ জন হলেন-লে. কর্ণেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্ণেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর বজলুল হুদা, লে. কর্ণেল মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি) এবং লে. কর্ণেল একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার)। ২০০১ সালের ২ জুন লে. কর্ণেল (অব.) আব্দুল আজিজ জিম্বাবুয়েতে মারা যান বলে কথিত আছে।

২০২০ সালের ৭ এপ্রিল ক্যাপ্টেন (অব.) আব্দুল মাজেদকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ১২ এপ্রিল তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। আরেক খুনি রিসালদার মোসলেম উদ্দিন গত ১৯ এপ্রিল ভারতে গ্রেফতার হন। তবে তার গ্রেফতার নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা আছে। এছাড়া এখনো ১২ জনের মধ্যে চার জন বিদেশে পালিয়ে রয়েছে। পলাতকরা হলেন- কর্ণেল খন্দকার আব্দুর রশিদ, লে. কর্ণেল শরিফুল হক ডালিক, লে. কর্ণেল এ এম রাশেদ চৌধুরী এবং লে. কর্ণেল এস এইচ নূর চৌধুরী।

১৫ আগস্টের হৃদয় বিদারক ঘটনা যদি না ঘটতো তা হলে বিশ্ব দরবারে বহু আগেই আমরা একটি মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে পরিগণিত হতে পারতাম। তবে যে উদ্দেশ্য নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছিল তার পরিপূর্ণ সফলতা অর্জন করতে পারেনি শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে যাওয়ায়। তাই হয়তো ২০০৪ সালের ২১ আগস্টসহ এ পর্যন্ত প্রায় ২১ বার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মেরে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছিল ষড়যন্ত্রকারী ঘাতকেরা। কোটি কোটি দেশবাসীর দোয়া এবং আশির্বাদের জন্যই হয়তো শেখ হাসিনাকে বারবার মেরে ফেলার উদ্যোগ ভেস্তে গেছে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার সকল দুরভিসন্ধির সাথে সংশ্লিস্ট আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী ও পাকিস্তানী চক্র এবং তাদের এ দেশীয় দালালদের গোপন আতাতের কথা আজ দেশর মানুষের কাছে পরিস্কার হয়ে গেছে। আজ মানুষ বুঝতে পেরেছে বঙ্গবন্ধু হত্যার উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে বাংলাদেশের নাম চিরতরে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলতে। কিন্ত তাদের সেই ধ্যান ধারণা বাস্তবে রুপ লাভ করতে পারেনি।

জাতীয় শোককে শক্তিতে রুপান্তরিত করে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে এবং কাঙ্খিত অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দিতে পারলেই জাতির জনকের বিদেহী আত্মা শান্তি পাবে। আর এ লক্ষেই দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন মানবতার জনণী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে বিরামহীন নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন মানবতার মাতা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৭ কোটি মানুষ বিশ্বনেত্রী শেখ হাসিনার সকল কর্মকান্ডে সহযোগীতা করবেন আজকের সময়ে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ১৫ই আগষ্টের সকল শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর যে সমস্ত খুনীদের এখনও ফাঁসি দেওয়া যায়নি তাদেরকে অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসি কার্যকর করার জোর দাবী জানাচ্ছি।

লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব

মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় শাহবাগ, ঢাকা।

ভালো লাগলে শেয়ার করে দিন :)

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x