নাজমুস আহমেদ (আলবাব)
সময়টা ২০১১ সালের, দেশের মাটিতে প্রথমবার বিশ্বকাপ আয়োজন হচ্ছে। একজন ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক কর্মকর্তা, ক্রিকেটার ও ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে এই আয়োজনটা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, আনন্দ এবং গর্বের তা বলে বোঝানো যাবে না। ইচ্ছা ছিল প্রতিটা ম্যাচ গ্যালারিতে বসে দেখার, ম্যাচের সময় দর্শকরা যেমন বুনো উল্লাসে মেতে উঠে সেটির মজা টিভি সেটের সামনে বসে একদমই পাওয়া যায় না। তবে মাঠে বসে খেলা দেখার সময় কোথায়? ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা এমন, কি আর বলবো? এমনিতেই গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে যে গরম, তার উপর তাড়াতাড়ি শিপমেন্টের জন্য চাপ সবসময়ই থাকে, অফিসের সবাই অসম্ভব ব্যস্ততার মধ্যে থাকে।
আমার তিন রত্ন নাশওয়ান, আরশিয়ান ও মাহাদিয়া এবং ওদের আম্মুকে নিয়ে আমাকে একজন সুখি মানুষই বলা চলে। সপ্তাহে ছয়দিন অফিস একদিন মাত্র ওদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারি। আমার মেয়েটা তিনভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট্ট, বয়স মাত্র ১০ বছর। এই বয়সেই আমাকে অনেক শাসন করে, আমার মা। ওদের তিনজনকে আমি এখন তেমন বেশি একটা সময় দিতে পারি না। তবে আমি আমার তিন রতœকে অনেক বেশি ভালোবাসি।
এর মধ্যে হঠাৎ করে শরীরটা একটু খারাপ খারাপ লাগা শুরু করেছে, এই শীতের শেষের দিকের ধুলাবালির জন্য, নাকি জ্যামের মধ্যে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে আশুলিয়া পর্যন্ত সকাল বেলার জার্নি, নাকি ফ্যাক্টরির অসহ্য গরম, নাকি অন্য কিছু কিছুই বলা যাচ্ছে না। আর কাজের জন্য নিজের শরীরের প্রতি একটু যত্ন নেওয়া বা ডাক্তারের কাছে যাওয়া কিছুই হচ্ছে না। আমরা পুরুষ মানুষ অল্পতে এত কাতর হলে চলে না। পরদিন শিপমেন্ট আছে, অফিসে অনেক কাজ, কিন্তু অফিসে যাওয়ার পর থেকে শরীরটা এত খারাপার লাগছে বলে বোঝানো যাবে না। কিছুক্ষণ কাজ করার পর খেয়াল করলাম আমার সারা শরীর ব্যথা, জ্বর উঠে গেছে । সেদিন অফিস থেকে বের হয়ে গেলাম দুপুরে, বাসায় এসে ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লাম, কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না ওষুধে।
আর সহ্য করতে না পেরে দুইটা সাপোজিটর নিলাম কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হলো না, বিছানায় শুয়ে ক্লান্তিতে ওই জ্বর নিয়েই ঘুম চলে আসলো। সন্ধ্যায় ঘুম থেকে ওঠার পর আরও বেশি খারাপ লাগছিলো, জ¦র, শরীর ব্যথার সঙ্গে সঙ্গে এখন মনে হচ্ছে যে দুনিয়াটা কেমন যেন দুলছে। বাথরুমে গেলাম কোনো মতে ওয়ালটা ধরে ধরে, কাশির সঙ্গে সঙ্গে রক্ত আসলো। তখনই খানিকটা ভয় পেয়ে গেলাম, দেরি না করে পরদিনই চলে গেলাম এ্যাপোলো হাসপাতালে। ডাক্তাররা বেশ কিছু পরীক্ষার পাশাপাশি ভর্তি নিয়ে নিলো। পরের দিন ডাক্তাররা বললো প্লাটিলেট লেভেলটা অনেক কম, ডেঙ্গু হতে পারে, তবে শরীরের যে অবস্থা তাই আরও কিছু পরীক্ষা করতে দিলো। এমনিতেই তখন শরীরটা বেশি ভালো না তার উপর ডাক্তাররা সামান্য জ্বরকে কি পর্যায়ে নিয়ে গেছে তাই নিয়ে ভাবছি, এক জ্বরের জন্য সাত দিন হাসপাতালে আমার নিজের ভর্তি থাকতে হবে তা কল্পনাতেও ভাবি নি।
সাতদিন পর বাসায় এলাম, বাসায় এসে দেখি দুনিয়ার সব আত্মীয়স্বজন আমাকে দেখার জন্য হাজির। আর হাসপাতালে যে কয়দিন ছিলাম সে কয়দিন কত আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, কলিগ আরও কত মানুষ যে আমাকে দেখার জন্য চলে এসেছে তার হিসাব নেই। আমার হাসপাতালের কেবিনের টেবিলে ফলের স্তুপ হয়ে গিয়েছিল যেন একটা ফলের দোকান, বেদানা আর আঙুর খাওয়ার চেয়ে ওগুলো দেখতে দেখতে অভক্তি চলে এসেছিল। আমার ডেঙ্গু হয়েছে তার জন্য সবাই এত উদ্বিগ্ন, মনে মনে খুশিই লাগছিলো যে আমাকে সবাই এত ভালোবাসে। তবে আমার পরিবারের সবাই কেমন যেন ভেঙে পড়েছিল আর চেহারা একদম মলিন হয়ে গিয়েছিল।
কয়েকদিন বাসায় থাকার পর সবাই আমাকে বললো যে সিঙ্গাপুর গিয়ে একটু চেআকাপ করে আসার জন্য, মানে আমার বাবা আর মামা। মনে হলো এই জ্বরের জন্য সিঙ্গাপুর? আমাদের দেশে মানুষ ভালো করে চিকিৎসা পায় না, আর আমি আমার সামান্য জ্বর হয়েছে, আমি যাবো সিঙ্গাপুরে শুধু চেআকাপ করার জন্য। বাবাকে প্রচণ্ড ভয় পেতাম, তাই কিছু বলতে পারলাম না। আমার বোন আমাকে বলেছিল ভাইয়া তুমি তো এমনিতে অসুস্থ হও না, যেহেতু হঠাৎ করে এত অসুস্থ হয়ে গেছো, তাই আর দেরি না করে একটু ভালো ডাক্তার দেখিয়ে আসো। আমি হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার ১০ দিনের মাথায় সিঙ্গাপুরের উদ্দ্যেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম, সঙ্গে আমার বাবা আর আমার স্ত্রী। আমি তখনও জানতাম না ঢাকার ডাক্তাররা আমার শরীরে লিউকেমিয়া নামের ব্লাড ক্যান্সারের জীবাণু খুঁজে পেয়েছে।
আমি সিঙ্গাপুরের গ্লেন ইগল হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। আমাকে হেমাটোলজি ডিপার্টমেন্টে ভর্তি রেখে পরীক্ষা করছিলো, আমার মনে তখন একটু একটু করে সন্দেহ হচ্ছিল যে আমার মনে হয় বাজে কোনো ধরনের রোগ হয়েছে। আশে পাশে যারা আছে তাদের সবারই ব্লাড ক্যান্সার, বেশিরভাগ লিউকেমিয়ার রোগী। আমার ডাক্তার ছিল ফ্রেডি, রিপোর্ট দেখানোর সময় ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ডাক্তার আমার কি লিউকেমিয়া হয়েছে? ডাক্তার খুবই সহজভাবে বললো, হ্যাঁ, বন্ধু তোমার লিউকেমিয়া হয়েছে। তুমি আর আমি দুইজন মিলে এই রোগটার সঙ্গে যুদ্ধ করবো। তোমাকে মাত্র ৫টা কেমোথেরাপি দিবো, তুমি খুব দ্রুত দেশ থেকে সব কিছু গুছিয়ে চলে এসো এখানে। ফ্রেডিকে জিজ্ঞেস করলাম আমি কি মারা যাচ্ছি? ফ্রেডি তখন হাসতে হাসতে বললো, অবশ্যই মারা যাচ্ছো, কিন্তু এমন কোনো মানুষ নেই যে সে মারা যাচ্ছে না। তবে তুমি এই লিউকেমিয়াতে মারা যাচ্ছো না। ফ্রেডির কথায় তেমন একটা কিছু মনে হলো না যে আমার ক্যান্সার হয়েছে বা ক্যান্সার কতটা ভয়াবহ।
ফ্রেডি চলে যাওয়ার পর উপলব্ধি হয়েছিল যে আমার লিউকেমিয়া হয়েছে, তখন আমার খেয়াল হলো এজন্যই কি আমার পরিবারের সবাই এতটা ভেঙে পড়েছিল? আমাকে জানতে দেয়নি, আমি যদি মারা যাই আমার ছেলে মেয়েগুলোর কি হবে? এইসব ভাবতে ভাবতে আমি কেমন যেন ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছিলাম আর আমার সব অসুখ যেন তখন আমার শরীরে বিশাল এক পাহাড়ের মত করে এসে চেপে বসলো। ডাক্তারের কথা মতো আমি দেশে চলে এলাম সব কিছু গুছিয়ে নেওয়ার জন্য, কারণ পাঁচটা কেমোথেরাপি দিতে প্রায় চার-পাঁচ মাস লাগবে। সিঙ্গাপুর থেকে আসার সময় বাবা আমাকে একটা বিজ্ঞাপন দেখিয়েছিল একটা মেয়ের লিউকেমিয়া হয়েছে কিন্তু অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছে না। আমি দেশে এসে সর্বপ্রথম যে কাজটা করলাম সেটা হলো ওই যে মেয়েটার লিউকেমিয়া হয়েছিল, অর্থের অভাব চিকিৎসা করাতে পারছে না, তার জন্য আমি আমার যত বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন আছে সবার কাছে থেকে মেয়েটার চিকিৎসার খরচ জোগাড় করে তার বাবার কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করলাম।
তারপর সবার কাছে থেকে বিদায় নিলাম, যখনই কারও কাছে থেকে বিদায় নিতাম তখন আমার মধ্যে একটা ভয় কাজ করতো আর হয়তো কারও সঙ্গে দেখা হবে না, আমি হয়তো আর ফিরে আসবো না। সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছিলাম মায়ের কাছে থেকে বিদায় নেওয়ার সময়। মা আসার সময় বলেছিল, ‘ঠিক আছে বাবা। ঠিকমতো যাস।’ আমি খুব কষ্ট করে কান্না আটকে রেখেছিলাম, জানতাম যে আমার চোখ দিয়ে পানি পড়লে আম্মুও নিজেকে ধরে রাখতে পারবে না। এরপর আমার তিন যক্ষের ধন নাশওয়ান, আরশিয়ান ও মাহাদিয়ার কাছে থেকে বিদায় নিয়েই রওয়ানা দিলাম সিঙ্গাপুরের উদ্দ্যেশ্যে।
সিঙ্গাপুরে বাবা এবং স্ত্রীকে নিয়ে উঠলাম সারাঙ্গন এলাকার একটি ফ্ল্যাটে, শুধু ডাক্তার দেখান সময়, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য এবং কেমোথেরাপি নেওয়ার জন্য হাসপাতালে যাওয়া লাগতো। এছাড়া বাকি সময়টুকু ফ্ল্যাটেই থাকা হতো। আমি জীবনে ভালো কিছু বন্ধু-বান্ধব পেয়েছিলাম, একে একে সবাই বাংলাদেশ থেকে ছুটে এসেছিল আমাকে দেখার জন্য। কেমোথেরাপি দেওয়ার পর শরীরের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা হতো, মনে হতো যে শরীরের প্রত্যকটি শিরায় শিরায় আগুন জ্বলছে। খুবই ক্লান্ত লাগতো, সকালে কেমোথারাপি দেওয়ার পর বাসায় এসে সারাদিন ঘুমাতাম। ওষুধগুলোর প্রভাবে আমার মেজাজও দিন দিন হারাচ্ছিলাম। সব সময় কোনো না কোনো কিছু নিয়ে আমি আর আমার স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া লেগেই থাকতো। সিঙ্গাপুরে যাওয়ার প্রথম দিকে সব ঠিক ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে যখন ওষুধের ডোজ বাড়ছিলো। তারপর আমি আর আমার মেজাজ ধরে রাখতে পারতাম না, বেচারীর কোনো দোষ ছিল না, তর্কগুলো আমিই করতাম। আমার কখন কোনোটা দরকার হয় এগুলো নিয়েই ও সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতো। আস্তে আস্তে ও কেমন যে নিষ্প্রভ হয়ে পড়ছিলো, দিন দিন ওর চেহারা আর স্বাস্থ্য ভেঙে যাচ্ছিলো।
ছয় মাস পর ডাক্তার আমাকে বললেন, আলবাব তুমি ভালো হয়ে গেছো। তুমি পৃথিবী অত্যন্ত ভাগ্যবান মানুষগুলোর মধ্যে একজন। আমি বললাম, তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ ডাক্তার; আমি তোমার কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। ফ্রেডি আবার বললো, ইশ্বর তোমাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছেন, নিশ্চয়ই তিনি তোমাকে নিয়ে কোনো পরিকল্পনা করেছেন। আর শোনো, দেশে গিয়ে শক্ত কোনো কাজ করবে না, গরম লাগাবে না, ঠাণ্ডা লাগাবে না। একদম শিশুর মতো করে তোমার যত্ন নিতে হবে। আমি বললাম, পেটের তাগিদে গার্মেন্টস ব্যবসা করে খাই, ওখানে তো অনেক গরম। ফ্রেডি বললো ,ওটা ছেড়ে দাও, বেঁচে আছো এটাই অনেক বড়। তারপর আমি দেশে চলে এলাম।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা এবং ট্রাস্ট্রি
বাংলাদেশ ক্যান্সার এইড ট্রাস্ট – BANCAT