ই-পেপার

নিউজ স্ক্রল

মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম

সেভেন্থ ডে আদ্ভেন্টিস্ট চার্চ সাউথ বাংলাদেশ মিশন স্কুল, গোপালগঞ্জ এর সংস্কারের জন্য অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা ও শ্রমমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর পথ আটকে দাঁড়িয়েছিলো যে স্কুল ছাত্র, তার রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের গল্প শুরুও একই গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। বাংলা নামক ভূখন্ডের অজ পাড়াগাঁয়ে বেড়ে ওঠা বালক, যুবক, কৈশোর পেরিয়ে যতই সামনে অগ্রসর হয়েছেন ততই সমকালীন সরকারের রোষানলে পড়েছেন। হেনস্তা হয়েছেন। কারণ একটাই। বুদ্ধি ফোটার সময় থেকে শুরু করে ভুখা নাঙ্গা হতদরিদ্র এই অঞ্চলের মানুষের অধিকারের কথা বলেছেন তিনি সর্বদাই। তাদের ভাত কাপড় শিক্ষা চিকিৎসার অধিকারের কথা বলতে গিয়ে তিনি বারেবারে সরকারের কোপাক্রান্ত হয়েছেন। জেল খেটেছেন। দমেননি কখনো। তারপরে যখন ক্রমান্বয়ে লেখাপড়া শিখে রাজনৈতিক নেতাদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে গিয়েছেন তখন থেকেই ভুখানাঙ্গা মানুষগুলোর রাজনৈতিক অধিকারের কথা বলেছেন, তাদের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই শুরু করেছেন, তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সম্বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টি করেছেন। আর ব্রিটিশ শাসক থেকে শুরু করে একের পর এক প্রশাসন যখন এই অঞ্চলের অতি সাধারণ মানুষের অধিকারকে বুটের চাপায় নিস্পেষিত করেছে তখন থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন স্বাধীকারের। যার ¯পষ্ট রূপ দেখতে পাই ৭ই মার্চে।

৭ই মার্চ দিনক্ষণ হিসেবে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্যালেন্ডারে সঠিকভাবে চিত্রায়িত হয় তখন, যখন আমরা পিছন ফিরে বঙ্গবন্ধুর জীবনের যৌবনঘন অধ্যায়গুলোতে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্মকথা উপলব্ধি করার চেষ্টা করি। সেই পূর্ব পাকিস্তান তথা পাকিস্তানের জন্ম পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর মতো এ অঞ্চলের যে সকল নেতৃবৃন্দ পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাঁদের অনেকেরই মোহভঙ্গ ঘটেছিল পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাঞ্জাবীদের বুটের যাঁতাকলে পড়ে। এই যাতাকল এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম পদচারণা যখন এ অঞ্চলকে তোলপাড় করে তোলে তখনই ৪৫-৪৬ কিংবা ৪৭ এর ঘটনাপ্রবাহ শেখ মুজিবের স্বপ্নভঙ্গের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

৪৭-৪৮ এ পাকিস্তান সৃষ্টির স্বপ্নভঙ্গের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের ছাত্রত্ব বিসর্জন দিয়ে নিজের মাথায় শাস্তির বোঝা বহন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে আপোষ করেন নাই। সে সময় তার বয়সি সমসাময়িক অনেক নেতাই ক্ষমতার সিঁড়ি ¯পর্শ করার বিফল প্রচেষ্টায় সময়ক্ষেপন করেছেন। তার চাইতে প্রবীণ নেতা মওলানা ভাসানী ও মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন, কিন্তু রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করার প্রয়োজন কেবল তার মধ্যেই অনুভূত হয়েছে। তাই তিনিই রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগ তৈরি করেছেন। তৎকালীন প্রগতিশীল সমাজ মুসলিম কেটে শুধু আওয়ামী লীগ করতে চেয়েছেন। কিন্তু শেখ মুজিব তার প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে উপলব্ধি করেছেন মুসলিম লীগের ধোঁয়ায় সৃষ্ট পাকিস্তানে তখনও মুসলিম শব্দটি ত্যাগ করার সময় আসেনি। তাই তিনি বলেছেন আপাতত আওয়ামী মুসলিম লীগই চলবে। সময় বুঝে মুসলিম বাদ দেয়া যাবে। আর এই ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে রাজনৈতিক দলকে শক্ত ভিত্তিতে দাঁড় করানোর জন্য ভ্যানগার্ড হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ সৃষ্টি করেছেন। এভাবেই তিনি পাকিস্তানি রাজনীতিতে পূর্ব পাকিস্তানের শোষিত বঞ্চিত মানুষের রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। এটা কারো দয়া বা ভিক্ষার ফসল নয়। এটা ছিল তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ফসল। তারও পরে কথা থাকে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। এসময়ে জনতার প্রাণের দাবি মাতৃভাষা বাংলা চাই। এ দাবি অর্জনে দীর্ঘ কারাবাসের অন্তরালে তিনি ছাত্রদের চিরকুট পাঠান। চুয়াল্লিশ ধারা ভঙ্গ করতে হবে। তখনকার জগন্নাথ হলের অভ্যন্তরে জাতীয় সংসদে দাবি তুলতে হবে, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। যেকোনো অবস্থায়। উত্তরে মেলে গুলি। গুলিবিদ্ধ জাতিকে টেনে তুলতে তিনি করেন আমরণ অনশন। পাঞ্জা লড়েন মৃত্যুর সাথে। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নেয়ার প্রতিবাদী সংগ্রামে তিনি-ই নেতা। এ নেতৃত্ব কি তাকে কেউ এমনি এমনি হাতে তুলে দিয়েছে? তার সমসাময়িক ঢাকাকেন্দ্রিক সমপর্যায়ের অথবা তাঁর চাইতে বয়োজেষ্ঠ্য নেতৃবৃন্দ যেমন আতাউর রহমান খান, তথাকথিত বাম প্রগতিশীল রাজনীতির ধারক, প্রফেসর মোজাফফর আহমদ, চৈনিক বামপন্থী আলাউদ্দিন, আব্দুল হক, তোহাদের উন্নাসিকতা ভেদ করে তিনি নিজেকে আপন স্বকীয়তায় উজ্জ্বল করেছেন। স্বীয় জ্ঞাতিগোষ্ঠী গোপালগঞ্জের এডভোকেট সালাম খান, কাজী কাদেরদের নিরন্তর বিরোধিতার বিরুদ্ধে লড়াই করে কোটালীপাড়ায় জনগণের নেতা হয়েছেন। নির্বাচনে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের সহযোগিতায় বিশাল বিশাল মুসলিম লীগের প্রতিনিধিদের পরাজিত করেছেন। স্বীয় মেধা প্রজ্ঞা ও কর্মতৎপরতাকে কাজে লাগিয়ে যৌবনের শুরুতে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ও সোহরাওয়ার্দী টুঙ্গীপাড়া আগমনকে কেন্দ্র করে নিজের স্কুলের ছাদ মেরামতের জন্য উক্ত দুই ক্ষমতাবানদের প্রতিশ্রুতি আদায় করে তাদের সঙ্গে সখ্যতার যে বীজ রোপণ করেছিলেন তারই সূত্র ধরে তিনি ঢাকার কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে এসে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ

১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭১। আওয়ামী লীগের সংগঠন হিসেবে বেড়ে ওঠার সময়। সংগঠনকে বঙ্গবন্ধু তৈরি করেছেন রাজনীতি করার জন্য। সময়ের পথ পরিক্রমায় সংগঠন শক্তিশালী হয়েছে। ’৫২, ’৫৪, ’৬২, ’৬৬, ’৬৯, ’৭০, ’৭১। একেকটি ক্ষণ, এক একটি মাইলফলক। এ সময়ে শেখ মুজিব বাংলাদেশের ভুখানাঙ্গা বাঙালির রাজনীতির অনুঘটক হিসেবে, নেতা হয়েছেন, বঙ্গবন্ধু হয়েছেন। তার সংগঠন ডালপালা মেলেছে। শক্তিশালী হয়েছে। কঠিন থেকে কঠিনতর কর্মকান্ডে সফলতা দেখিয়েছে। তাঁর আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচন করেছে, নিরঙ্কুশ বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের মানুষ তাদের অধিকার আদায়ের পক্ষে কথা বলার অধিকার দিয়েছে। যে অধিকার আদায়ের জন্য তিনি মওলানা ভাসানীর ভোটের আগে ভাত চাই স্লোগানের বুকে পদাঘাত করে ভোট যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে পাকিস্তানপন্থীদের চরমভাবে পরাভূত করেছেন। পাকিস্তানের ক্ষমতা আহরণের চাবিকাঠি নিজের মুঠোয় পুরে নিয়েছেন। শক্ত হাতে ৭ মার্চ জাতিকে সশস্ত্র সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছেন। ২৩ মার্চ পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছেন। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি অপারেশন সার্চলাইটের মুখে তুড়ি মেরে বাঙালি নিধনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। বাঙালি তাঁকে জাতির পিতা ঘোষণা দিয়েছে। এই প্রতিটি পদক্ষেপে আওয়ামীলীগ ছিল তার একমাত্র সংগঠন। বিপদে-আপদে পথে-প্রান্তরে রাজপথে গ্রামেগঞ্জে এই সংগঠন তাকে শক্তি যুগিয়েছে সাহস দিয়েছে। তৃণমূল থেকে শুরু করে তার সবচাইতে ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা তাকে নির্ভরতা দিয়েছে আনুগত্য দিয়েছে। নির্ভেজাল সহায়তার অবারিত দ্বার খুলে তার সামনে দাঁড়িয়েছে। বলেছে, “বন্ধু, তুমি হুকুম দাও আমরা তোমার হুকুম প্রতিটি অক্ষরের অক্ষরে পালন করব।”

দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রামী জীবনের পলে পলে গড়ে তোলা এ আওয়ামী লীগ বহু অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ। জীবনের শেষ অগ্নিপরীক্ষা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতা যুদ্ধ। এই যুদ্ধে বিজয়ী হতে হবে। এই যুদ্ধে প্রশিক্ষিত, পারঙ্গম জীবন দেয়া নেয়ার উন্মাদনা তাড়িত মানুষগুলোই গাইতে পারে জীবনের জয়গান। এই পরীক্ষিত মানুষগুলো আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোথায় আছে? নেই। অন্তত তাবৎ কালে জন্মায়নি। এজন্যই তো স্বাধীনতা সংগ্রামে আওয়ামী লীগের সফলতা। জয় জয়কার।

৭ই মার্চ ও স্বাধীনতার ঘোষণা

একটা রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণার সরাসরি সরলীকরণ হয়না। পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন শক্তি থাকে। পক্ষের শক্তির বেড়াজালে বিপক্ষীয় সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলে। বঙ্গবন্ধু এসব কথা বিবেচনায় রেখেই ৭ই মার্চের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রথমত নির্বাচনে বিজয়ী দল হিসেবে পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণ করার আইনগত অধিকার ছিল তাঁর। সেই অধিকারের দাবিতে তিনি অনড় ছিলেন। একইসঙ্গে জনগণের ম্যান্ডেট ৬ দফা নিয়ে কোন কূটচালে জড়াতে চাচ্ছিলেন না। সেজন্য সকল নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে কনস্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলি তৈরি করে সবাইকে বলে দিয়েছিলেন, ৬ দফা এখন জনগণের সপদ। এর সঙ্গে কেউ বেইমানি করলে তাঁকে চরম শাস্তি পেতে হবে। এ সিদ্ধান্ত সকল জনপ্রতিনিধিগণ মেনে নিয়েছিলেন। ইতিহাস এর সাক্ষী। অপরদিকে পাকিস্তান আর ইয়াহিয়া কোনমতেই শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে পারছিলেন না। মিলিটারি আর পশ্চিমা পাঞ্জাবি রাজনৈতিক শক্তির বিরোধিতার কারণে। এ অবস্থায় ইয়াহিয়া ভুট্টো চাচ্ছিল, যেকোনো ভাবেই হোক শেখ মুজিবকে পাকিস্তান ভাঙ্গার দায়িত্ব কাঁধে দিয়ে দেশদ্রোহীতার নামে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলাতে। ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে এই ফাঁদে পা দিলে ইয়াহিয়ার বিমান বাহিনী রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত জনতার উপরে গুলি চালিয়ে অসংখ্য মানুষ হত্যায় সামান্যতম দ্বিধা করতো না। আমাদের কষ্টার্জিত নির্বাচনী বিজয় ভূলুণ্ঠিত হত। আর শেখ মুজিবের ললাটে মিলতো পাকিস্তান ভাঙ্গার অপবাদ। ইয়াহিয়ার পূর্ব পাকিস্তানকে কুক্ষিগত করে রাখার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হত।

বঙ্গবন্ধু বাঙালি হয়ে বাংলার মানুষের অধিকার রক্ষা করার প্রয়োজনে কোনো অবস্থাতেই নিজেকে বা তাঁর দলকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায় আখ্যায়িত করতে রাজি ছিলেন না। পাকিস্তান চাচ্ছিল বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায় আখ্যায়িত করতে। ওদের ফাঁদে পা  না দিয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, সংগ্রামের কথা- স্বাধীনতার কথা। কিন্তু কখন সেটা ¯পষ্ট করলেন না। আর জনগণকে বলে দিলেন প্রস্তুতি নিতে। যা হবার তাই হল। ২৩শে মার্চ বাংলার পথে প্রান্তরে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হলো আর পাকিস্তানের পতাকা পুড়ে ছাই হলো। বাঙালি আক্রমণ করল না কিন্তু আক্রমণের প্রস্তুতি নিল। আর বোকা ইয়াহিয়া বাঙালিদের আক্রমণ করল। বাংলাদেশ পৃথিবীকে দেখিয়ে দিল জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবে অধিকার সংরক্ষণ করার দাবিতে অনড় বাঙালি জাতি আক্রান্ত আর পাকিস্তানিরা আক্রমণকারী। আক্রান্ত জাতিকে সাহায্য করতে পৃথিবীর সকল গণতন্ত্রকামী রাষ্ট্র ও জনগণ এগিয়ে আসতে বাধ্য হলো। কারণ পৃথিবীর চোখে বাঙালি জাতিসত্তা তার আইনগত অধিকার দিয়ে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে, কাউকে আঘাত করেনি। আক্রান্ত জাতি হিসাবে তার অধিকার প্রতিষ্ঠায় নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার আইনানুগ হকদার। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নেতা হিসেবে তাই তিনি ঘোষণা করলেন, “আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।” সময়ের প্রয়োজনে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার এক ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এহেন কার্যকরণের কারণেই বাঙালি জাতি তাঁকে জাতির পিতার আসনে সমাসীন করল। তারিখ ২৬ মার্চ, ০১:২০; ১৯৭১। আওয়ামীলীগের নেতাদের কাছে একটা অবশ্য করণীয় সংবাদ ছিল, “যুদ্ধকে সাংগঠনিকভাবে চালাতে রাষ্ট্রীয় কাঠামো তৈরি করো।”

যুদ্ধ করার জন্য বঙ্গবন্ধু কি দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন সে ব্যাপারে আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিস্কার ভাষায় বলতে চাই। তিনি দীর্ঘ ২৩ বছর লড়াই করেছেন সংগ্রাম করেছেন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসীন হবেন এবং নির্বাচনে যেহেতু বিজয়ী হয়েছেন জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সরকার গঠন করবেন। এটাই স্বাভাবিক এবং এটাই ছিল তাঁর দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রাম লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়নের কঠিন সিড়ি।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রবাসী সরকার গঠন করার পক্ষে ছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াইরত সকল বাঙালি সামরিক অফিসারবৃন্দ। অর্থাৎ যুদ্ধরত প্রধান সেনাপতি এমএজি ওসমানী, মেজর শফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, কর্নেল রব, কর্নেল রেজা, মেজর সি আর দত্ত, ক্যাপ্টেন হায়দার, ক্যাপ্টেন নজমুল হুদা, ক্যাপ্টেন মইনুল হোসেন চৌধুরী, মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরী, সহ অন্যান্য। এদের অনেকেই ৪ঠা এপ্রিল এক সভায় মিলিত হয়েছিলেন সিলেটের তেলিয়াপাড়র চা বাগানের সবুজ-পাহাড়ি প্রাঙ্গণে। এখানে অবশ্য মেজর জিয়াউর রহমানও ছিলেন। তবে তিনি ছিলেন উচ্চাভিলাষী, তাই পরবর্তীতে মতিভ্রষ্ট। তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন সরকার গঠন না করলে সবাই একদল ভাড়াটিয়া বাহিনী হিসেবে নাগরিকত্ববিহীন অন্ধকার অরণ্যে মিলিয়ে যাবেন। বাংলাদেশ নামক বঙ্গবন্ধুর সৃষ্ট স্বাধীন রাষ্ট্রভূমি মিশে যাবে অমানিশার কাল গহ্বরে।

প্রসঙ্গত তেলিয়াপাড়ায় সমবেত সকল মুক্তিযুদ্ধের জন্য তৈরী-সামরিক, আধাসামরিক কিংবা বেসামরিক অফিসারদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ছিল কর্নেল ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি করতে হবে। তারা গণপ্রজাতন্ত্রী স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের জায়গাও দিতে চেয়েছিলেন সিলেটের মাধবপুরের ওই চা বাগানে। কিন্তু পাকিস্তানিরা সংবাদ পেয়ে মাধবপুর আক্রমণ করে তাদের সেই প্রচেষ্টাকে ভন্ডুল করে দেয়। ইতিহাস স্বাক্ষী সর্বশেষে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠাণ হয়েছিল ঐতিহাসিক মুজিব নগরে।

মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা

ভারত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। গণতন্ত্র চর্চার দীর্ঘ ইতিহাস আছে তার। ভারতের শাসনতন্ত্র সামরিক শাসন বরদাস্ত করে না। বিদ্রোহ কিংবা বেআইনি অস্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী যে কোন দলকে ভারত বর্জন করে। ভারতের সকল বামপন্থী দল গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে পরিচালিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলে বিশ্বাস করে। এভাবেই চলেছে এই দেশটি ১৯৪৭ থেকে। পূর্ব পাকিস্তান আমলে অর্থাৎ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই এদেশে বিদেশি প্রভাবান্বিত চৈনিক বামপন্থীদের অভাব ছিল না। ১৯৬৮ সালে বেআইনি অস্ত্রধারী বামপন্থী হিসাবে এদেশের মাটিতে আবির্ভূত হলো সিরাজ সিকদার। সে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের আহত-নিহত করেছে, তাদের হাতিয়ার কেড়ে নিয়েছে। তার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে চৈনিকপন্থী হক, তোহা, আলাউদ্দিনগণ।

মধ্য বামপন্থী দল হিসেবে মাওলানা ভাসানী তাঁর ভাসানী ন্যাপ তৈরি করেছেন। তাদের সঙ্গে যুদ্ধের আগে কিংবা পরে আওয়ামী লীগের কোনো সময় খুব একটা ভালো বনিবনা হচ্ছিল না। আর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে একমাত্র গণতান্ত্রিক নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দল ছিল আওয়ামী লীগ। সুতরাং আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্যতাহীন কোন পার্টির পক্ষে ভারতের সহযোগিতা লাভ করা সম্ভব ছিল না। এই কারণেই ভারত নির্বাচনে নিরঙ্কুশভাবে বিজয়ী আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুদ্ধাবস্থায় আলাপ-আলোচনা চালিয়েছে। তাদের প্রতি সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। পরবর্তীতে ন্যাপ-ভাসানী যখন আওয়ামী লীগের সাথে হাত মিলিয়েছে তখন তাকেও সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করেছে। তার আগে নয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী

আমাদের মনে রাখা দরকার পাকিস্তান সাড়ে সাত কোটি বাঙালির নির্বাচনের মাধ্যমে অর্জিত জন্মগত অধিকারকে চিরদিনের জন্য পোড়ামাটির ছাইভস্মে পরিণত করার জন্য ২৫ তারিখ মধ্যরাতের আগেই তার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। তারপর মাত্র সাত দিনের মাথায় ভারতের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ¯পষ্ট ভাষায় পৃথিবীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির জন্মগত অধিকার এর প্রতি ভারতীয় জনগণ ও সরকারের পূর্ণ আস্থা আছে। ইতিমধ্যেই পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণ লড়াই শুরু করেছে। এ লড়াইয়ে বাঙালি জনগণের পাশে থাকবে ভারত।” যুদ্ধ শুরুর প্রথম প্রহরে ভারতের মতো একটা বন্ধু প্রতিম রাষ্ট্রের এহেন সহমর্মিতা আমাদের ভবিষ্যৎ যুদ্ধজয়ের একটা বিশাল অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। এ বিষয়ে একজন লড়াকু সৈনিক হিসেবে অন্তত আমার মনে কোনো দ্বন্দ্ব নেই দ্বিধা নেই। প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত বিশ্বস্ত প্রিয়ভাজন ভারতের কেন্দ্রীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রধান কে. এফ রুস্তম জি’র সাথে একান্তে আলাপ করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে স্বল্পতম সময়ে সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন তাজউদ্দিন সাহেব ও তাঁর সহকর্মীরা। এ প্রসঙ্গে উপদেশদাতা ছিলেন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। কারণ একটা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত আইনানুগ সরকার ই যেকোনো গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে প্রয়োজনীয়  চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারে। এবং সেসব চুক্তির সঙ্গে বিশ্বের যে কোন আইনানুগ সরকার নির্দ্বিধায় একাত্মতা ঘোষণা করতে পারে। এভাবে সরকার গঠনে তাঁর সার্বিক সহায়তা নিশ্চিত করলেন শ্রীমতি গান্ধী। সরকার গঠনের প্রক্রিয়া যাতে নিশ্চিতভাবেই  সফলতার দ্বারে পৌছে সে জন্য একান্ত আপনজন বিশ্বস্ত ধর্মপ্রাণ এবং আমাদের সংগ্রামের প্রতি আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধাশীল, মানবিক গুণাবলী সমৃদ্ধ একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল নগেন্দ্র সিং-কে তাজউদ্দিন সাহেবের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে আমাদের সামরিক ব্যপারে পরামর্শ দেওয়ার জন্য নিয়োজিত করলেন। তাজউদ্দিন সাহেব প্রথম একান্ত বৈঠকেই দেশে যুদ্ধ চলছে এ কথা জানিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে অস্ত্র রসদ ও যুদ্ধ পরিচালনায় সাজ সরঞ্জাম চাইলেন। প্রসঙ্গত একটা অত্যন্ত জরুরী গুঢ় কথা বললেন তাজউদ্দিন সাহেবকে শ্রীমতি গান্ধী। “ইয়াহিয়া চাইবে বাংলাদেশের সমস্যাকে আন্তর্জাতিকীকরণ করতে। কোন অবস্থাতে ইয়াহিয়ার সেই ফাঁদে পা ফেলা যাবে না,”। আর এ সবগুলো কাজই তিনি করলেন বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকার প্রধান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠতম বাধ্যগত কজন নেতার মাধ্যমে। বাম, ন্যাপ তো নির্বাচন বর্জনকারী দল। ভাসানী ন্যাপ আর মোজাফফর ন্যাপ  সরকারের বাইরে। তাদের সাথে গাঁটছড়া বাঁধার প্রশ্নই আসে না। চৈনিক পন্থী বামেরা ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ করুক এটা তো চায়নি। বরঞ্চ মুক্তিযোদ্ধাদের তারা হত্যা করেছে। তাদের হাতিয়ার কেড়ে নিয়েছে। আমি নিজে সাক্ষী। আমার সেক্টরের ৭ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ওরা হত্যা করেছে। সে হত্যাকারীদের সাথে ছিল সর্বহারা, হক, তোয়াহা, আলাউদ্দিন। ওদের মতে, “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ফলশ্রুতিতে বাঙালির শোষণের কেন্দ্র পিন্ডি থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হবে।” এই সমস্ত ভুয়া ধোঁয়া তুলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীরা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকে পথভ্রষ্ট করতে চেয়েছে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে অটল ছিলেন। ফলে ভারতীয় সামরিক বাহিনী কিংবা বেসামরিক আমলাতন্ত্রের কূটনৈতিক চালে আমাদের যাত্রাপথ দিশা হারায়নি। বরঞ্চ রাশিয়াপন্থী কমিউনিস্টদের সাথে নিয়ে ভারত-রাশিয়া মৈত্রী চুক্তি করে আমেরিকান পরাশক্তির প্রতিভূ সপ্তম নৌবহরকে রাশিয়ার অষ্টম আরমাডা দিয়ে ভারত মহাসাগরের প্রতিহত করেছেন। রাশিয়ার সহায়তায় জাতিসংঘে তিনবার ভেটো প্রয়োগর ফলে বাংলাদেশের বিজয় ডঙ্কা বাজলো ১৬ ডিসেম্বর। পৃথিবীর ২৯টি দেশে ব্যক্তিগত সফর করে বঙ্গবন্ধুর হত্যা বন্ধ করেছেন শ্রীমতি গান্ধী।

স্বাধীনতা আন্দোলনে আওয়ামী লীগ

স্বাধীনতা পূর্ব বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমানদের অধিকার আদায়ের একমাত্র রাজনৈতিক দল। পোড় খাওয়া আওয়ামী লীগ কর্মী আর নেতার সম্মিলিত শক্তির আধার। শেখ মুজিব তার অবিসংবাদিত নেতা। অযুত বাঙালি গণমানুষের শক্তিতে বলীয়ান তিনি ক্ষমতার পাদপ্রদীপে বারে বারে ছিনতাইয়ের শিকার। প্রথম পর্যায় পাঞ্জাবি বেনিয়াদের কুটচালে পরাভূত, তারপর যুক্তফ্রন্ট নেতৃত্বের হটকারী সিদ্ধান্তে আইয়ুব খার সামরিক শাসনের যাতাকল, জেল, জুলুম অত্যাচার ক্ষমতার চোরাবালি বাঙালিদের নাগালের বাইরে। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগ রাজপথে, আন্দোলনে গণতন্ত্রের পূজারী শেখ মুজিব, ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শিক উওরণ। সমাজ হৃদ্য হয়, রাজনীতির পালে লাগে দোলা। শেখ মুজিবের মহা প্রয়ানের পর আওয়ামী লীগের রাজনীতি মুখ থুবড়ে ভিনদেশী পাকিস্তানপন্থী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী, জামায়াত, শিবিরের প্রাণ বিধ্বংসী থাবায় যখন ক্ষতবিক্ষত তখনই বিদ্যুতের ঝলকানির মত শেখ হাসিনার আগমন। তার পর মুৎসুদ্দি, আমলা, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক আমলা আর ব্যবসায়ী জামায়াতপন্থী বাংলাদেশ বিরোধী দলের হাতে তুলে দেয়া জেনারেল জিয়ার দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি আওয়ামী রাজনীতির ধারে বিধ্বস্ত করে গণতান্ত্রিক ধারায় প্রত্যাবর্তন করেছে আজ বাংলাদেশ। আওয়ামী রাজনীতির ধারক বাহক শেখ হাসিনা। তিনি উন্নয়নের রাজনীতির প্রবক্তা।

নাতিদীর্ঘ এই বক্তব্যের মূলে এখন ফিরে যেতে চাই। দীর্ঘ আন্দোলন এবং জনগণের মুক্তির অপেক্ষায় প্রস্ফুটিত ফুলটির অঙ্কুরোদগম ঘটেছিল ১৭ই মার্চ ১৯২০। ফরিদপুরের টুঙ্গিপাড়ার বুক চিরে বয়ে চলা মধুমতি নদীর বাঁকে। সে নদীর কাকচক্ষু জলে কুলুকুলু রবে বয়ে চলা স্রোতের সোনালী পরশে বেড়ে উঠেছিল এই প্রাণ। তাঁর হাতের সোনার পরশে কালের স্রোত পেরিয়ে আজ জেগে উঠেছে অজ পাড়াগাঁয়ের সেই কুহেলিকায় প্রাণ চাঞ্চল্যে, নব উদ্যমে ভরপুর একটি গ্রাম, না একটি জনপদ। সে জনপদকে আরো সমৃদ্ধ করার জন্য আজ জেগে উঠছে বাঙালি প্রাণের অতি প্রিয় আকাক্সক্ষার ধন, সাধনার সফলতা- পদ্মা সেতু। যাকে ঘিরে আজকে উন্নয়নের জোয়ার বইছে, বইবে সমস্ত দক্ষিণ বাংলা জুড়ে। স্বপ্নের এই পদ্মা সেতু কে ঘিরে আজকে তাবৎ পৃথিবীর হরেক রকম সওদাগরেরা সওদার পসরা সাজিয়ে ছুটে আসবে বাংলা নামক পলিমাটির এই দেশে। জীবন যদি কর্ম হয় আর কর্মই যদি মানুষের মহত্ত্বের নিরিখ হয়, তাহলে তিনি শুধু মহৎ-ই নন তিনি মহামানব ও বটে। তিনি তাঁর জীবনের স্থির আরাধ্য লক্ষ্য অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে অনমনীয় দৃঢ়তার সাথে নিজের জীবন বাজি রেখে বারে বারে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে দীর্ঘ ২৩ বছর এই ভূখন্ডের পথে-প্রান্তরে মাঠে ঘাটে বাটে নদী নালায় বিলে জঙ্গলে সংগ্রাম করেছেন আন্দোলন করেছেন সমাবেশ মহাসমাবেশ করেছেন। থেমে থাকেননি একটি মুহূর্তের জন্যও। গভীর আত্মপ্রত্যয় নিয়ে লড়াই করেছেন, বারে বারে স্বৈরাচারের কোপানলে পড়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন কিন্তু মাথা নত করেননি। তার জীবদ্দশায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনে দিয়ে তিনি জাতির পিতা হয়েছেন, কিন্তু সেখানেই বসে থাকেননি। মাত্র সাড়ে তিন বছর কাজ করেছিলেন তিনি বাংলাদেশের কর্ণধার হিসেবে, আজকে আমরা যে বাংলাদেশ দেখছি, যে বাংলাদেশের কথাবার্তা তাবৎ পৃথিবীর সবাই আশ্চর্য হয়ে বলে বিস্মিত হয়ে বলে, মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় তিনি সেই বাংলাদেশের গোড়াপত্তন করে গিয়েছিলেন, দেশকে খাদ্যে স্বয়ংস¤পূর্ণ করার দোড়গোড়ায় নিয়ে গিয়েছিলেন, মানুষকে দুর্ভিক্ষের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন, বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার নিরন্তর প্রচেষ্টায় লিপ্ত যুক্তরাষ্ট্র ছিল তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, জল্লাদের তরবারি উন্মোচন করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাক্রমশালী যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের হয়ে সৌদি আরব আর চীনকে সাথে নিয়ে লড়াইয়ে ন্যাক্কারজনকভাবে পরাজিত হয়ে মাথা নিচু করে সরে গিয়েছিল, ১৬ই ডিসেম্বর। বাঙালি গেরিলাদের হাতে মুখে চুনকালি লেপ্টে পরাজয় বরণ করেছিল, তাদের ষড়যন্ত্র একদিনের জন্যও বসে থাকেনি। বাংলাদেশকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার বিরতিহীন ষড়যন্ত্র শেখ মুজিবকে পেছন থেকে ছুরিকাঘাত করতে উদ্বুদ্ধ করেছে তাদের। বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক মুক্তি দানের তাঁর অন্তহীন প্রচেষ্টা যখন সফলতার দুয়ারে পৌঁছার সোপান ছুঁই ছুঁই করছে ঠিক তখনই তাঁকে আমাদের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়েছে, হত্যা করেছে জঘন্য নৃশংসতায় সপরিবারে। আর মাত্র এক বছর বেঁচে থাকলেই তিনি ১৯৭৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ পদদলিত করে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংস্বপূর্ণ করার কৃতিত্ব নিতে পারতেন। কারণ তাঁর নির্দেশিত পথে চলে প্রতিটি ইঞ্চি জমিতে খাদ্যশস্য লাগিয়ে সেদিন বাংলাদেশ বা¤পার খাদ্যের ফলন করেছিল ১৯৭৪-৭৫ সালের ফসল কাটার মৌসুমে। এটা ছিল তার প্রশাসনিক জীবনের অন্যতম প্রধান সফলতা। দেশব্যাপী খাদ্যশস্য ও অন্যান্য নিত্যপণ্যের অপ্রতুল সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও জনগণের দোরগোড়ায় চাল ডাল নুন তেল শিশুখাদ্য চিনি দুধ ওষুধ পত্র  ইত্যাদি পৌঁছে দেয়ার জন্য সৃষ্টি করেছিলেন কনজ্যুমার সাপ্লাই কর্পোরেশন ও ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ, শুরু করেছিলেন সার্বজনীন রেশনিং ব্যবস্থা, দুর্ভিক্ষ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে তৈরি করেছিলেন লঙ্গরখানা তার সার্বিক তত্ত্বাবধানে। অন্নবস্ত্র গৃহ বাসস্থান রাস্তাঘাট পুল, সেতু, কালভার্ট, ভঙ্গুর স্কুল কলেজ এর কারনে লন্ডভন্ড শিক্ষা ব্যবস্থা, যুদ্ধাবস্থায় ফেলে যাওয়া পাকিস্তানি বেআইনি অস্ত্রের ঝনঝনানি, জাসদ সর্বহারা বামপন্থী চৈনিক আর আন্ডারগ্রাউন্ডে লুকিয়ে থাকা পাকিস্তানি বশংবদদের অস্ত্রের মহড়া, সমাজকে নড়বড়ে করে দেওয়ার জন্য ব্যাংক লুট,থানা লুট, পাটের গুদামে আগুন, কলকারখানায় স্ট্রাইক ইত্যাকার সামাজিক বিশৃঙ্খলতা, সবই ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে যুদ্ধ পরবর্তীকালে ভঙ্গুর প্রশাসনিক ও আইন-শৃংখলা ভঙ্গকারিদের সরকারবিরোধী কাজের ফসল। এসব শক্ত হাতে দমন করে দেশের মানুষকে শান্তি ও স্বস্তি দিয়েছিলেন তিনি। দেশের সার্বিক অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য তিনশত ব্রিজ-কালভার্ট পুনর্গঠন করেছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছরে। এ ছাড়াও মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই তিনি যেসব কালজয়ী কর্ম সাধন করেছিলেন তার একটি ভগ্নাংশ মাত্র নিম্নে বিধৃত করা যায়:

১.         অতি অল্প সময়ের মধ্যেই স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের আকাক্সক্ষার প্রতীক হিসেবে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন।

২.         শাসনতন্ত্রের কাঠামোতে সার্বজনীন নির্বাচন।

৩.         বিদেশিদের সঙ্গে তৈল ও গ্যাস চুক্তি বাতিল করে দেশে তৈল ও গ্যাস অনুসন্ধানের ব্যবস্থা করে খনিজ, তৈল ও গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য দেশীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।

৪.         ভাঙ্গাচূরা বিধ্বস্ত পুলিশ বাহিনীকে পুনর্গঠন করা। আইনশৃঙ্খলা ও প্রশাসন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো এবং বামপন্থী ও চরমপন্থী দমনে রক্ষীবাহিনী গঠন।

৫.         স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বাধীনতার প্রতীক সশস্ত্র বাহিনী সমূহকে ঢেলে সাজানো।

৬.        একটা প্রাদেশিক প্রশাসনকে কেন্দ্রীয় প্রশাসনে পর্যবসিত করা।

৭.         পাকিস্তান ফেরত হাজার হাজার সামরিক বাহিনীর সদস্যদের পুনর্বাসন করা।

৮.         ভারত থেকে প্রত্যাগত এক কোটি মানুষের অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।

৯.         যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতিকে পুনরূদ্ধার করে শিল্পজাত পণ্য উৎপাদনের চাকা ঘোরাতে পরিত্যক্ত সকল কল-কারখানা জাতীয়করণ।

১০.       গণমুখী আধুনিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য কুদরত-ই-খুদা কমিশন গঠন।

১১.       ১৯৭৩ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ, অর্থোপেডিক চিকিৎসার উদ্যোগ নিয়ে বিদেশে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস এন্ড সার্জারি স্থাপন, মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড, সরকারি আলিয়া ক্যাম্পাস উদ্বোধন ইত্যাদি শিক্ষাকে সর্বোতোভাবে যুগোপযোগী করার তাঁর উদ্যোগেরই অংশ

১২.       যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের দ্রুত আরোগ্য লাভের প্রচেষ্টা হিসাবে জার্মানি, ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চেকোশ্লোভাকিয়া, ফ্রান্স ইত্যাদি বিভিন্ন দেশে প্রেরণ।

১৩.       জন্মনিয়ন্ত্রন, চ্যারিটেবল ডিসপেন্সারি স্থাপন, ইউনিয় পর্যায়ে দশ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা।

১৪.       তবলীগে জামাতের জন্য রমনা গ্রীনে জমি দান, বিশ্ব ইজতেমার জন্য টঙ্গীতে তুরাগ তীরে বিশাল জমি দান।

১৫.       শিক্ষক জাতীয়করণ, প্রাইমারি শিক্ষা অবৈতনিকীকরণ, ৩৬,১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১৫৭০০০ শিক্ষককে জাতীয়করণ করে প্রাইমারি শিক্ষকদের জীবন ও জীবিকার দারিদ্র্য বিমোচন।

১৬.      আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে কেবলমাত্র চীন ও সৌদি আরব ছাড়া সবার স্বীকৃতি আদায়, বাংলাদেশকে কমনওয়েলথে অন্তর্ভূক্তি, আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রসমূহের সম্মেলনে যোগদান, অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কান্ট্রিজ এর সদস্যপদ লাভ ইত্যাদি সময়োপযোগী কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ।

১৭.       যেহেতু আমি একজন পুলিশ অফিসার এবং একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে তাঁর সান্নিধ্য পেয়ে ছিলাম, সেহেতু পুলিশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য তিনি যে সকল সময়োপযোগী ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন তার একটু সারাংশ এখানে আমার বলতেই হবে।

ক)        পাকিস্তান আমলের পুলিশ কমান্ড-কন্ট্রোল ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন।

খ)        পুলিশ মহাপরিদর্শকের পদমর্যাদা অতিরিক্ত সচিবের সম-পদমর্যাদায় উন্নীতকরণ

গ)        রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স পুননির্মাণ

ঘ)        চরমপন্থী দমন

ঙ)        ‘ষোড়শ ডিভিশন’ দমন

চ)         নারী পুলিশ নিয়োগ

ছ)        ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ গঠনের পদক্ষেপ গ্রহণ

জ)       যুদ্ধবিধ্বস্ত থানা পুননির্মাণ

ঞ)       পুলিশের ভবিষ্যৎ স্থাপনা বিনির্মানে জমি অধিগ্রহণ

ট)         প্রথম পুলিশ সপ্তাহ উদ্বোধন

ঠ)        পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তির উন্নয়ন

ড)        মানবিক ও পেশাদারিত্বের উন্নয়নের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ

ঢ)         রেশনিং ব্যবস্থার পরিধি বৃদ্ধিকরণ ও রাজারবাগের পানি সঙ্কট নিরসনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা

১৮.       হতদরিদ্র ভুখানাঙ্গা সহায় সম্বলহীন চাষাভূষা খেটে খাওয়া মানুষ, শ্রমিক সবার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ছিল তাঁর জীবনের সকল আকাক্সক্ষার গোড়ার কথা। বাংলার সব শ্রমজীবী মানুষের ক্ষুন্নিবৃত্তি, অর্থনৈতিক ও আর্থিক সামর্থ্য সৃষ্টি করার জন্য তিনি সৃষ্টি করেছিলেন বাকশাল। একই সঙ্গে এই বাকশালের কাঠামোয় তিনি তৈরি করতে চেয়েছিলেন একদল নিঃস্বার্থ নির্লোভ নির্মোহ দেশের জন্য নিবেদিতপ্রাণ কর্মী ও নেতা। যাদের মাধ্যমে তিনি তৈরি করতে  চেয়ে ছিলেন একটা গণমুখী প্রশাসন ব্যবস্থা। যে প্রশাসন ব্যবস্থা মানুষকে সমৃদ্ধি দেবে, আলোকিত পথ দেখাবে, সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের উচ্চপথে দেশকে নিয়ে যাবে। সমস্টিক উন্নয়নের জন্য তাঁর এই পদক্ষেপটি নেহায়েতই স্বল্পমেয়াদী। কারণ গণতান্ত্রিক পথে তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছেন, যে গণতন্ত্রই ছিল তাঁর জীবনে অস্থিমজ্জা আর অস্তিত্বের নির্যাস।

উপসংহার:

আজ থেকে ৪৭ বছর আগে বঙ্গবন্ধু আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আমরা হারিয়েছি আমাদের শ্রেষ্ঠ স¤পদ। তাঁর সৃষ্ট বাংলাদেশ আজ ৫০ বছর পেরিয়েছে। তাঁর জন্ম শতবর্ষ আমরা পালন করেছি। রাষ্ট্রীয়ভাবে।

তাঁর স্মৃতি আজ আমাদের প্রতিটি নিঃশ্বাসে বিশ্বাসে। তিনি আজ মহাবিশ্বের আনন্দলোকে। আকাশের যত তারা জ্বলে নীল আকাশ নীল সমুদ্রের জলে, ধূমকেতু, ছায়াপথ জুড়ে, ব্রহ্মান্ডের পরতে পরতে যত নক্ষত্র ছুটে চলে চক্রাকারে আবদ্ধ গতিতে, ভূলোক দ্যুলোক ত্রিলোকের অন্তর জুড়ে জাল ফেলে ছুটে ছুটে চলে যে আলোকবর্তিকা, তার প্রতি কনা জুড়ে তাঁর অস্তিত্ব, তাঁর মাহাত্ম্য আমাদের পথ দেখাবে যুগে যুগে, যুগ হতে যুগান্তরে মহাকালের গভীর আবর্তে। তাঁর হৃদয় নিঃসৃত শোণিত ধারা, তাঁর সৃষ্ট সোনার বাংলাকে, আমাদের অস্তিত্বকে এক মহা মঙ্গল শোভাযাত্রায় শাণিত করে বাঁচিয়ে রাখবে চিরকাল। সকল প্রলয়কে পদানত  করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা এগিয়ে যাব, যাব দূর বহুদূর। আজি এ শোক হোক শক্তির হাতিয়ার। আমাদের অহংকার আমাদের অস্তিত্বের তলোয়ার।

এক একটা ছবি এক একটা যুগের প্রতিচ্ছবি – প্রতিনিয়ত

সৃজনশীল বাংলাদেশ – একজন মহানায়কের পথ রেখায় কি অসম্ভব সুন্দর প্রতীক হয়ে জেগে আছে। নিরন্তর কর্মধারার হিরণ্ময় জগৎকে বুকে ধারণ করে।

জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক এস.পি, ঢাকা জেলা।

ভালো লাগলে শেয়ার করে দিন :)

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x