মোঃ মোস্তফা হারুন
এই গল্পের ট্রপিকসটি এত গুরুত্বপূর্ণ যে প্রতিটি পরিবারের সদস্যের উপলব্ধি করা প্রয়োজন। আমি এই প্রসংগে কিছু বাস্তব ঘটনার আলোকে গল্পের অবতারণা করবো যা সবার জন্য শিক্ষণীয় হয়ে রবে ইনশাআল্লাহ। প্রায় প্রতিটি পরিবারে কমবেশি এমন একজন সদস্য থাকে যে কি-না পিতামাতা ভাইবোনের অবাধ্য হয়ে থাকে। তার আচার আচরণে সে বরাবরই বাধ্যগত ভাব দেখায়। প্রকৃতপক্ষে সে অবাধ্য ও স্বার্থপর। নিজ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য সে না না কৌশল অবলম্বন করে। সৌরভ ঠিক তেমনই একটি ছেলে। এসব সন্তান বা পরিবারের সদস্য কোনো না কোনোভাবে নেশাসক্ত হয়ে থাকে। সৌরভ গোপনে নেশা করে বাড়ি ফিরে ভেজা বেড়ালের মতো ঘাপটি মেরে থাকে। সৌরভ নেশার পয়সা জোগানের জন্য নিজের ও আত্মীয় স্বজনের মূল্যবান জিনিসপত্র কৌশলে সরিয়ে ফেলে এবং বিক্রি করে নেশাদ্রব্য কিনে সেবন করে। এরকম সদস্যরা কম শিক্ষিত বা বেশি শিক্ষিতও হতে পারে। সৌরভ ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। এই নেশার কারণে তার আর লেখাপড়া এগুইনি।
এমন সন্তান বাবা মায়ের কথা গুরুত্ব দেয় না। এমনকি তারা পিতামাতার আদর্শকে পদদলিত করে পারিবারিক সম্মান ভূলুণ্ঠিত করতেও দ্বিধাবোধ করে না। সৌরভের নেশার টাকা শেষ হয়ে গেলে নানান কৌশলে ব্যবসার অজুহাতে বা অন্য কোনো কিছু প্রয়োজন আছে এমন অজুহাতে বড়ভাই, বড়বোন, পিতামাতার নিকট হতে টাকা দাবি করে। টাকা না পেলে নিজে আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে পরিবারের সবাইকে চিন্তাগ্রস্ত করে তোলে। যাতে অভিভাবক সন্ত্রস্ত হয়ে টাকা পয়সা দিয়ে দেয়। জীবনে বড় হওয়ার জন্য অনেক সুযোগ সৌরভকে বাড়ির বড়রা করে দিয়েছিল হয়তো, কিন্তু সে সেই সুযোগগুলোর দ্বারা উপার্জিত অর্থও নেশার কাজে ব্যবহার করে থাকে। ফলে একসময় সে ব্যবসাহীন, অর্থহীন হয়ে যায়। তখন টাকা আদায়ের জন্য পুনরায় নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করতে থাকে।
সৌরভকে বড় হওয়ার জন্য, আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য ইতোপূর্বে তার বড় ভাই কাঠের ব্যবসার জন্য বিভিন্নভাবে আর্থিক সাহায্য করেছে। যাতে সে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ছেলেটি ব্যবসার আড়ালে মরণ নেশা হিরোইন, ফেন্সিডিল, ইয়াবা ইত্যাদি নেশাদ্রব্যের দ্বারা নেশাসক্ত হয়ে যায়। ফলে তার ব্যবসা বাণিজ্য শেষ হয়ে যায়। একসময় পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে বড় ভাই মাদক নিরাময় কেন্দ্রে সৌরভকে ভর্তি করে দেয়। সেখানে অনেক টাকা ব্যয় করে চিকিৎসা করিয়ে ভালো করে তাকে বাসায় নিয়ে আসে। বেশ কিছুমাস ভালো থাকার পর আবারও সে গোপনে সঙ্গ দোষে নেশার জগতে ফিরে যায়। কোনোক্রমেই কোনো কিছুতেই তাকে ভালো করা যাচ্ছিল না। একসময় বড় ভাই সৌরভকে ঢাকায় নিজের কাছে রেখে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সম্পৃক্ত করে কর্মক্ষম করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। অবশেষে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বড় ভাই সৌরভকে পর্যটন করপোরেশনের আওতাভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠানে বেভারেজ ও ফাস্ট ফুডের ওপর ট্রেনিং নেওয়ার জন্য ভর্তি করে দেয়। সৌরভের বড় ভাইয়ের প্ল্যান ছিল তাকে সেখান থেকে প্রশিক্ষণ শেষে একটি বেকারির ফ্যাক্টরি করে দিবে এবং উৎপাদিত প্রোডাক্ট বাজারে মার্কেটিং করে ধীরে ধীরে বড় বেকারির ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।
সৌরভ প্রতিদিন সকালে বাড়ি থেকে ট্রেনিংয়ের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায় এবং সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে। একদিন সৌরভ তার বড় ভাইকে বললো, বাসায় একটি মাইক্রো ওভেন দরকার পড়বে। বাসায় এসে তাকে প্র্যাকটিস করতে হবে। সৌরভের কথা বড় ভাই কিস্তিতে একটি মাইক্রো ওভেন কিনে দেয় এবং বেকারির সকল উপাদান কিনে দেয়। বেশ কিছুদিন ভালোভাবেই কাজ করছিল। হঠাৎ সৌরভের কাজের গতিতে কিছুটা ব্রেক আসে, সেটা বড় ভাই খেয়াল করে দেখতে পেল। পর্যটনে যারা কাজ শিখে, তাদের ভিতর যারা ভালো রেজাল্ট করে থাকে তারা সাধারণত হোটেল শেরাটন, হোটেল সোনারগাঁও ইত্যাদি নামি-দামি হোটেলে ইন্টার্নি করার সুযোগ পায়। সফলভাবে ইন্টার্নি শেষ করতে পারলে অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের সেখানেই চাকরির ব্যবস্থা হয়ে যায়। ধীরে ধীরে তারা মূল্যায়ন পেতে থাকে। তাদের আর জীবনে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয় না। ট্রেনিংয়ের শেষ পর্যায়ে ফাইনাল পরীক্ষা হয়। সেখানে সৌরভ ভালো রেজাল্ট না করতে পারার কারণে, তাকে কম গুরুত্বপূর্ণ এক হোটেলে ইন্টার্নি করার সুযোগ দেয়। রেজাল্ট খারাপ হওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে সৌরভের বড় ভাই চন্দন জানতে পারে, সৌরভ অধিকাংশ দিনই ট্রেনিং-এর নামে বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়ে এদিক সেদিক বন্ধু বান্ধবদের সাথে আড্ডা, নেশা ইত্যাদিতে জড়িয়ে পড়েছিল। কি আর করার এখানেও চন্দন তার ভাইকে নিয়ে হতাশ হয়ে গেল। চন্দন ভাবছে কি করা যায়, একে নিয়ে।
চন্দন একদিন সৌরভের ব্যাপারে বাবার সাথে, ছোট বোন জামাইয়ের সাথে আলোচনা করে, কিভাবে সৌরভকে ভালো পথে ফিরে আনা যায়। কি করে সৌরভকে খারাপ সঙ্গ থেকে দূরে রাখা যায়…. এসব ঘটনার আগের ঘটনা সৌরভ একসময় ভালোবেসে সুরভি নামের একটি মেয়েকে বিয়েও করেছিল বেকার অবস্থায়। মেয়ের পরিবার সৌরভের পিতার ও বড় ভাইয়ের সামাজিক মর্যাদার কারণে এই বিয়ে মেনে নিয়েছিল। বেশ ভালোই চলছিল তাদের সংসার। ধীরে ধীরে সুরভি জানতে পারে তার স্বামীর নেশার কথা ও নেশাসক্ত হয়ে আচার আচরণ সম্পর্কে। একটু একটু করে তাদের সংসারে ফাটল ধরতে শুরু করে। সুরভি তার স্বামীকে নেশার জগৎ থেকে ফেরানোর অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। অবশেষে সুরভি তার বাবামায়ের সাথে আলোচনা করে সৌরভকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যায়। সংসার ভেঙে যাবার পর সৌরভ যখন বেসামাল অবস্থায় ছিল ঠিক তখনই তার বড় ভাই সৌরভকে নিয়ে গিয়েছিল নিজের কাছে এবং তার জীবনটাকে অন্যভাবে গড়ানোর দায়িত্ব নেয়। ব্যবসায়িক ব্যর্থতা, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ট্রেনিংয়ে যখন সৌরভ ভালো করতে পারলো না। তখন সৌরভের বড় ভাই সিদ্ধান্ত নেয় সৌরভকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার। সেইমতে অনেক চেষ্টার পর মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে একটি কনস্ট্রাকশন ফার্মের স্টোর ইনচার্জ হিসেবে চাকরি দিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়। পরিবারের সবাই ভেবেছিল, সকল চিন্তার হয়তো এখানেই সমাপ্তি ঘটবে।
বিদেশ থেকে বেশ কয়েকবার দেশে এসে আবার ফিরেও যায়। তার ভিতর অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, যেটা পজিটিভ। ইতোমধ্যে সৌরভের বাবা আকস্মিক হার্ট অ্যাটাক করে মৃত্যুবরণ করেন। বাবা মায়ের সবচেয়ে ছোট ছেলে। তাই বাবা মা অনেক ভালোবাসতেন তাকে। মৃত্যুর কয়েকমাস আগে থেকে বাবা সৌরভকে দেখার জন্য পাগলের মতো হয়ে যায়। মাঝেমধ্যে বাবা বলতেন, মরার আগে ছেলেকে হয়তো দেখে যেতে পারবো না। তাই তিনি ছেলেকে একবার দেশে আসতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু সৌরভ তার পিতাকে দেখতে আসেনি। এমনকি মৃত্যুর পড়েও আসেনি। ইচ্ছে থাকলে বাবাকে শেষবারের মতো একবার দেখতে আসতে পারতো। আসলে মাদকাসক্তির কারণে হয়তো তার মনের ভিতর কাঠিন্যতা চলে এসেছিল। পরিবারের সবাই তাকে ভালোবাসলেও তার কিন্তু পরিবারের কারো প্রতি মায়া ছিল না। বিদেশ থেকেও সে ফেসবুকের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়েদের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। সেইসব মেয়েদের জন্য দামি দামি মোবাইল, কসমেটিক ইত্যাদি গিফট পাঠাতো। অথচ নিজের পিতামাতার জন্য হাতখরচ পাঠাবার কথা সে ভাবতই না। পিতার মৃত্যুর আগে সে তার রোজগারের একটি টাকাও পিতার মাতার জন্য পাঠায়নি।
অথচ এই বাবা, সৌরভের ছোট বেলায় এত আদর করতো তেমন আদর অন্য কোনো সন্তানকে করে নাই। ছেলেকে আদর করে গানের শিক্ষক রেখে গান শিখাতো বাবা। বাবা পাশে বসে ছেলের গান শুনতো। বাবার কল্পনা ও বড় আশা ছিল ছেলেকে সংগীত শিল্পী বানাবেন। আশ্চর্য হলেও অতি সত্য কথা যে, সৌরভের গানের গলা চমৎকার ছিল। এখনও আছে। সৌরভ নেশার জগতে চলে না গিয়ে যদি গান নিয়েই সাধনা করতো, হয়তো সে এতদিনে দেশের একজন বরেণ্য নামকরা সংগীত শিল্পী হিসেবে প্রকাশ ঘটাতে পারতো। দুঃখজনক হলেও সত্য, নেশা তার ভিতর থাকা সকল গুণ নষ্ট করে দিয়েছিল। ছাত্র জীবনে সৌরভ যখন কলেজে ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র ছিল, তখন সে তুখোড় ছাত্র নেতা হিসেবেও পরিচিতি লাভ করে। একজন রাজনৈতিক দলের নেতার গুণাগুণ তার ভিতর ছিল। পাশাপাশি সে একজন সুবক্তাও ছিল। কিন্তু সেখানে ধীরে ধীরে সৌরভ রাজনৈতিক বড় নেতাদের ক্যাডারে রুপান্তরিত হয়ে যায়। একবার কলেজে ছাত্রদের দুপক্ষের ভিতর গোলমাল চলাকালে সৌরভ আগ্নেয়াস্ত্রসহ পুলিশের হাতে ধৃত হয়। অস্ত্র মামলায় জেলে যায়।
জেলে থাকাবস্থায়, কোনো নেতাই তার পাশে এসে দাঁড়ায়নি সৌরভের মুক্তির জন্য। একমাত্র সৌরভের বড় ভাই এই মামলায় লড়ে সৌরভকে নির্দোষী করে বের করে আনে। সেই অস্ত্র মামলার সিডিতে মামলার আইও মামলার ঘটনাস্থল আসল কলেজের পরিবর্তে অন্য কলেজের নাম লিখেছিল ভুলক্রমে। স্কেচম্যাপেও একই ভুল করেছিল। সিডির এই গোপন ভুল একমাত্র তার বড় ভাই সার্কেল অফিস থেকে কেসডাইরি পড়ে আইও এর ভুল বের করে আদালতে উপস্থাপন করার ব্যবস্থা করলে সে মামলার রায়ে খালাস প্রাপ্ত হয়েছিল। এরপরে সৌরভের বড় ভাই ওকে আর রাজনীতি করতে দেয়নি। সৌরভের ভিতর ভালো ভালো গুণ থাকলেও সে বুঝতে পারেনি, সেসব তার জীবনে কিভাবে সফলতার জন্য প্রয়োগ করবে! তার একটিই কারণ সেটি হলো মাদকের নেশা ও অসৎ সঙ্গ এবং পরিবারের বড়দের নিকট অবাধ্যতা। এই তিনটি জিনিসই তার জীবন ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল। সে ইচ্ছে করলেই নিজের ভিতর পুরুষবোধ জাগিয়ে তুলে নিজের জীবনকে সফল করতে পারতো। কিন্তু তার ভিতর ভালো কাজ করার এবং কাজে মনোযোগী হওয়ার মতো সংকল্পবদ্ধতা ছিল না। যার কারণে জীবনের অসফলতা তাকে ঘিরে ধরেছিল। অথচ বিদেশে থাকাকালীন সময়ে সে সেখানে ভালো কাজ করেছে এবং কোম্পানিতে তার সুনামও ছিল।
যখন বিদেশে ছিল তখন সৌরভ দুই দুই বার সৌদি আরবে গিয়ে হজব্রত পালন করেছিল। তার এই পরিবর্তনে দেশ থেকে পিতামাতা ভাইবোন সবাই খুশি হয়েছিল এবং মানসিকভাবে নিশ্চিত হয়েছিল যাক সে বুঝি ভালোই হয়ে গেছে।
ইতোমধ্যে ফেসবুকের প্রেম তাকে পেয়ে বসে। আলাপচারিতার মাঝে সুমি নামের একটি বিবাহিতা তালাকপ্রাপ্ত মহিলার সাথে সৌরভের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বাবা মারা যাওয়ার কয়েকবছর পরে সৌরভ দেশে ফিরে আসে। এসেই বিয়ের বায়না ধরে। সবাই মিলে মেয়ে দেখা শুরু হলো। মেয়ে ঠিকও হয়ে যায়। ঠিক সেই মুহূর্তে সে জানায়, মেয়ে ঠিক হয়ে আছে। মেয়েটি তার নিজের পছন্দের, মেয়েটির নাম সুমি। মেয়ের খোঁজ নিয়ে পরিবারের সবাই জানতে পারে মেয়েটির একাধিকবার বিয়ে হয়েছে। মেয়ের একটি কন্যা সন্তানও আছে। মেয়েটির আগের স্বামী সৌরভের বড় ভাই চন্দনকে মোবাইলের মাধ্যমে মেয়ের সম্পর্কে অনেক নেগেটিভ মতামত জানায়। চন্দন বিয়েতে অসম্মতি জানালে, বাড়ির সবাই অসম্মতি জানায়। কিন্তু সৌরভের কথা সে এই মেয়েকেই বিয়ে করবে। সৌরভের সেই আগের চরিত্র যেন আবার ফুটে ওঠে। আবারও সবার অবাধ্য হয়। যার কারণে পরিবারের সবারই অনিচ্ছায় বিয়েতে রাজি হতে বাধ্য হয়।
যথারীতি বিয়ে হয়ে যায়। বউ নিয়ে মায়ের সাথে থাকে। কিন্তু বউয়ের সাথে মায়ের বনাবনি হচ্ছিল না। মায়ের সাথে বউ খারাপ আচরণ করলেও সৌরভ কোনোদিনই তার প্রতিবাদ করেনি। সৌরভ আর বিদেশে ফিরে যায় না। দেশেই কিছু করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু সবকিছুতেই ব্যর্থ হয় এবং অর্থহীন হয়ে পড়ে। আবারও হাতশূন্য। একপর্যায়ে মায়ের একটি জমি বিক্রি করে সৌরভ ও তার মেজো ভাই টাকা নেয়। দুজনাই ব্যবসাতে লস খেয়ে বসে থাকে। সৌরভ কৌশলে বউয়ের পরামর্শে বউকে নিয়ে মাকে ছেড়ে শহরে গিয়ে বাসা ভাড়া নেয়। এদিকে মেজো তো অনেক বছর আগেই মাকে একা গ্রামের বাড়িতে রেখে বউ নিয়ে শহরে বাসা বেঁধেছে।
মায়ের বড় আশা ছিল। অনেক বছর পর ছেলে বিদেশ থেকে এসেছে। বাসা ফাঁকা। বড়ছেলে চাকরির খাতিরে দেশের বিভিন্ন জায়গায়
থাকতে হয়। মেজো তো শহরে বাড়ি করে বউ ছেলেমেয়েসহ শহরে চলে গেছে। ছোটটাও বউসহ চলে গেল। মা আবার একা হয়ে যায়। মা মানসিকভাবে কষ্ট পেলেও মনের ভিতর দুঃখ পুষিয়ে রাখেন। বর্তমানে মানুষের জন্য আনন্দ-প্রমোদ ও ভোগ-বিলাসের অত্যাধুনিক ব্যবস্থাপনা থাকলেও তাদের অন্তরে নেই প্রশান্তির ছোঁয়া। সবার মধ্যে বিরাজ করে বিষ্ণতা ও অস্থিরতা। সৌরভ বিদেশ থেকে এসে দুইবার হজ করলেও নামাজ একেবারেই ছেড়ে দেয়। আবার শহরের কুবন্ধুদের পাল্লায় পড়ে আড্ডাবাজ হয়ে যায় এবং পুনরায় গোপনে নেশার জগতে ফিরে যায়। নেশাসক্ত নিয়ে এই স্ত্রীর সাথেও সৌরভের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সৌরভ তার জীবনটাই নেশায় আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
সৌরভের আচরণগত পরিবর্তন না হওয়ায় সৌরভের পিছন থেকে বড়ভাই, মেজভাই, বোনেরা সরে যায়। সবাই সিদ্ধান্ত নেয়, যে ভাই পরিবারের মানসম্মান সমাজে লুটিয়ে দেয়। নিষেধ করার পরেও মাদকাসক্ত জীবন থেকে সরে আসতে পারেনি সে ভাই থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। এদিকে সৌরভ তার প্রয়োজনে বড় ভাইয়ের কাছ থেকে এক লক্ষ টাকা দাবি করতে থাকে তা নাহলে সে আত্মহত্যা করবে। ভাই ভাবি অন্যান্য পরিবারের সদস্যদের কাছে ম্যাসেঞ্জারে ম্যাসেজ পাঠাতে থাকে টাকা না দিলে বা আর্থিক সাহায্য না দিলে সে আত্মহত্যা করবে বলে হুমকি দিতে থাকে। সৌরভের এমন আচরণে পরিবারের সকল সদস্যগণ ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে যায়। কেউ কেউ সৌরভের মোবাইল নাম্বারটি ব্লক করে দেয়। উপায়ান্তর না দেখে সে তার মাকে মোবাইল করে জানায় বাড়ির পুকুর বিক্রি করে তাকে যেন টাকা দেওয়া হয়। মাকেও সে আত্মহত্যার হুমকি দিতে থাকে।
মা ছেলের আত্মহত্যার কথা শুনে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। একসময় সৌরভের মানসিক নিপীড়ন মায়ের প্রতি আরও বেড়ে যায়। অবশেষে অন্যান্য ভাইবোনেরা মাকে পরামর্শ দেয়, এসব নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। এর আগেও সৌরভ মাদক সেবন করবে না বলে কথা দিয়ে কথা রাখেনি। চিরকালই সে পিতামাতা ভাইবোনের অবাধ্য হয়ে উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে যায়। এবার মাও কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়, এমন ছেলে থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। আত্মহত্যা করার কথা বলে সে সবাইকেই ব্ল্যাক মেইল করতে চায়। মোটামুটি এটা সবাই বুঝে ফেলেছে। এখন বিশ্লেষণে যাওয়া যাক। কেন একটি ছেলে মাদকাসক্ত হয়ে যায়। আসুন কারণগুলো খুঁজে দেখি এবং কিভাবে সমাজ থেকে মাদক নির্মূল করা যেতে পারে।
১) বেশি আদর-স্নেহ সন্তানকে বিপথে ধাবিত করতে পারে
সৌরভ ছিল ভাইবোনদের ভিতর সবচেয়ে ছোট। তাই পরিবারের সবাই তাকে আদর করতো, ভালোবাসতো, সৌরভের যেকোনো দাবি, চাওয়া পাওয়া বাবা ভাইয়েরা পূরণ করতো। অতিমাত্রায় আদর যে কাউকে বিপথে পরিচালিত করতে পারে।
২) পারিবারিক শিক্ষা
পারিবারিকভাবে প্রথম থেকেই সন্তানদেরকে মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে জ্ঞানদান করে নিরুৎসাহিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা উচিত। মাদক কিভাবে নিজের জীবনে, পারিবারিক জীবনে, সাংসারিক জীবনে খারাপ প্রভাব বিস্তার করে একটি সুন্দর সাজানো জীবন ধ্বংস করে দিতে পারে সে সম্পর্কে জ্ঞানদান করা পরিবারের প্রতিটি সদস্যের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এই ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব অপরিসীম। এছাড়াও জাতীয়ভাবে এবং রাজনৈতিকভাবেও সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন আছে।
৩) মাদকের প্রতুলতা
সমাজে মাদকের প্রতুলতা একটি বড় সমস্যা। যেখানে যত্রতত্র মাদক পাওয়া যায় এবং এই মাদক সিন্ডিকেটকে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে যুবসমাজের ধ্বংস অনিবার্য।
৪) হতাশা বা ডিপ্রেশন
ডিপ্রেশন বা হতাশা যেকোনো কারণে কারো জীবনে চলে আসতে পারে। হয়তো কেউ উচ্চ শিক্ষিত হয়েও বেকার হয়ে পথে পথে ঘুরছে। হয়তো কেউ দারিদ্র্য কশাঘাতে হতাশায় ভুগছে। হয়তো কেউ প্রেমে ব্যর্থ হয়ে জীবনটা দুর্বিষহ মনে করছে। কেউ হয়তো ব্যবসায়ে লস করে চোখে সরষের ভূত দেখছে। এমন বহু কারণেই হতাশা নামক এক ঘাতক আক্রমণ করে বসতে পারে। ঠিক তখনই এই হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তি এবং যুবক মনের প্রশান্তি খুঁজে পেতে মাদকের আশ্রয় নেই। সে মনে করে মাদক সেবন করলেই এসব ভুলে থাকা সম্ভব। আসলে কি তাই? আসলে তাই নয়। হতাশা ভুলতে এই মাদকই তার জীবন যৌবন, জীবনী শক্তি ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে দেয়।
৫) সমাজ ও পরিবারের ইগনোর মুডের কারণেও মাদকাসক্তি হতে পারে
অবহেলাজনিত কারণেও অনেকে হতাশাগ্রস্ত হয়ে মাদকাসক্ত হয়ে যেতে পারে।
৬) মাদক উৎপাদন, বিপণন নিয়ন্ত্রণ
একজন মাদকসেবী তার মাদকের অগ্রযাত্রা শুরু হয় প্রথমেই সিগারেট, বিড়ি এবং গুল গ্রহণের দ্বারা। এরপরেই বড় পর্দার আগমন ঘটে ধীরে ধীরে। মনের অজান্তে বা সঙ্গ দোষেই হোক একদিন সে হয়ে ওঠে মদ, ফেন্সিডিল, গাঁজা, ইয়াবা ইত্যাদি সেবনকারী।
৭) ধর্মীয় অনুশাসনের অভাব
ইসলাম ধর্মে মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। মাদক সেবনকারী, মাদক বহনকারী, মাদক বিক্রেতা, মাদকের হিসাব কিতাব রক্ষণকারী, মাদক বিক্রির সহকারী ও সহযোগীদের জন্য জান্নাতকে হারাম করে দেওয়া হয়েছে। মাদকের ভয়াবহতা ও পরিণতি অত্যন্ত খারাপ বিধায় ইসলাম মাদককে সমর্থন করে না। আধুনিক যুগের ছেলেমেয়েরা ও অভিভাবকগণ ইসলামের বিধিনিষেধ অজ্ঞতার কারণে তারা নিজেরাও সংশোধন হচ্ছে না এবং তাদের সন্তানদেরও সংশোধন করতে পারছে না।
৮) সফলতা পেতে নিজেকে পরিশ্রমী করে তুলুন
এগিয়ে চলা প্রতি মুহূর্তে পরিশ্রমকারী ব্যক্তি কখনও ব্যর্থ হয় না, কোনো না কোনো রাস্তা তার জন্য খুলে যায় একদিন। জ্যাক মা বা মা ইয়ান একজন চাইনিজ উদ্যোক্তা। জনপ্রিয় ই-কমার্স সাইট আলিবাবা ডট কমের ফাউন্ডার। হাজার হাজার তরুণ উদ্যোক্তাদের আইডল। ফোর্বস ম্যাগাজিনের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে বিশ্বের ২৬তম ধনী ব্যক্তি তিনি। তার বর্তমান সম্পদের পরিমাণ ২৭ বিলিয়ন ডলার এর ওপর।
বিল গেটস থেকে শুরু করে বড় বড় ব্যক্তিরা আজকের এ অবস্থানে আসতে পেরেছেন, শুধু নিজেদের পরিশ্রমের কারণে। জনপ্রিয় ট্রেডিং সাইট Alibaba.Com এর কর্ণধার এবং চীনা কোটিপতি জ্যাক মার গল্পটাও সেরকম। জ্যাক মাকে না চিনলেও Alibaba.Com চিনেনা, এরকম মানুষ কম পাওয়া যাবে। এ জ্যাক মা এখনকার অবস্থানে কখনও ছিলেন না। উনার আজকের এ উত্থানটাই হয়েছে Alibaba.Com এর মাধ্যমে। যখন উনি এ ওয়েবসাইট নিয়ে ভাবেন, তখন চীনের ইন্টারনেট এত বেশি ব্যবহৃত হত না। সেই দেশে বসে এধরনের ওয়েবসাইটের কল্পনা করাটাও আসলে তখন অনেক রিস্কের ছিল।
জ্যাক মা যুব সমাজের জন্য, যারা নিজেরা কিছু একটা করে দেখাতে চায়, তাদের জন্য কয়েকটি উক্তি করেন-
আপনার দরিদ্র হয়ে জন্মানোটা দোষের নয় কিন্তু দরিদ্র হয়ে থাকাটাই দোষের।
আপনি যদি একটি দরিদ্র ঘরে জন্ম নিয়ে নিজের ৩৫ বছর বয়সেও সেই দরিদ্রই থাকেন তবে দরিদ্র হয়ে থাকাটা আপনার কপালের দোষ নয়, আপনি এটি প্রত্যাশা করেন। কারণ আপনি আপনার যুবক বয়সকে কোনো কাজে লাগাতে পারেননি, আপনি সম্পূর্ণভাবে সময়টা নষ্ট করে দিয়েছেন।
জীবনে অনেক উপরে উঠতে হলে ২৫ বছর থেকেই শুরু করুন, নিজে পরিকল্পনা করুন, তাই করুন যা আপনি উপভোগ করতে জানেন।
এগিয়ে যাও তা না হলে ঘরে ফিরে যাও।
গরিব কারণ আপনার দূরদর্শিতার অভাব।
আপনার দরিদ্রতা কারণ আপনি আপনার ভীরুতাকে জয় করতে পারেননি।
গরিব কারণ আপনি আপনার সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারেননি।
আপনি দরিদ্র তাই সবাই আফসোস করবে কেউই আপনাকে সচ্ছল বানিয়ে দিবে না।
লেখক : সহকারী পুলিশ সুপার
৫ এপিবিএন, উত্তরা, ঢাকা।
0 Comments