রফিকুর রশীদ
বাঙালি জাতির সংগ্রাম মুখর ইতিহাসে ভাষা-আন্দোলন অত্যুজ্জ্বল এক গৌরবময় অধ্যায়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের এই ভূখন্ডে ঘটে যাওয়া এ অন্দোলনের শোকাবহ এং বহু দ্যোতনাব্যঞ্জক পরিণতির কথা আমরা বছরের এই বিশেষ দিনে স্বরণ করি, শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে এক মিনিট নীরবতা পালন অথবা মিঠেকড়া শীতার্ত সকালে পুষ্পমাল্য হাতে প্রভাতফেরি করে শহীদ মিনারে গিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করি; এমনই সব আনুষ্ঠানিকতা-সর্বস্ব কর্মকান্ডের ফ্রেমে বন্দী করে অমর একুশকে আমরা জাতীয়ভাবে স্মরণীয় একটি দিবসে পরিণত করেছি। একুশ আমাদের দিয়েছে অনেক। বাঙালির জাতীয় চেতনা সুসংহত করা, বাঙালি সংস্কৃতির স্বকীয়তা শনাক্ত করা, সর্বপরি বাঙালির আত্মপরিচয় অনুসন্ধানে কৌতূহলী করে তোলা-এসবই তো একুশের কাছে থেকে পাওয়া। এমন কি এ বিষয়েও কোন ধরনের বিতর্কের অবকাশ নেই যে বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ যে অর্জন মহান স্বাধীনতা, তার বীজও উপ্ত ছিল এই একুশের চেতনার মধ্যেই। শুধু কি তাই। ১৯৭১ এ নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভের পরও এ জাতিকে বহু চড়াই-উতরাই অতিক্রম করতে হয়েছে, রাজনৈতিক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে জাতীয় ইতিহাসের নানান বাঁক বদল ঘটেছে; আমাদের সেই সব ক্রান্তিকালেও একুশের প্রদীপ্ত শিক্ষা অমানিশার ঘোর কাটিয়ে পথের দিশা দিয়েছে। তাই বলা চলে, মহান একুশের কাছে আমাদের ঋণের কোন পরিসীমা নেই। এই ঋণ কোথায় কেন কী রকম, জাতীয় এই ঋণের সঙ্গে ব্যক্তি আমার কী সম্পর্ক সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে আমরা ঋণ পরিশোধের দায় অনুভব করব কেমন করে? এই দায়বোধ না থাকলে ঋণ পরিশোধে ব্রতী হব কী উপায়ে? এ যেন অনেকটা বাতাসের মধ্যে বাস করে বাতাসের অস্তিত্ব বিস্তৃত হওয়ার মতো ঘটনা। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা নয়! বাতাসের কাছে ঋণের কথা ভুলে গিয়ে বেঁচে থাকা যেমন অসম্ভবপ্রায় ঘটনা, আমাদের জাতীয় জীবনে একুশের উপস্থিতির অপরিহার্যতাও তেমনি অনিবার্য ঘটনা।
এ কথা আজ দিবালোকের মতোই পরিষ্কার-বাঙালি জাতির কাছে একুশ কেবল একটি গাণিতিক সংখ্যামাত্র নয়, অথবা ক্যালেন্ডারের পাতায় লালকালিতে চিহ্নিত একটি তারিখ মাত্র নয়। একুশের তেজদীপ্ত প্রাখর্য স্বাধীনতকামী শান্তিপ্রিয় মৃত্তিকালগ্ন একটি জাতির সারা শরীরে পরিব্যাপ্ত। বিস্মরণের দোলায় এ শরীর হয়ত সাময়িকভাবে দুলে উঠতে পারে, কিন্তু একুশের চেতনা এতটাই অপরিত্যাজ্য, অবিভাজ্য এবং অপরিহার্য হয়ে উঠেছে বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্গে। দুর্ভাগ্যই বলতে হয় রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, মধুসূদন ও বিদ্যাসাগরের, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য এবং বাঙালি জাতির জাগৃতির জন্য অনেক কিছুই করেছেন তাঁরা, কিন্তু এই উন্নতি-সমৃদ্ধি-জাগৃতির প্রকৃত চাবিকাঠির সমাধান পাননি; কারণ অমল ধবল সেই চাবি লুকানো ছিল একুশের সিন্ধুকে। কোথায় ১৯৫২-এর একুশ (ফেব্রুয়ারি), আর কোথায় বা তাদের সময়কাল! তবে হ্যাঁ, বায়ান্নোতে যারা সেই হিরণ্ময় চাবিকাঠি খুঁজে পেয়েছেন তাদের সঙ্গে কীর্তিমন্ত পূর্বপুরুষের গৌরবদীপ্ত কর্মকান্ডের কোন সম্পর্ক নেই, এমন কিন্তু নয়। সাদা চোখে সেই সম্পর্কের অস্তিত্ব কিছুতেই অস্বীকার করা যাবে না। তাদের রচিত পটভূমি বা পাটাতনে দাঁড়িয়েই বায়ান্নোতে বীর বাঙালি পাহাড়চূড়া স্পর্শ করেছে। চর্যাপদের অন্যতম পদকর্তা ভুসুকূপা, যদি সেদিন ঘোষণা না করতেন ‘আজি হতে তু বঙ্গালী ভইলি,’ কবি আবদুল হাকিম যদি মধ্যযুগে চিৎকার করে না বলতেন-‘যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি,’ মাইকেল মধুসূদন যদি উনিশ শতকেই উপলব্ধি না করতেন-‘হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিবিধ রতন,’ তাহলে বিশ শতকের মাঝামাঝি কালে এসে ভাষা-আন্দোলন এমন প্রাণশক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠত না এবং একটি পরাধীন জাতির মুক্তি সংগ্রামকে এমন বেগবান করে একেবারে স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিতে পারত না। সেই বিবেচনায় বাঙালি জাতির হাজার বছরের সংগ্রামমুখর ইতিহাসে বিগত শতকের একুশের ভাষা-আন্দোলনের অবস্থান একেবারেই অনন্য, অতুলনীয়। মাতৃভাষার মর্যাদার প্রশ্নে এমন অগ্নি-স্ফুলিঙ্গ অবস্থান গ্রহণ পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালি ভিন্ন আর কোন জাতিই বা করেছে! বাঙালি জাতির এই বিস্ময়কর আত্মজাগরণ দেখার সুযোগ হয়নি বলেই হয়ত প্রায় দেড় শ’ বছর পূর্বে গভীর আক্ষেপ করে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘ইতিহাসবিহীন জাতির দুঃখ অসীম। এমন দু’একজন হতভাগ্য আছে যে, পিতৃপিতামহের নাম জানে না; এবং এমন দুই এক হতভাগ্য জাতি যে, কীর্তিমন্ত পূর্বপুরুষগণের কীর্তি অবগত নহে। সেই হতভাগ্য জাতিদিগের মধ্যে অগ্রগণ্য বাঙালী।’
সত্যিই কি তাই? একুশের উত্তাল ঊর্মিমুখর ভাষা-আন্দোলন এবং সেই দুর্বার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় রক্তাক্ত একাত্তরে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা অর্জনের মতো অবিনাশী ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও কি এ জাতিকে কথিত ‘হতভাগ্য জাতি’ বলা চলে? অনুমান করি, বাঙালির এই অবিস্মরণীয় অর্জনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ ঘটলে বঙ্কিমচন্দ্রের মর্মবেদনা প্রশমিত হতো এবং এই আত্মঘাতী আক্ষেপোক্তিও তিনি নিজেই প্রত্যাহার করে নিতেন। তবে হ্যাঁ, এ প্রসঙ্গে পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগে-‘কীর্তিমন্ত পূর্বপুরুষগণের কীর্তি অবগত নহে’ বলেই কি তিনি বাঙালিকে ‘হতভাগ্য জাতিদিগের মধ্যে অগ্রগণ্য’ বলেছিলেন, না কি কীর্তিমন্ত পূর্বপুরুষদের সুকৃতি থেকে শক্তি-সাহস-শৌর্য সংগ্রহ করে উত্তর পুরুষদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে না পারার এই ব্যর্থতার জন্য হতভাগ্য জাতি হিসেবে স্বজাতিকে চিহ্নিত করেছিলেন? এ প্রশ্নের সদুত্তর মেলানো বেশ কঠিন। আর বর্তমান সময়ে তো পূর্বপুরুষগণের কীর্তি ও কৃতি মূল্যায়নের সংস্কৃতি এমনভাবে চালু করা হয়েছে যে তথাকথিত নিরপেক্ষতার নামে পক্ষপাতকেই জায়েজ করা হচ্ছে। নইলে স্বাধীনতার চার দশক পর শহীদদের সংখ্যা নিয়ে অভব্য বিতর্কের আদৌ কোন মানে হয়? এ বিতর্ক কার স্বার্থে? পূর্ব-পুরুষগণের কীর্তি এবং কৃতি, ত্যাগ ও তিতিক্ষা মূল্যায়নের এ কোন সংস্কৃতি? মহান ভাষা-আন্দোলন নিয়েও পরিহাস তরল কটুকাটব্য করতে রুচিতে বাধে না এই বর্ণচোরা মহলটির। অতি সাম্প্রতিককালের এই রুচিহীন ভ্রষ্ট সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় ঘটলে প্রখর ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন বঙ্কিমচন্দ্র নিশ্চয় পুনর্বার শমিত হতেন এবং সুগভীর মর্মবেদনায় আর্তনাদ করতেন।
আচ্ছা থাক সেই কল্পলোকের কথা। আমরা দৃষ্টি ফেরাই একুশের দিকে। একুশের মর্মমূলে ছিল ভাষার প্রশ্ন এবং মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত জাতীয়তাবোধ ও আত্মমর্যাদাবোধের প্রশ্নটি-এ নিয়ে নিশ্চয় বিতর্কের কোনে অবকাশ নেই। ভাষার প্রশ্ন, মানে কোন সে ভাষা? অবশ্যই সেটা মাতৃভাষা। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের যে কোন মানুষের কাছে আদিম ভাষা হচ্ছে তার মাতৃভাষা। কথা বলা, স¦প্ন দেখা, চিন্তা করা, লেখাপড়া করা, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, অফিস আদালতের কাজকর্ম থেকে শুরু করে জীবন যাপনের জন্য সবকিছুই মাতৃভাষায় সম্পাদনের অধিকার যে কোন মানুষের জন্মগত অধিকার। এই অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে আন্দোলন, তাই ভাষা-আন্দোলন। সে দিনের পরিপ্রেক্ষিত ছিল বাংলা ভাষা নিয়ে। বাঙালির মুখের ভাষা বাংলা। ভাষা শুধু নয়, বাঙালির আছে নিজস্ব শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি আচার আহার বিহার জীবনযাপন ধারা। এই সবকিছু নিয়েই সে বাঙালি; হাজার বছরের বাঙালি। দিনে দিনে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবোধের এই পরিচয় হিমালয়স্পর্শী উচ্চতা লাভ করেছে অসংখ্য কৃতি মানুষের কর্মে ও সাধনায়। স্বাধীনভাবে মাতৃভাষা ব্যবহারের জন্মগত অধিকার কে পারে রোধ করতে? কবে কোথায় কোন দেশে ঘটেছে এমন সর্বনেশে কান্ড? দুর্ভাগ্য হলো এই-এমন ঘটনা একদা আমাদের এই দেশেই ঘটেছে। বাঙালি জাতি বুকের রক্তে রুখে দিয়েছে সব অপচেষ্টা। নিষেধের বেড়াজাল ছিঁড়ে বাংলা ভাষা ঠিক সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বমহিমায়। এক অর্থে বাংলা ভাষা যেন বা জনমদুখিনী মেয়ে। ধনীর দুলালী তো নয়। খুব সাধারণভাবে প্রকৃতিলগ্ন সাধারণ মানুষের সুখে-দুখে তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। জন্ম থেকেই অভিজাত শ্রেণী তথা রাজ-রাজন্যের কাছ থেকে বাংলা ভাষা পেয়েছে ঘৃণা আর অবজ্ঞা। এই ভাষা ব্যবহারকারী জনসাধারণকে ‘রৌরব’ নামের নরকের ভয় দেখানো হয়েছে। এ ছাড়াও অনেক প্রকার সামাজিক পীড়নের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। ফলে নিজের অস্তিত্বের স্বার্থে এ লড়াই করতে হয়েছে একেবারে শুরু থেকেই। সে লড়াই প্রাণসংহারী রূপ নিলে অনেক মানুষ দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছে, কিন্তু মুখের ভাষা এবং সে ভাষার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন চর্যাপদকে ত্যাগ করেনি। সে কারণেই বহু শতাব্দী পরে পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সেই আদি কাব্য ‘আশ্চর্য চর্যাবিনিশ্চয়’ আবিষ্কার করলেন নেপাল থেকে। মধ্যযুগের গীতিকাব্য ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ খুঁজে পেলেন বসন্তরঞ্জন বিদ্যাল্লভ বাঁকুড়ার এক গোয়ালঘরে। সমাজের উচ্চ শ্রেণী কৃত্রিম ভাষা সংস্কৃতের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে এবং একই সঙ্গে অবহেলা করেছে বাংলা ভাষাকে। বাংলা তবু টিকে থেকেছে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। রাজকীয় আনুকূল্য বলতে মুসলিম শাসন-আমলে বেশ খানিকটা জুটেছে। ফলে দৌলত উজির শাহ গরীবুল্লাহর মতো কবির পক্ষে বাংলা ভাষায় কাব্যচর্চা সম্ভব হয়েছে। তবে দালাল শ্রেণীর দৌরাত্ম্য তখনও ছিল। তারাই শাসকদের মনোরঞ্জনের জন্য মুসলিম শাসনামলে যেমন রাজভাষা তুর্কী শিখেছে, তেমনি ইংরেজ শাসনামলে ইংরেজী শিখেছে এবং বাংলাচর্চার প্রতি ঘৃণা আর অবজ্ঞা ছুড়ে দিয়েছে। পাকিস্তানি আমলেও দালাল শ্রেণীর অভাব হয়নি। তারা প্রভুতোষণের জন্য নির্লজ্জভাবে উর্দুকে চাপিয়ে দিতে চেয়েছে বাঙালির কাঁধে, বাংলা বর্ণমালা নিয়ে ষড়যন্ত্র করে আরবি হরফে বাংলা লেখার কুটযুক্তি পর্যন্ত উত্থাপন করেছে, এ দেশে রবীন্দ্রচর্চা নিষিদ্ধ এবং নজরুল চর্চাও খন্ডিত (শুধু মুসলিম সংস্কৃতির প্রতিফলন যেটুকু সাহিত্যে পাওয়া যায়) করেছে। ধর্মকে তারা ভাষা ও সাহিত্যের মুখোমুখি এনে দাঁড় করেছে। বাংলা ভাষা তো এই রকম প্রতিকূল পরিবেশের বৈরিতাকে অতিক্রম করেই টিকে থেকেছে, ফুল-ফল দিয়েছে, বুকভরা আবেগ দিয়েছে, লড়াইয়ের শক্তি সাহস দিয়েছে। তাই আমাদের ভাষা আন্দোলন হঠাৎ ১৯৫২ সালে শুরু হয়েছে ভাবলে খুব ভুল হবে। এ আন্দোলনের শেকড় অনেক গভীরে প্রোথিত; এ লড়াইয়ের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে হলে অনেক পেছনে দৃষ্টি ফেরাতে হবে।
বাঙালির ভাষার লড়াই কীভাবে কোন প্রেক্ষাপটে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে রূপান্তরিত হলো, ’৫২, ’৬২, ’৬৬, ’৬৯ এর সব স্রোত কীভাবে একাত্তরে এসে এক মোহনায় মিশে গেল, সে প্রসঙ্গে অল্প দু’একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে চাই। মুখের ভাষা বাংলা বলেই আমি বাঙালি, এই-ই আমার জাতীয় পরিচয়। বসবাস বা অবস্থানের বিচারে আমার নাগরিক পরিচয় ভিন্ন হতে পারে। নাগরিক পরিচয় কিংবা ধর্মীয় পরিচয়ের বদল হয় বা হতে পারে, ভাষাভিত্তিক জাতীয় পরিচয়ের কিছুতেই বদল হয় না। কাজেই ভাষা-আন্দোলন করতে গিয়েই এ দেশের সাধারণ মানুষ আত্মপরিচয় খুঁজে পেয়েছে: ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি।’ এই বাঙালি হওয়ার জন্যেই চর্যাপদের কাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত চরম মূল্য দিতে হয়েছে। রক্তে ধোয়া সংবিধানে তাই আমাদের জাতীয়তা লেখা হয়েছে বাঙালি। বাঙালি হওয়ার নয়, বাঙালি পরিচয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচার এই গণ আকাঙ্খা থেকেই তো রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে গণমানুষের অংশগ্রহণ। সহসা সঙ্গীনের খোঁচায় বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার কুটচেষ্টা বাঙালির হাজার বছরের লড়াই সংগ্রামের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতারই অন্য নাম।
সেই গোড়া থেকেই ধর্ম এসে বাঙালিত্বের পথ আগলে দাঁড়িয়েছে। রক্ষণশীল হিন্দুর ব্রাহ্মণ্যবাদই হোক আর কট্টর মুসলমানের মোল্লাতন্ত্রই হোক, বাংলা চর্চার পথে কাঁটা বিঁছিয়েছে তারা উভয়েই। ধর্মের জিগির তুলে বাঙালিত্বের অসাম্প্রদায়িক বিকাশ বার বার বিঘ্নসংকুল করা হয়েছে অতীতে। তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই বাঙালি সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। কাজেই গণআকাঙ্খা জেগে উঠতেই পারে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রাদর্শের প্রতি। বিশেষত পাকিস্তানি শাসকদের (ধর্মপরিচয়ে তারাও মুসলমান) বিদ্বেষ ও বৈষম্যপূর্ণ শাসন ও নির্যাতনে ক্ষুব্ধ বাঙালি মুসলমানেরাও ‘মুসলিম-মুসলিম ভাই ভাই’-এই ধোঁকাপূর্ণ তত্বে আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং ধর্ম নিরপেক্ষতার স্বপ্ন বুকে নিয়েই মুক্তিযুদ্ধ করে। ভাষা আন্দোলনই বাঙালিকে ধর্মনিরপেক্ষতার মন্ত্রে দীক্ষিত করেছে, তারপর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তা রাষ্ট্রীয় সংবিধানে প্রতিষ্ঠিত করেছে। হঠাৎ সেই ধর্মনিরপেক্ষতা যদি সংবিধান থেকে বিসর্জিত হয় তাহলে তো মুক্তিযুদ্ধ এবং ভাষা আন্দোলন দুটোকেই পরিহাস করা হয়।
শ্রেণী বিভক্ত সমাজে বসবাসের সুবাদে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে শোষিত ও নির্যাতিত হতে হতে আপামর জনসাধারণ তো শোষণমুক্ত শ্রেণী-নিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখতেই পারে। ভাষার লড়াই করতে গিয়েই এ দেশের সাধারণ মানুষ টের পেয়েছে শ্রেণী-বিদ্বেষের বিষবাষ্প কতটা ভয়াবহ হতে পারে। কাজেই সেই শিক্ষা থেকে তারা অর্থনৈতিক শোষণ ও বৈষম্যের অবসানের আকাক্সক্ষা বুকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদের স্তম্বকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেখে আশ্বস্ত বোধ করেছে। পঁচাত্তরের পরে কূটকৌশলে সেই স্তম্ব সরিয়ে নিয়ে শ্রেণী-নিরপেক্ষ শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্নকে সমূলে উৎপাটন করা হয়েছে। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তো বটেই, ভাষা-আন্দোলনের মূল স্পিরিটও অনেকাংশে ভুলুন্ঠিত হয়েছে। এতসব নেতির মধ্যেও ইতিবাচক দিক হচ্ছে, আমরা ভাষা-আন্দোলনের পথ বেয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা পাওয়া বাংলাদেশে মাথা উঁচু করে বেঁচে আছি। ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলা এখন পৃথিবীতে চতুর্থ অবস্থানের ভাষা। বাংলা ভাষী যত মানুষ বাংলাদেশে বাস করে, প্রায় তার সমপরিমাণ মানুষ বাংলাদেশের বাইরে বিভিন্ন দেশে বাস করে; তারা বাংলায় কথা বলে, গান গায়, স্বপ্ন দেখে, সাহিত্যচর্চা করে; তবু তারা বাংলাদেশের বাঙালিদের সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারে না কিছুতেই। তাদের হাতের মুঠোয় নেই ২১ ফেব্রুয়ারি, নেই ২৬ মার্চ, নেই ষোলই ডিসেম্বর। শুধু এই তিনটি তারিখের তাৎপর্য নিয়ে বাংলাদেশে যে পরিমাণ শিল্পসাহিত্য রচিত হয়েছে, বাংলাদেশের বাইরের বাঙালিরা কোথায় পাবে এই আবেগ, এই উত্তাপ! তাকে তো দুর্ভাগ্য বলতেই হয়-বাঙালি হয়েও বাংলার ভাষা-আন্দোলন এবং বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত সাহিত্য চিত্রকলা নাট্যকলার সঙ্গে যোগযুক্ত হয়ে ওঠা যার হলো না। কিছু কিছু আত্মসচেতন ভারতীয় বাঙালি লেখককে এ দেশে বেড়াতে এসে এই নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেও দেখা গেছে। তাই তো বলি, ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার। এ দুটোই অমিত সম্ভাবনাময় ইতিবাচকতার অফুরন্ত খনি। পথের বাঁকে ঝড়-ঝাপটা আগেও এসেছে, আমরা ভেঙ্গে পড়িনি, পথ হারাইনি; ঘনঘোর অন্ধকারেও একুশ আমাদের পথের দিশা দিয়েছে; আগামীতেও এই অবিনাশী আলোকবর্তিতা যে কোন দৈব দুর্বিপাকে সামনে চলার পথ দেখাবে; পায়ের তলে শক্ত মাটি দেবে এবং মাথার উপরে উদার আকাশ দেবে।
লেখক : অধ্যাপক, গাংনী ডিগ্রি কলেজ, গাংনী, মেহেরপুর।