মো: কামরুজ্জামান বিপিএম
‘স্বপ্নের পদ্মা সেতু’ কথাটি গত কয়েক বছরের অগণন উচ্চারিত ও অযুতবিশ্রুত একটি শব্দগুচ্ছ। আচমকা এই শব্দগুচ্ছ প্রতিষ্ঠা পায়নি। প্রথমে একজন স্বপ্নদ্রষ্টা তাঁর কল্পনার চোখে প্রমত্ত পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে ‘বয়ে চলা’ একটি সেতু দেখেছেন। তাঁর সেই স্বপ্নকে প্রকৌশলীরা নকশায় রূপ দিয়েছেন। অসংখ্য কর্মীর নিরন্তর বহুমুখী অংশগ্রহণে সেই সেতু নকশা থেকে অবশেষে বাস্তবে ধরা দিয়েছে।
আজ থেকে ১০ বছর আগে যে পদ্মা সেতুকে দেখতে চোখ বন্ধ করে স্বপ্নের দৃষ্টি দিয়ে কল্পনার দৃশ্যপটে তাকাতে হতো, আজ তা চোখ খুলেই দেখা যায়। তাকে আজ ছোঁয়া যায়। আজ তা এক মহাস্বপ্নের পূর্ণ দৃষ্টিগ্রাহ্য ও স্পর্শযোগ্য পরম বাস্তবতা। সেই স্বপ্ন আজ ধরা দিয়েছে।
২৫ জুন চালু হতে যাচ্ছে সেই স্বপ্নের পদ্মা সেতু। দুই প্রান্তের উড়ালপথ মিলিয়ে মোট ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে (মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। দুই প্রান্তের উড়ালপথ (ভায়াডাক্ট) ৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার) দ্বিতলবিশিষ্ট সেতুর ওপর দিয়ে চলবে যানবাহন। ভেতর দিয়ে যাবে ট্রেন। এখন যানবাহন চলাচল উদ্বোধন করা হচ্ছে। রেল চালু হবে আরও পরে।
ভারতের মিসাইলম্যানখ্যাত প্রয়াত রাষ্ট্রপতি বিজ্ঞানী এপিজে আবদুল কালাম তাঁর ‘ইগনাইটেড মাইন্ডস’ বইয়ে শিশুদের উদ্দেশে নিজের একটি সংক্ষিপ্ত কবিতায় বলেছেন : ‘ড্রিম, ড্রিম, ড্রিম/ড্রিম ট্রান্সফর্ম ইন টু থটস্/অ্যান্ড থটস্ রেজাল্ট ইন অ্যাকশন।’ এই কবিতার চুম্বক কথা হলো- স্বপ্ন দেখার মতো দেখলে তা বাস্তব হয়ে ধরা দিতে বাধ্য।
কিন্তু অতলস্পর্শী স্বপ্ন সবাই দেখতে পারে না। প্রকৃতির নিয়মে সমাজ, দেশ ও দুনিয়া বদলে দেওয়ার মতো স্বপ্ন শুধু সৃষ্টিকর্তার নির্বাচিত মানুষই দেখতে পারেন। যতক্ষণ না সেই নির্বাচিত বা প্রতিশ্রুত মানুষটির আবির্ভাব না হয়, ততক্ষণ সেই ইপ্সিত পরিবর্তন ধরা দেয় না।
প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম মেনে বাংলাদেশ নামের এই দেশটির জন্মের পূর্বশর্ত ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম। এই গাঙ্গেয় বদ্বীপে হাজার বছর ধরে বাঙালি বাস করলেও ভূমিপুত্রদের হাতে কোনো কালেই শাসনক্ষমতায় আসেনি। পাল বংশ, সেন বংশ, বখতিয়ার খিলজি, মুঘল আমল, মুর্শিদ কুলি খান, সিরাজ উদ দৌলার আমল থেকে ব্রিটিশ
অথবা পাকিস্তানি আমলেও আমাদের শাসক ছিলেন অবাঙালিরা। অবশেষে বিংশ শতকে এসে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেওয়া শেখ মুজিবুর রহমান সেই ছাত্রজীবনে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের বেকার হোস্টেলে থাকার সময়ই একটি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন বাঙালিরাই হবে বাঙালির শাসক। সেই স্বপ্ন তাঁকে ঘুমাতে দেয়নি। এরপর শত-সহস্র বাধা এসেছে। বাধার দুর্গম হিমালয়-হিন্দুকুশ ডিঙিয়ে শেষ পর্যন্ত জাতির পিতা স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন।
আজ পদ্মা সেতুর বাস্তব রূপলাভের পেছনেও ঠিক একইভাবে একটি স্বপ্ন ও একজন প্রতিশ্রুত স্বপ্নদ্রষ্টা অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছেন। সেই স্বপ্নদ্রষ্টা হলেন স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য তনয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
একটি স্বাধীন ও দারিদ্র্যমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশে স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর লৌকিক জীবদ্দশায় সে স্বপ্ন অংশত বাস্তব রূপ পেয়েছে। দেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম হয়েছে। তাঁর স্বপ্নের বাকি অংশ বাস্তবায়নের, অর্থাৎ এক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের দায়িত্ব নিয়েছেন তাঁর আত্মজা শেখ হাসিনা। সেই দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত এক বাংলাদেশ গড়ার জন্য তিনি যে স্বপ্ন দেখেছেন, তার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হলো পদ্মা সেতু। এটি বাংলাদেশের উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ আইকন হয়ে থাকছে। এটিকে পদ্মার বুকে দাঁড়িয়ে থাকা নিছক একটি স্টিল-কংক্রিটের অতিকায় কাঠামো হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এর সদর্প অস্তিত্ব ঘোষণার মধ্যে বাঙালি জাতির নিজ প্রত্যয়ে অটল থাকার এবং দেশি-বিদেশি চক্রান্তের জাল ছিঁড়ে আত্মশ্লাঘায় উদ্দীপ্ত হয়ে আপন মহিমা ঘোষণার প্রতীকী তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। আর উন্নয়ন তো এর অনিবার্য ও অবশ্যম্ভাবী ফল।
একটি সেতু একটি জনপদ তথা গোটা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে যে কত বড় ভূমিকা রাখে। তার জলজ্যান্ত প্রমাণ যমুনা বহুমুখী সেতু। এই সেতুটি হওয়ার পর গোটা উত্তরবঙ্গের সঙ্গে ঢাকাসহ দেশের বাকি অংশের যোগাযোগ সহজ হয়েছে। এতে উত্তরবঙ্গের আর্থসামাজিক বাস্তবতা বদলে গেছে। ‘মঙ্গা’ নামের অভিশাপ থেকে ওই অঞ্চলে মুক্তি পেয়েছে।
একইভাবে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলাকে সারা দেশের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করতে; মোংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনে পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দেখেছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সেই স্বপ্ন সত্যি হচ্ছে। এই সেতু চালু হওয়ার পর দেশের অর্থনীতিতে বড় প্রভাব পড়বে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রসার ঘটবে। ইতিমধ্যেই এই সেতুকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সেতুর প্রভাবে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে দাঁড়াবে ১.৫ শতাংশ। এতে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি মিলবে। দারিদ্র্য বিমোচন হবে শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেছেন, ‘ফিজিবিলিটি স্টাডিতে যেমন ছিল যে, ২৪-২৫ বছরের মধ্যে টাকাটা (পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়) উঠে আসবে। এখন মনে হচ্ছে ১৬-১৭ বছরের মধ্যেই টাকাটা উঠে আসবে। ওই পাড়ের যেসব কাজকর্ম এবং যেগুলো আছে, সেগুলো ফিজিবিলিটি স্টাডিতে আসেনি। মোংলা পোর্ট যে এত স্ট্রং হবে, পায়রা বন্দর হবে, এত শিল্পায়ন হবে- এগুলো কিন্তু আসেনি।’ তিনি বলেছেন, ‘ধারণা ছিল পদ্মা সেতু ১ দশমিক ৩ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি আনবে। এটা ২ এর কাছাকাছি চলে যাবে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে।’
বঙ্গবন্ধুকে তাঁর স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনে বারবার দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীদের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হয়েছে। একইভাবে তাঁর কন্যাকেও আজ দেশ গঠনের কাজে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বিশেষ করে পদ্মা সেতু নির্মাণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে একাধারে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। এই সেতু নির্মাণে বিশ^ব্যাংকের অর্থায়ন নিয়ে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের যে চক্রান্ত তাঁকে মোকাবিলা করতে হয়েছে, তা ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে।
২০১২ সালের বিশ্বব্যাংক বলেছিল, তাদের কাছে নিশ্চিত প্রমাণ আছে, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র ঘটেছে। বাংলাদেশ সরকারের পদস্থ কর্মকর্তারা, এসএনসি লাভালিন এবং সরকারের বাইরের কয়েকজন ব্যক্তিও এর সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে সরাসরি দুর্নীতির অপবাদ দিয়ে তারা অর্থায়ন বাতিল করেছিল।
সে সময় এ দেশেরই একটি মহল বিশ্বব্যাংকের প্রশংসা করেছিল বাংলাদেশ সরকারের ‘দুর্নীতি ধরে ফেলার জন্য’। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী টলে যাননি। তিনি পিতার মতোই তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নে অসম সাহসে অটল থেকেছেন। তিনি বিশ্বব্যাংকের অভিযোগকে চ্যালেঞ্জ করে তাদের কাছে দুর্নীতির প্রমাণ চেয়েছেন। পরে প্রমাণ হয়েছে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ ভিত্তিহীন ছিল। ২০১৭ সালে কানাডার আদালতের বিচারক রায় দেন, ‘অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যে তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে তা জল্পনা, গুজব আর জনশ্রুতি ছাড়া কিছুই নয়।’ বিশ্বব্যাংককে অর্থায়ন প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করতে এ দেশেরই অনেক প্রভাবশালী মানুষ তদবির করেছেন বলেও পরে প্রমাণ মিলেছে।
প্রধানমন্ত্রী সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হবে বলে ঘোষণা দেওয়ার পর অনেকেই বলেছিলেন, এত বড় প্রকল্প বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব হবে না। কিন্তু দূরদর্শী প্রধানমন্ত্রী তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নে অটল থেকেছেন। তাঁর ইস্পাত কঠিন প্রত্যয় শেষ পর্যন্ত স্বপ্নের সেতুকে আমাদের সামনে বাস্তবের সেতু হিসেবে হাজির করেছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ সব ভীরুতা ও মূঢ়তা ঠেলে ফেলে, সব ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে এগিয়ে যাচ্ছে।
পরিতাপের বিষয়, পদ্মা সেতুর নির্মাণ নিয়ে একটি মহল খুশি হতে পারেনি। এখনো তারা এর নির্মাণ ব্যয় নিয়ে ক্রমাগত বিভ্রান্তি ছড়িয়ে চলেছে। এটি যে পুরো জাতির একটি সমন্বিত স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন, তা তারা মানতে পারছে না। এ কারণে তারা এই উৎসবকে উদ্যাপন করতে পারছে না।
আনন্দের বিষয়, চক্রান্তকারীরা সংখ্যায় অতি সামান্য। তাদের কোনো ষড়যন্ত্রই আর কাজে আসবে না। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর বাস্তব রূপলাভের মতোই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বপ্নের ক্ষুধামুক্ত সমৃদ্ধ সোনার বাংলা বাস্তবতায় ধরা দেবে- এমন একটি প্রতীতি আমাদের নতুন ভোরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
লেখক : এআইজি (মিডিয়া এন্ড পাবলিক রিলেশন্স)।