ই-পেপার

নিউজ স্ক্রল

সিরাজুল ইসলাম কাদির

আমরা যখন গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছালাম তখন ঘণ্টার কাটা প্রায় ১১টার ঘর আলতো করে ছুঁয়ে নিজের গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে চলছে। গাড়ি থেকে নামার পরই ভবনের নামকরণে এক মনোরম আবাসের গন্ধ স্পষ্ট হলো। ওয়েসিস, কল্পনায় তখন আমি এক মরুময় জগতে। চারদিকে শুধু তপ্ত বালু। পথিক তৃষ্ণার্ত। হঠাৎ পথিক এক মনোরম উদ্যানের সন্ধান পেল। এই সন্ধান তার জীবনে বহতা নদীর মতো কলধ্বনি করে জীবনকে অবলীলায় অবগাহন করিয়ে দেয়। চমৎকার এক কাব্যিক নাম। পুলিশ বাহিনীর অন্তরে এরকম অন্তসাধনার সন্ধান, মনকে চঞ্চল করে তুলল এই ভবনের ভেতর বাহির অনুপুঙ্খ দেখার জন্য।

সুশান্ত নারায়ণ দে ঢাকাস্থ পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা। এই ওয়েসিসে ডেপুটেশনে প্রশাসনের দায়িত্বে। ঢাকা থেকে সঙ্গী হয়ে এসেছেন। ন’ কিলোমিটার পথ। সঙ্গী হয়ে আরো এসেছেন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের অন্যতম সংগঠক মারুফ ইবনে মাহবুব এবং তাঁর দুই সহকর্মী। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে বাংলাদেশ পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্ট পরিচালিত প্রতিষ্ঠানটি মাদকাসক্তি নিরাময় ও মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শ কেন্দ্র। মুনাফা নয়, দেশের বিভ্রান্ত মানুষকে পথে আনো, জীবনের দ্যোতনা উপলব্দি করার জন্য মূল পথে ফিরিয়ে আনাই এই কেন্দ্রের লক্ষ্য- বললেন, সুশান্ত নারায়ণ। তাঁদের এই কার্যক্রমের আড়ালে যিনি প্রেরণা জোগান তিনি হচ্ছেন হাবিবুর রহমান। বর্তমানে ট্যুরিস্ট পুলিশ বাহিনীর প্রধান। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি। ভবনটি যেন প্রকৃত অর্থে নান্দনিক হয়, তার সব চেষ্টা ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে বিদ্যমান। নাগরিক জীবনের আধুনিক সব উপকরণ ও সেবা এখানে বিদ্যমান। এখানে তরুণ, তরুণী এমনকি বয়োবৃদ্ধ যে কেউ সেবা নিতে আসেন পরিবারের ইচ্ছায়। চার থেকে ছ’মাস চিকিৎসা শেষে একজন সুস্থ মানুষ হয়ে সমাজের মূল ধারায় ফিরে যান। এখানে এমনভাবে প্রতিটি রোগীকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয় যেন তিনি এই প্রতিষ্ঠানকে নিজেরই বাড়ি বলে বিবেচনা করেন। খুব দ্রুত এই পরিবারের সদস্য হয়ে যান তিনি। এ প্রসঙ্গে হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমাদের মূল উদ্দেশ্য বিভ্রান্ত এইসব মানুষকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে এনে সমাজের মূলপ্রবাহে নিষিক্ত করা- যাতে তিনি আগের মতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গিয়ে পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্য বোঝা নয়, সম্পদে পরিণত হন।’

তাঁর এই কথার সত্যতা মিলল চল্লিশের কোঠায় পা রাখা মুক্তা জাহানের সঙ্গে (ছদ্মনাম) কথা বলে। ঢাকা শহরে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের এই মহিলা কিশোরী বয়সে বন্ধুদের সঙ্গে সিগারেটে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। তার এই নেশা কেবল সিগারেটে সীমিত থাকেনি। তিনি এলকোহল পান করার পাশাপাশি মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেতেন। এই মহিলার সঙ্গে যখন কথা বলি, তার মধ্যে নতুন জীবনের আনন্দ, পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে মিলনের গভীর স্পৃহা তখন পরিলক্ষিত। তিনি তার মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু মেয়ের শ্বশুরবাড়ির সবাই মুক্তার এই উচ্ছন্নে যাওয়া জীবন সম্পর্কে অনবহিত। একমাত্র ছেলের বয়স ১১ বছর। মুক্তার এই স্বল্প-মেয়াদি আবাসে পুত্র একবার এলেও স্বামী কিংবা মেয়ে কখনো আসেননি। বললেন, চারজনের ছোট সংসার আমার উচ্ছৃখল জীবন কাউকে কখনো শান্তি দেয়নি। আমার মধ্যে তখন এই চেতনা ছিলনা। আমি এখন নতুন জীবন পেয়েছি। এখানকার সবাই খুব কেয়ারিং ছিলেন। এ প্রসঙ্গে মোর্তজা হাসান বলেন, এই নারীকে প্রথম দিকে হ্যান্ডেল করতে গিয়ে আমরা হিমশিম খেয়েছি। তিনি মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেতেন। হঠাৎ আমরা এটা বন্ধ করে দিলে, তার নানা রকম শারীরিক জটিলতা হতে পারত। যেমন খিচুনি হতে পারে। নাড়ীর স্পন্দন বেড়ে গিয়ে জীবন সংশয় তৈরি হতে পারে। তিনি প্রচুর ধূমপান এবং মদ্যপান করতেন। মোটকথা তার জীবনে কোনো শৃঙ্খলা ছিল না। উদ্বেগজনিত সমস্যার সঙ্গে মানসিক বৈকল্য এই দুয়ের সংমিশ্রণে গভীর উদ্বেগ এবং হতাশা তাকে গ্রাস করে। বদরাগ এবং মদাচ্ছন্নতা থেকে তার মধ্যে আত্মহননের প্রবণতা তৈরি হয়। পরিবারকে তিনি প্রতিনিয়ত উৎপাত করতেন। নিজের ভেতরের গভীর হতাশাকে তিনি অতিমাত্রায় ক্রেইজ-এর মধ্য দিয়ে বহিঃপ্রকাশ ঘটাতেন। তাকে স্বাভাবিক জীবনে আনতে হয়েছে। তাকে এই কেন্দ্রে আনা অভিভাবকদের জন্য একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ ছিল। তাকে স্বাভাবিক জীবনে আনতে আমাদের একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পার হতে হয়েছে। স্বামীর সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই সম্পর্ক ছিল তিক্ত। নানারকম যন্ত্রণা, সন্দেহ এবং অবিশ্বাস দ্বারা তিনি এক অসুস্থ জীবনে জড়িয়ে পড়েন। একজন মানুষের মধ্যে এই ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার কারণ কি, জানতে চাইলে মর্তুজা হাসান বলেন, ‘ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষা বিষয়ক মতবাদ অনুযায়ী মনমানসিক শক্তি কর্ম প্রেরণা দ্বারা ‘উৎসারিত’। কোনো কারণে এই কর্মপ্রেরণা আঘাতপ্রাপ্ত হলে যে গভীর হতাশার জন্ম হয়- সেখান থেকে মানুষ মুক্তি পাওয়ার জন্য এরকম উচ্ছৃঙ্খল জীবন বেছে নেয়। প্রসঙ্গত মর্তুজা হাসান একজন এম.বি.বি.এস, এফসিপিএস ডিগ্রিধারী সাইকিয়ট্রিক্ট এবং এই কেন্দ্রের সার্বক্ষণিক সেবায় নিয়োজিত। তিনি এই কেন্দ্রের এই পেশাকে আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। এখানে আরিফুল হক নামে অপর একজন মনোবিজ্ঞানী রয়েছেন। এ ধরনের বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা বাংলাদেশ পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্ট দ্বারা পরিচালিত বলেই সম্ভব হয়েছে। শুধু মানসিক বিশেষজ্ঞরা নয়- এখানে ফিজিওথেরাপিস্ট, ইয়োগা বিশেষজ্ঞ এবং মাদক নেশা থেকে নিরাময়ের জন্য অভিজ্ঞ পরামর্শক রয়েছেন। চিকিৎসা শেষে ফলোআপ পরামর্শ বা চিকিৎসার জন্য এখানে কোনো অর্থ গ্রহণ করা হয় না। পরিচ্ছন্ন ও মনোরম পরিবেশে নির্মিত এই কেন্দ্রটি ২০২১ সালে ৭ অক্টোবর, প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এ পর্যন্ত অন্তত ১০০ রোগীকে সুস্থ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে এই কেন্দ্রটি।

লেখক : রয়টার্সের সাবেক ব্যুরো প্রধান এবং তিনি বর্তমানে আমেরিকান চেম্বার্স জার্নালের নির্বাহী সম্পাদক।

ভালো লাগলে শেয়ার করে দিন :)