ড. বেনজীর আহমেদ বিপিএম (বার)
কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। সংক্ষেপে সিবিবিএল; কিন্তু ‘কমিউনিটি ব্যাংক’ হিসেবেই মানুষের কাছে বেশি পরিচিত। বাংলাদেশ পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের অধীভুক্ত এক প্রতিষ্ঠান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সানুগ্রহে ২০১৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর দেশের চতুর্থ প্রজন্মের বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে পথ চলা শুরু করে। সে হিসেবে ১১ সেপ্টেম্বর ব্যাংকটির দুই বছর পূর্তি হয়েছে। শতভাগ পুলিশ সদস্যদের মালিকানাধীন এই ব্যাংকটির দুই বছরের সার্বিক কার্যক্রমের সালতামামি করলে অর্জনের পাল্লাই অনেক ভারী। এই অল্প সময়ের মধ্যে কমিউনিটি ব্যাংক এমন কিছু অর্জন করেছে, যা অনেকের কাছে ঈর্ষণীয়।
কমিউনিটি ব্যাংকের যত সাফল্য
বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যগণের শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে ৫০০ কোটি টাকা মূলধন সংগ্রহের মাধ্যমে কমিউনিটি ব্যাংক যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে ব্যাংকটি দেশব্যাপী ১৮টি শাখার মাধ্যমে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে এই ব্যাংকটির দেশব্যাপী শাখা বিস্তারের কাজ চলমান রয়েছে। মাত্র ১৮টি শাখার মাধ্যমে পরিচালিত হলেও এ বছর করোনা ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যেও ব্যাংকটি ২০ কোটি টাকা গ্রস লাভ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী যেহেতু ব্যাংক চালুর প্রথম তিন বছরের মধ্যে শেয়ার হোল্ডারদের মধ্যে লভ্যাংশ বিতরণ করা হয় না, তাই লাভের টাকা পুনরায় বিনিয়োগ করা হয়েছে।
কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনাকারী কমিউনিটি ব্যাংক দেশব্যাপী ইতিমধ্যেই ১৮০টি এটিএম বুথ স্থাপন করেছে। অত্যন্ত দক্ষতা, সক্ষমতা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে নতুন চালুকৃত ব্যাংকে কোর ব্যাংকিং চালু করার ৪৮ দিনের মধ্যেই কমিউনিটি ব্যাংক ‘Finacle Infosys Innovation Award’ পেয়েছে। এত অল্প সময়ে কোর ব্যাংকিং এমন সূচারুভাবে সম্পন্ন করার নজির বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে নেই।
এ ছাড়াও গ্রাহকগণ আইটিসিএল ও এনপিএসবি সুবিধার আওতায় দেশের অন্যান্য ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলতে পারছেন। ব্যাংকটির ডিজিটাল ট্রানজেকশন সুবিধা ব্যবহার করে মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশ, নগদসহ ইএফটির মতো সেবাগুলো গ্রহণ করতে পারছেন।
সেখানে সব পুলিশ সদস্যের সমান শেয়ার
কমিউনিটি ব্যাংক এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে র্যাংক নির্বিশেষে সব পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের জন্য সমান শেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অর্থাৎ এখানে আইজিপি থেকে কনস্টেবল এবং পুলিশে কর্মরত সব নন-পুলিশ ও সিভিল সদস্যগণ একটি করে শেয়ারের মালিক। এখানে ব্যাংকের বোর্ড অব ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালনকারী আইজিপি মহোদয়ের একটি শেয়ার, তেমনিভাবে নিম্নপদস্থ পুলিশ সদস্য যেমন কনস্টেবলেরও একটি শেয়ার রয়েছে। সমবায়ের এমন নজির খুবই বিরল।
যেভাবে কমিউনিটি ব্যাংকের মূলধন গঠন
পুলিশ সদস্যদের ক্রয়কৃত শেয়ার থেকে প্রাপ্ত অর্থের মাধ্যমে এই ব্যাংকের মূলধন গঠন করা হয়েছে। তবে, কেউ এই ব্যাংকের শেয়ার হোল্ডার হবেন কি না, সেই সিদ্ধান্ত পুলিশ সদস্যগণ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। শুরুতে র্যাংক ও পদ ৩২ হাজার টাকা করে শেয়ারমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। পুলিশের নিম্নপদস্থ সদস্যদের কথা বিবেচনা করে প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা করে মোট ৩২ হাজার টাকা নিয়ে এই ব্যাংকের মূলধন গঠন করা হয়েছে। এই ব্যাংকের শেয়ার হোল্ডার হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে পুলিশ সদস্যগণ সম্পূর্ণ স্বাধীন, অর্থাৎ তারা চাইলে ব্যাংক নির্ধারিত শেয়ারমূল্য পরিশোধ করে ব্যাংকের মালিক হতে পারেন অথবা না চাইলে কমিউনিটি ব্যাংকের মালিক হওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারেন।
কমিউনিটি ব্যাংকের বর্তমান মূলধন স্থিতি
৫০০ কোটি টাকা মূলধন নিয়ে চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক হিসেবে পথচলা শুরু করা কমিউনিটি ব্যাংকের দুই বছরেই গ্রাহক আমানত ছয় হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে, নতুন একটি ব্যাংক হিসেবে যা অনন্য অর্জন।
কমিউনিটি ব্যাংকের ঋণ বণ্টন
ব্যাংকের গত দুই বছরের ঋণের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত ৩১ আগস্ট ২০২১ তারিখ পর্যন্ত কমিউনিটি ব্যাংক থেকে ৫৮ হাজার ৬৩২ জন পুলিশ সদস্য স্বল্পসুদে সহজ শর্তে দুই হাজার ৫৫০ কোটি ৭৬ লাখ ৯৬ হাজার টাকা ঋণসুবিধা পেয়েছেন। ঋণ গ্রহীতাদের র্যাংক বিশ্লেষণে দেখা যায়, এসআই থেকে অ্যাডিশনাল ডিআইজি পর্যন্ত পদমর্যাদার চার হাজার ৮১৪ জন পুলিশ সদস্য এই ব্যাংক থেকে মোট ৩৫৩ কোটি ৬৮ লাখ ৩৭ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। পক্ষান্তরে, ৫৩ হাজার ৮১৮ জন কনস্টেবল থেকে এএসআই ও পুলিশের সিভিল এবং নন-পুলিশ সদস্য এই ব্যাংক থেকে মোট দুই হাজার ১৯৭ কোটি আট লাখ ৫৯ হাজার টাকা ঋণসুবিধা নিয়েছেন।
নিম্নপদস্থ পুলিশ সদস্যদের আর্থিক ভরসাস্থল কমিউনিটি ব্যাংক
কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ পুলিশের নিম্নপদস্থ বিশেষ করে কনস্টেবল, নায়েক ও এএসআইদের জন্য এক আর্থিক আশ্রয়ে পরিণত হয়েছে। ব্যাংকের ঋণ বিতরণের তথ্যাদি বিশ্লেষণে দেখা যায়, ব্যাংকের ঋণসুবিধা গ্রহণকারীদের মধ্যে ৯১ দশমিক ৭৯ শতাংশই নিম্নপদস্থ পুলিশ সদস্য। এ ছাড়াও র্যাংক বিবেচনায় কনস্টেবল পদের সর্বোচ্চ ৪৩ হাজার ২৪৭ জন পুলিশ সদস্য, এএসআই র্যাংকের পাঁচ হাজার ৯৩০ জন পুলিশ সদস্য এবং নায়েক র্যাংকের দুই হাজার ৫৪৪ জন পুলিশ সদস্য কমিউনিটি ব্যাংকের ঋণসুবিধা নিয়েছেন। এ হিসাবে এই তিন পদের পুলিশ সদস্যগণ মোট ঋণসুবিধার ৮৮ দশমিক ২১ শতাংশ সুবিধাভোগী।
কমিউনিটি ব্যাংকের ঋণ নিয়ে যেভাবে নিম্নপদস্থ পুলিশ সদস্যগণ লাভবান হচ্ছেন
সরকারি চাকরির গ্রেড বিবেচনায় অনেক ব্যাংক কনস্টেবল থেকে এএসআই পদমর্যাদার পুলিশ সদস্যদের ঋণ দিত না। এজন্য তারা নিজেদের জিপিএফের বিপরীতে ঋণসুবিধা গ্রহণ করত। এই ঋণে ক্ষেত্রবিশেষে পুলিশ সদস্যকে ১৩ থেকে ১৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিতে হতো। এছাড়াও জিপিএফ থেকে ঋণ গ্রহণের পর তা নির্ধারিত মেয়াদের আগে পরিশোধ করাও যেত না; কিন্তু কমিউনিটি ব্যাংক খুবই সহজ শর্তে বিনা জামানতে বেতনের বিপরীতে মাত্র ৯ শতাংশ বা তার চেয়ে কম সুদে ঋণসুবিধা দিয়েছেন। কেউ চাইলে তার জন্য প্রিসেটেলমেন্টের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। এ কারণে কমিউনিটি ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে পুলিশ সদস্যগণ অধিক লাভবান হচ্ছেন। বিষয়টি একটি উদাহরণের সাহায্যে স্পষ্ট করা যাক।
ধরা যাক, একজন পুলিশ কনস্টেবল পারিবারিক আর্থিক সমস্যার কারণে এক লাখ টাকা তিন বছরের জন্য ১৬ শতাংশ সরল সুদে ঋণ নিলেন। এক্ষেত্রে ওই পুলিশ সদস্যকে কমপক্ষে ৪৮ হাজার টাকা সুদ দিতে হবে। পক্ষান্তরে ওই কনস্টেবল যদি কমিউনিটি ব্যাংক থেকে এই পরিমাণ টাকা একই সময়ের জন্য ঋণ নিলে ৯ শতাংশ সুদে তাকে ২৭ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে। এ ছাড়াও পুলিশ সদস্যকে জিপিএফে হাত দিতে হবে না এবং ওই পুলিশ সদস্য চাইলে নির্ধারিত সময়ের আগেও ঋণটি ক্লোজ করতে পারছেন। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরে ঋণসুবিধা থেকে বঞ্চিত নিম্নপদস্থ পুলিশ সদস্যগণ কমিউনিটি ব্যাংকের দিকে বেশি ঝুঁকছেন।
সবার জন্য সমান ব্যাংকিং সুবিধা
কমিউনিটি ব্যাংক সব পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের জন্য বেতন স্কেল অনুযায়ী সমান সুবিধা নিয়ে এসেছে। পুলিশ সদস্যগণ তাদের বেতন স্কেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ঋণসুবিধা পাচ্ছেন। ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ডসহ অন্য সেবাগুলো নায্যতা ও সমতাভিত্তিক করা হয়েছে। পুলিশ সদস্যদের বাইরে বিভিন্ন আকারের ৫০০ ব্যবসায়/উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানে প্রায় এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ ও ঋণ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও কমিউনিটি ব্যাংকের ৫০০ কোটি টাকা সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ আছে। এভাবেই কমিউনিটি ব্যাংক দেশের সামগ্রিক আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলছে।
আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে কমিউনিটি ব্যাংক
আন্তর্জাতিক খ্যাতিপ্রাপ্ত ইনফোসিস কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যারের সফল বাস্তবায়ন কমিউনিটি ব্যাংকের কার্যক্রমকে দিয়েছে মসৃণ গতিময়তা। ইবাইসের মাধ্যমে স্বল্পতম সময়ে বেতনের টাকা গ্রাহক তার ব্যাংক হিসাবে যেমন আনতে পারছেন তেমনি বিকাশ বা নগদের মাধ্যমে তার পরিবার পরিজনের কাছেও অর্থ প্রেরণ করতে পারছেন। আর গ্রাহক এ সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম স্বচ্ছন্দে তার মোবাইল ফোনে কমিউনিটি ক্যাশের মাধ্যমে বিনা খরচে ও দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করতে পারছেন।
বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যদের কল্যাণ নিশ্চিতের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কমিউনিটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হলেও দিনে দিনে এটি গণমানুষের ব্যাংকে পরিণত হচ্ছে। চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক হওয়া সত্ত্বেও ব্যাংকটি যেভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে চলছে, তাতে এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়, আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই কমিউনিটি ব্যাংক দেশের সামগ্রিক আর্থসামাজিক ও ব্যাংকিং সেবা উন্নয়নের অন্যতম বড় প্রভাবক হিসেবে আবির্ভূত হবে।
বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্ন এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘ভিশন-২০৪১’ বাস্তবায়নের অন্যতম সারথি হিসেবে আর্থিক কার্যক্রম পরিচালনায় অঙ্গীকারবদ্ধ কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড।
লেখক : ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ, বাংলাদেশ