ই-পেপার

মুফতী মোঃ আবদুল্লাহ্

সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য, যিনি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানি করা বিধিবদ্ধ করেছেন; যেন তারা তাঁরই প্রদত্ত চতুষ্পদ জন্তু আল্লাহর নামে কুরবানি করতে পারে। তাঁর প্রিয় হাবীব (স) এর প্রতি, তাঁর আল, আসহাব ও আহলে-বায়ত-এর প্রতি অগণিত দুরূদ ও সালাম, যাঁর মাধ্যমে এ কুরবানি করার মাহাত্ম্য, আদর্শ, বিধিবিধান, কল্যাণ, পন্থা-পদ্ধতি শেখার, আমল করার  সৌভাগ্য আমরা পেয়েছি।

কুরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। ভোগের মানসিকতা পরিহার করে ত্যাগের মহিমায় অভ্যস্ত হওয়ার জন্য এটি একটি শিক্ষামূলক ইবাদত। স্বভাবগতভাবে আমরা সব সময় নিজের ভোগ-বিলাসের চিন্তায় মগ্ন থাকি। যে-কারণে ত্যাগের অভ্যাস গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইসলামী শরীয়ত অন্যতম একটি আমল হিসাবে ‘কুরবানি’র বিধান বিধিবদ্ধ করেছে। পশু জবাই এর মাধ্যমে একদিকে আমরা আমাদের সম্পদ তাঁর রাহে ব্যয় করার এবং অপরদিকে আমাদের সত্তার মাঝে লুকিয়ে থাকা পাশবিকতা, দোষ-ত্রুটি, পশু-প্রবৃত্তি বিসর্জন দিতে শিখবো; তাতেই আমাদের কুরবানি সফল ও সার্থক হবে।

প্রিয় পাঠক! জাতীয় ও জন-গুরুত্বপূর্ণ এ লেখাটিকে আমরা তিন অংশে আলোকপাত করবো : এক. করোনা ও কুরবানি, দুই. কুরবানি : ফাযায়েল, তিন. কুরবানি : নিয়ম ও মাসায়েল।

করোনা ও কুরবানি

২০২০খ্রি. শুরুতে করোনা মহামারি শুরু হয়ে মাহে রমজানের ঈদুল-ফিতর পেরিয়ে কুরবানির দিনগুলো কাছাকাছি হওয়ার পূর্ব থেকেইÑ কয়েকদিন ধরে আলেম ও গর-আলেমসহ বেশ কয়েকজন জ্ঞানী-গুণী মানুষ করোনা মহামারির এ পরিস্থিতিতে, ‘এ বছর কুরবানি না করলে হয় না’? Ñমর্মে আমাকে প্রশ্ন করতে থাকেন। এমনকি তাঁদের কেউ কেউ বর্তমান পরিস্থিতিতে কুরবানি করার প্রশ্নে অর্থাৎ না-করার পক্ষে নেতিবাচক অনেক যুক্তি, ওযর-আপত্তি ও তার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে চেষ্টায় মোটেও ক্রুটি করেননি। যে-কারণে মনে হল, এমন দৃষ্টিভঙ্গি তো আরও অনেকেরও হয়ে থাকবে! তাই, ভুল বুঝাবুঝি দূরিকরণার্থে, লেখাটি প্রস্তুত করার এ প্রয়াস। গবেষণামূলক এ লেখাটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও এর বাইরের প্রথমসারির কয়েকজন আলেম গবেষক দেখেছেন, আনন্দিত হয়েছেন, দোয়া ও শুভকামনা করেছেন।

কুরবানি একটি ওয়াজিব আমল। করোনা’র ভয়ে বা তেমন সন্দেহ-সংশয়ের কারণে কুরবানি করা বাদ দেওয়া যাবে না। যেমন কারও সন্দেহ জাগলো যে, ‘কুরবানি’র জন্য যে-পশুটি ক্রয় করবো, তা-ও যদি করোনা রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে?’ অথবা ‘আমি যদি কুরবানি’র জন্তুটি ক্রয়ে বাজারে যাই, আর আমাকেও যদি করোনা রোগে পেয়ে বসে?’ অথবা ‘যাদের দ্বারা কুরবানি’র জন্তুটি কাটা-ছেঁড়া করাবো, তাদের কেউ যদি করোনা রোগে আক্রান্ত রোগী হয়ে থাকে; তবে তো আমাদেরও করোনা হতে পারে!’ Ñইত্যাদি সন্দেহ বা শঙ্কা বা আশঙ্কা’র কারণে কুরবানি’র ওয়াজিব আমল ছেড়ে দেয়া যাবে না; কিংবা কুরবানি রহিত বা মাফ হয়ে যাবে না। তবে হ্যাঁ, অপরাপর কাজ, হাট-বাজার বা অফিস-আদালত আমরা যেভাবে সতর্কতা অবলম্বন করে সম্পন্ন করে থাকি; স্বাস্থ্যবিধি ও সুরক্ষা ব্যবস্থার প্রতি লক্ষ্য রাখি Ñসেভাবেই আমাদের কুরবানিসহ সবকিছুই করে যেতে হবে।

১। ‘শরীয়া আইন’ ও ‘আইন গবেষণা’র নীতি-মূলনীতি’ সামনে রেখে যেসব বিবেচনায় ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত, নফল, হালাল-হারাম ইত্যাদি করা বা না করা বা ওযর-সমস্যায় ছাড় দেওয়া হয়Ñ এর সবকিছুই সেই রাসূল স., সাহাবাগণ ও গবেষক ইমামদের সময় থেকেই নির্ধারিত ও পূর্ব-স্থিরীকৃত হয়ে আছে। সুতরাং শরীয়তের কোনো বিষয়-ব্যাপারই নিজেদের মন মতো করে কিছু বলার বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা ফাতওয়া দেবার সুযোগ ইসলাম ধর্মে নেই। তাই, শরীয়তের সেসব তথ্য-উপাত্ত ও বিধি-বিধানের নিরীখে, কেবল ‘শঙ্কা বা আশঙ্কা বা সংশয়’ বা ‘ধারণা’ বা ‘সন্দেহ-সংশয়’ এর কোনো মূল্য নেই। কেননা, তেমন শঙ্কা, সংশয় ও সন্দেহ তো জাগতিক সর্বক্ষেত্রেও হয়ে থাকে বা থাকতে পারে। যেমন মনে করুন! আপনি রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। এমতাবস্থায় তো শঙ্কা জাগতে পারে যে, ‘পাশর্^বর্তী দেয়ালটি না আবার ভেঙে আমার মাথার ওপর পড়ে যায়!’ রেল-বাস-লঞ্চ বা বিমানে চড়তে গিয়ে সংশয় বা সন্দেহ জাগলো, ‘আরে! বাস-বিমান আবার দুর্ঘটনা কবলিত হয় কি না?’ অথবা ‘লঞ্চটি আবার ডুবে যায় কি না!’ Ñসন্দেহের কারণে কি আমরা এসব জাগতিক কর্মকা- ছেড়ে দেই? কক্ষণও না।

২। অবশ্য শরীয়তে ‘প্রবল সন্দেহ বা শঙ্কা’র মূল্যায়ন আছে। অর্থাৎ যা বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে বা পাওয়া যাচ্ছে বা ঘটে যাচ্ছে এবং তার ‘আলামত-নিদর্শন-সংকেত’ বিদ্যমান। যেমন কিনা ‘পরিস্থিতি বিপদ-সঙ্কুল’ বা ‘আবহাওয়া মারাত্মক খারাপ’ মর্মে সংশ্লিষ্ট সূত্র ও বিভাগ থেকে বলা হচ্ছে- সেক্ষেত্রে আপাতত লঞ্চ ছাড়বে না এবং বিমান উড্ডয়ন করবে না। তেমন পরিস্থিতিতে বরং বিকল্প চিন্তা করা হবে, আপাতত যাত্রা স্থগিত করা হবে; কিন্তু প্রয়োজনীয় যাত্রা বা সফর একেবারে বাদ দেওয়া হবে না।

অর্থাৎ কেবল সাধারণ ও স্বাভাবিক সন্দেহ-সংশয় এর কারণে, প্রয়োজনীয় কাজ, যাতায়াত, বা ইবাদত ইত্যাদি বাদ দেওয়া যাবে না। এমনকি ‘প্রবল সন্দেহ-আশঙ্কা’র ক্ষেত্রেও তা পরিহার করা যাবে না। একইভাবে কুরবানি’র পশুটি যদি অসুস্থ মর্মে দেখা যাচ্ছে বা তেমন কোনো রোগের আলামত পাওয়া যাচ্ছে; কিংবা যারা কাটা-ছেঁড়া করতে এসেছে তাদের কারও আলামত-সংকেত দেখা যাচ্ছে, যেমন প্রচ- হাঁচি-কাশি বা জ¦র- সেক্ষেত্রে তেমন কাউকে মজদুর হিসাবেও নেওয়া যাবে না; কাজে লাগানো হবে না। কারণ, এক্ষেত্রে ‘কেবল সন্দেহ’ নয় বরং ‘প্রবল সন্দেহ’ ও সম্ভাবনা বিদ্যমান; তাই শরীয়তেও তার মূল্যায়ন আছে। যে-কারণে দেখে-শুনে ও সতর্কতা রক্ষা করে কুরবানি করতে হবে; কিন্তু একেবারে বাদ দেওয়া যাবে না; যেমন কিনা অপরাপর কর্মকা- বাদ দেওয়া হচ্ছে না।

উল্লেখ্য, শরীয়তের উক্ত বিবেচনা ও মূল্যায়নকে সামনে রেখেই দেশের বিজ্ঞ আলেম ও মুফতীগণ আলোচ্য ‘করোনা’ এর প্রারম্ভিক কালে নামাজ-জামাত-জুমু‘আ ইত্যাদি একেবারে বাদ বা বন্ধ করার নির্দেশনা প্রদান করেননি; বরং সাবধানতা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সতর্কতা অবলম্বন করে সম্পাদন করতে বলেছেন মাত্র।

৩। আরেকটি ‘পরিস্থিতি বা অবস্থা’ এমন যা ‘নিশ্চিত’  ও ‘অবশ্যম্ভাবী’। অর্থাৎ ‘নিশ্চিত আমি মারা যাব’ বা ‘নিশ্চিত যে, আমার ‘করোনা’ হবেই’; যেমন-‘নিশ্চিত যে, ‘মসজিদে গেলে আমার করোনা হবেই’; কিংবা ‘নিশ্চিত যে, মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হলেই পথিমধ্যে শত্রু আমাকে হত্যা করবেই’; কিংবা ‘এমনকি এ মুহূর্তে বা অমুক নির্দিষ্ট দিনে বা স্থানে বা সময় পর্যন্ত যদি আমি নিজ বাসা-বাড়ি-দোকানেও নামাজে দাঁড়াই, তা হলেও শত্রু অবশ্যই আমার ওপর হামলে পড়বে’।  এমন সব নিশ্চিত পরিস্থিতির ক্ষেত্রে শরীয়তেরই নির্দেশ বা নির্দেশনা হচ্ছে, “আপনি মসজিদে যাবেন না; জামাতে অংশগ্রহণ আপনার জন্যে নয়; এমনকি তেমন পরিস্থিতিতে আপনি বাসা-বাড়িতেও সালাত আদায় করবেন না”। তবে হ্যাঁ, পরিস্থিতি যখন স্বাভাবিক ও শান্ত হবে তখন আপনি সেই নামাজ বা আমল যদি  ফরয বা ওয়াজিব স্তরের হয়; তা কাযা করে নেবেন। আর তা যদি সুন্নাত-নফল স্তরের কোনো আমল হয়, তা হলে সেটি আর কাযাও করতে হবে না এবং তাতে কোনো পাপও হবে না।

এখন বলুন তো, ‘আপনি কি নিশ্চিত যে, উক্তসব অবস্থায় বা এমনিতেই আপনার করোনা-রোগ হবে? অথবা ‘করোনা রোগ’ হলেই, আপনি কি নিশ্চিত যে, আপনি অবশ্যই মারা যাবেন?’ না, না তেমনটি কারও বেলায়ই ‘নিশ্চিত’ নয়; বরং ‘সম্ভাব্য’ অথবা ‘অনেকটা সম্ভাব্য’। সুতরাং শরীয়া আইন গবেষণা’র উক্ত নিয়ম-বিধি অনুযায়ী তিনটি পরিস্থিতি অর্থাৎ ‘সম্ভাব্য বা শঙ্কা-আশঙ্কা’র কোনো মূল্য নেই; তাই বিধি মোতাবেক যাদের ওপর ওয়াজিব, তাদেরকে কুরবানি অবশ্যই দিতে হবে। আর যাদের সঙ্গত কারণে তেমন ‘প্রবল আশঙ্কা’ হবে, তাঁদেরও কুরবানি দিতে হবে। তবে হ্যাঁ, সার্বিক সতর্কতার প্রতিও যতœবান থাকতে হবে; স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। আর আইন-বিধানের তৃতীয় ‘নিশ্চিত’ অবস্থা বা পরিস্থিতি যেহেতু আমাদের ‘করোনা’ পরিস্থিতির ব্যাপারে বলা যাচ্ছে না বা প্রযোজ্য বা প্রয়োগ করা যাচ্ছে না; তাই তেমন চিন্তা-কল্পনাও বাতিল, অবান্তর।

কুরবানি : ফাযায়েল

ঈদুল আযহা’র মর্যাদা: হযরত আনাস ইবন মালিক রা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : জাহেলিয়্যা যুগে প্রতি বছরে দুটি দিন এমন নির্ধারিত ছিল যার মধ্যে তারা খেলাধুলা (আনন্দ-ফূর্তি) উদযাপন করতো। রাসূল স. যখন মদিনায় তাশরীফ আনলেন, ইরশাদ করলেন: “তোমাদের এখানে দু’দিন এমন ছিল যাতে তোমরা খেলাধুলা করতে, আনন্দ-খুশি উদযাপন করতে; মহান আল্লাহ্ আরও শ্রেষ্ঠ দু’দিন দ্বারা তোমাদের ওই দু’দিনকে পরিবর্তন করে দিয়েছেন Ñঅর্থাৎ ঈদুল ফিতরের দিবস এবং ঈদুল আযহা দিবস”। 

কুরবানির অর্থ: আরবী ‘ক্বুরবান’ ও ‘ক্বুরবাতুন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে নৈকট্য লাভ করা, হোক তা পশু কুরবানির দ্বারা বা অন্য কোনোভাবে। একইভাবে ‘কুরবাতুন’ যেসব  নেক আমল দ্বারা মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা হয় যেমন ইবাদত-আনুগত্য, কল্যাণকাজ ইত্যাদিকেও বোঝায়।  বাংলা ভাষায় ‘কুরবানি’ মানে  ত্যাগ, উৎসর্গ করা, পশু কুরবানির মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। তবে হাদিস, ফিকহ-ফাতাওয়া ইত্যাদি গ্রন্থে  ‘কুরবানি’ এর পরিবর্তে ‘উদ্বহিয়্যা’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।

পারিভাষিক অর্থে, “আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য অর্জনকল্পে কুরবানির দিনে যে পশু জবাই করা হয়, তারই নাম ‘কুরবানি’। একই কারণে কুরবানির দিনকে ‘ইয়াওমুল-আদ্বহা’ ও কুরবানির ঈদকে ‘ঈদুল-আদ্বহা’ বলা হয়।”।

ফাযাইল: (১) মহানবী (স) ইরশাদ করেন:

“ঈদুল-আযহা’র দিনগুলোতে মহান আল্লাহর কাছে আদম-সন্তানদের সর্বাধিক প্রিয় আমল হচ্ছে, তাদের পশু কুরবানি করা। আর এ পশুর শিং, লোম ও খুর কিয়ামত দিবসে তার পক্ষে (সাক্ষী হিসাবে) উপস্থিত হবে। এ কুরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার পূর্বেই, আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা সন্তুষ্টচিত্তে কুরবানি করো।

(২) আরেকটি হাদীসে এসেছে:

“সাহাŸাগণ জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (স)! এ কুরবানি’র স্বরূপ কি? মহানবী (স) উত্তরে বললেন, “এটা হচ্ছে তোমাদের পিতা ইবরাহীম (আ)-এর সুন্নাত-আদর্শ।” সাহাবাগণ পুনঃ আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (স)! এতে আমাদের কি লাভ হবে? নবীজী (স) উত্তরে বললেন, “তার প্রত্যেকটি লোমের বিনিময়ে এক-একটি করে পুণ্য রয়েছে”। তাঁরা পুনঃ আরজ করলেন, পশমের (ভেড়া ও দুম্বা) ক্ষেত্রেও? তিনি জবাব দিলেন, এগুলোরও প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকী রয়েছে”।

(৩) মহানবী (স) আরও ইরশাদ করেন:

“যার কুরবানি করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সে কুরবানি না করে, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে”।

(৪) হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা) বলেছেন:

“ঈদুল-আযহা দিবসের পরেও আরও দু‘দিন কুরবানি করা যায়। একই রকম বর্ণনা হযরত আলী (রা)-সূত্রেও বিদ্যমান”।

একই রকম বর্ণনা হযরত ইবন আব্বাস রা. ও হযরত আনাস রা. থেকেও উদ্ধৃত হয়েছে।

কুরবানি : নিয়ম বা মাসাইল

কুরবানি কার ওপর ওয়াজিব? যাদের ওপর জাকাত বা ফেতরা ওয়াজিব হয়ে থাকে তাদের ওপর কুরবানিও ওয়াজিব।  তবে পার্থক্য শুধু এটুকু যে, জাকাতের ক্ষেত্রে নিসাব পরিমাণ সম্পদ সারা বছর হাতে থাকা শর্ত; আর ফেতরা ও কুরবানি’র ক্ষেত্রে যথাক্রমে ঈদুল-ফিতরের দিন সোবহে সাদেকের সময় এবং কুরবানি’র তিনদিন ওই পরিমাণ সম্পদের মালিক হলেই, ফেতরা ও কুরবানি ওয়াজিব হয়ে থাকে।

‘নিসাব’ মানে? নিসাব মানে জাকাত বা ফিতরা বা কুরবানি প্রদানযোগ্য সুনির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ। আর যিনি এই সুনির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিক হন তাঁকে বলা হয় ‘মালিকে নিসাব’ অর্থাৎ কুরবানি ইত্যাদি দান যোগ্য একজন সম্পদশালী। কেবল স্বর্ণের ক্ষেত্রে নিসাব হচ্ছে ৭.৫ তোলা স্বর্ণ যা বর্তমান হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৮৭.৫ গ্রা. বা ৮৮ গ্রাম স্বর্ণ হয়; এবং কেবল রৌপ্যের ক্ষেত্রে নিসাব হচ্ছে ৫২.৫ (সাড়ে বায়ান্ন) তোলা রূপা, যা বর্তমান হিসাব মতে প্রায় ৬১৩ গ্রাম রৌপ্য হয়।

উল্লেখ্য, ১। শরীয়তের হিসাব মোতাবেক ৭.৫ সাড়ে ভরি সোনার যে কথা বলা হয়, তাতে প্রতি ভরি হয়ে থাকে ১২গ্রাম স্বর্ণে (প্রায়) অথচ বর্তমানে প্রতি ভরি স্বর্ণে থাকে ১০ গ্রাম স্বর্ণ।  সে হিসাবে বর্তমানে তা হবে ৮ভরি ৭গ্রাম তথা ৮৭.৫গ্রাম প্রায়। সুতরাং স্বর্ণের ক্ষেত্রে এর চেয়ে কম স্বর্ণ থাকলে জাকাত বা কুরবানি ফরয/ওয়াজিব হবে না।

২। একইভাবে রূপার ক্ষেত্রে মূল হিসাবে ৬১২ গ্রাম+৩৬০মি. গ্রাম. অর্থাৎ সামান্য কম ৬১৩ গ্রাম, তাই আমরা বুঝা ও মনে রাখার সুবিধার্থে পুরো ৬১৩ গ্রামই দেখালাম। এর চেয়ে কম রূপা থাকলে যাকাত বা কুরবানি ইত্যাদি ফরয/ওয়াজিব হবে না। 

সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুকীম সাবালক মুসলমান (নর-নারী) এর ওপর প্রতি বছরই কুরবানি করা ওয়াজিব।

‘সামর্থ্যবান’ বলতে যিনি ‘হওয়ায়েজে আসলিয়া’ তথা দৈনন্দিন জীবনের নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচাদি বাদেও কুরবানির দিনগুলোতে ৮৭.৫ সাড়ে সাতাশি গ্রাম সোনার বা ৬১৩গ্রাম রূপার কিংবা এর কোনো একটির মূল্যের সমপরিমাণ অর্থ-সম্পদের মালিক হবেন তাঁর ওপর কুরবানি করা ওয়াজিব বলে গণ্য হবে।

কুরবানির সময় : ১০ই যিলহাজ্জ  ফজরের পর হতে ১২ই যিলহাজ্জ সন্ধ্যা পর্যন্ত মোট এ তিনদিন কুরবানি করার সময়।  তবে প্রথমদিনে বেশি সওয়াব পাওয়া যায়।

১। বিধি মোতাবেক যেখানে জুমু‘আ ও ঈদের সালাত জরুরি হয়ে থাকে সেখানে ঈদের সালাতের পূর্বে কুরবানি করা বৈধ নয়। আর যেখানে বিধি মোতাবেক ঈদের জামাত জরুরি হয় না সেখানে ফজরের পরেই কুরবানি করা যায়। 

২। নিজের কুরবানির পশু নিজহাতে জবাই করা উত্তম; তবে মেয়েলোক হলে অথবা অন্য কোনো কারণে অপর কাউকে দিয়ে জবাই করলেও বাধা নেই। অবশ্য সাহস থাকলে মেয়েলোক নিজেও নিজ কুরবানির পশু জবাই করতে পারে। 

৩। কুরবানির পশু জবাই করার সময় মুখে নিয়ত করা বা দু‘আ উচ্চারণ করা জরুরি নয়; করলে ভালো।  তাই কেবল অন্তরে নিয়ত রেখে মুখে সশব্দে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করলেই কুরবানি সহীহ-শুদ্ধ হয়ে যায়।   

৪। কুরবানি শুধু ব্যক্তির নিজের ওপর ওয়াজিব হয়। পুত্র-কন্যা বা স্ত্রীর কুরবানিযোগ্য নিজস্ব সম্পদ থাকলে, তাদের কুরবানি পৃথকভাবে তাদের ওপর ওয়াজিব হবে। তাই পূর্ব-আলোচনা ব্যতীত এবং একে-অপরকে দায়িত্ব বা অনুমতি প্রদান ব্যতীত কুরবানি করলে তা শুদ্ধ হবে না। 

৫। সন্তান নাবালক হলে তার ওপর কুরবানি ওয়াজিব নয়। সুতরাং নাবালকের সম্পদ থাকলেও তা থেকে কুরবানি করা বৈধ নয়। তবে পিতা বা অন্য কেউ নিজের সম্পদ দ্বারা তেমন নাবালকের পক্ষে কুরবানি করলে, তা হবে নফল কুরবানি। একইভাবে যার ওপর কুরবানি ওয়াজিব সে নিজের ওয়াজিব পরিহার করে স্ত্রী/বাবা-মা বা অন্য কারও নামে কুরবানি করলে তাও শুদ্ধ হবে না। 

৬। সঠিক নিয়ম হল, যাদের একাধিক পশু বা সাতজন শরিক হতে পারে এমন বড় একটি পশুর একাধিক শেয়ারের সক্ষমতা রয়েছে; তাঁরা প্রথমে নিজের ওয়াজিব পালনে একটি পশু বা একটি শেয়ার প্রদানের পর অবশিষ্ট পশু বা শেয়ারগুলো স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, বাবা-মা, দাদা-দাদি, শ্বশুর-শাশুড়ি, পীর-উস্তাদ এবং রাসূল স. এর নামেও কুরবানি করতে পারেন।

সুতরাং, নিজের ওয়াজিব পালনের পাশাপাশি সামর্থ্য থাকলে, নফল হিসাবে মহানবী (স)-এর নামে, জীবিত বা মৃত পিতা-মাতা, দাদ-দাদি, শ্বশুর-শাশুড়ি, পীর-উস্তাদ প্রমুখের পক্ষেও কুরবানি করা অনেক উত্তম।  এতে তাঁদের আমলনামায়ও বিশাল অঙ্কের সওয়াব যোগ হবে। উদাহরণবশত, যারা এককভাবে এক বা একাধিক পশু বা একাধিক অংশ কুরবানি করেন, তাঁরা একটি বা এক নাম নিজের ওয়াজিব হিসাবে দিয়ে অবশিষ্ট অংশে পিতা-মাতা, স্ত্রী প্রমুখের নামে দিতে পারেন।

৭। উল্লেখ্য, ‘নামে’ বলতে অনেকে আবার প্রশ্ন করেন, ‘কুরবানি তো একমাত্র আল্লাহ্র নামেই হওয়ার কথা?’ তার জবাব হল, আসলে সাধারণ জনগণের বাক্যালাপের প্রচলিত বাকধারায় এবং বোঝার স্বার্থে বলা হয়ে থাকে, ‘অমুকের নামে’; কিন্তু মূলত এর উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, অমুকের নামে অর্থ ‘অমুকের পক্ষে বা পক্ষ থেকে’ কুরবানি করা হচ্ছে। আর ‘আল্লাহ্র নামে’ বলতে, ‘তাঁর উদ্দেশ্যে বা তাঁকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে’। মনে রাখা চাই যে, শরীয়া আইন গবেষণা’র মূলনীতিতে বলা হয়েছে-

অর্থাৎ “সর্ব-সাধারণ, জনগণ যেসব শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করে এবং কথা বলে থাকে; তাতে তাদের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য কী? Ñশরীয়া আইনের বিবেচনায় সেটাই ধর্তব্য; তারা মুখে শব্দ বা বাক্য কি বললো, তা ধর্তব্য নয়”।  সুতরাং এসব নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অবকাশ শরীয়তে নেই।

৮। কেউ ১০ই যিলহজ বা ১১ই যিলহজ পর্যন্ত সফরে ছিল বা গরিব ছিল; ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বে বাড়ি পৌঁছেছে বা সম্পদশালী হয়েছে অথবা সফররত অবস্থায় কোথাও ১৫দিন অবস্থানের নিয়ত করেছে; এমতাবস্থায় তাঁর ওপর কুরবানি ওয়াজিব হয়ে যাবে।

৯। কারও কুরবানি ওয়াজিব ছিল কিন্তু কুরবানির তিনটি দিনই অতিবাহিত হয়ে গেল, সে কুরবানি করলো না বা করতে পারলো না। তা হলে এমতাবস্থায় একটি ভেড়া বা ছাগলের মূল্য দান করে দিবে। যদি ছাগল বা ভেড়া ইত্যাদি ক্রয়ও করে থাকে, সেক্ষেত্রে ওই পশুটিই আস্ত বা জবাই করে গরিব-মিসকিনদের বণ্টন করে দিতে হবে। 

‘কাযা কুরবানি’ বা যে কুরবানি ১০-১২ এ তিনদিনের মধ্যে জবাই করতে পারবে না Ñএমন কুরবানির জন্তুর গোশত নিজে বা ধনী কেউ খেতে পারবে না। মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়াতে এমন জন্তু ওয়াজিব সাদকা ও মান্নতের পশুর কাতারে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।

১০। কারও ওপর বিধি মোতাবেক গরিব হওয়াতে কুরবানি ওয়াজিব নয়; কিন্তু সে নিজে ইচ্ছা-নিয়ত করেই কুরবানি দানের জন্য পশু ক্রয় করেছে Ñসেক্ষেত্রে মূলে তার ওপর ওয়াজিব না থাকলেও এখন সে নিজেই নিজের ওপর তা আবশ্যক করে নিয়েছে। কেননা শরীয়তের বিধান মতে কেউ নফল কাজের নিয়ত করে তা শুরু করলে সেটি তখন তার ওপর ওয়াজিব হয়ে যায়।

১১। কেউ কোন উদ্দেশ্য পূরণের নিয়তে কুরবানি করার মান্নত করেছিল; এতে তার উদ্দেশ্য পূর্ণ হল, তা হলে সেক্ষেত্রে তাঁর পক্ষে কুরবানি করা ওয়াজিব বলে গণ্য হবে এবং এমন মান্নতের কুরবানির গোশত কেবল গরিব লোকজনই খেতে পারবে। নিজেও খেতে পারবে না এবং ধনী কারও জন্যও তা খাওয়া জায়েয হবে না। 

১২। কেউ নিজ সন্তুষ্টি মতে কোনো মৃত ব্যক্তির রূহে সওয়াব পৌঁছানোর নিয়তে নফল কুরবানি দান করলে সেই কুরবানির গোশতের বিধান সাধারণ কুরবানির মতোই অর্থাৎ নিজে, ধনী-গরিব সকলেই তার গোশত খেতে পারবে।

১৩। তবে এমন যদি হয় যে, কোনো মৃত ব্যক্তি মৃত্যুর পূর্বে কুরবানি করার ওসিয়ত করে গিয়েছিল এবং তার ওয়ারিসগণ সেই ওসিয়ত বাবদ কুরবানি যবাই করেছে। তা হলে এমন কুরবানির গোশতও নিজেরা খেতে পারবে না এবং ধনী কাউকে খেতে দিতে পারবে না।

কুরবানির পশু

১। ছাগল, খাসি, পাঠা, দুম্বা, ভেড়া নর-মাদি জন্তুতে শুধু একজন বা এক নামেই কুরবানি করা বৈধ হয়। আর গরু, মহিষ ও উট Ñএ তিন প্রকারের জন্তুতে এককভাবে অথবা সর্বোচ্চ সাতজনে  মিলে কুরবানি দেওয়া বৈধ হয়। তবে শরিকদের কারও অংশ এক-সপ্তমাংশের কম হলে কুরবানি শুদ্ধ হবে না।

শরিকী কুরবানি ও হাদিস : আবার শরিকদের কারও অংশ যদি পশুটির অর্ধেক হয় বা এক-তৃতীয়াংশ হয় অর্থাৎ দু’জনে বা তিনজনে সমান হারে কুরবানি দিচ্ছেন তাতেও কোন সমস্যা নেই; বরং ভালো। মোটকথা একজন শরিকের অংশ যেন এক-সপ্তমাংশের কম না হয়; সেটাই মূল বিবেচ্য ও ধর্তব্য। 

হযরত জাবির ইবন আবদুল্লাহ্ আনসারী রা. থেকে বর্ণিত, “আমরা তাকবীর-তালবিয়া পাঠরত অবস্থায় রাসূল স. এর সঙ্গে হজে বের হলাম। রাসূল স. আমাদের নির্দেশ দিলেন আমরা যেন উট ও গরুর মধ্যে শরিক হয়ে যাই Ñআমাদের প্রতি সাতজন করে একটি পশুতে”। 

“হযরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত, মহানবী স. ইরশাদ করেছেন : গরু সাতজনের পক্ষ থেকে এবং উটও সাতজনের পক্ষ থেকে যথেষ্ট হবে, বৈধ হবে”।

২। ভেড়া, ছাগল-খাসি, দুম্বা ইত্যাদির ক্ষেত্রে জন্তুটির কমপক্ষে এক বছর বয়স হওয়া চাই। তবে সমস্য ও পশু-সংকট থাকলে দুম্বার ক্ষেত্রে মোটা-তাজা ছয় মাসোর্ধ্ব হলেও জায়েজ হয়ে যাবে অর্থাৎ দেখতে যদি এক বছর বয়সি দুম্বার মতো মনে হয়। ছাগল-ভেড়া ইত্যাদির ক্ষেত্রে মোটাতাজা মনে হলেও এক বছরের কম বয়সে শুদ্ধ হবে না। গরু, মহিষ এর ক্ষেত্রে কমপক্ষে দু’বছর বয়সের হওয়া চাই এবং উটের ক্ষেত্রে কমপক্ষে পাঁচ বছর বয়সের হওয়া চাই। 

৩। কুরবানির জন্তুটি সুস্থ সবল ও ত্রুটিমুক্ত হওয়া চাই। যদি সামান্য ত্রুটি থাকে যেমন কান বা লেজের এক-তৃতীয়াংশের চেয়ে কম কাটা হয় Ñইত্যাদি, তাতেও কুরবানি শুদ্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু যদি অধিক দোষ-ত্রুটি থাকে, সেক্ষেত্রে মোটেও কুরবানি সহীহ হবে না।

৪। কুরবানির জন্তু ক্রয় থেকে শুরু করে রক্ষণাবেক্ষণ, ঘাস খাওয়ানো, জবাই, বণ্টন ইত্যাদি সর্বপ্রকার যৌথ খরচ, দায়-দায়িত্ব আনুপাতিক হারে সকল অংশীদারকে বহন করতে হবে; নতুবা কুরবানি সহীহ হবে না। অংশ অনুপাতে সমান হারে গোশত ইত্যাদি বণ্টন করতে হবে; তবে সম্মতি সাপেক্ষে পায়া/মাথা/ভুঁড়ি কোন শরিক যদি না নেয় বা কম নেয়, তাতে কোন সমস্যা নেই।

৫। যে জন্তুটি এ পরিমাণে খোঁড়া যে, তিন পায়ে চলে থাকে চতুর্থ পা মাটিতে রেখে ভর দিতেও পারে না Ñএমন জন্তুর দ্বারা কুরবানি সহীহ হবে না। তবে হ্যাঁ, যদি এমন খোঁড়া হয় যে, ওই খোঁড়া পা দ্বারাও ভর দিতে পারে তা হলে এমন পশু দ্বারাও কুরবানি সহীহ হয়ে যাবে; যদিও সামর্থ্য থাকা সাপেক্ষে অধিক উত্তম হবে, সম্পূর্ণ সুস্থ ও সবল একটি পশু কুরবানি প্রদান করা।

৬। যে জন্তুটির একেবারেই দাঁত নেই (অর্থাৎ বৃদ্ধ হয়ে সব পড়ে গেছে) এমন পশুর দ্বারা কুরবানি জায়েজ হবে না। তবে এমন যদি হয় যে, যে-কয়টি পড়ে গেছে তার চেয়ে বেশি সংখ্যক বিদ্যমান আছে; তা হলে সেক্ষেত্রে তার দ্বারা কুরবানি জায়েয হবে।

৭। যে জন্তুটির জন্মগতভাবেই শিং উঠেনি কিংবা উঠেছিল এবং আগা থেকে ভেঙে গেছে, তার দ্বারাও কুরবানি সহীহ হবে; তবে শিং যদি গোড়া থেকেই উপড়ে যায়, সেক্ষেত্রে তার দ্বারা কুরবানি শুদ্ধ হবে না।

৮। হৃষ্টপুষ্ট করার জন্যে জন্তুটিকে খাসি বানিয়ে দিলে, এটিকে দোষরূপে গণ্য করা হয় না এবং তেমন জন্তুর কুরবানিও জায়েজ হয়ে থাকে।

৯। সুস্থ জন্ত ক্রয়ের পর তার মধ্যে এমন কোনো দোষ বা রোগ দেখা দিল, যে কারণে তার দ্বারা কুরবানি সহীহ হয় না। সেক্ষেত্রে তার পরিবর্তে আরেকটি জন্তু ক্রয় করে কুরবানি দিতে হবে। তবে লোকটি গরিব হলে, সেটি দ্বারাই তার কুরবানি হয়ে যাবে।

গোশত

১। কুরবানির গোশত কুরবানিদাতা, ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ সকলেই খেতে পারে।  এমনকি অমুসলিমদেরও তা প্রদান বা আহার করা বৈধ। 

২। তবে জাকাত, ফেতরা ও কুরবানির চামড়া ইত্যাদি বাধ্যতামূলক দানগুলো অমুসলিমদের প্রদান বৈধ নয়। সুতরাং কুরবানি’র গোশত কোনো অমুসলিমকে প্রদান বৈধ হয় বিধায় তার ওপর ভিত্তি করে কোনো অমুসলিমকে জাকাত ইত্যাদি প্রদান বৈধ মনে করা যাবে না। 

৩। তা ছাড়া, কুরবানির গোশতের ক্ষেত্রে সাধারণ বিধান হচ্ছে, তা তিন ভাগ করে একভাগ নিজে, একভাগ স্বজনদের এবং একভাগ গরিবদের প্রদান ‘মুস্তাহাব’ তথা ভালো।  কিন্তু প্রয়োজনে তার ব্যতিক্রম বা কমবেশি করলেও কোনো পাপ হবে না। অবশ্য, যত বেশি পরিমাণ গরিবদের দেওয়া হবে ততবেশি উত্তম ও অধিক সওয়াব পাওয়া যাবে।

৪। মান্নতের কুরবানি, ওসিয়্যত পালনের কুরবানি এবং যার ওপর কুরবানি ওয়াজিব ছিল কিন্তু বিশেষ কোনো কারণবশত কুরবানির সুনির্দিষ্ট তিন দিনে তা পালন করতে না পারায়, পরে তা কাযা করছেনÑ সেক্ষেত্রে এ তিন প্রকার কুরবানির গোশত নিজে বা ধনী কাউকে দান বা আহার করা বা করানো বৈধ নয়। তা কেবল গরিবদের মাঝেই বণ্টন করতে হবে।

৫। কুরবানি+আকীকা: “ছেলে সন্তান হলে আকীকায় দুটি ছাগল বা দুটি ভেড়া ইত্যাদি; আর মেয়ে হলে একটি ছাগল বা একটি ভেড়া জবাই করার নিয়ম। কিংবা কুরবানি’র গরু ইত্যাদির মধ্যে ছেলের জন্য দু’অংশ আর মেয়ে’র জন্য এক অংশ বা শেয়ার নিতে পারে। তেমন সচ্ছল না হলে বা সামর্থ্যে না কুলালে ছেলের জন্যও একটি ছাগল বা কুরবানিতে এক অংশও নিতে পারে”।

৬। যেসব জন্তু দ্বারা কুরবানি শুদ্ধ হয় তা দ্বারা আকিকাও শুদ্ধ হয়ে থাকে; আর যেসব পশু দ্বারা কুরবানি জায়েজ হয় না, তা দ্বারা আকিকাও জায়েয হয় না। 

৭। তবে কুরবানি যাদের ওপর ওয়াজিব বলে গণ্য; তারা কুরবানি বাদ দিয়ে আকিকা করলে, তা শুদ্ধ হবে না। কারণ, আকিকা ওয়াজিবও নয়, সুন্নাতে মুয়াক্কাদাও (গরিবদের জন্যও নয়) নয়; বরং তা সুন্নাতে গায়রে-মুয়াক্কাদা’ পর্যায়ের। যে-কারণে অসমর্থ কেউ আকিকা না দিলে, তার কোন পাপ হয় না, ইত্যাদি।

৮। কুরবানির অনুরূপ আকিকার গোশতও আকিকাদাতা নিজে, স্ত্রী-কন্য, ছেলে-মেয়ে, আপন-পর, ধনী-গরিব, সকলকে বণ্টন করে দেওয়া যায়, রান্না করে খাইয়ে দেওয়া যায়। 

৯। কুরবানির চামড়া: কুরবানির পশুর চামড়া বিক্রয়ান্তে তা কেবল ফকির-মিসকিনের হক হয়ে যায়। যে-কারণে চামড়ার মূল্য একমাত্র তাদেরকেই দেওয়া যাবে যারা বিধি মোতাবেক জাকাত, ফেতরা গ্রহণ করতে পারে। 

১০। কোন ধনী বা সচ্ছল ও অমুসলিম ব্যক্তিকে যেমনিভাবে জাকাত, ফেতরা দেয়া যায় না; কুরবানির চামড়ার অর্থও এদের কাউকে দেওয়া যায় না। একইভাবে তা ব্যাপক জনকল্যাণমূলক যৌথ কোনো কাজে বা প্রতিষ্ঠানের কাজে লাগানোর জন্যেও প্রদান করা জায়েজ নয়। তবে এসব প্রতিষ্ঠান বা সমিতি-সংস্থার তত্ত্বাবধানে যদি কোনো গরিব-দরিদ্র লোকজন বা ছাত্র-শিক্ষার্থী থাকে তাদেরকে প্রদান করা জায়েজ; এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে অর্থাৎ যারা দরিদ্র অথচ ধর্মীয় কাজে বা শিক্ষায়রত তাদেরকে তা প্রদান করা উত্তমও বটে।

উদাহরণবশত, মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা, হাসপাতাল বা কোনো সমিতি, সংস্থাকে তাদের নির্মাণকাজ বা বেতন ইত্যাদি বাবদ তা দেওয়া যাবে না। কেননা, এসব ক্ষেত্রে বিধি মোতাবেক সুনির্দিষ্ট বৈধ ব্যয়খাত হিসাবে সংশ্লিষ্ট গরিব অসহায়দের সরাসরি মালিক বানিয়ে দেওয়ার যে-শর্ত অবশ্য পালনীয়; তা পালিত হয় না এবং সম্ভবও হয় না। অবশ্য মাদরাসা, মসজিদ বা এতিমখানার গরিব ছাত্র-ছাত্রীদের, গরিব শিক্ষক/ ইমাম/ মুয়াজেন/ খাদেম প্রমুখকে প্রদান করা বৈধ হয়। কিন্তু এদের কাউকেও তা বেতন বা পারিশ্রমিক বিবেচনায় প্রদান করা জায়েয নয়।

১১। কুরবানির পশু জবাই করার নিয়ম: কুরবানি করার নিয়ম হচ্ছে, জন্তুটিকে কিবলামুখী শায়িত করে যথাসাধ্য অধিক ধারালো চুরি বা চাকু দ্বারা জবাই করবে। ‘ইন্নি ওয়াজ্জাহতু………’ আরবী দু‘আটি পাঠান্তে, কার কার বা কয়জনের পক্ষে কুরবানি হচ্ছে তা পূর্বে জেনে নিয়ে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করবে। 

১২। জবাই-পূর্ব মুহূর্তে যেমন মনে থাকবে, “হে আল্লাহ! আপনিই এ পশু সম্পদ দিয়েছেন এবং আপনার নামেই তা কুরবানি করছি”। একইভাবে জবাই শেষে বলবে, “হে আল্লাহ! এ কুরবানিকে সেভাবে কবুল করে নিন, যেভাবে তা আপনার হাবীব হযরত মুহাম্মদ (স) ও আপনার খলীল হযরত ইবরাহীম (আ)-এর পক্ষ থেকে কবুল করেছিলেন”।

মহান আল্লাহ আমাদের জেনে-শুনে, নিষ্ঠাপূর্ণ ও সহীহভাবে কুরবানি করার তাওফিক দিন। আমীন!

  লেখক : গ্র্যান্ড মুফতী   ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ

ভালো লাগলে শেয়ার করে দিন :)

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x