ই-পেপার

ডাঃ ওয়াজেদ শামসুন্নাহার দিশা

বিশ্বব্যপী মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে করোনা ভাইরাস। এর সর্বগ্রাসী ছোবলে এখন পর্যন্ত চার লক্ষাধিক মানুষ পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছেন, আক্রান্ত হয়েছেন সত্তর লক্ষাধিক মানুষ। প্রতিনিয়ত বাড়ছে মৃত ও আক্রান্তের পরিসংখ্যান।

ভাইরাসটি বিশ্ববাসীর কাছে এক মহা আতঙ্কের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা গোটা বিশ্বের স্বাভাবিকতার মারাত্মক ছন্দপতন ঘটিয়েছে। বিশ্বব্যাপী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রায় মুখ থুবড়ে পড়েছে।

বলা হচ্ছে চীনের উহান থেকে শুরু হয়ে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসটি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে আটলান্টিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের দুপারের প্রায় ২১৫ টি দেশে কমবেশি বিস্তার ঘটেছে করোনা তথা কোভিড-১৯ ভাইরাসের। ইতোমধ্যেই ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের তাবৎ ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো ভাইরাসের তান্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। এক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই মৃতের সংখ্যা লক্ষাধিক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশ মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। সংস্থাটি এমন কথাও বলেছে যে করোনা হয়তো পৃথিবী থেকে কখনোই নির্মূল হবে না!

তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে মুক্ত গণমাধ্যমের কল্যানে আমরা ঘরে বসেই পুরো পৃথিবীর করোনা আপডেট জানতে পারছি। মানুষ টেলিভিশনের পর্দায় করোনা ভাইরাসের আক্রমণে মারা যাওয়া মৃতদের কফিনের দীর্ঘ মিছিল দেখে আতঙ্কিত হচ্ছেন। সংক্রমণের আশঙ্কায় স্বজনদের মরদেহ থেকে নিরাপদ দুরত্বে অবস্থান করার ঘটনাগুলো জনমনে ভীতি সঞ্চার করেছে। সব মিলিয়ে অধুনা এই প্রাণঘাতী ভাইরাস গোটা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে জাতীয়তা, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষ এক কাতারে নিয়ে এসেছে। মানুষের মধ্যে তৈরী হয়েছে চাপা আতঙ্ক। আজ পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে কেবল প্রাণ বাঁচানোই মানুষের একমাত্র চাওয়া।

করোনা ভাইরাসের মরণকামড় থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পৃথিবীর বড় বড় গবেষণাগারে চলছে প্রতিষেধক আবিস্কারের জন্য বিজ্ঞানীদের সীমাহীন ব্যস্ততা। তবু এখন পর্যন্ত বলার মতো কোন আবিস্কারের খবর পাওয়া যায়নি। অতীতের মতো এক সময় অবশ্যই মানুষ জিতে যাবে, আবিস্কৃত হবে জীবনরক্ষাকারী প্রতিষেধক। সুতরাং, আমাদের অপেক্ষা করার বিকল্প নেই।

এই চরম বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমাদের করণীয় সম্পর্কে আলোকপাত করতে চাই। আমরা কি কখনও জানতে চেষ্টা করেছি সারা বিশ্বে করোনায় কত মানুষ মারা যাচ্ছেন ও করোনার বাইরে সড়ক দূর্ঘটনা ও অন্যান্য রোগে কত মানুষ মৃত্যুবরণ করছেন। চলুন চলতি বছরের শেষ তিন মাসে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর পরিসংখ্যানটা দেখে নেওয়া যাক।

পরিসংখ্যানের কিছু পদ্ধতিগত ত্রুটি রয়েছে সত্য। তারপরেও আপনি নিশ্চয় অবাক হচ্ছেন এটা দেখে যে সারাবিশ্বে গত তিন মাসে করোনায় যত মানুষ মারা গেছেন সেই সংখ্যার চেয়েও আট লক্ষের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন শুধুমাত্র ক্যন্সারে আক্রান্ত হয়ে। গত তিন মাসে করোনায় মৃতের সংখ্যা অপেক্ষা প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ বেশি মারা গেছেন কেবল ধূমপানজনিত সৃষ্ট নানাবিধ রোগে। শুধু তাই নয়। করোনায় মৃত্যুর চেয়েও দুই লক্ষাধিক মানুষ বেশি মারা গেছেন মদ্যপানের কারণে। এমনকি পরিসংখ্যান বলছে সাধারণ ফ্লু থেকেও যে সংখ্যক মৃত্যু হচ্ছে তা করোনায় মৃত্যুর থেকেও অর্ধলক্ষাধিক বেশি। যদি সড়ক দূর্ঘটনার কথা বলি, তাহলে দেখবো গত তিন মাসে করোনার চেয়েও প্রায় ৭০ হাজার মানুষ বেশি মারা গেছেন কেবল সড়ক দূর্ঘটনায়।

এই যখন বাস্তবতা, তখন জীবন-মৃত্যু নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে বৈকি। গত তিন মাসে বিশ্বব্যপী করোনাভাইরাসে যত মানুষ মারা গেছেন তার চেয়েও বহুগুণ মানুষ মারা গেছেন সড়ক দূর্ঘটনা, ধূমপান, মদ্যপান ও ক্যান্সারে।

করোনা বা কোভিড-১৯ ভাইরাসের সঙ্গে মানুষের যুদ্ধ চার মাসের বেশি সময়ের। তবে আশার কথা হলো ইতোমধ্যে অনেক দেশই ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে। অনেক দেশই লকডাউন শিথিল করে স্বাভাবিক কর্মকান্ড শুরু করেছে। বাংলাদেশ সে পথেই এগুচ্ছে। এই তালা খোলা ঠিক না বেঠিক তা নিয়েও পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যখন বলে আরও বহুদিন লড়াই করতে হবে ভাইরাসের বিরুদ্ধে তখন ভাবতে হয় আর কতদিন চলবে এই বন্দীত্ব।

ইতোমধ্যেই অনেকেই ঘরে আটকে না থেকে ভাইরাসের সঙ্গে বসবাস করে পেশাগত দায়িত্বে ফিরে আসার পরিকল্পনা করছেন। করোনা আমাদের পথচলা থামাতে পারেনি। জীবনের তাগিদে আমাদের ঘরের বাইরে যেতেই হচ্ছে। করোনার সাথে খাপ খাইয়েই আমরা বসবাস করছি। এই অদৃশ্য শত্রুর হাত থেকে বাঁচতে হলে আমি সহজভাবে বলবো করোনাকে আমরা উপেক্ষা করতে পারবোনা- এটা যেমন সত্য, তেমনি করোনা আতঙ্কে আমরা আমাদের সব উৎপাদনশীল কাজ কর্ম বন্ধ করে দিয়ে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবো- এটাও অযৌক্তিক। রোগ-ব্যাধি আগেও ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভাবিষ্যতেও থাকবে। আমরা এখন পর্যন্ত ফ্লু, ম্যালেরিয়া, এইচআইভি, ক্যান্সার প্রভৃতি রোগের সাথে বসবাস করছি! এভাবে হয়তো করোনার সাথেও আমাদের বসবাস করতে হবে।

পরিসংখ্যান আমাদের আশাবাদী করে তোলে এজন্য যে করোনা আক্রান্তদের মৃত্যুর হার মাত্র ২ শতাংশের কম যেখানে এর আগে সংক্রমিত হওয়া সার্স ভাইরাস ও সোয়াইন ফ্লুতে মৃত্যু হার ছিলো যথাক্রমে ১০ ও ২৮ শতাংশ। একথা বললে মোটেও অত্যুক্তি হবেনা যে করোনা তেমন প্রাণঘাতী নয় যদিও প্রত্যেকটি মৃত্যুই অনাকাক্ষিত।

এই অবস্থায় আমরা আতঙ্কিত হয়ে আমাদের সম্প্রসারণশীল অর্থনীতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারিনা। আসুন অযথা আতঙ্কিত না হয়ে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে সচেতন হই, সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে দৈনন্দিন কাজ কর্ম শুরু করি। অযথা ঘোরাঘুরি ও আড্ডা বন্ধ করে করে গঠনমূলক কাজে সময় ব্যয় করি এবং পরিস্কার পরিচ্ছন্ন জীবনধারা অনুসরণ করি। হয়তো এই করোনাই শুদ্ধাচার চর্চাকে আমাদের আচরণের অংশে পরিণত করে দেবে।

পরিশেষে বলবো, আমাদের সচেতনতা ও বাস্তব উপলব্ধিই হতে পারে এই মুহূর্তে ভাইরাস প্রতিরোধের মূল হাতিয়ার।

লেখক : চিকিৎসক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

ভালো লাগলে শেয়ার করে দিন :)

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x