মোহাম্মদ আমজাদ হোসাইন
গার্মেন্টস শিল্পসহ করোনার ক্ষতি মোকাবেলায় রফতানিমুখী খাতকে ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। ২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে তিনি এ ঘোষণা দেন। এ তহবিলের অর্থ দ্বারা শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা যাবে। করোনা ভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত রপ্তানি খাতের শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধে প্রধামন্ত্রী ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকা তাদের তহবিল থেকে ২ শতাংশ সুদে ঋণ দেবে। এই ঋণ নেওয়ার পর প্রথম ৬ মাস কিস্তি দিতে হবে না, যা গ্রেস পিরিয়ড নামে পরিচিত। ঋণ নেওয়ার দুই বছরের মধ্যে তা পরিশোধ করতে হবে। আর বাজেট থেকে টাকা না দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ৫ হাজার কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করবে অর্থ মন্ত্রণালয়। তার বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃ অর্থায়ন তহবিল গঠন করে ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত রপ্তানিকারকদের ঋণ দেবে। তহবিলের জন্য বাজেট থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হবে। ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প মালিকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরাসরি শ্রমিকদের বেতন হিসাবে টাকা বিতরণ করবে। কোন কোন রপ্তানি খাত এই সুবিধা পাবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে প্রধান রপ্তানি খাত হিসেবে তৈরী পোশাক শিল্প এটি পাবে, তা নিশ্চিত করেছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্য কোন কোন খাত এই তহবিল থেকে কী কাজে , কীভাবে সহায়তা পাবে, তা ঠিক করবে অর্থ মন্ত্রণালয়।
প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসের কারণে দেশের অধিকাংশ পোশাক কারখানা বন্ধ। পোশাক সংশ্লিষ্ট সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, সংগঠনের সদস্য ৯৬ শতাংশ পোশাক বন্ধ। পোশাক শিল্পের নিট পণ্য প্রস্তুতকারদের সংগঠন বিকেএমই এর পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে, সংগঠনের সদস্য অধিকাংশ কারখানাই বন্ধ হয়ে গেছে। ভাইরাস সংক্রমণ এড়ানোর জন্য সবাইকে ঘরে থাকতে প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তা অনুসরণে যতদিন ছুটি থাকবে, ততদিন কারখানা বন্ধ রাখার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ ক্ষেত্রে কারখানা চালু রাখতে চাইলে শ্রমিকদের পূর্ণ স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা দিতে হবে। ব্যতিক্রমী পরিস্থিতির উদাহরণ হচ্ছে চিকিৎসকদের সুরক্ষা পোশাক তৈরীতে বিজিএমইএর চলমান উদ্যোগে যুক্ত থাকা কারখানা।
বিশ^ময় ছড়িয়ে পড়া কঠিন সংকটে নিমজ্জিত হতে শুরু করেছে। বিশেষ করে যারা শতভাগ রফতানির ওপর নির্ভর করেন তাদের অবস্থা কঠিন। সামনে আরো দুর্দিন হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সে কারণে তারা সরকারের কাছে বড় ধরণের ভর্তুকি তহবিল চেয়েছেন। বিজেএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বিদেশী বায়ারদের উদ্দেশ্যে টেলিভিশনের মাধ্যমে একটি ভিডিও বার্তায় বায়াররা যেন তাদের অর্ডার বা ক্রয়াদেশ বাতিল না করে এবং যা উৎপাদন করা হয়েছে তা যেন তারা নিয়ে নেয়। বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস বিস্তারের কারনে বাংলাদেশের ১ হাজার ৮৯ গার্মেন্টেসের ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার বাতিল করা হয়েছে। ফলে এ ফ্যাক্টরিগুলোয় ১২ লাখ শ্রমিক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে ধারণা করা হয়।
যখন স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা হলো, তখন গার্মেন্টস কারখানায় শত শত শ্রমিকের একত্রে কাজ করা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারেন এমন প্রশ্ন উঠেছিল। এ যুক্তিতে বিভিন্ন শ্রমিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছিল ২৫ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত গার্মেন্টস শ্রমিকদের স্ববেতনে ছুটি দেয়া হোক। শ্রমিকদের কাজ না করে বাড়ি থাকবেন নিজের ইচ্ছায় নয়, সার্বিক পরিস্থিতির কারণে। কাজেই তাদের বেতন যেন কাটা না হয়। শ্রম প্রতিমন্ত্রী মনুজান সুফিয়ান বলেছেন দেশে প্রায় ৬ কোটি ৩৫ লাখ শিল্প-কারখানায় শ্রমিকরা কাজ করেন। সরকার শুধু গার্মেন্টস সেক্টরের শ্রমিকদের দায়িত্ব নিবে না। দায়িত্ব নিবে সব শ্রমিকদের। কারণ কোভিড-১৯ সংক্রমণ জাতীয় সমস্যা হয় তাহলে সরকারকে সব শ্রমিকের দায়িত্ব নিতে হবে, শুধু পোশাক-কারখানার শ্রমিক নয়। এমনকি রিক্সাওয়ালা, দিনমজুর, গৃহকর্মীসহ যারা কারখানাকেন্দ্রিক শ্রমজীবী নয়, দিন আনে দিন খায়, তাদের দায়িত্বও সরকার নিবে।
বাংলাদেশের চার হাজারোও বেশি পোশাক-কারখানায় ৪০ লাখের বেশি শ্রমিক রয়েছেন। এ খাত থেকে বছরে ৩০ বিলিয়নের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। সে কারণে পোশাক খাত অগ্রাধিকার পায়, গুরুত্ব পায়। গার্মেন্টস মালিকেরা জানিয়েছেন, তাদের ৪ হাজার কোটি টাকা বেতন দিতে লাগে, প্রণোদনা হিসেবে দেয়া হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা। আশা করি, আর কালবিলম্ব না করে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করা হবে এবং সেটা যেন অবশ্যই করা হয়, তার জন্য সরকার বিশেষ নজরদারি করবে।
করোনা ভাইরাসের প্রভাবে উদ্ভূত বাস্তবতায় অর্থনৈতিক ঝুঁকি এড়াতে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের অন্যতম হলো রফতানি খাতে নিয়োজিত শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাবদ ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল। রফতানিকারদের জন্য প্রযোজ্য অন্যান্য সুবিধার মধ্যে আছে ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে জুন পর্যন্ত কাউকে খেলাপি করা যাবে না, রফতানির অর্থ ফিরিয়ে আনার সময় এবং আমদানি ব্যয় মেটানোর সময় চার থেকে বাড়িয়ে ছয় মাস করা ইত্যাদি। সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজে গৃহ ও ভূমিহীনদর জন্য খাবার ও গৃহ সুবিধার কথাও বলা হয়েছে।
এসময়ে বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক সংকট তা সাম্প্রতিক অন্য যেকোনো সংকটের চেয়ে আলাদা এবং ব্যাপক। যেমন ২০০৭-০৮ এর দিকে যে অর্থনৈতিক সংকট হয়েছিল, তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির ওপর তেমন কেনো প্রভাব রাখেনি। কেবল বৈশি^ক অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত বিষয় সে সংকটের অংশ ছিল। ফলে সে সময় রফতানি খাতকে সরকার যেসব বিশেষ প্রণোদনা দেয়, তার যুক্তি বেশ স্পষ্ট ছিল। আবার ২০১৩ সালের মার্চে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে ১ হাজার ১৩৪ জনের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু ও হাজার শ্রমিকের পঙ্গুত্ব দেশের প্রধান রফতানি খাত তৈরী পোশাককে সংকটে ফেলেছিল, তা মোকাবেলায় পোশাক খাতের প্রতি সরকারের বিশেষ মনোযোগ ছিল। প্রতি বছরের জাতীয় বাজেটে রফতানি খাতের জন্য যে নগদ প্রণোদনা দেয়া হয়, তার মধ্যে তৈরী পোশাক, চামড়া, হিমায়িত খাদ্যসহ সব প্রধান খাতই আছে। কিছু শর্ত মেনে নিয়ে যে নগদ প্রণোদনা পায় রফতানি খাত, তার পরিমাণ ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ছিল ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এ প্রণোদনার সিংহভাগ স্বাভাবিকভাবেই যায় তৈরী পোশাক খাতে। চলমান ২০১৯-২০ অর্থবছরে তৈরী পোশাক খাতকে বিগত বছরগুলোর নগদ প্রণোদনা ছাড়াও আরো ১ শতাংশ (রফতানি আয়ের উপর) বিশেষ নগদ প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। বড়-ছোট সব রফতানিকারকই পান এ নগদ প্রণোদনা।
কভিড-১৯ কে ঘিরে বিশ্বব্যাপী সামাজিক দূরত্ব নিয়ম মেনে চলার যে জরুরী প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, তার প্রভাবে খাদ্য, ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্য ও সেবা ছাড়া চাহিদা কমে গেছে বেশির ভাগ পণ্যের। তাছাড়া নানা পণ্যের বিপণন ও প্রচার এসব কাজকর্মে যেমন স্থবিরতা এসেছে, এমনি হুমকির মুখে পড়েছে নিম্ন আয়ের দিনমজুর, ফেরিওয়ালা, পরিবহনকর্র্মীসহ সর্বসাধারণ মানুষের জীবিকা অনু ক্ষুদ্র ও মধ্যম শিল্পের পণ্য উৎপাদন ও বিপণন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে কেবল রফতানি নির্ভর শিল্পের সংকট নয়, দেশীয় বাজারনির্ভর শিল্পেরও সংকট। এ সময়ের শিল্পের সংকট মূলত শিল্পপণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে হচ্ছে। যেমন তৈরী পোশাক রফতানিকারকদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২৫ মার্চ পর্যন্ত কভিড-১৯ এর কারণ তাদের প্রায় ২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার স্থগিত হয়েছে। যেহেতু তৈরী পোশাক পণ্যের অনেকগুলোই ঋতুভিত্তিক, তাই এ অর্ডারগুলো বাতিল হওয়ার আশঙ্কাই বেশী। কোনো সন্দেহ নেই, সংকটে পড়েছে আমদের প্রধান রফতানি খাত। ফলে যে খাত ৩৮ বিলিয়ন ডলারের তৈরী পোশাকপণ্য রফতানি করেছিল, এ বছর হয়তো রফতানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব করা হচ্ছে না। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তৈরী পোশাক খাতে রফতানি লক্ষ্যমাত্রা ৩৮ বিলিয়ন ডলার। তবে এ খাতে চলমান অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যে রফতানি হয়েছে, তা গত বছরের তুনায় প্রায় ৫ শতাংশ কম। চামড়া, হিমায়িত খাদ্যসহ বেশির ভাগ রফতানি খাতের চিত্র কম-বেশি হতে পারে। এবারের অর্থনৈতিক ঝুঁকি কিন্তু কেবল রফতানি খাতের নয়, বরং পুরো অর্থনীতির। কাজেই যে-কোনো পদক্ষেপে ভাবতে হবে পুরো অর্থনীতির কথাই। আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে না গেলে তৈরী পোশাকসহ অন্যান্য রফতানি পণ্যের বাজার আগের অবস্থায় যাবে না। ঠিকই একইভাবে দেশের অর্থনীতিতেও চাহিদা স্বাভাবিক না হলে শিল্পপণ্য তথা জোগান ব্যাহত হয়ে দেশীয় শিল্প বিপদে থাকবে।
করোনা ভাইরাসের প্রভাবে কোনা খাতে যাতে কোনো শ্রমিক বেকার না হয়ে, সে জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রয়োজনীয় সব ধরণের উদ্যোগ নিয়েছেন। করোনা ভাইরাসের পরে যাতে প্রতিটি শিল্প খাত স্বাভাবিক ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রতিবেদক : পুলিশ সুপার (অপস্ এন্ড ইন্টেলিজেন্স-২) ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স।
0 Comments