ডাঃ এস, এম, শহীদুল ইসলাম পিপিএম
ক্রোধ বা রাগ হচ্ছে কোনো ব্যক্তি বিশেষের আবেগের বশবর্তী হয়ে এমন একটি চারিত্রিক নেতিবাচক মনস্তাত্বিক বহিঃপ্রকাশ যা অন্য কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তির আচরণ বা বস্তু বা বস্তুকে বা সংগঠনকে বিরুদ্ধাচারণ করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তৈরি হয়, যা দৃশ্যমান হতেও পারে বা না-ও হতে পারে। তাই ক্রোধ বা রাগকে আয়ত্তের মধ্যে রেখে নিয়ন্ত্রণ করাকে বলে রাগের ব্যবস্থাপনাকরণ। নতুবা হাজারো পরিশ্রম বা মেধা থাকা সত্ত্বেও জীবন যুদ্ধের পিরামিড আকৃতির উপরের স্তরে সিঁড়ি বেয়ে উঠা সম্ভব না। সেই সঙ্গে কাজের সুফল কোনো বক্তি, সংগঠন, দেশ বা জাতি পাবে না। রাগের সময় মস্তিষ্কের অ্যাডরানেল গ্রন্থি থেকে অ্যাডরালিন রস নিঃস্রিত হয়ে উত্তেজনা তৈরি করে। তাই সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ক্রোধ বা রাগকে আয়ত্তে করে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
রাগের চারটি ধাপ আছে-
ক) রাগের কারণ তৈরি হওয়া ।
খ) রাগের স্ফুলিঙ্গ তৈরি হওয়া।
গ) রাগের বিকট বহিঃপ্রকাশ হওয়া।
ঘ) রাগ নিয়ন্ত্রণে আসা ।
রাগের কারণগুলো-
১) ভয়, ২) লজ্জা, ৩) ঘৃণা, ৪) নিন্দা, ৫) ব্যর্থতা, ৬) ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়া।
রাগের সাইনগুলো-
১) বুকে বা মাথা ব্যথা হওয়া, ২) দাঁত কামড়ানো , ৩) উত্তেজিত হওয়া , ৪) তেষ্টা পাওয়া , ৫) তর্কে জড়িয়ে পড়া, ৬) উঁচু গলায় কথা বলা, ৭) চোখে মুখে প্রতিশোধের ছাপ আসা, ৮) হতাশা প্রকাশ পাওয়া, ৯) শারীরিকভাবে হাত-পা ছোড়া, ১০) হার্ট, পালস, শ্বাস-প্রশ্বাস রেট বেড়ে যাওয়া।
এটা সাধারণত তিন প্রকার-
১) আক্রমণাত্মক কর্মবাচ্য, ২) খোলা আগ্রাসন এবং ৩) জিদ পূর্ণ রাগ ।
রাগ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে পরিণতি নিম্নরূপ হতে পারে-
১) দ্বন্দ্ব, ২) মতানৈক্য, ৩) বিভেদ, ৪) দলাদলি, ৫) মন কষাকষি, ৬) হাতাহাতি, ৭) মারামারি, ৮) মানসিকচাপ, ৯) দুঃশ্চিন্তা, ১০) কাজের স্থবিরতা, ১১) সন্দেহ প্রবণতা, ১২) বন্ধুত্বহীনতা, ১৩) দলগত প্রচেষ্টার অভাব, ১৪) ব্যক্তিগত বা সাংগঠনিক ব্যর্থতা, ১৫) হতাশা, ১৬) মাদকাসক্তি, ১৭) নিদ্রাহীনতা, ১৮) স্বাস্থ্যের অবনতি, ১৯) প্রতিশোধ প্রবণতা, ২০) আইন বহির্ভূত কাজে লিপ্ত হওয়া, ২১) নিয়ম বহির্ভূত কাজের জন্য শাস্তির সম্মুখীন হওয়া, ২২) শাস্তি পাওয়া, ২৩) পরিবেশ নষ্ট হওয়া, ২৪) নিজের ক্যারিয়ার ধ্বংস হওয়া ২৫) আত্মহনন।
কর্মক্ষেত্রে রাগের উদ্রেক হলে, তা নিয়ন্ত্রণের উপায়-
১) জোরে জোরে গাঁঢ় শ্বাস নিতে হবে, ২) মনে মনে বারবার সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতে হবে নিজেকে শান্ত করার জন্য, ৩) ধীরে ধীরে তিন-চার বার এক থেকে ১০ পর্যন্ত গুণতে হবে, ৪) পৃথিবী-স্বীকৃত সর্বজন শ্রদ্ধেয় কোনো নেতাকে স্মরণ করতে হবে, ৫) শরীরের মাংশ পেশিগুলোকে শক্ত না রেখে নরম করতে হবে, ৬) নিজের পছন্দের কোন গান মনে মনে স্মরণ করতে হবে , ৭) কাজ শেষে বাসায় ফিরে ব্যায়াম করতে হবে, ৮) ভাল ভাবে গোসল করে পরিধেয় কাপড় ধুয়ে ফেলতে হবে, ৯) রাগের কারণ স্থগিত রেখে ভালো ঘুম দিতে হবে, ১০) ঘুমের পর রাগের যৌক্তিকতা নিয়ে ভাবতে হবে, ১১) আত্মসমালোচনা করতে হবে, ১২) সক্রিয় ও পজেটিভ চিন্তা করতে হবে, ১৩) ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে সব দেখতে হবে, ১৪) রাগের কারণের ভালো অংশগুলোকে প্রশংসা করতে হবে এবং খটকা লাগা অংশগুলোকে সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সুন্দর রূপ দিতে হবে, ১৫) নিজের ব্যর্থতা বা কাজের অস্বীকৃতিকে সহজভাবে নিতে হবে, ১৬) সবার সাফল্যকে অভিনন্দন জানাতে হবে, ১৭) প্রতি মুহূর্তে অন্যের ভালো গুণগুলোকে রপ্ত করতে হবে, ১৮) শরীর ও মনকে সর্বদা সুস্থ রাখার চিন্তা করতে হবে, ১৯) সবার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে, ২০) হাসিমুখে সবার সঙ্গে কথা বলতে হবে, ২১) নিজেকে মহাবিশ্বের কাছে সামান্য ছাত্র ভাবতে হবে, ২২) আত্মঅহংকার বা গরিমা ত্যাগ করতে হবে, ২৩) ধর্মের নিগূঢ় অর্থগুলোকে জানতে হবে, ২৪) যোগ ব্যায়াম করার চেষ্টা করতে হবে, ২৫) যে কোনো কাজ সুন্দরভাবে করতে হবে সাফল্যের কথা না ভেবে, ২৬) ব্যর্থতা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে মেনে নিতে হবে এবং তা থেকে শিখতে হবে, ২৭) মনে রাখতে হবে কর্মক্ষেত্রে দয়া বা ক্ষমার কোনো সুযোগ নেই সুতরাং আমাকে নির্ভুলভাবে কাজ করতে হবে কিন্তু তাতে যে সাফল্য আসবেই তার কোনো নিশ্চয়তা নেই, ২৮) প্রয়োজনে রাগ কমানোর জন্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
কর্মক্ষেত্রে সুন্দর পরিবেশ রাগ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
১) কর্মস্থলে দলবদ্ধ কাজকে প্রাধান্য দিয়ে সবার মধ্যে আন্তরিকতা তৈরি করতে হবে, ২) সবার যোগ্যতাকে নিখুঁতভাবে যাচাই-বাছাই করে পোস্টিং, ট্রান্সফার ও প্রমোশন দিতে হবে, ৩) বিহেভিরাল সেন্স, সুন্দর কমিনিউকেশন এবং সবার প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণকেও অবশ্যই কর্মক্ষেত্রের মূল্যায়ন করতে হবে, ৪) কোনো কিছুতেই শৃঙ্গলা ভঙ্গ করা চলবে না, ৫) বিহেবিরাল সায়েন্সের উপর নিয়মিত প্রশিক্ষণ চালাতে হবে, ৬) রাতারাতি কড়া কথা বলে কাউকে বদলানো যায় না, সুতরাং সুন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে সময় নিয়ে বদলানোর পরিবেশ তৈরি করতে হবে ৭) প্রত্যেকের সার্ভিস রেকর্ড পরিপাটিভাবে রাখতে হবে, ৮) রেকর্ডে সংঘটনের আলোকে সব থাকতে হবে কোনো বক্তি স্বার্থে নয়, ৯) প্রত্যেকের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে, ১০) সংঘটনে প্রত্যেকে কাজের গ্রান্টচার্ট মেনে চলতে হবে।
লেখক : পরিচালক (পুলিশ সুপার),
‘ওয়েসিস’ মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র
বসুন্ধরা রিভারভিউ, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা।