ই-পেপার

মোঃ আবু জাফর

নববর্ষ আসলেই মনটা খুব খারাপ হয়ে যায় শফিক সাহেবের। এত আনন্দ স্ফুর্তি, চারিদিকে সাজসজ্জা, ছোট ছোট ছেলে মেয়েসহ সর্বস্তরের মানুষের নানা রংয়ের পোশাক পরিচ্ছদের ঝলকানি, আনন্দ উচ্ছ্বাস সব কিছুই শফিক সাহেবের জন্য কষ্ট বয়ে আনে। নিদারুণ এক মানসিক যন্ত্রণায় মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে। তারপরেও তিনি প্রতি বছর নববর্ষের দিন সকালে একবার বাসা থেকে বাহির হন। কোনো কাজ নাই। তবুও উদ্দেশ্যবিহীনভাবেই রাস্তায় কিছুটা সময় হাঁটাহাঁটি করেন। রমনা পার্কের চারিদিকেও একবার হেঁটে আসেন। উৎসুক নয়নে তাকিয়ে থাকেন প্রতিটি মানুষের মুখের দিকে। এই সময়টাতে কেয়ার মুখটা বড় বেশি মনে পরে। ঠোঁটের কোনে লুকানো সেই অভিমান ভরা ব্যতিক্রমী হাসিটা এখনও স্পষ্ট দেখতে পান তিনি। এমনকি ডান গালের ছোট্ট তিলটা পর্যন্ত চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কখনও কখনও দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে চোখের কোনো বেয়ে, যা খেয়াল করেন না শফিক সাহেব। চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসে। তখন কোনো এক জায়গায় বসে পড়েন। তিনি ভালো করেই জানেন এই বয়সে এবং শরীরের এ অবস্থায় রাস্তায় একাকী হাঁটাচলা করা ঠিক না। বাহির হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই খারাপ লাগার জন্য বাসায় চলে আসেন। সারা দিন আর বাহির হন না। কারো সাথে তেমন একটা কথাও বলেন না। তাছাড়া অবসরগ্রহণের পর কারো সাথে বেশি কথা বলতেও ভালো লাগে না তার। আপনজন বা চারিপাশে যারা আছে তারা তো আছেই, এমনকি স্ত্রীও নানারকম কটাক্ষ ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কথা বলে। হাতে টাকা পয়সা না থাকলে এ অপমানটুকু সহ্য করতেই হয় ভেবে চুপ করে থাকেন তিনি। অথচ যখন চাকরিতে ছিলেন তখন সকলের কাছেই তার সম্মান ছিল, গুরুত্ব ছিল এবং আজ তিনি পরিবারের কাছেও একজন বাড়তি ও অপ্রয়োজনীয় মানুষ। অথচ তার জীবনটা এমন ছিল না।

বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর একজন সৎ, নীতিবান ও দক্ষ এসআই ছিলেন তিনি। অনেক গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় চাকরি করেছেন। উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে যথেষ্ট সুনাম ছিল তার। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা কাজ করতেন। বিশ্রাম, খাওয়া বা ঘুম এ শব্দগুলো কখনোই তার কর্মের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। কাজের বাইরে কখনো কোনো কিছুকেই গুরুত্ব দিতেন না তিনি। আর আজ তিনি ঘরের কোণে চুপচাপ বসে থাকেন। যে যা পারছে বলে যাচ্ছে। অথচ কি তার অপরাধ তিনি জানেন না। আরও ৪ বছর চাকরি থাকতেই স্বেচ্ছায় অবসরগ্রহণ করেছেন। স্ত্রী তার এই আর্থিক ক্ষতিটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু শফিক সাহেবের কিছুই করার ছিল না। শরীর সুস্থ থাকলেই তো আর চাকরি করা চলে না। মনটাও তো সুস্থ থাকতে হয়। এতবড় একটা আঘাতের পর কি করে চাকরিতে মন দেওয়া যায় বুঝতে পারেন না শফিক সাহেব। আবারও কেয়ার মুখটা মনের পর্দাায় ভেসে ওঠে। মনটা চলে যায় কয়েক বছর অতীতে.. .. ..

সময়টা তখন ২০১০ সালের মাঝামাঝি। বরিশালের একটি থানায় এসআই শফিক কর্মরত। স্ত্রীর অসুস্থতার কথা জানতে পেরে পাঁচ দিনের ছুটি নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। রামপুরা টিভি রোডে বাসা। ঢাকায় চাকরি করাকালীন রামপুরা যে বাসায় ছিলেন সেই বাসায়ই আছেন। বরিশাল নতুন কর্মস্থলে স্ত্রী ও সন্তানকে নেওয়া হয়নি। ছুটির চতুর্থ দিনে স্ত্রী মারা যান। যেদিন স্ত্রী মারা যান সেদিন থেকেই শফিক সাহেবের জীবনে ঘোর অন্ধকার নেমে আসে। একমাত্র মেয়ে কেয়াকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন। তখন কেয়ার বয়স মাত্র ৭ বছর। কি করবেন বুঝতে পারেন না। অবশেষে কেয়ার দূর সম্পর্কের এক বিধবা খালাকে বাসায় এনে কেয়াকে তার কাছে রেখে আবার কর্মস্থলে যোগদান করেন। সারাদিনের শত ব্যস্ততার মাঝেও মনটা পরে থাকে কেয়ার কাছে। প্রতিদিন দুই বেলা ফোনে খোঁজ খবর নেন। স্যারকে বলে প্রায় শুক্রবারেই একদিনের অনুমতি ছুটি নিয়ে ঢাকায় কেয়ার কাছে চলে আসেন। কয়েক ঘণ্টার জন্য কেয়াকে দেখে আবার রাতের লঞ্চে বরিশালে চলে যান। এ অবস্থায় কাজ কর্ম সঠিক ভাবে হচ্ছে না দেখে সিনিয়র অফিসাররা শফিককে আরও মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে বলেন। তবে অফিসারদের বলার আগে শফিক সাহেব নিজেই জানেন, সব সময় দক্ষতা ও সুনামের সাথে চাকরি করে এখন যেভাবে কাজ করছে তা কোনো দিক দিয়েই আগের কাজের সাথে তুলনা করা যায় না। তাই সারাক্ষণ একটা অপরাধবোধ তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। এরই মধ্যে জানতে পারেন কেয়ার উপর তার এই খালা নানা রকম অত্যাচার করছে। মাঝে মাঝে ঘরের নানা রকম কাজ করতে বাধ্য করে। ঘরে বাইরে এ অশান্তির কারণেই এক সময় সকলের পরামর্শে ও কেয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বিবাহ করেন শফিক সাহেব। আর এখানেই তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা হয়ে যায়। যে মেয়েটিকে বিবাহ করেন সে একজন বিধবা। বিবাহের ৮ বছরের মাথায় কি এক রোগে আগের স্বামী মারা যায়। কোনো ছেলেমেয়ে নাই। সকলের ধারণা নিঃসন্তান এই নতুন মা অন্তত নিজের মাতৃত্বের ভান্ডার পূর্ণ করার জন্য হলেও কেয়াকে সন্তান ¯েœহে বুকে আশ্রয় দিবে। কিন্তু ভাবনাটা কোনোদিনই বাস্তবে রূপ নেয় না। সংসারে আসার পর থেকেই নানা রকম অশান্তি শুরু করে দেয় সে। শফিক সাহেবের টাকা পয়সাসহ যাবতীয় সম্পত্তি কিভাবে হস্তগত করা যায় সারাক্ষণ সেই চেষ্টায় লিপ্ত থাকে। কেয়াকে কোনো ভাবেই সহ্য করতে পারে না। মাঝে মাঝে মারধোর করে। অতটুকু মেয়ের উপরে সংসারের যাবতীয় কাজ ফেলে রেখে সে নিজে সারাদিন সেজেগুজে ও পাড়া প্রতিবেশীর সাথে গল্প গুজবে মেতে থাকে। সংসারের নানা রকম জিনিসপত্র লুকিয়ে তার মা ও ভাইকে পাঠিয়ে দেয়। কেয়া সবকিছু দেখেও কোনো কথা বলতে পারে না। সে জানে তার বাবা কত অশান্তির মধ্যে বেঁচে আছে। মাঝে মাঝে সকলের চোখের আড়ালে একটু সময় পেলেই মায়ের কবরের কাছে গিয়ে কান্না করে কেয়া। এই অশান্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে। এর মাঝে একদিন কি এক সামান্য কথার সূত্র ধরে নতুন মা কেয়ার বই খাতা সব আলমারিতে আটকে রাখে। কেয়ার পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। এসবও কেয়া সহ্য করে। কিন্তু কেয়া সব থেকে বেশি কষ্ট পায় যখন এই নতুন মা তার মৃতা মায়ের প্রসঙ্গ তুলে নানা রকম খারাপ মন্তব্য করে। আগে কেয়া সব সময় বাবাকে ফোন করে খোঁজ খবর নিতো এবং সময় পেলেই বাবাকে আসতে বলতো। ফোন এখন কেয়ার নাগালের বাইরে। কোনো সময়ই কেয়া এখন আর বাবার সাথে কথা বলতে পারেনা। আর বাবা যখন আসে তখন এত ঝগড়া বিবাদ শুরু হয় এবং নতুন মা যেসব বাজে ভাষায় কথা বলে তা শুনে কেয়া লজ্জায় বাবার কাছ থেকে দূরে সরে যায়। এরই মধ্যে আর এক নতুন উপদ্রব শুরু হয়েছে। নতুন মায়ের এক দূর সম্পর্কের বড় বোন বেড়াতে এসে প্রায় মাস দেড়েক ধরে জুড়ে বসেছে। আপাতত যাবে বলেও মনে হয় না। নতুন মা যদি এক কথা বলে তো সেই খালা বলে দশ কথা। খালার অনেক ব্যক্তিগত কাজও কেয়াকেই করে দিতে হয়। কেয়া সব সহ্য করে আর আল্লাহকে ডাকে। সে বুঝতে পারে তার মায়ের মৃত্যুর সাথে সাথেই জীবন থেকে সুখ নামক অধ্যায়টা চিরদিনের জন্যই বন্ধ হয়ে গেছে। আগে যারা কেয়াকে দেখেছে তারা হঠাৎ করে এখনকার কেয়াকে দেখে চিনতেই পারে না। অযতœ অবহেলায় শরীর যেমন শীর্ণ হয়ে গেছে তেমনি গায়ের রং হয়েছে কালো। মানসিক চিন্তার কারণে এক সময়ের আনন্দময়ী উচ্ছল কেয়া এখন একেবারেই চুপচাপ।

আরও চার বছর চাকরি থাকার পারেও শফিক সাহেব শুধু কেয়ার জীবনের একটু সুখ শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য এবং কেয়াকে একটু সান্নিধ্য দেওয়ার জন্য স্বেচ্ছায় অবসরগ্রহণ করেন। অবসরে যাবার পর থেকে প্রাপ্ত সমস্ত অর্থ ও এত বছরে অর্জিত সমস্ত সম্পত্তি কিভাবে হস্তগত করা যায় তাই নিয়েই এই নতুন মায়ের পরিকল্পনা। স্বামী, সন্তানতুল্য কেয়া বা সংসারের দিকে তার একটুও মন নাই। বাকি চার বছর চাকরি না করাটাকেও সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। এই চার বছর চাকরি করলে আরও কত টাকা আসতো এ নিয়ে দিনের মধ্যে বহুবার হিসেব নিকেশ চলে। সংসারে সারাদিন ঘ্যানর ঘ্যানর চলতেই থাকে। এভাবে চলছে কেয়া ও নতুন স্ত্রীকে নিয়ে শফিক সাহেবের জীবন। শফিক সাহেব সবক্ষেত্রেই চরম ধৈর্যের পরিচয় দেন। পুলিশে চাকরি করেও কোনোদিন তিনি মাথা গরম করেন নি। কখনও ঝগড়া বিবাদ পছন্দ করেন না। শুধু নিজ গ্রাম নয়, আশ পাশের কয়েকটি গ্রামের লোকজনও জানে শফিক সাহেবের মত লোক এই তল্লাটে আর একটিও নাই। তার মাধ্যমে কারও ক্ষতি হতে পারে এ কথাটি কেউই বিশ্বাস করে না। সবাই শফিককে দেখে আর নানা রকম সান্ত¡নার কথা বলে। এসব কথা শুনতেও এখন আর শফিক সাহেবের ভালো লাগে না। তাই খুব দরকার না হলে এখন আর শফিক সাহেব বাড়ি থেকে বাহির হন না। কিন্তু ঘরের মধ্যে যে শান্তিতে একটু থাকবেন সে সুযোগও নাই। তবুও সময় কারো জন্য থেমে থাকে না। এ ভাবেই চলছে কেয়াকে নিয়ে শফিকের জীবন আর সংসার।

এর পরের ঘটনা শফিকের জন্য আরও ভয়াবহ। সময়টা ২০১৮ সালের ১৪ এপ্রিল। বাংলা নববর্ষ। কেয়া চার পাঁচ দিন আগে থেকেই শফিককে বার বার বলে রেখেছে এবার তাকে নববর্ষের দিন বাইরে বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে। শফিক সাহেবের তো এখন হাতে কোনো কাজ নাই। সারাদিনই শুয়ে বসে সময় কাটান। তাই মেয়েকে কথা দেন বেড়াতে নিয়ে যাবেন। নববর্ষের দিন খুব সকালে কেয়া একটি লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পড়ে বাবার সাথে বের হয়। ঘর থেকে মাত্র কয়েক পা সামনে মেইন রোডে গিয়েই কেয়া আবদার করে শাহজাহানপুর কবরস্থানে যাবে বলে। মায়ের কবরের কাছে অনেক দিন যাওয়া হয়নি। তাই তার খুব ইচ্ছে একবার মায়ের কবরের পাশে যাবে। শফিক সাহেবের মনটা আজ খুব ভালো। কারণ অনেকদিন পরে কেয়াকে নিয়ে বাহিরে বের হয়েছেন। মুক্ত পরিবেশে মন খুলে কেয়ার সাথে কথা বলতে পারবেন। বাসায় বসে ইচ্ছে করলেও কেয়ার সাথে কথা বলা যায় না। বাবা মেয়ে এক মিনিটের জন্যও একত্রিত হলে বা দুই একটি কথা বলতে গেলেই সৎ মা তাকে কোনো না কোনো কাজের নাম করে দু’জনকে আলাদা করে দেয়। তাই কেয়ার এই কথায় শফিক সাহেবের মনটা আরও ভাল হয়ে যায়। তারা একটি রিকশা নিয়ে শাহজাহানপুর কবরস্থানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। দশ বারো মিনিটের মধ্যেই রিকশা তাদের নিয়ে কবরস্থানে চলে আসে। ভিতরে প্রবেশ করে কেয়া একটু দূরে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে মায়ের কবরের দিকে তাকিয়ে থাকে। শফিক সাহেব কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। দোয়া দুরুদ পাঠ করে স্ত্রীর জন্য মোনাজাত করেন। অতীত দিনের সুখগুলোর কথা মনে পড়ে তার চোখ দিয়ে তপ্ত অশ্রু গাড়িয়ে পরে। তারও বড় সাধ হয় এভাবে চির শান্তির কোলে ঘুমিয়ে পড়তে। শুধু কেয়ার কথা ভেবে বাঁচার তাগিদ অনুভব করে। মায়ের মত সে ও চলে গেলে কেয়ার যে আর কেউই থাকবে না। কেয়ার যদি একটা বিয়ে শাদী দিতে পারেন তারপর তিনি কোথায় যাবেন বা কি করবেন নিজেও জানেন না। কেয়ার দিকে তাকিয়ে দেখেন তার চোখ থেকে দরদর করে পানি গড়িয়ে দুই গাল ভিজে যাচ্ছে। কবরের উপরে দুই তিনটি শুকনো পাতা পরে ছিল। শফিক সাহেব পরম মমতায় পাতা কয়টি হাত দিয়ে তুলে পাশে ফেলে দেন। বাবা ও মেয়ে দুজনেই কবরস্থান থেকে বের হয়ে আসেন। এবার একটি রিকশা নিতে গেলে কেয়া বাধা দেয়। সে বাবার হাত ধরে হেঁটে হেঁটে রমনা পার্কের দিকে যেতে চায়। শফিক সাহেব আজ আর কেয়ার কোনো কথাতেই দ্বিমত করেন না। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই তারা রমনা পার্কে প্রবেশ করে। অবাক হয়ে চারিদিকে আনন্দিত মুখগুলো লক্ষ্য করেন শফিক সাহেব। আবার মাঝে মাঝে কেয়ার মুখের দিকে তাকান। সেই মুখে কোন হাসি দেখতে পান না। পরনের শাড়িটাও পুরাতন আর অন্যদের তুলনায় আজকের এই বিশেষ দিনে বড় বেশি বেমানান মনে হয়। এই সময় শফিক সাহেব খেয়াল করেন যে, তিনি তো কখনও কেয়াকে শাড়ি কিনে দেননি। তাহলে শাড়িটা পেল কোথায়। কেয়াকে তিনি একটু ভিন্নভাবে প্রশ্ন করে জানতে চান এটা কার শাড়ি। কেয়া একটি মাত্র শব্দে উত্তর দেন- “মায়ের”। তখন শফিক সাহেবের মনে পড়ে যায়। প্রায় আট দশ বছর আগে সে এই শাড়িটা কেয়ার মাকে কিনে দিয়েছিল। শফিক সাহেব ভাবেন আর নিজেকেই বলেন- বড় ভুল হয়ে গেছে। মেয়েকে নিয়ে এভাবে বের হবেন জানার পরেই কেয়াকে একটা নতুন শাড়ি কিনে দেওয়া উচিত ছিল। যাক, ভুল যা হবার তা তো হয়েই গেছে। শফিক সাহেব মেলা থেকে কেয়াকে কিছু কিনতে বা কিছু খেতে বলেন। কেয়া কিছুই খেতে চায় না। শুধু রজনীগন্ধা ও গোলাপ দিয়ে বানানো একটি ছোট ফুলের তোড়া কেনে। আরও কয়েক জায়গায় ঘোরাঘুরি করে তারা। যখন বেলা প্রায় এগারটা বাজে তখন রমনা পার্ক থেকে বের হয়ে কাকরাইল মসজিদের সামনে দিয়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে রাস্তার মাঝামাঝি এসে শফিক সাহেবের হাত ধরে কেয়া বসে পরে। কি হয়েছে বুঝতে না পেরে শফিক সাহেব কেয়াকে জড়িয়ে ধরেন। মুহূর্তে রাস্তায় গাড়ির লম্বা জ্যাম হয়ে যায়। দ্রুত শফিক সাহেব মেয়েকে কোলে নিয়ে বাকি রাস্তাটুকু পার হয়ে ফুটপাতে বসে পড়েন। কেয়া কোনো কথা বলতে পারছে না। থরথর করে কাঁপছে। নিশ্বাস নিচ্ছে খুব দ্রুত। মুহূর্তে সমস্ত শরীর গামে ভিজে যায়। ফুলের তোড়াটি হাত থেকে আস্তে আস্তে গড়িয়ে শফিক সাহেবের পায়ের উপর পরে। ক্ষনিকের জন্য শফিক সাহেবের মনে হয় কেয়া ইচ্ছে করেই বাবার পায়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ দুটি বন্ধ দেখতে পায়। ঠোঁট সামান্য নড়ে ওঠে। কিছু একটা বলতে চায় কেয়া। মুখের কাছে কান নিয়েও স্পষ্ট কিছু বুঝতে পারেন না শফিক সাহেব। পাশেই ডিউটিরত একজন সার্জেন্ট বিষয়টি লক্ষ্য করে এগিয়ে আসেন। একটি গাড়ি থামিয়ে দুজনকে পুলিশ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। দশ মিনিটেই তারা পুলিশ হাসপাতালে চলে আসেন। দুই তিন মিনিটের মধ্যেই কয়েকজন ডাক্তার ও নার্স চলে আসে। ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের বেডে কেয়াকে শুইয়ে দেওয়া হয়। শফিক সাহেব একজন রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার জেনে স্বয়ং তত্ত্বাবধায়ক সাহেব নিজেও চলে আসেন এবং ডাক্তারদের দিকনির্দেশনা দেন। ডাক্তার ও নার্স নানা রকম চেষ্টা করতে থাকে। কয়েকটি ইনজেকশন দেয়া হয়। তারপর মাত্র ২০ মিনিট সময় অতিবাহিত হয়। ডাক্তারের সর্বপ্রকার চেষ্টা, ওষুধের ক্ষমতা, সৎ মায়ের অত্যাচার ও বাবার অপরিসীম ¯েœহ মমতা সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চির নিদ্রায় ঢলে পড়ে কেয়া। ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করার সাথে সাথে একজন নার্স এসে একটি সাদা চাদর দিয়ে শরীরটাকে ঢেকে দেয়। পড়নের সাদা শাড়ি আর হাসপাতালের সাদা চাদর মিলে একাকার হয়ে যায়। কয়েকজন স্টাফ ও পরোপকারি কয়েকজন পুলিশ যারা শফিক সাহেবকে বা কেয়াকে চিনে না জানে না তবুও তারা সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে। একটি পিক-আপ ঠিক করে তাতে দুজনকেই তুলে দেয়। দু’জন বলতে এখন একজন জীবিত আর একজন মানুষ নয়, মানুষের লাশ। শফিক সাহেব মেয়ের লাশ নিয়ে রামপুরা বাসার দিকে রওয়ানা করেন। রামপুরার কাছাকাছি এসে হঠাৎ কি মনে করে গাড়ির ড্রাইভারকে গাড়ি ঘুরিয়ে শাহজাহানপুর কবরস্থানের দিকে যেতে বলেন। ড্রাইভার প্রথমে একটু অবাক হয়। তারপর গাড়ি ঘুরিয়ে শাহজাহানপুর যেতে শুরু করে। শফিক সাহেব কেয়ার লাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলেন- “কেয়া মা আমার, আমি তোকে ঐ অত্যাচারী সৎ মায়ের কাছে, ঐ দোজখসম অশান্তির সংসারে আর নিয়ে যাব না। তার চেয়ে চল তোকে তোর আসল মায়ের কাছে পৌঁছে দেই। দেখবি আর কোনোদিন তোকে তোর সৎ মা বা অন্য কেউই কোনো কষ্ট দিতে পারবে না। আর আমি তো তোর কাছেই আছি মা। আমাকেও আল্লাহ যখন তোদের কাছে  যাবার হুকুম করবেন তখন ঠিক চলে আসব দেখিস মা। তুই যেন ভয় পাস না। আমি আসার পরে তুই, তোর মা আর আমি এই তিন জনে মিলে চির সুখে শান্তিতে সেই আগের দিনগুলোর মতো অনন্তকাল ধরে ঘুমিয়ে থাকব মা। দোয়া করিস মা, তোদের দুজনকে ছেড়ে ঐ সংসারে আমারও যেন বেশিদিন থাকতে না হয়”। ড্রাইভার এরই মধ্যে শাহজাহানপুর কবরস্থানের কাছাকাছি চলে এসেছে। কবরস্থানের গাছগুলোকে স্পষ্ট দেখা যাচেছ। এটুকু দূরত্ব অতিক্রম করতে আর হয়ত দুই থেকে তিন মিনিট লাগবে। শফিক সাহেব শেষ বারের মতো মেয়ের মাথাটা বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে শক্ত হয়ে বসে থাকেন আর নববর্ষের এই দিনটি শফিক সাহেবের কাছে হয়ে যায় চিরস্মরণীয় একটি দিন। 

লেখক : পুলিশ পরিদর্শক (নিঃ),

স্কুল অব ইন্টেলিজেন্স

স্পেশাল ব্রাঞ্চ, উত্তরা, ঢাকা

ভালো লাগলে শেয়ার করে দিন :)

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x