ই-পেপার

মোহাম্মদ আমজাদ হোসাইন

বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে আবির্ভূত করোনা ভাইরাস কোভিভ-১৯ বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। ভাইরাস সংক্রমণ রোধে গৃহীত ব্যবস্থা যেমন: কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন, লকডাউন প্রভৃতি অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে ব্যাপকভাবে সীমিত করেছে। এর প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিয়েছে এবং এ মন্দার তীব্রতা ২০০৮-২০০৯ সালের আর্থিক মন্দা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর সর্বশেষ প্রকাশিত World Economic Outlook (WEO), October, 2020 অনুযায়ী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার সংকোচিত হতে পারে, যেখানে এপ্রিল ২০২০-এর Outlook-এ উক্ত সংকোচন ৩.০ শতাংশ হবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছিল।

বৈশ্বিক অর্থনীতি প্রক্ষেপণে আইএমএফ বেইজলাইন দৃশ্যকল্পে (baseline scenario) সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিধান ২০২১ সালেও অব্যাহত থাকবে এবং ২০২২ সালের মধ্যে সর্বত্র টিকা সরবরাহের ফলে মহামারির প্রকোপ কেটে যাবে বলে অনুমান করা হয়েছে। একই সালে রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ আর্থিক প্রণোদনাসহ বিভিন্ন নীতি সহায়তার ফলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে এবং বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ২০২১ সালে ৫.২ শতাংশে উপনীত হতে পারে মর্মে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। কোভিড-১৯ এর দ্রুত ও ব্যাপক বিস্তার এবং এর ফলে অর্থনৈতিক কর্মকা- স্থবির হয়ে পড়া প্রবৃদ্ধি হ্রাসের কারণ। বিকাশমান বাজার এবং উন্নয়নশীল অর্থনীতি দেশসমূহকে স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায় বহিঃ খাত চাহিদার অভিঘাত, বৈশ্বিক আর্থিক বাজার পরিস্থিতি অভিঘাত এবং পণ্যমূল্য হ্রাস প্রভৃতি অর্থনৈতিক কর্মকা- চরম ঝুঁকির মুখে ফেলছে। এছাড়া, জ্বালানি তেলসহ পণ্যমূল্য নিম্নমুখী হওয়ায় রপ্তানিকারক দেশসমূহ সমস্যায় পড়বে।

২০২১ সালে বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানো নির্ভর করছে কত দ্রুত এ মহামারিকে নিয়ন্ত্রণে এনে ভোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা যায়। এ লক্ষ্যে জনসাধারণকে স্বাস্থসেবা প্রদানের মাধ্যমে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি পুনঃ উদ্ধারের লক্ষ্যে রাষ্ট্রসমূহ বিভিন্ন আর্থিক ও প্রণোদনা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। 

এসব বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দাভাবের মধ্যে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলমান করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলায় করে দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম সচল রাখার লক্ষ্যে স্বাস্থ্যসেবা খাতে অতিরিক্ত ব্যয় জরুরি মানবিক সহায়তায় এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সরকারের ইতোমধ্যে ১.২ লক্ষ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এ প্যাকেজে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কার্যক্রম: রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য বিশেষ তহবিল, ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরে প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিট্যাল সুবিধা প্রদান এবং ক্ষুদ্র (কুটির শিল্পসহ) ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের ওয়াকিং ক্যাপিট্যাল সুবিধা প্রদান, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলে সুবিধা বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বৃদ্ধি, লক্ষ্যভিত্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য নগদ অর্থ বণ্টন, কৃষি খাতের জন্য বিভিন্ন তহবিল গঠন। আর্থিক প্রণোদনার পাশাপাশি কোভিড-১৯ সংশ্লিষ্ট পণ্যের আমদানি শুল্ক হ্রাস, ব্যাংকিং খাতে তারল্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে নীতি সহায়তা প্রদানসহ বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারের গৃহীত এসব কার্যক্রমের ফলে অর্থনীতি অনেকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

সাময়িক হিসাব অনুযায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে জিডিপি’র ৩১.৭৫ শতাংশে, পূর্ববর্তী অর্থবছরে যা ছিল জিডিপি’র ৩১.৫৭ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারি বিনিয়োগ এবং বেসরকারি বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে জিডিপি’র ৮.১২ শতাংশ এবং ২৩.৬৩ শতাংশ, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরে ছিল যথাক্রমে জিডিপি’র ৮.০৩ শতাংশ এবং ২৩.৫৪ শতাংশ।

২০১৯-২০ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৫.৬৫ শতাংশ, যা লক্ষ্যমাত্রা (৫.৫০%) এর তুলনায় সামান্য বেশি। এ ক্ষেত্রে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৫.৫৬ শতাংশ এবং খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ৫.৮৫ শতাংশ। করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) এর প্রভাবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কর্মকা- স্থবির হয়ে পড়ায় বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি হ্রাস পেয়েছে। তবে বৈশ্বিক এ মহামারির ফলে খাদ্য ও সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটলে আগামী দিনগুলোতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির ঝুঁকি রয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩,৪৮,০৬৯ কোটি টাকা, যা জিডিপি’র ১২.৪১ শতাংশ এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ববোর্ড (এনবিআর) কর্তৃক কর রাজস্ব আহরণের  লক্ষ্যমাত্রা ৩,০০,৫০০ কোটি টাকা (জিডিপি’র ১০.৭১ শতাংশ), এনবিআর বহির্ভূত কর রাজস্ব ১২,৫৬৭ কোটি টাকা (জিডিপি’র ০.৪৫%) এবং কর বহিভূর্ত রাজস্ব ৩৫,০০২ কোটি টাকা (জিডিপি’র ১.২৫ শতাংশ)।

কোভিড-১৯ মহামারি থেকে উদ্ভুত আর্থিক মন্দা মোকাবিলার লক্ষ্যে আর্থিক খাতে যাতে পর্যাপ্ত তারল্য বজায় থাকে তা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদ হার রেপো ৬ শতাংশ থেকে একাধিক বার হ্রাস করে ৫.২৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নগদ জমা সংরক্ষণ আবশ্যকতা প্রথম পর্যায়ে ৫ শতাংশ থেকে ৪.৫ শতাংশে (দৈনিক ভিত্তিতে) এবং ৫.৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ (দুই সপ্তাহ ভিত্তিক) হ্রাস করা হয়। সিআরআর পুনরায় হ্রাস করে যথাক্রমে ৪ শতাংশ এবং ৩.৫ শতাংশ করা হয়, যা ১৫ এপ্রিল ২০২০ থেকে কার্যকর হয়েছে। এছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অগ্রিম আমানত অনুপাত এবং বিনিয়োগ- আমানত অনুপাত ২ শতাংশ বৃদ্ধি করে যথাক্রমে ৮৭ শতাংশ এবং ৯২ শতাংশে পুনঃ নির্ধারণ করা হয়েছে, যা ব্যাংক খাতে তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি ঘটিয়েছে এবং বেসরকারি খাতে ঋণ প্রাপ্তি সহজ করেছে।

২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে ব্যাপক মুদ্রার প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১২.৬৪ শতাংশ যা লক্ষ্যমাত্রার (১২.৫০%) থেকে সামান্য বেশি। এসময় বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৯.৬ শতাংশ, পূর্ববর্তী অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১১.৩২ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে সরকারি খাতে নিট ঋণবৃদ্ধি পায় ৫৫.৫১ শতাংশ, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরে ছিল ১৯.৩৭ শতাংশ। শিল্প ব্যবসা ও সেবা প্রতিষ্ঠানসমূহের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে আর্থিক সক্ষমতা অর্জনসহ শিল্প ও ব্যবসাবান্ধব বাজারে পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে ঋণ/বিনিয়োগ এর সুদ/মুনাফা হার যৌক্তিকীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হযেছে। এ লক্ষ্যে ঋণের সুদের হার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ (ক্রেডিট কার্ড ছাড়া) নির্ধারণ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্য বিরোধ, জ্বালানি তেলের হ্রাসের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহের আয় হ্রাস প্রভৃতি কারণে ২০২০ সালের শুরু থেকেই বিশ্ববাণিজ্যের গতি শ্লথ ছিল। পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকা- স্থবির হয়ে পড়ে, যার প্রভাব বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যেও পড়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের পরিমান দাঁড়ায় ৩৩, ৬৭৪.০৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের রপ্তানি আয় অপেক্ষা ১৬.৯৩ শতাংশ কম। একই সময়ে আমদানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৪, ৭৮৪.৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের আমদানি ব্যয় অপেক্ষা ৮.৫৬ শতাংশ কম। করোনা সংকট কেটে গেলে রপ্তানি খাত ঘুরে দাঁড়ারে বলে আশা করা যায়। রপ্তানি প্রণোদনা হিসেবে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে রপ্তানি উন্নয়ন ফান্ড এর আকার ৩৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বাড়িয়ে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের উন্নীত করা হয়েছে এবং সুদের হার ২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।

২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ,২০২০) দেশের শ্রমশক্তি রপ্তানি দাঁড়িয়েছে ৫.৩১ লক্ষ জন, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২.৭৩ শতাংশ বেশি। এপ্রিল ২০২০ থেকে জুন ২০২০ জনশক্তি রপ্তানি কার্যত বন্ধ ছিল। প্রবাসী বাংলাদেশি কর্তৃক অর্থ প্রেরণের ক্ষেত্রে ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনার ব্যবস্থা চালু করায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবাস আয় প্রবাহের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৮,২০৫.০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় ১০.৮৭ শতাংশ বেশি।

রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ার চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতির পরিমাণ হ্রাস পায়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে চলতি হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪,৮৪৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের ছিল ৫,১০২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। পক্ষান্তরে, মূলধন ও আর্থিক হিসাবে প্রবাহ বৃদ্ধির ফলে সার্বিক হিসেবে ভারসাম্যের উদ্ধৃত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ১৭৯ মিলিয়ন মার্কিন থেকে বেড়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে দাঁড়ায় ৩,৬৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বৈদেশিক লেনদেনের সার্বিক ভারসাম্যের উদ্বৃত্ত থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতির পরিমাণ ৩০ জুন ২০২০ তারিখে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩৬.০৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে মার্কিন ডলারের সাথে টাকার বিনিময় হার মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল।

বিশ্বব্যাপী মহামারি সৃষ্টিকারী করোনাভাইরাস বাংলাদেশ কৃষিক্ষেত্রকেও প্রবাহিত করেছে। করোনার প্রভাব মোকাবিলায় উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে উপকরণে ভর্তুকি বৃদ্ধি, কৃষি কৃষি উপকরণ সহজলভ্য করা ও কৃষি ঋণের আওতা বৃদ্ধি এবং প্রাপ্তি স্তর পদ্ধতি সহজতর করা হয়েছে। দেশজ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কৃষকের সহায়তা প্রদানের জন্য সার ও অন্যান্য কৃষি কার্যক্রমের ভর্তুকি বাবদ ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ৯,০০০ কোটি টাকা এবং ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ৯,৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

দেশের শিল্পায়নের গতিকে বেগবান করতে ‘শিল্পনীতি ২০১৬’ ঘোষণা করা হয়। এ নীতির নারীর উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাসহ নারীদেরকে শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার মূল ধারায় নিয়ে আশা এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে ভূমিকা পালন করবে। এ উদ্দেশ্য যেখানে সম্ভব সেখানে পুঁজিঘন শিল্পের পরিবর্তে শ্রমঘন শিল্প স্থাপনকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে শিল্পনীতিতে নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণসহ কুটির শিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রসারে কার্যক্রম গ্রহণ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রসারে উৎসাহ প্রদানকল্পে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যমে শিল্পঋণ বিতরণ ও অন্যান্য সহযোগিতা প্রদানের প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে। ২০১৯ সালে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত এসএমই খাতে সকল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিতরণকৃত মোট ঋণের স্থিতি ২,১৯,২৯৩.৯৭ কোটি টাকা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ বিগত ২০১৯ সালে ৭৭৪,১২২টি এসএমই উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে সর্বমোট ১,৬৭,৯৭০.৬৭ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। একই সময়কালে ৫৬.৭০৬টি এসএমই নারী উদ্যোগক্তা প্রতিষ্ঠানকে ৬,১০৮.৯৯ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়।

ইপিজেডসমূহে বিনিয়োগ ও রপ্তানি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইপিজেডসমূহে ফেব্রুয়ারি ২০২০ পর্যন্ত ৪৭৪টি শিল্প প্রতিষ্ঠান উৎপাদনরত এবং ৮৬টি শিল্প প্রতিষ্ঠান বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। বাংলাদেশের ইপিজেডসমূহে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ পর্যন্ত মোট বিনিয়োগ হয়েছে ৫,২২৬.৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ফেব্রুয়ারি, ২০২০ পর্যন্ত বেপজার ইপিজেড এর শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহে সর্বমোট ৫,০১,৩৫৫ বাংলাদেশির প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তন্মধ্যে ৬৬ শতাংশ নারী।

অপরদিকে, প্রাকৃতিক গ্যাস দেশের মোট বাণিজ্যিক জ¦ালানি ব্যবহারের প্রায় ৭১ শতাংশ পূরণ করছে। বর্তমানে মোট আবিষ্কৃত ২৭টি গ্যাস ক্ষেত্রে ডিসেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত ক্রমপুঞ্জিত গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ১৭.৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুট এবং জানুয়ারি ২০২০ সময়ে উত্তোলনযোগ্য নিট মজুদের পরিমাণ ১০.৬৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে দেশের জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা প্রায় ১৩.২৭ লক্ষ মেট্রিক টন। প্রাকৃতিক গ্যাস ও জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য খনিজ সম্পদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে এবং দেশের দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে জ্বালানি উৎসের বহুমুখীকরণ (fuel diversification) বিশেষ করে প্রাকৃতিক গ্যাসসহ জ্বালানির দক্ষ ও সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে।

আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিবহন এবং তথ্য ও অন্যান্য যোগাযোগ নেটওয়ার্কের সাথে বাংলাদেশকে সংযুক্ত করার উপযোগী উন্নত এবং সুসমন্বিত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দেশে ফেব্রুয়ারি ২০২০ পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণির মোট প্রায় ২২,০৯৬ কিলোমিটার মহাসাগর আছে। সড়কপথে উন্নয়নের পাশাপাশি পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, বিআরটি, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

পরিবেশ বান্ধব, নিরাপদ এবং সুলভে মালামাল পরিবহনে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হিসেবে রেলের ভূমিকা অব্যাহত রাখার জন্য উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের মোট রেলপথের দৈর্ঘ্য ২,৯৫৫.৫৩ কিলোমিটার। নৌপথের নাব্যতা সংরক্ষণ ও নৌপথ উদ্ধার, নিরাপদ নৌযান চলাচল নিশ্চিতকরণ, অভ্যন্তরীণ নৌ বন্দরসমূহের উন্নয়ন, অভ্যন্তরীণ নৌপথে কন্টেইনার পণ্য পরিবহনের অবকাঠামো সৃষ্টি ইত্যাদি কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। সমুদ্রপথে দেশের প্রায় ৯২ শতাংশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের প্রবৃদ্ধির হার ১২.৩৮ শতাংশ।

জাতীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেড বর্তমানে ০৭ (সাত) টি অভ্যন্তরীণ ও ১৫টি (পনের) আন্তর্জাতিক গন্তব্যে সার্ভিস পরিচালনা করছে। দেশি টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং এর মান উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের জানুয়ারি ২০২০ পর্যন্ত দেশের মোট মোবাইল ফোন গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬.৬০ কোটিতে। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (SDG) ও সপ্তম পঞ্চমবার্ষিকী পরিকল্পনার সাথে সংগতিপূর্ণ করে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার মানবসম্পদ উন্নয়নের সাথে সম্পৃক্ত খাতসমূহ- শিক্ষা ও প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ, নারী ও শিশু, সমাজ কল্যাণ, যুব ও ক্রীড়া উন্নয়ন, সংস্কৃতি, শ্রম ও কর্মসংস্থান ইত্যাদি ক্ষেত্রে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৩.৬৭ শতাংশ বাজেট বরাদ্দ ব্যয় করেছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শতকরা ৬০ ভাগ মহিলা শিক্ষকের হার ১৯৯১ সালের ২১.০৯ শতাংশ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৬৪.৫২ শতাংশ উন্নীত হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহ সকলের জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিদ্যালয়ে ভর্তি, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা, উপবৃত্তি ও ছাত্র-শিক্ষক সংযোগ ঘণ্টা বৃদ্ধির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা খাতে সরকারের নেয়া অগ্রাধিকারভিত্তিক বিভিন্ন কর্মকান্ডের ফলে দেশের প্রজনন হার ও মৃত্যুর হার কমেছে। গড় আয়ুসহ নবজাতক শিশু ও মাতৃ মৃত্যু হ্রাসে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। অপুষ্টির হার ও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে সরকার স্বাস্থ্যখাত সংক্রান্ত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (SDG) অর্জন কাজ করেছে। করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) এর বিস্তার রোধ ও নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সংক্রমিত ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছে। জাতীয় উন্নয়ন কর্মকা- বাস্তবায়নে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ও নারী রাজনৈতিক সামাজিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে আইন ও বিধিমালা করা হয়েছে। এছাড়া, জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির বাস্তবায়ন এবং নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ২টি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণের ফলে মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ ক্রমশও  এগিয়ে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, ‘Human Development Report-2019’ অনুযায়ী  মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় একধাপ এগিয়ে ১৩৫তম হয়েছে। গত এক দশকে সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং সরকারি, বেসরকারি, বহুবিধ উন্নয়ন কর্মকান্ডের সঠিক ও কার্যকর বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচনে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুযায়ী দারিদ্র্যের হার ২০০৫ সালের ৪০.০ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০১৬ সালে ২৩.৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বিবিএস এর সর্বশেষ প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দারিদ্র্যের হার হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২০.৫ শতাংশ।

দারিদ্র্য বিমোচনে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য বাস্তবায়নে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এ খাতের মাত্রা পরিধি ও বরাদ্দ প্রতি বছর বাড়ছে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দের সঠিক ও কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ সামাজিক নিরাপত্তা বিষয়ক জীবনচক্র পদ্ধতি অনুসরণ করছে। এ লক্ষ্যে জাতীয় সামাজি নিরাপত্তা কৌশল প্রণীত হয়েছে। ২০১৮-২০ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ৭৪,৩৬৭ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্য হার ৯.৭ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। দারিদ্র্য হ্রাসকরণে সরকারের নানা কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ক্ষুদ্র ঋণসহ নানাবিধ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। তন্মধ্যে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ ‘গৃহায়ন’ ও ‘আশ্রয়ন’, ‘ঘরে ফেরা’ ‘কর্মসূচি উল্লেখযোগ্য’। এছাড়াও, বয়স্কভাতা, বিধবা ও স্বামী পরিত্যাগ তাদের ভাতা, দুঃস্থ মহিলা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা প্রদানের মাধ্যমে সরকার দেশের দরিদ্র্য জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে কাজ করছে।

দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি বেসরকারি খাত। শিল্পের প্রসার, রপ্তানি খাত সম্প্রসারণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সরকারি বেসরকারি খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। উন্নয়ন কর্মকান্ডের সাথে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সার্বিক বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নে সরকার নিরলস কাজ করছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি অর্থায়নে পৃথকভাবে গৃহীত প্রকল্প ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সরকার নানা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১,৩৬৮টি বেসরকারি প্রকল্পে মোট বিনিয়োগ প্রস্তাবনা ছিল ১,১৪,০৯৫.০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (ফেব্রুয়ারি ২০২০ পর্যন্ত) ৭৬৪টি বেসরকারি প্রকল্পে এ প্রস্তাবনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯২,৭৫৯.০০ কোটি টাকা। ২০১৯ (জানুয়ারি-ডিসেম্বর পর্যন্ত) সালে মোট বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রবাহ ছিল ২,৮৭৩.৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০১৮ সালে ছিল ৩,৬১৩.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জানুয়ারি ২০২০ পর্যন্ত) মোট ৪১,৮৪৮ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে যার ৩৭.৯২ শতাংশই এসেছে বেসরকারি খাত থেকে।

টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিবেশ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিকে উন্নয়ন কার্যক্রমের সাথে সমন্বিত করার প্রয়াস অব্যহত রয়েছে। পরিবেশগত সমস্যা সমূহ নিরসনপূর্বক দূষণমুক্ত, সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিতকল্পে ও পরিবেশবান্ধব প্রতিবেশ গড়ে তুলতে বিভিন্ন নীতি এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (SDGs) এর পরিবেশ গত লক্ষ্যমাত্রাসমূহ অর্জনে কর্মকৌশল প্রণয়ন করা হয়েছে।

দেশে কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারির প্রার্দুভাবের প্রেক্ষাপটে সংকট মোকাবিলা ও অর্থনীতির ওপর সম্ভাব্য বিরূপ প্রভাব উত্তরণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি একটি সামগ্রিক কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছেন। এ কর্মপন্থার চারটি প্রধান কৌশলগত দিক রয়েছে, যার প্রথমটি হল সরকারি ব্যয় হ্রাস করা, এ ক্ষেত্রে কর্মসৃজনকে প্রাধান্য দেওয়া এবং বিলাসী ব্যয় নিরুৎসাহিত করা। দ্বিতীয় কৌশলটি হল ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্প সুদে কতিপয় ঋণ সুবিধা প্রবর্তন করা যাতে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পুনরুজ্জীবিত হয় এবং দেশে বিদেশে উদোক্তাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তৃতীয় কৌশলটি হল হতদরিদ্র ও কর্মহীন হয়ে পড়া নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত জনগণকে সুরক্ষা দিতে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি করা এবং চতুর্থ ও সর্বশেষ কৌশলটি হল বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি করা। তবে এ কৌশলটি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে মূল্যস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাব যেন নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

উক্ত কর্মপন্থার আলোকে জরুরি মানবিক সহায়তা এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য সরকার ইতোমধ্যে ১,২০,৯৫৩ কোটি টাকার আর্থিক ও প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, যা জিডিপি’র ৪.৩ শতাংশ। এই প্যাকেজে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ঃ

  • রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা অব্যাহত রাখার স্বার্থে প্রাথমিকভাবে মাত্র ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জের ভিত্তিতে ৫ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল প্রদান করা হয়েছে, যার মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক কর্মচারীর কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে।
  • ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবসায় টিকিয়ে রাখতে ৩৩ হাজার কোটি টাকার ওয়ার্কিং ক্যাপিট্যাল ঋণ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, তার সুদের হার হচ্ছে ৯ শতাংশ। এর মধ্যে অর্ধেক ৪.৫০ শতাংশ ঋণ গৃহীত এবং অবশিষ্ট ৪.৫০ শতাংশ সরকারি ভর্তুকি হিসেবে প্রদান করবে। ফলে বৃহৎ শিল্প ও সার্ভিস সেক্টর করোনার সময় তাদের ব্যবসায় কার্যক্রম চালু রাখতে সক্ষম হয়েছে।
  • কুটির শিল্পসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার স্বল্প সুদের ওয়ার্কিং ক্যাপিট্যাল ঋণ সুবিধা চালু করা হয়েছে, তারও সুদের হার ৯ শতাংশ। এর মধ্যে ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে প্রদান করবে অবশিষ্ট ৪ শতাংশ প্রদান করবে ঋণগৃহীতা। ফলে সার্ভিস সেক্টর কুটির শিল্পসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো করোনার সময়ে তাদের ব্যবসা কার্যক্রম চালু রাখতে সক্ষম হয়েছে।

 বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবর্তিত ইডিএফ (Export Development Fund)- এর সুবিধা বাড়ানো ও Preshipment credit refinance scheme সুবিধা প্রদান করা হয়েছে।

  • করোনা ভাইরাস এর প্রাদুর্ভাবের কারণে হঠাৎ কর্মহীন হয়ে পড়া দরিদ্র মানুষের জন্য মানবিক সহায়তা হিসেবে দেশব্যাপী মোট ৫ লক্ষ মেট্রিক টন চাল ও ১ লক্ষ মেট্রিক টন গম বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে।  পুনরায়, নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর মাঝে মাত্র ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করা হচ্ছে। এ সকল পদক্ষেপের কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খাদ্যের অভাব হয়নি এবং তাদেরকে পুনরায় দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস পেয়েছে।
  • ভাইরাসজনিত কারণে কর্মহীনতা ও আয়ের সুযোগ হ্রাসের কবল থেকে দেশের অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিতে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সারা দেশের নির্বাচিত ৫০ লক্ষ উপকারভোগী পরিবারে প্রত্যেককে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে অনুদান ট্রেজারি থেকে সরাসরি তাদের ব্যাংক বা মোবাইল একাউন্টে প্রদান করা হয়েছে।
  • সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় দেশের অতি দরিদ্র ১০০টি উপজেলায় বয়স্ক ভাতা কর্মসূচি এবং বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা কর্মসূচির আওতায় শতভাগে উন্নীত করা হয়েছে। ফলে, প্রতিবন্ধী ভাতাসহ এই দুই ভাতার আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা মোট ১১ লক্ষ জন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং করোনাকালে তাদের জীবন নির্বাহ সহজ হয়েছে।
  • করোনাভাইরাস পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য যে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার হলো কৃষিখাতের উৎপাদন অব্যাহত রাখা। দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা  নিশ্চিতের জন্য কৃষি উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কৃষকের উৎপাদিত ধান-চালের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি ও বাজারে চালের দাম স্থিতিশীল রাখতে চলতি ইরি-বোরো মৌসুমে সরাসরি ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা আরো দুই লক্ষ টন বাড়ানো হয়েছে।
  • জাতির পিতার জন্মশর্তবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সকল গৃহহীন মানুষের জন্য গৃহনির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে দরিদ্র মানুষকে আর গৃহহীন থাকতে হবে না।

সার্বিকভাবে বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও দূরদর্শি পরিকল্পনায় বাংলাদেশে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ প্রসারের লক্ষ্যে সরকার বিনিয়োগবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন, আইন ও বিধিগত সংস্কার তথ্য সার্বিক বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে সারাদেশে মোট ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ১ কোটি লোককে কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ব্যবসা সহজীকরণ এবং বিনিয়োগকারীদের দ্রুত এবং নির্বিঘ্ন সেবা প্রদানের লক্ষ্যে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস আইন, ২০১৮’ জাতীয় সংসদে পাশ হয়েছে। এ আইনের আওতায় বিনিয়োগকারীগণকে একই অফিস থেকে প্রয়োজনীয় সেবাসমূহ প্রদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে ওয়ান স্টপ সার্ভিসের আওতায় বিনিয়োগকারীদেরকে ০৯ ধরনের সেবা অনলাইনে প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়া, বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দ্রুত বিদ্যুতায়নের প্রচেষ্টা বাস্তবায়ন, জ্বালানির বহুমুখীকরণ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং সর্বোপরি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহারসহ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ও পিপিপি’র আওতায় অবকাঠামো খাতে সরকার যে ব্যাপক পরিকল্পনা নিয়েছে তা বাস্তবায়নের ফলে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে এবং আরও উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।

প্রতিবেদক : এআইজি (প্ল্যানিং অ্যান্ড রিসার্চ-১), বাংলাদেশ পুলিশ

ভালো লাগলে শেয়ার করে দিন :)

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x