মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ
সকাল বেলা রওনা দিই গোলাপগঞ্জ থানার উদ্দেশ্যে। থানা সদর পার হয়ে ডানে মোড় নিই। ঢাকা দক্ষিণের সড়ক ধরে সামনে এগিয়ে চলছি। আকা-বাঁকা ও হালকা পাহাড়ি পথ। দুপাশে সবুজের সমারোহ। রাস্তার গুণগত মান অনেক ভালো। গাড়ি দ্রুত এগিয়ে চলছে। কিছু দুর যাওয়ার পর বামে মোড় নেই। গ্রাম্য চিকন পথ পেরুতেই গোলাপগঞ্জ ঢাকা দক্ষিণ সরকারি কলেজ।
টিলার ওপর ঢাকা দক্ষিণ কলেজটি। তিনস্তরের পাহাড়ি সিঁড়ি মাড়িয়ে উঁচুতে উঠি। একটি বড় মাঠ। একসাইডে কলেজটির একাডেমিক ভবন। মাঠে প্রবেশের মুখে মবিলাইজেশন কন্টিনজেন্ট ক্যাম্পের গেট বানানো হয়েছে। এর উল্টা দিকে সামিয়ানা টানিয়ে বানানো হয়েছে সম্মেলন স্থল। মাঠের আরেক পাশে একটির পর আরেকটি তাঁবু খাটিয়ে পুলিশ সদস্যদের জন্য থাকার জায়গা তৈরি করা হয়েছে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের ১৫ দিন মবিলাইজেশন কন্টিনজেন্টের জন্য জায়গাটি নির্ধারণ করা হয়। পুলিশ সুপার সিলেট মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন কন্টিনজেন্টের শুভ উদ্বোধন করেন। সমাপনি দিনে আমাকে প্রধান অতিথি হিসেবে দাওয়াত করা হয়। সিলেট জেলার বিভিন্ন ইউনিটের শতাধিক পুলিশ সদস্য এ কন্টিনজেন্টে অংশগ্রহণ করেন। সমাপনি দিনের অনুষ্ঠানের শুরুতে রায়ট কন্ট্রোলের একটি মহড়ার আয়োজন করা হয়। মহড়াটি ছিল দৃষ্টিনন্দন ও শিক্ষণীয়।
পরে সামিয়ানার মধ্যে আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণ করা হয়। এ ১৫ দিনের মধ্যে বাঙালি জাতির গর্বের ২১ ফেব্রুয়ারির দিনটিও ছিল। সেদিনে পুলিশ সদস্যরা ক্রীড়া উৎসবের আয়োজন করে। ১৫ দিনে আইন ও পুলিশি কার্যক্রমের ওপর তাদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ ও ক্রীড়া উৎসবে যারা ভালো করেছিলেন তাদের পুরস্কার দেওয়া হয়। ক্যাম্প থেকে পুলিশ সদস্যগণ পাশ্ববর্তী এলাকায় নিয়মিত অভিযান চালান। ওয়ারেন্ট তামিল ও নিয়মিত মামলার আসামি গ্রেফতার করেন। পথে পথে পুলিশ চেক পোস্ট করেন। বাজারে প্যাট্রোল করেন। লোকালয়ে গিয়ে উঠান বৈঠক করেন। বিট অফিসে গিয়ে মিটিং করেন। মোটকথা ওই এলাকার আইন-শৃঙ্খলার উন্নয়ন ও অপরাধ প্রবণতা হ্রাসকল্পে প্রয়োজনীয় সব কিছুই করা হয়। দূরবর্তী কোনো এলাকার আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হলে এবং অপরাধ বেড়ে গেলে সাময়িক পুলিশ মোতায়েন করে এ ধরনের কাজ করার নজির রয়েছে পুলিশ বাহিনীতে।
প্রয়োজনের তাগিদে ছাত্ররা নিজের পরিবার ছেড়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে লেখাপড়া করেন এবং হলে থাকেন। সেখানে পারিবারিক মায়া-মমতা সাময়িক বিসর্জন দিয়ে শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। তেমনি পুলিশ সদস্যরা জনসেবার লক্ষ্যে দূরবর্তী অঞ্চলে গিয়ে এ ধরনের কাজ করে থাকেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যেমন শীতকালীন মহড়ায় ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে কাজ করেন, পুলিশ মবিলাইজেশন কন্টিনজেন্টের কাজও অনেকটা সেরকম।
জরুরি প্রয়োজনে একটি দেশের কমান্ডো বাহিনী অ্যারোপ্লেনে গিয়ে প্যারাসুটে করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বা গহীন জঙ্গলে গিয়ে সামরিক আবাসন গড়েন এবং তাদের কর্মসিদ্ধির জন্য মোতায়েন হন। একটি সাজোয়া নৌ-বহর সব আয়োজন নিয়ে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে ছুটে গিয়ে অন্য প্রান্তে কাজ করেন। মবিলাইজেশন কন্টিনজেন্ট সে ধরনের কাজেরই ক্ষুদ্ররূপ। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে জাতিসংঘ পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের এ ধরনের তাঁবুতে বসবাস করে কাজ চালিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়।
গোলাপগঞ্জ থানার ঢাকা দক্ষিণের মবিলাইজেশন কন্টিনজেন্টের প্রত্যেক সদস্য চাকরি জীবনে নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। বিরূপ পরিস্থিতিতে খাপ খেয়ে কাজ করার যোগ্যতা অর্জন করেন। কষ্ট করে এখানে থাকার জন্য তাদের অতিরিক্ত ভাতা দেওয়ার বিষয়ে পুলিশ সুপারকে অনুরোধ করা হয়। এখান থেকে ফিরে গিয়ে পরিবারের সংস্পর্শে আসার লক্ষ্যে ছুটি দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। এ যেন কষ্টের পরে সুখের দিন ফিরে পাওয়া।
পুলিশ সুপার সিলেট ফরিদসহ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গোলাপগঞ্জ সার্কেল রাশেদ, ওসি গোলাপগঞ্জ থানা হারুন, আরআই পুলিশ লাইনস্ সিলেট মোঃ নূরুল ইসলাম মবিলাইজেশন কন্টিনজেন্ট চলাকালীন অফিসার-ফোর্সের মনোবল বৃদ্ধি, কাজের মান পরীক্ষা, সুবিধা-অসুবিধা দেখার জন্য কন্টিনজেন্ট প্রাঙ্গণে অনেকবার এসেছিলেন। এ ১৫ দিনের মধ্যে ঝড়-বৃষ্টিও হয়েছিল একদিন। বিরূপ আবহাওয়ায় খাপ খেয়ে কাজ চালিয়ে নিয়েছিলেন তারা। এটাই এ কাজের সৌন্দর্য।
সমাপ্তি দিনে বেশ কয়েকজন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এসেছিলেন আমাদের শুভেচ্ছা জানাতে। সাংবাদিকও ছিলেন। মিডিয়া কাভারেজ দিয়েছিলেন তারা। পাশেই একটি ছোট্ট টিলার ওপর সামিয়ানা টানিয়ে মধ্যহ্ন ভোজের আয়োজন করা হয়েছিল। সবাই এ ভোজে অংশগ্রহণ করেন। আয়োজন ছিল অনেকটা পিকনিকের মতো।
পুলিশ সুপারকে জানানো হয়েছিল কন্টিনজেন্ট শেষে চলে আসার সময় যেন সমস্ত আঙ্গিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখা হয়। ১৫ দিনের ঘর সংসারে যে সব পুলিশ সদস্য অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং আমরা যারা সাময়িক সময়ের জন্য গিয়েছিলাম, বিষয়টি ছিল সবার মনে রাখার মতো।
লেখক : ডিআইজি, সিলেট রেঞ্জ।
0 Comments