মোহাম্মদ শাহজাহান পিএইচডি
১.
এ মূহুর্তে সর্বাধিক আলোচনার বিষয় কি? যাকে-ই প্রশ্ন করা হোক, উত্তর একটিই ‘করোনা’ নামক বৈশ্বিক মহামারির প্রতিষেধক আবিষ্কার। মানব স্বাস্থ্যের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক এ যুদ্ধের সমাধান খোঁজার জন্য সমগ্র বিশ্বের বৈজ্ঞানিকদের ঘুম হারাম। সংক্ষেপে যদি বলি, সমস্যার সমাধান আবিষ্কারের অলীককল্পনা ধারাবাহিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে বাস্তব সম্মতও প্রমানিত পথ খুঁজে পাওয়ার দীর্ঘ প্রক্রিয়াই হলো গবেষণা। যার শুরু হলো আপাত অবাস্তব কিংবা স্বপ্নের মধ্য দিয়ে আর শেষ হলো বাস্তব সম্মত ও প্রমানিত সমাধান রুপায়নের মাধ্যমে।
শুরু করতে চাই আলবার্ট আইনস্টাইন এর মতে, “Imagination is the highest form of Research’’ সকলের জানা আছে যে, প্রচলিত ধারণার বাইরে অবস্থান নেয়া চ্যালেঞ্জের। এজন্য প্রচলিত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়নীতি এবং প্রজন্ম শুণ্যতার মানসিকতা আর নতুন আবিষ্কারের প্রতি চরম অনীহা প্রভৃতি নতুন কিছু চিন্তা, আবিষ্কার এবং উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। চিন্তন প্রক্রিয়ায় বাধা দিয়ে বা শাস্তি (জরিমানা, মৃত্যু কিংবা নির্বাসন) দিয়ে বন্ধ করার নজির ইতিহাসে প্রচুর পাওয়া যাবে। তাতে কি নতুন সূত্র আবিষ্কার বন্ধ হয়েছে, হয়নি। মানুষের অদম্য ইচ্ছা শক্তি অবদমিত করা যায় নি। নতুন সৃষ্টির উন্মাদনায় মানুষ এগিয়েছে। বাহ্যিক অনেক ধরণের লাগাম টেনে অনেক কিছু বন্ধ করা গেলেও মানুষের মনে লাগাম টানা যায়নি। প্রচলিত বিশ্বাস ও অন্ধত্বের দেয়াল ভেঙ্গে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে নতুন আবিষ্কারের নেশায় গবেষণা কাজ এগিয়ে গিয়ে মানব সেবার অনেক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এ ক্ষেত্রে গুণিজনরা সব ক্ষেত্রে মোটিভেশন দিয়ে নতুনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে নতুনের উদ্যোগ সমর্থন দিয়েছে। জয়গান গেয়েছে নতুনের। এ প্রসঙ্গে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর কবিতর দু’টি চরণ উদ্ধৃত করা যায়-
‘ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ,
আধ মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।’
মানুষের কল্পনা প্রথমে অবিশ্বাস্য বলে মনে হলেও স্বপ্নের জগতে অনবরত পথ চলা বন্ধ হয়নি। একদিন স্বপ্নই সত্য বা বাস্তবে রূপ লাভ করেছে। একবার সফলতা অর্জিত হওয়ার পর দুর্বার গতি শুধুই এগিয়েছে। আটকাতে পারেনি মানুষের প্রচলিত প্রথা, মূল্যবোধ, নীতি, সংস্কৃতি কিংবা ধর্ম। প্রশ্ন হতে পারে এর কারণ কি?
নতুন আবিষ্কারের নেশা-ই মানুষকে বেগবান করেছে। আজকে যা অসম্ভব মনে হয়েছে আগামীদিনে সেটি-ই হয়েছে সম্ভব। মানুষের ‘কল্পনা ও ভাবনাকে যখন অসম্ভব ও অবাস্তব বলে মনে হবে, তখনই ধরে নিতে হবে নতুন কোন ধারণা, আবিষ্কার পৃথিবীতে আসার আগাম বার্তা ঘোষণা করছে।
এতে একটিবিষয় স্পষ্ট যে, মানুষের প্রয়োজন নতুন আবিষ্কারকে আমন্ত্রণ জানায়। নতুন চাহিদা পূরণের বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে হয়তো পূরণ করা সম্ভব হয়না কিন্তু নিত্য প্রচেষ্টায় মানুষ সকল অজেয়কে জয় করে তবে সৃষ্টি সুখের স্বাদ গ্রহণ করে। এগুলো সময় নির্ভর। আজ হয়নি, কাল হবে। এ মানসিকতায় নিরন্তর প্রচেষ্টায় সফলতা হাতের মুঠোয় ধরা দিবেই। দিতে হবে, কারণ এটাই প্রকৃতির রীতি। প্রকৃতি জন্ম ও মৃত্যু ব্যতীত সব বিষয়ে দ্বার উন্মুক্ত করে রেখেছে। পবিত্র কোরআনে অনেক জায়গায় আল্লাহতায়ালা ‘জ্ঞানীদের চিন্তা’র বিষয়ে উল্লেখ করে পৃথিবী ঘুরে দেখতে নির্দেশনা দিয়েছেন। তাই ভীত হলে ঘর কুনো হয়ে থাকতে হবে আর অদৃষ্টকে দোষারোপ করে অস্বাভাবিক আত্মতৃপ্তি লাভ করে বসে থাকতে হবে। জ্ঞানীরা বলেছেন- ‘একবার না পারিলে দেখ শতবার’।
আমরা বলার চেষ্টা করেছি যে, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের যুক্তি, চিন্তা ও বিশ্বাস এবং মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিক জগতে পরিবর্তন আসে। প্রথমে হয়তো মানুষ নতুনকে গ্রহণ করতে চায়না কিন্তু প্রয়োগিক ফলাফল মানুষকে বাধ্য করে নতুনকে গ্রহণ করতে। এজন্য নিরন্তর গবেষণা অব্যাহত রাখতে হবে। সকল ধরণের চ্যালেঞ্জকে মনে করতে হবে সাময়িক বাধা। অনেকটা রাস্তা চলার ক্ষেত্রে স্পিডব্রেকার হিসেবে মনে করলে সাময়িক ধকল কাটিয়ে বড় যাত্রার মিছিলে সম্পৃক্ত হওয়া সম্ভব হবে।
এটি স্বীকৃত যে , এক সময় মানুষ যখন অবিশ্বাস্য, উদ্ভট বা কাল্পনিক মনে করেছে সময়ের বিবর্তন কিংবা পরিবর্তনের ফলে সেটিকে বাস্তব হতে দেখে বিম্মিত ও চমৎকৃত হয়েছে। মেনে নিয়েছে নতুনের আগমনকে। নতুন আবিষ্কার মানুষকে করেছে প্রভাবিত এবং চিন্তার জগতে এনছে অভাবনীয় পরিবর্তন। মানুষের ধারাবাহিক সভ্যতা আলোচনা থেকেই সেটি প্রমানিত।
মৌলিক ধারণার ফলিত ফলাফল মানুষের কল্যাণে ব্যবহার উপযোগি হওয়ায় নতুন ও পুরাতন হয়েছে একাকার এবং একের মধ্যে অপরটি হয়েছে বিলিন। এতে মানুষের অদম্য উৎসাহ কমেনি, বেড়েছে আরও নতুন কী করা যায় বা করার আছে। একটি শেষ তো অপরটি যাত্রার পদধ্বনি মানুষকে শুধু এগুতেই শিখিয়েছে, পিছপা হতে নয়। যার ফলে এক সভ্যতা গেছে তো নতুন সভ্যতা হাজির হয়েছে। এটাকে ইলেট্রনিক্স ডিভাইসগুলোর দ্রুত পরিবর্তনের সাথে তুলনা করা যেতে পারে।
কালের বিবর্তনে এ সকল পরিবর্তনকে বিজ্ঞান এবং সামাজিক বিজ্ঞান এ দু’নামে পরিচিতি দিয়েছে। বিজ্ঞান আর সামাজিক বিজ্ঞানের লক্ষ্যণীয় পার্থক্য হচ্ছে বিজ্ঞান যে সত্য আবিষ্কার করে তা সব জায়গায় ফলাফল একই থাকে অপরদিকে সামাজিক বিজ্ঞানের সত্য স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে পবির্তন হলেও সত্যের কাছাকাছি থাকে। এরও কারণ আছে একটি গবেষণা করে মানুষ ব্যতীত অন্যান্য বিষয়ে আর অপরটি মানুষ নিয়ে। ভৌগলিক পরিবেশ সংস্কৃতি, ধর্ম ও বর্ণ কিংবা আচরণ পরিবর্তনজনিত কারণে সামাজিক বিজ্ঞানের প্রক্ষেপন সত্যের কাছাকাছি যায়। এতে মানুষ একটি সাধারণ ধারণা পায় যা প্রয়োগিক কাজে ব্যবহারে তাকে সহায়তা করে। আর বিজ্ঞানের সত্য আবিষ্কার গ্রহণ করতে চিন্তা করার অবকাশ থাকেনা। এক কথায়, বিজ্ঞানের সুত্রপাত ক্লান্তিহীন এক পরিশ্রমের ফলিত রূপ। মানুষের মেধা-চিন্তা ও পরিশ্রমের মিশ্রনে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সুত্রপাত।
মানুষ যা ভেবেছে, স্বপ্ন দেখেছে সে ভাবা এবং স্বপ্ন দেখাকে বাস্তবে প্রমাণ করেছে সেটি-ই গবেষণা। এর মৌলিক দর্শনই হলো প্রশ্ন করা এবং প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা। এটিকে সারলীকরণ করা হলে এ রকম দাঁড়ায়- আজকে যা অসম্ভব, কালকে সেটি-ই জয় করে প্রমাণ করার বিধিবদ্ধ, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানই হলো গবেষণা। এটাকে অন্যভাবেও বলা যায়- মানব মনের কৌতুহল নিরসনের জন্য ধারাবাহিক, প্রণালীবদ্ধ বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানকে বলা হয় গবেষণা।
গবেষণার অন্যতম কাজ হচ্ছে- পুরাতন মতবাদ বা সুত্রকে পরিবর্তন করে নতুন মতবাদ বা সুত্র প্রদান করা। বৈজ্ঞানিক গবেষণা সত্য আবিষ্কারে নিরলসভাবে কাজ করে। বিজ্ঞান সত্যের উপর আত্ম-বিশ্বাস নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। যে কেউ এ সত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে, সেক্ষেত্রে যিনি চ্যালেঞ্জ করবেন তাকে প্রমান করতে হবে সত্য কোনটি? এখানেই গবেষণার সফলতা।
পৃথিবীতে এখন অনেক ধরণে স্টাইল এর পুলিশিং রয়েছে। একেক দেশ একেক ধরণের পুলিশিং স্টাইল নিয়ে কাজ করে। নিত্য নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করে, পরীক্ষা করে। তারপর সে-টিই ব্যবহার করে জনকল্যাণ ও সেবাধর্মী পুলিশি ব্যবস্থা কার্যকর করে। এটি-ই অধুনা ‘‘ইভিডেন্স বেইজ পুলিশিং স্টাইল’’ নামে পরিচিত পেয়েছে।
লেখক : পরিচালক (আরএন্ডপি),
পুলিশ স্টাফ কলেজ।
0 Comments