॥১॥
মুজিব রাজনীতিতে বেশি সময় দিতে লাগলেন। বাবা লুৎফর রহমান তাকে বাঁধা দিতেন না, শুধু বলতেন, ‘লেখাপড়ার দিকে নজর দিও।’ মুজিবও লেখাপড়ার দিকে একটু নজর দিলেন। কারণ কয়েক বছর অসুস্থতার জন্য লেখাপড়ার ক্ষতি হয়েছে। খেলাধুলার দিকেও মুজিবের খুব ঝোঁক ছিল। স্কুলের ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন মুজিব। বাবাও ভালো খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারি ছিলেন। মুজিবের টিম ও বাবার টিমের যখন খেলা হতো তখন জনসাধারণ খুব উপভোগ করত। মুজিবের মিশন স্কুলের টিম খুব ভালো ছিলো। মহকুমায় যারা ভালো খেলোয়াড় ছিলেন, মুজিব তাদের স্কুলে ভর্তি করাতেন আর স্যারদের অনুরুধ করে বেতন ফ্রি করে দিতেন। ১৯৪০ সালে বাবার টিমের সাথে যতবার খেলা হয়েছে ততবারই মুজিবের টিম জয়ী হয়েছে। অফিসার্স ক্লাবের টাকার অভাব ছিলো না। তারা বাইরে থেকে ভালো খেলোয়াড় ভাড়া করে আনতো। আর মুজিবরা তো ছাত্র, তাদের এগারো জন খেলোয়াড় রোজই খেলতো। খেলতে খেলতে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো। ওদিকে লুৎফর সাহেব বললেন, ‘কাল সকালেই খেলতে হবে। বাইরের খেলোয়াড়দের আর রাখা যাবে না, অনেক খরচ।’ মুজিব বললেন, ‘আগামীকাল সকালে আমরা খেলতে পারবো না, সামনে আমাদের পরীক্ষা।’ মুজিবের বাবা প্রথমে গোপালগঞ্জ ফুটবল ক্লাবের সেক্রেটারীর কাছে গেলেন। পরে স্কুলের হেডমাস্টারকে খেলার আয়োজন করতে বললেন। হেডমাস্টার বাবু বসুরঞ্জন সেনগুপ্ত বললেন, ‘মুজিব, আগামীকাল সকালে খেলো।’ মুজিব বললেন, ‘স্যার, আমাদের সকলেই ক্লান্ত, এগারো জনই সারা বছর খেলেছি। সকলের পায়ে ব্যথা, দুই-চার দিন বিশ্রাম দরকার। নতুবা হেরে যাবো।’ হেডমাস্টার বললেন, ‘মুজিব, বাবার কাছে হেরে যাও।’ হেডমাস্টারের অনুরোধে মুজিব খেলতে রাজি হলেন। পরের দিন সকালে খেলা হলো। বাবার টিমের কাছে মুজিবের টিম এক গোলে পরাজিত হলো।
॥২॥
১৯৪১ সালে মুজিবের সাথে প্রথম কাজী নজরুলের সাক্ষাৎ হয়। ফরিদপুর ছাত্রলীগের জেলা সম্মেলন। আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদদের। তাঁরা হলেন-কবি কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির এবং ইব্রাহিম খাঁ। মুজিবদের বিরোধী পক্ষ সে সভা করতে দিলো না। প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করলো। সম্মেলন হলো হুমায়ুন কবির সাহেবের বাড়িতে। সম্মেলনে কমিটি বিষয়ক আলোচনা হলো না। শিক্ষা ও ছাত্রদের কর্তব্য সম্বন্ধে বক্তৃতা হলো। বক্তৃতা হলো ছাত্রদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে। আর যার আলোচনা মুজিবকে মোহিত করলে তিনি হলেন নজরুল। নজরুল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম অগ্রনায়ক। নজরুল তার জীবনের কথা সবাইকে শোনালেন। ১৯১৯ সালে দশম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার আগে স্কুল ত্যাগ করে ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে সৈনিক হিসেবে যোগদান করেন এবং ব্রিটিশের হয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন। তারপর যুদ্ধ থেকে ফিরে কলকাতার সাহিত্যিক জীবন শুরু করলেন এবং লেখা শুরু করলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। তার একের পর এক বই বাজেয়াপ্ত হতে লাগলো। ১৯২২ সালের ১৩ অক্টোবর নজরুল প্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করেন। এ কারণে ব্রিটিশ সরকার তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। ২৩ নভেম্বর তিনি গ্রেফতার হন। ১৯২৩ সালে নজরুল তার রাজবন্দির জবানবন্দি আদালতে উপস্থাপন করেন। তারপরও তাকে এক বছর সশ্রম কারাদ- প্রদান করা হয়। কারাভোগকালীন নজরুল ৩৯ দিনের অনশন করেন। নজরুলকে রবীন্দ্রনাথ তার ‘বসন্ত গীতিনাট্য’ উৎসর্গ করেন এবং অনশন ভঙ্গের জন্য অনুরোধ করেন। এসব গল্প মুজিবকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। নজরুল নিজের লেখা গান গেয়ে শোনান আর কবিতা আবৃত্তি করেন। নজরুলের গাওয়া গান-
দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার!
আর ‘মানুষ’ কবিতার আবৃত্তি-
গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে সব কালে ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।-
গান ও কবিতার মাধ্যমে মুজিবের মনের গভীরে কাজী নজরুল ইসলাম গ্রন্থিত করে দিলেন এটাই যে, মানব সেবাই জগতের সবচেয়ে বড় ধর্ম।
॥৩॥
কলকাতায় গিয়ে মুজিব প্রায় সকল সময় শহীদ সাহেবের কাছে কাছে থাকতেন। আনোয়ার হোসেন তখন ছাত্রদের অন্যতম নেতা ছিলেন। তাঁর সাথে কলকাতার মুজিবের পরিচয় হয়। শহীদ সাহেব আনোয়ারকেও খুব ভালোবাসতেন। ছাত্রদের মধ্যে দুইটা দল ছিলো। ফজলুল কাদের চৌধুরী ও ওয়াছেক সাহেবের মধ্যে গোলমাল লেগেই থাকতো। ১৯৪২ সালের একটি সম্মেলনে দুই পক্ষের ভীষণ গোলমাল বাঁধে। শহীদ সাহেব সেই গোলমাল বন্ধ করেন। তার হস্তক্ষেপে অবিভক্ত বাংলায় ছাত্রলীগের নেতা নির্ধারিত হন সাদেকুর রহমান। পরে আনোয়ারও ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। অন্যদিকে, আই এ ক্লাসের ছাত্র হয়েও মুজিব ইসলামিয়া কলেজে খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তার কথা কলেজের সবাই শুনে। অফিসিয়াল ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে প্রার্থী দাঁড় কারিয়ে মুজিব তাদের পরাজিত করে। পরের বছরও ১৯৪৩ সালে নির্বাচনে আনোয়ার সাহেবের অফিসিয়াল ছাত্রলীগ পরাজিত হলো। তারপর আর তিন বছর কেউই মুজিবের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন করে নাই। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচন হতো! মুজিব ছাত্রনেতাদের নিয়ে আলোচনা করে যাদের ঠিক করে দিতো তারাই নমিনেশন দাখিল করতো, আর কেউ করত না। কারণ সবাই জানতো, মুজিবের মতের বিরুদ্ধে কারও জেতার সম্ভাবনা নেই। এই কাজে জহিরুদ্দিন মুজিবকে সাহায্য করতো। জহির কলকাতার বাসিন্দা। ছাত্রদের উপর তার যথেষ্ট প্রভাব ছিলো। নিঃস্বার্থ কর্মী বলে সকলে তাকে শ্রদ্ধা করতো। এছাড়া জহির চমৎকার ইংরেজি, বাংলা ও উর্দুতে বক্তৃতা করতে পারতো। তাই মুজিব জহিরকে গুরুত্ব দেয় এবং নিজের কাছে রাখে তাদের কলেজ ইউনিয়নকে শক্তিশালী করে। উল্লেখ্য, ১৯৪৬ সালে মুজিব ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
॥৪॥
১৯৪৩ সাল। মুজিব প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য হন। দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। প্রতিনিয়ত লোক মারা যাচ্ছে। গ্রাম থেকে লাখে লাখে লোক শহরের দিকে ছুটছে। খাবার নাই, কাপড় নাই। ইংরেজ যুদ্ধের জন্য সব নৌকা বাজেয়াপ্ত করে দিয়েছে। ধান চাল সৈন্যদের খাওয়ার জন্য গুদাম জব্দ করেছে। আর যা কিছু ছিল ব্যবসায়ীরা তা গুদামজাত করেছে। ফলে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা দশ টাকা মণের চাল চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকায় বিক্রি করছে। এমন কোনো দিন নাই রাস্তায় লোক মরে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। মুজিব শহীদ সাহেবের কাছে গিয়ে বললেন, ‘কিছুতেই লোক বাঁচাতে পারবেন না, কিছু একটা করেন।’ শহীদ সাহেব বললেন, ‘দেখি, চেষ্টা করে কিছু করা যায় কি না, কিছু লোক তো বাঁচাতে চেষ্টা করবো।’ শহীদ সাহেব দিল্লিতে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে ভয়াবহ অবস্থার কথা জানালেন এবং সাহায্য দিতে বললেন। চাল, আটা ও গম নৌকায় করে আনতে শুরু করলেন। কিন্তু ইংরেজদের কথা হলো, বাংলায় মানুষ যদি মরে তো মরুক, যুদ্ধের সাহায্য আগে। ট্রেনে অস্ত্র যাবে, তারপর যদি জায়গা থাকে তবে রিলিফের খাবার যাবে। যুদ্ধ করে ইংরেজ, আর না খেয়ে মরে বাঙালি! মুজিব বাঙালির দুরবস্থার ছবি নিজ চোখে দেখছে। মা মরে পড়ে আছে, ছোট বাচ্চা সেই মরা মার দুধ চাটছে! কুকুর ও মানুষ একসাথে ডাস্টবিন থেকে খাবার কাড়াকাড়ি করছে। ছেলেমেয়েদের রাস্তায় ফেলে দিয়ে মা কোথায় পালিয়ে গেছে। পেটের দায়ে নিজের ছেলেমেয়েকে বিক্রি করতে চেষ্টা করছে। কেউ কিনতে রাজি হয়নি। বাড়ির দুয়ারে এসে চিৎকার করছে, ‘মা বাঁচাও, কিছু খেতে দাও, মরে তো গেলাম, আর পারি না, একটু ফেন দাও।’ এই কথা বলতে বলতে ঐ বাড়ির দুয়ারের কাছেই পড়ে মরে গেছে। মুজিব কী করবে? হোস্টেলে যা বাঁচে দুপুরে ও রাতে বুভুক্ষুদের বসিয়ে ভাগ করে দেয়, কিন্তু এতে কী হবে? শেখ মুজিব প্রচ- চিন্তিত হয়ে পড়লেন দুর্গত অসহায় মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানোর জন্য।
॥৫॥
ত্রাণ সহায়তার জন্য সম্মেলন উপলক্ষ্যে অতিথিদের খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য মুজিবের মা ও রেণু গ্রামের বাড়ি থেকে গোপালগঞ্জের বাড়িতে এসেছে। সম্মেলনে মুজিবের আব্বাও অনেক টাকা খরচ করছেন। বাদামের টাকা আব্বার কাছে কীভাবে চাইবে মুজিব? আব্বা বড়লোক তো নয়। কি করে বাবাকে বলবে মুজিব? অবশেষে মুজিবের আব্বা নিজেই সমাধান করে দিলেন। যাদের ব্যবসা ভালো না, তাদের কিছু কিছু টাকা দিয়ে বিদায় দিলেন। একজন ব্যবসায়ী যার আট দশটা বাদাম নষ্ট হয়েছে তিনি পুরো টাকা দাবি করলেন। পুরো টাকা না দিলে তিনি মামলা করবেন। মুজিবের আব্বা বললেন, ‘কিছু টাকা নিয়ে আপনি এগুলো মেরামত করান। মামলার ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। যারা আপনাকে মামলার পরামর্শ দিয়েছে, তারা হয়তো জানে না মুজিব যে আপনার বাদাম এনেছে তা প্রমাণ করতে তাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হবে।’ মুজিবের জ্বর ভয়ানকভাবে আরো বেড়ে গেছে। রেণু কয়েকদিন মুজিবকে খুব সেবা করলেন। জ্বর ভালো হলো। আর ঐ ভদ্রলোক শেষ পর্যন্ত উকিল নোটিশ দিয়ে দিলেন। মামলা করেননি। কলকাতা যেতে হবে মুজিবকে। পরীক্ষা নিকটবর্তী। লেখাপড়া তো মোটেই করেন না। দিনরাত রিলিফের কাজ করে কূল পান না। মুজিবের আব্বা এ সময় একটা কথা বলেছিলেন, বাবা, রাজনীতি কর, আপত্তি করবো না। পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছো এ তো সুখের কথা। তবে লেখাপড়া করতে ভুলো না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না। আর একটা কথা মনে রাখবা, ÔSincerity of purpose and honesty of purpose থাকলে জীবনে পরাজিত হবে না।’ এ কথা কোনোদিন মুজিব ভুলেননি। আর একদিনের কথা। গোপালগঞ্জ শহরের কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি মুজিবের আব্বাকে বলেছিলেন, আপনার ছেলে যা করছে তাতে তার জেল খাটতে হবে, তার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। মুজিবের আব্বা বলেছিলেন, ‘দেশের কাজ করছে, অন্যায় তো কিছু করছে না। যদি জেল খাটতে হয়, খাটবে; তাতেও আমি দুঃখ পাবো না। জীবনটা নষ্ট নাও তো হতে পারে। আমি ওর কাজে বাঁধা দিব না।
লেখক : উপ-পুলিশ কমিশনার, (ট্রাফিক-
উত্তরা), ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, ঢাকা।