মুফতী মোঃ আবদুল্লাহ
॥শেষ পর্ব॥
ছুফিয়ায়ে কিরাম ও আওলিয়ায়ে কিরাম-এর ‘স্তর ও মর্যাদা’ বিষয়ক পাঁচটি হাদিস:
ইমাম হাফেয আবু নুয়াঈম ইস্পাহানী (র) নিজ প্রসিদ্ধ গ্রন্থটিতে অনেক হাদিসের অবতারণা করে তাছাওউফ অনুসারী ওলী-ছুফীদের মর্যাদা ও স্তর বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। আমরা এখানে সনদের দীর্ঘ সূত্র-পরস্পরাগুলো বাদে কেবল কয়েকটি মূল হাদিসের মত ও তরজমা উপস্থাপন করছি। যা থেকে পাঠকগণ অনুমান করতে সক্ষম হবেন যে, তাছাওউফ ও তরীকত অনুসারী পীর-মাশায়েখ ও ছুফী-দরবেশদের মান-মর্যাদা শরীয়তের মাপকাঠিতে কত ঊর্ধ্বে!
হাদিস নং- ১ : হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহানবী (স) ইরশাদ করেছেন : প্রত্যেক শতাব্দী (বা যুগে)তে আমার উম্মতের মধ্যে অগ্রগামীগণ রয়েছেন বা থাকবেন।’
হাদীস নং-২ : হযরত ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রিয়নবী (স) ইরশাদ করেছেন: প্রত্যেক শতাব্দীতে (পুরো বিশ্বে) আমার উম্মতের ৫০০ জন (ওলী) শ্রেষ্ঠ মনীষী অবস্থান করেন এবং (৪০) ৪০ জন ‘আবদাল’-ও। ওই ৫০০ জনের সংখ্যা কখনও কমে না এবং ৪০ জনের সংখ্যাও কমে না। এই ৫০০ জন ওলীর মধ্য থেকে যখন কারও ইন্তেকাল হয় তখন আরেকজনকে (নেককার-মোত্তাক্বীকে বেলায়েত দান করে) তাঁর স্থলাভিষিক্ত করা হয়। একইভাবে ৪০ জন আবদালের ক্ষেত্রেও কারও ইন্তেকাল হলে ৫০০ জনের সংখ্যা থেকে একজন দ্বারা ৪০ জনের সংখ্যা পূর্ণ করা হয়।’
সাহাবাগণ আরজ করলেন : হে আল্লাহর রাসূল! আমাদেরকে তাঁদের আমল-পরিচয় বিষয়ে অবগত করুন! প্রিয়নবী (স) বললেন : তাদের পরিচয় হচ্ছে, তাঁরা তাঁদের প্রতি অবিচারকারীদের ক্ষমা করে দেন; যারা তাঁদের প্রতি দূর্ব্যবহার করেন তাঁরা তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার করে থাকেন এবং মহান আল্লাহ তাঁদের যা দান করেন, তা দ্বারা তাঁরা জনগণের কল্যাণে ব্রতী হয়ে থাকেন।১
হাদীস নং ৩ : হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, মহানবী (স) ইরশাদ করেছেন : “আল্লাহ তা’লার সৃষ্টির (পৃথিবীতে) মধ্যে তাঁরই জন্যে নিবেদিত ৩০০ জন ওলী/খাছবান্দা মজুদ থাকেন; যাঁদের কলবের (অন্তরের) সম্পর্ক হযরত আদম (আঃ)-এর কলবের সঙ্গে হয়ে থাকে অর্থাৎ তাঁরা হযরত আদম (আঃ) থেকে ফয়েয প্রাপ্ত হয়ে থাকেন।
একইভাবে আল্লাহপাকের সৃষ্টির মধ্যে ৫০ জন এমন খাছ বান্দা বা ওলী বিদ্যমান থাকেন, যাঁদের অন্তরের সম্পর্ক হযরত মূসা (আঃ)-এর অন্তরের সঙ্গে হয়ে থাকে। একইভাবে তাঁর জন্যে নিবেদিত আরও ৭ জন এমন খাছ বান্দা মজুদ থাকেন, যাঁদের কলবের সম্পর্ক হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর কলবের সঙ্গে হয়ে থাকে। একইভাবে পৃথিবীতে তাঁর পাঁচ জন এমন খাছ ওলী মজুদ থাকেন, যাঁদের কলবের সম্পর্ক হযরত জিব্রাঈল (আঃ) এর সঙ্গে হয়ে থাকে। আরও তিনজন এমন বিশেষ ওলী থাকেন, যাদের আত্মার সম্পর্ক হযরত মীকাঈল (আঃ)-এর আত্মার সঙ্গে হয়ে থাকে। এ ছাড়া, আরও একজন (১) এমন খাছ ওলী বিদ্যমান থাকেন, যাঁর কলবের সম্পর্ক হযরত ইসরাফীল (আঃ)-এর আত্মার সঙ্গে হয়ে থাকে।
ওই আলোচিত এক জনের ইন্তেকাল হয়ে গেলে উপরিউক্ত তিন জন থেকে একজনকে মহান আল্লাহ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নিয়োগ দেন। তিনজন থেকে কারও মৃত্যু সংঘটিত হলে তাঁর স্থলে মহান আল্লাহ ওই পাঁচ জন হতে একজনকে স্থলাভিষিক্ত করেন। একইভাবে ৫ জন হতে কারও ইন্তেকাল হলে সাত জন থেকে একজনকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন এবং সাত জন থেকে কারও ইন্তেকাল হলে ৪০ জন থেকে একজকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন; এবং ৪০ জন থেকে কারও তিরোধান ঘটলে ৩০০ জন থেকে একজনকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন এবং ৩০০ জন থেকে কারও মৃত্যু সংঘটিত হলে তাঁর স্থলে সাধারণ নেককার মুমিনদের থেকে একজনকে স্থলাভিষিক্ত (ওলী) হিসাবে নিযুক্ত করেন। এঁদের মাধ্যমেই জীবন-মৃত্যু সংঘটিত হয়! মেঘ-বৃষ্টির ফায়সালা হয়। ফল-ফসল উৎপন্ন হয়! বিপদ আপদ দূর হয়।’
হাদিসটি শুনে কেউ প্রশ্ন করল : ‘এঁদের (ওলী-আবদাল) দ্বারা কীভাবে জীবন-মৃত্যু সংঘটিত হয়?’ জবাবে তিনি বললেন: ‘এসব খাছ বান্দারা মহান আল্লাহর দরবারে যখন উম্মতের প্রবৃদ্ধির প্রার্থনা করেন তখন উম্মতের প্রবৃদ্ধি ঘটে। যালিম শাসক-শোসকদের বিরুদ্ধে দু’আ করলে তারা নিপাত যায়। বৃষ্টির জন্যে মোনাজাত করলে বৃষ্টি বর্ষণ হয়। ফল-ফসলের জন্যে প্রার্থনা করলে ভুমি তা উৎপন্ন করে এবং তাঁদের দু’আর মাধ্যমে বহুমুখী বিপদ-আপদ বিদূরিত হয়ে যায়’।২
হাদিস নং-৪ : হযরত হুযাইফা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহানবী (স) ইরশাদ করেছেন : ‘হে হুয়াইফা! নিশ্চিত জেনে রেখো, আমার উম্মতের প্রত্যেক সম্প্রদায়ের মধ্যেই একদল মানুষ এমন আছে যাদের ধুলোয় ধূসরিত, আলুথালু অবস্থা। তারা একমাত্র আমাকেই চায়; কেবল আমারই অনুসরণ করে এবং মহান আল্লাহর কিতাব পবিত্র কুরআনকে প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর। এরা আমার দলের অন্তর্ভুক্ত এবং আমিও তাদের সঙ্গে আছি; যদিও তারা আমাকে দেখেনি।’ অর্থাৎ এ হাদিস দ্বারাও অনাড়ম্বর সাদাসিদে চাল-চলনবিশিষ্ট ওলীদের ফজিলত প্রমাণিত হচ্ছে”।৩
হাদিস নং – ৫ : হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রিয়নবী (স) ইরশাদ করেছেন : ‘যে ব্যক্তি আমার বিষয়ে জানতে চায় অথবা যার ইচ্ছা জাগে আমাকে দেখতে -সে যেন এমন একজন কঠোর পরিশ্রমী আলু-থালু ব্যক্তির (ওলী) দিকে তাকায় যিনি ইটের ওপর ইট রেখে (গৃহ) নির্মাণ করেন না এবং সুন্দর শহর-নগরের পিছনে পড়েন না। তাঁর সামনে বরং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য রয়েছে যে-দিকে তিনি কঠোর সাধনার মাধ্যমে এগিয়ে চলেছেন। আজ যিনি কঠোর প্রশিক্ষণের মাঠে রয়েছেন এবং আগামী দিন তিনি বিজয়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবেন; যার চূড়ান্ত পরিণতি জান্নাত বা জাহান্নাম হবে’।৪
অর্থাৎ যে সব সুফী-সাধক, ওলী-দরবেশগণ দুনিয়া বিমুখ এবং অত্যন্ত কঠোর সাধনার মাধ্যমে, সাদাসিদেভাবে মাওলার সন্তোষ অর্জনকল্পে জাগতিক জীবন পার করে দিচ্ছেন এঁরাই যেমন কিনা মহানবী (স)-এর বাস্তব প্রতিচ্ছবি।
ভিক্ষাবৃত্তি বিষয়ে পাঁচটি হাদিস
১। হাদিস : হযরত আবদুল্লাহ ইবন আমের রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি হযরত মু‘আবিয়া রা.-কে বলতে শুনেছি যে, মহানবী স. ইরশাদ করেছেন : ‘তোমরা অধিক হাদিস বর্ণনা হতে বেঁচে থাক, তবে সেই হাদিস যা হযরত উমর রা. এর যুগে প্রচলিত ছিল। কেননা হযরত উমর রা. লোকজনকে হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে আল্লাহ্র ভয় প্রদর্শন করতেন। আমি রাসূলুল্লাহ স.-কে এমনটি বলতে শুনেছি, ‘মহান আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকেই দীনের (তাফাক্কুহ্) সঠিক বুঝ দান করেন’। আমি তাঁকে আরও বলতে শুনেছি, ‘আমি বায়তুল-মালের (রাষ্ট্রীয় কোষাগারের) রক্ষক মাত্র। কাজেই আমি সন্তুষ্টচিত্তে (চাওয়া ব্যতীত) কাউকে যা দান করি, তাতে তার জন্য (আল্লাহ্র পক্ষ থেকে) বরকত হবে। আর যাকে তা তার চাওয়ার প্রেক্ষিতে ও মনের প্রবল বাসনার (পীড়াপীড়ির) কারণে দান করি, তার উদাহরণ ওই ব্যক্তির অনুরূপ যে-লোক আহার করে অথচ পরিতৃপ্ত হয় না’।
(তাকদীর বা অদৃষ্ট বলতে আমরা যা বুঝি, তাতেও দু’প্রকার ভাগ্যলিপির কথা বলা আছে (মুবরাম ও মু‘আল্লাক্ক)। অর্থাৎ যার অন্যতম হলো, বান্দা যেভাবে চেষ্টা করবে বা যে পথে হাঁটতে ইচ্ছুক মহান আল্লাহও তাকে সে পথে হাঁটা সহজ করে দেন। সুতরাং আমার অদৃষ্টেই লেখা ছিল ভিক্ষা করা Ñএমন বক্তব্যে পার পাওয়া যাবে না।)
২। হাদিস : হযরত আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ স.-কে বলতে শুনেছি যে, ‘তোমাদের যে কারও পক্ষে ভোর বেলায় খড়ি-কাঠ কুড়িয়ে তা পিঠে বহন করে (বিক্রি করে), তা থেকে দান করা এবং মানুষের কাছে হাত পাতা থেকে মুক্ত থাকাÑ এমনটি তার জন্য অধিক উত্তম যে, সে কারও কাছে ভিক্ষা চাইতে যাবে- সে তাকে কিছু দিবে বা না দিবে। কেননা উপরের হাত নিচের হাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ অর্থাৎ একজন দাতা হতে পারা একজন গ্রহিতা হওয়ার চেয়ে অধিক উত্তম। (এ ছাড়া) একজন দাতা হওয়ার সামর্থ অর্জিত হওয়ার পর, দান বা খরচ করার ক্ষেত্রে যাদের দায়-দায়িত্ব তোমার ওপর বর্তায় প্রথমে তাদেরকে দিয়ে তোমার দানের সূচনা করবে’।
৩। হাদিস : হযরত আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, মহানবী স. ইরশাদ করেছেন : ‘এই যে লোক মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে, ফলে তাকে এক লোকমা বা দু’লোকমা দান করা হয় এবং একটি বা দু’টি খেজুর দেয়া হয়; সে প্রকৃত মিসকীন নয়। সাহাবাগণ নিবেদন করলেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! তা হলে মিসকীন বলতে কে?
নবীজী স. জবাবে বললেন : আসল মিসকীন সেই ব্যক্তি যার এটুকু সম্পদ বা সামর্থও নেই, যা দ্বারা নিজ প্রয়োজন (মানবিক) মিটাইতে পারে এবং তার সম্পর্কে লোকজনে জানেও না, ফলে তাকে দানও করতে পারে না এবং সে নিজেও ভিক্ষা চেয়েও বেড়ায় না”।
৪। হাদিস : হযরত হামযা ইবন আবদুল্লাহ্ রা তাঁর পিতার বরাতে বর্ণনা করেন যে, মহানবী স. ইরশাদ করেছেন : ‘তোমাদের মাঝে কেউ (যেক্ষেত্রে) নিয়মিত ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ে সেক্ষেত্রে ওইলোক এমতাবস্থায় মহান আল্লাহ্র সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে যে, তার মুখমন্ডলে কোন গোশত থাকবে না’।
৫। হাদিস : হযরত আবূ হুরায়রা রা. এর থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মহানবী স. বলেছেন : ‘যে ব্যক্তি নিজ সম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে মানুষের সম্পদ থেকে ভিক্ষা করে বেড়ায়, সে প্রকারান্তরে (জাহান্নামের) অঙ্গার যাঞ্চা করে বেড়ায় (ধমক)। সুতরাং (বিষয়টি মনে রেখে) সে যেন তা হ্রাস করে কিংবা বৃদ্ধি করে!’।
লেখক : মুফতি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ,
বায়তুল মোকাররম, ঢাকা-১০০০।