মুফতী মোঃ আবদুল্লাহ
ঈমান-ইসলাম বিষয়ক পাঁচটি হাদীস
১। হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম স. ইরশাদ করেছেন : ‘যার মধ্যে তিনটি গুণ/ বিষয় বিদ্যমান থাকবে, সে ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করবে : ১. আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল তার কাছে সবচেয়ে অধিক ভালোবাসার পাত্র হবেন। ২. কাউকে ভালোবাসলে সেই ভালোবাসা কেবল আল্লাহর জন্যেই হবে। ৩. এবং কুফরির দিকে ফিরে যাওয়াকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মতোই অপছন্দ করবে’।
২। হযরত আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, মহানবী স. ইরশাদ করেন, ‘ঈমানের শাখা রয়েছে, ষাটের কিছু বেশি। আর লজ্জাও ঈমানের একটি শাখা’।
৩। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন ‘আমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ স. বলেন, ‘প্রকৃত মুসলমান সে-ই, যার জিহ্বা ও হাত থেকে অন্য সব মুসলিম নিরাপদ থাকে; এবং প্রকৃত মুহাজির সে-ই যে আল্লাহ তা‘আলার নিষিদ্ধ কাজ ত্যাগ করে’।
৪। হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম স. ইরশাদ করেন: ‘তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হবে না যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য তা-ই পসন্দ করবে, যা নিজের জন্য পছন্দ করে’।
৫। হযরত আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ্ স. লোকসমক্ষে ছিলেন, এমতাবস্থায় তাঁর কাছে একজন লোক হাজির হলেন এবং বললেন, হে আল্লাহ্র রাসুল! ‘ঈমান’ কী? রাসূলুল্লাহ্ স. বললেন: ঈমান হল, আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতা, তাঁর কিতাবগুলো, তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ , তাঁর প্রেরিত রাসূলদের প্রতি ঈমান আনা এবং পরকাল দিবসে বা শেষ উত্থানের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা।
তারপর আগন্তুক প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! ‘ইসলাম’ কী? রাসূল স. জবাবে বললেন : ইসলাম হলো, আল্লাহ্র ইবাদত করা, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক না করা, ফরয সালাত কায়েম করা, নির্ধারিত যাকাত আদায় করা এবং রমযানের রোযা পালন করা।
আগন্তুক আবার প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! ‘ইহসান’ কী? রাসূল স. বললেন : ইহসান হলো, তুমি এমনভাবে আল্লাহ্র ইবাদত-বন্দেগী করবে যেন তাঁকে দেখছ; যদি তুমি তাঁকে নাও দেখ, তা হলে ভাববে যে, তিনি তোমাকে দেখছেন। আগন্তুক পুনঃ প্রশ্ন করলেন, কিয়ামত কখন হবে? রাসূল স. বললেন : এ বিষয়ে প্রশ্নকারীর চেয়ে যাকে প্রশ্ন করা হয়েছে, তিনি অধিক অবহিত নন। তবে হ্যাঁ, কিয়ামতের কিছু নিদর্শন বর্ণনা করছি, দাসী তার প্রভুকে জন্ম দেবে। এটি কিয়ামতের অন্যতম নিদর্শন। বিবস্রদেহ, নগ্নপদ লোক হবে জনগণের নেতা; এটাও কিয়ামতের আরেকটি নিদর্শন। এ ছাড়া, রাখালদের বিরাট বিরাট অট্টালিকার প্রতিযোগিতায় গর্বিত দেখতে পাবে, এটিও আরেকটি নিদর্শন। পাঁচটি বিষয়ে আল্লাহ্ ব্যতীত কেউ কিছু জানে না। এ বলে, রাসূল স. পবিত্র কুরআনের আয়াতটি পাঠ করলেন, যার অর্থ : নিশ্চয়ই আল্লাহ্ , তাঁরই কাছে রয়েছে কিয়ামতের জ্ঞান। তিনি নাযিল করেন বৃষ্টি এবং তিনিই জানেন, যা রয়েছে মাতৃগর্ভে। কেউ জানে না আগামীকাল তার অর্জন বা উপার্জন কি বা কতটুকু হবে এবং জানে না কেউ কোন্ মাটিতে সে মারা যাবে। নিশ্চয় আল্লাহ্ সব জানেন, সব খবর রাখেন।
বর্ণনাকারী বলেন, তাপর লোকটি চলে গেল। রাসূলুল্লাহ্ স. বললেন : লোকটিকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনো তো। তাঁরা তাঁকে ফিরিয়ে আনার জন্য গেলেন। কিন্তু কাউকে পেলেন না অর্থাৎ তাৎক্ষণিক অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এর পর রাসুলুল্লাহ্ স. বললেন : ইনি ছিলেন জিবরাঈল আ.। লোকদের দীন-ধর্ম শিক্ষাদানের জন্য এসেছিলেন।
সালাত বিষয়ক ৫টি হাদিস
১। হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলা মুকিম অবস্থায় ও সফর অবস্থায় দুই রাকাত করে সালাত ফরয করেছিলেন। পরে সফরের সালাত আগের মতো বহাল রাখা হলো এবং মুকিম অবস্থায় সালাত বৃদ্ধি করা হলো।
২। হযরত উম্মে আতিয়্যা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : মহানবী স. ঈদের দিনে ঋতুমতী এবং পর্দানশীন মহিলাদের বের করে আনার নির্দেশ দিলেন, যাতে তারা মুসলমানদের জামা‘আত ও দু‘আয় শরিক হতে পারে। অবশ্য ঋতুমতী মহিলারা সালাতের স্থান থেকে দূরে থাকবে। এক মহিলা বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমাদের কারো উড়না নেই। তিনি বললেন : তার সাথীর উচিৎ তাকে নিজের উড়না থেকে পরিয়ে দেওয়া’।
৩। হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : মহানবী স. ফজরের সালাত আদায় করতেন আর তাঁর সঙ্গে অনেক মু‘মিন মহিলা চাদর দিয়ে গা ঢেকে শরিক হতো। এর পর তারা নিজ নিজ ঘরে ফিরে যেত এমতাবস্থায় যে, তাঁদেরকে কেউ চিনতে পারতো না’।
৪। হযরত আনাস ইবন মালিক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ্ স. ইরশাদ করেছেন: যে ব্যক্তি আমাদের মতো সালাত আদায় করে, আমাদের কিবলামুখী হয় এবং আমাদের যবাই করা প্রাণী খায়, সে-ই মুসলিম, যার জন্য আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল যিম্মাদার। সুতরাং তোমরা আল্লাহ্র যিম্মাদারীতে খিয়ানত করো না’। অর্থাৎ তেমন কোন মুসলমানের প্রতি যুলুম/অবিচার / আক্রমণ করতে যাবে না।
৫। হযরত জাবির ইবন আবদুল্লাহ্ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : মহানবী স. নিজের বাহনের উপর নফল সালাত আদায় করতেন Ñবাহন তাঁকে নিয়ে যেদিকেই মুখ করতো না কেন। কিন্তু যখন ফরয সালাত আদায়ের ইচ্ছা করতেন, তখন নেমে পড়তেন এবং কিবলার দিকে মুখ করতেন”।
যাকাত বিষয়ক পাঁচটি হাদিস
১। ‘যে ব্যক্তি তিনটি কাজ করবে সে ঈমানের স্বাদ ও মজা লাভ করবে : ১) যে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে; ২) জ্ঞান করবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই; এবং ৩) আনন্দিত চিত্তে পবিত্র মনে তার সম্পদের যাকাত দিবে।’
২। আরেকটি হাদিসে এসেছে : ‘যে ব্যক্তি তার সম্পদের যাকাত দেবে তার সম্পদের অকল্যাণ ও অমঙ্গল দূর হয়ে যাবে’।
৩। ‘প্রথম যে তিন ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করবে তারা হলো : স্বেচ্ছাচারী শাসক বা প্রশাসক, সম্পদশালী ব্যক্তি যে তার সম্পদে আল্লাহর প্রাপ্য হক (যাকাত) আদায় করে না এবং পাপাচারে লিপ্ত দরিদ্র ব্যক্তি।’
৪। হযরত আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ স. বলেন, প্রত্যহ মানুষের যখন ভোর হয়, তখন দু‘জন ফেরেশতা অবতরণ করেন। এর পর তাদের একজন বলেন, ‘হে আল্লাহ! দানকারীকে তার বদলা দাও’। অপরজন বলেন, ‘হে আল্লাহ কৃপণের ধন ধ্বংস কর’।
৫। হযরত আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, মহানবী স. বলেছেন, ‘কিয়ামত সংঘটিত হবে না যতক্ষণ না প্রচুর ধন-সম্পদ ও বিপুল প্রাচূর্য প্রকাশ পায়। এমনকি তখন মানুষ তার মালের যাকাত নিয়ে বের হবে, কিন্তু তা গ্রহণ করার মতো কাউকে পাওয়া যাবে না। আরব দেশ চারণভূমি ও নদী-নালায় পরিণত হবে’।১৬
সিয়াম সাধনা/ রোযা বিষয়ক পাঁচটি হাদিস
রোযা পালনকালীন মহান আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা ও দৃঢ় বিশ্বাস অন্তরে পোষণের পাশাপাশি তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন কল্পে নিষ্ঠার সঙ্গে, সওয়াবের প্রত্যাশায় তা পালন করতে হবে। কারণ, প্রিয়নবী (স) ইরশাদ করেন,
১। ‘যে ব্যক্তি ঈমানদার অবস্থায় ও সওয়াবের প্রত্যাশায় রোযা পালন করবে তার অতীত জীবনের গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। আর যে ব্যক্তি ঈমানদার অবস্থায় ও সওয়াবের প্রতাশা নিয়ে মাহে রমজানের তারাবিহ/তাহাজ্জুদ/রাত জাগরণ করবে তার অতীত জীবনের পাপ মাফ করে দেওয়া হবে’।
২। ‘যে ব্যক্তি পাপ, মিথ্যা বা অন্যায় কথা, অন্যায় কর্ম, ক্রোধ, মূর্খতা সুলভ কর্ম ত্যাগ না করবে, তার পানাহার ত্যাগ করাতে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’
৩। ‘কেবল পানাহার বর্জনের নাম সিয়াম নয়। সিয়াম হলো অনর্থক ও অশ্লীল কথা-কাজ বর্জন করা’।
৪। ‘যখন তোমাদের কারও রোযা পালনের দিন শুরু হয় তখন সে যেন অশ্লীল কিছু না করে, চিৎকার হৈ-হুল্লোড় না করে। যদি তাকে কেউ গালি দেয় বা তার সঙ্গে কেউ ঝগড়া-লাড়াইর সূত্রপাত করতে চায় তখন সে যেন বলে : জনাব! আমি রোযা রেখেছি’।
৫। যথা নিয়মে সাহরী খেতে হবে। কারণ, সাহরী খাওয়া সুন্নাত। সাহরী রাতের শেষ অংশে খাওয়া উত্তম। সাহরী খাওয়ার মধ্যে বরকত রয়েছে বলে প্রিয়নবী (স) উম্মতকে জানিয়েছেন। যেমন:
(ক) ‘তোমরা সাহরী খেও! কেননা সাহরীতে বরকত রয়েছে।
(খ) “প্রিয়নবী (স) বলেছেন! আমাদের রোযা আর ইহুদী-খ্রিস্টানদের রোযার পার্থক্য হল সাহরী খাওয়া। অর্থাৎ আমরা সাহরী খাই, তারা সাহরী খায় না।
(চলবে)
লেখক : মুফতি ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ
0 Comments