মোঃ আবদুস ছালাম
বিপ্লব বলতে সাধারণত কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ক্ষমতা বা পট পরিবর্তনকে বুঝে থাকি। কিন্তু শুধু রাজনৈতিক বিপ্লবই নয় যুগে যুগে পৃথিবীতে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নানা রকম বিপ্লব সাধিত হয়েছে। শিল্প বিপ্লবও তেমনি এক বিপ্লব। যান্ত্রিক শক্তি আবিষ্কারের ফলে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্য ভাগে ইউরোপের শিল্পজগতে উৎপাদন ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন ঘটে, তা প্রথম শিল্প বিপ্লব হিসেবে পরিগণিত হয়। মানবসভ্যতার ইতিহাসে তিনটি বড় শিল্প বিপ্লব গোটা দুনিয়ার গতিপথ ব্যাপকভাবে পাল্টে দিয়েছিল। তবে আগের তিনটি শিল্প বিপ্লবকে ছাড়িয়ে গেছে আজকের যুগের ডিজিটাল বিপ্লব, যাকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। এটি এমন একটি নতুন অধ্যায় যেখানে শিল্প-কারখানা, পণ্য, উৎপাদন, নকশা, সেবা ও বাজারজাতকরণ সব কিছুই নিয়ন্ত্রিত হবে তথ্য, কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবোটিক অটোমেশনের মাধ্যমে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব
ডিজিটাল বিপ্লবকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হিসেবে প্রথম সংজ্ঞায়িত করেন ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (WEF) এর চেয়ারম্যান ক্লাউস শোয়াব ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত তার লেখা ‘দ্যা ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভুলেশন’ গন্থে। পরবর্তী সময়ে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম এ ধারণার ব্যাপক প্রচার ও প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেয়। তারও আগে ২০১১ সালে একদল জার্মান বিজ্ঞানী শিল্প-কলকারখানাগুলোয় কীভাবে অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু করা যায় বা ডিজিটাল কৌশল প্রয়োগ করা যায়, তা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। যেখানে কম জনবল দিয়ে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে পণ্য উৎপাদন সহজ হবে। সেখান থেকেই মূলত চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ধারণাটির উদ্ভব। ডিজিটাল বিপ্লব কী, সে বিষয়টিরও বিশদ একটি ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন ক্লাউস শোয়াব। স্মার্টফোনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের পরিবর্তন, ইন্টারনেট অব থিংস, যন্ত্রপাতি পরিচালনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ, রোবোটিকস, জৈবপ্রযুক্তি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মতো বিষয়গুলো চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সূচনা করেছে বলে তিনি মনে করেন। ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে যেটি নিকট ভবিষ্যতে মানব সম্পদের বিকল্প হিসেবে কাজ করবে। এই ডিজিটাল বিপ্লবের ছোয়ায় উৎপাদন ব্যবস্থার ঘটবে অকল্পনীয় পরিবর্তন। সেখানে উৎপাদনের জন্য মানুষকে যন্ত্র চালাতে হবেনা, বরং যন্ত্র স্বয়ংক্রীয়ভাবে কর্ম সম্পাদন করবে এবং এর কাজ হবে আরও নিখুঁত ও নির্ভূল। অর্থাৎ চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হলো আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উৎপাদন এবং শিল্প ব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয়করণের একটি চলমান প্রক্রিয়া।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ
১। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হল চাকরির বাজার। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ঠিক কি ভূমিকা পালন করবে বা কত মিলিয়ন চাকরি রোবটের দখলে চলে যাবে এবং নতুন এই সিস্টেমে মানুষের কাজ কি হবে এসব নিয়ে প্রচুর জল্পনা-কল্পনা ও বিশ্লেষণ চলছে। স্টিফেন হকিং মনে করতেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স একসময় ফ্র্যাঙ্কেন্সটাইন হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের অর্থনীতির অর্জন মূলত যার ওপর নির্ভর করে এসেছে সেটা হল সস্তা শ্রম। রেমিট্যান্স বা গার্মেন্টস খাত দুই জায়গাতেই আমাদের হাতিয়ার ছিল সস্তায় শ্রমিক পাওয়া। দ্বিতীয়ত, এই শ্রমিকদের প্রায় সবাই স্বল্প শিক্ষিত এবং স্বল্প দক্ষ। যদি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এসে গতানুগতিক কাজগুলো দখল করে নেয়, তাহলে এই বিপুল পরিমাণ শ্রমিককে বেকার হতে হবে। অসংখ্য মানুষ চাকরি হারা হবে।
২। কোনো দেশ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য কতটুকু প্রস্তুত তার একটা গুরুত্বপূর্ণ মানদন্ড হল প্রযুক্তিগত অবকাঠামো। এখনো দেশের অধিকাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না। মোবাইল ব্যবহারকারীদের মধ্যেও ফোর জি নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারীর সংখ্যা খুবই কম। দেশের এই বিপুল সংখ্যক প্রযুক্তিবিমুখ মানুষকে প্রযুক্তিমুখী করাটা হবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বড় চ্যালেঞ্জ।
৩। অদুর ভবিষ্যতে মানুষকে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্রের সঙ্গে সহাবস্থান করতে হবে। ফলে মেশিন মানুষের কর্মক্ষেত্রকে সংকুচিত করবে। কমে যাবে সস্তা শ্রমের চাহিদা, বৃদ্ধি পাবে অসমতা, প্রযুক্তিগত জ্ঞানের ক্ষেত্রে বাড়বে বৈষম্য। যদি প্রযুক্তি সহজলভ্য এবং সহজে হস্তান্তরযোগ্য না হয় তাহলে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে।
৪। দেশের জিডিপিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অবদান প্রায় ২৫ শতাংশ। মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৩০ শতাংশ তৈরি করে এই এন্টারপ্রাইজগুলো। এনালগ প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার এই বিপুল সংখ্যক শিল্প প্রতিষ্ঠান ও তার সাথে জড়িত বিপুল সংখ্যক লোকবলকে ডিজিটাল প্লাটফর্মে নিয়ে আসা বাংলাদেশের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং।
৫। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব লিঙ্গবৈষম্যকে প্রভাবিত করতে পারে। কারিগরি ও প্রযুক্তি শিক্ষাগ্রহণে নারীদের অনীহা ও তুলনামূলকভাবে কম সুযোগ থাকায় অটোমেশনের ফলে নারীদের চাকরির ক্ষেত্র আরও কমে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। সার্বিকভাবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বাংলাদেশের নারী ক্ষমতায়নকে বাঁধাগ্রস্ত করতে পারে।
৬। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব (৪ওজ) এর ফলে সমাজে বৈষম্য তৈরি হতে পারে। যেমন, ‘‘কম-দক্ষতা স্বল্প বেতন’’ বনাম ‘‘উচ্চ দক্ষতা উন্নত বেতন’’ কাঠামো অর্থনৈতিক বিভাজন সৃষ্টি করবে।
৭। নানাবিধ প্রযুক্তিগত সমস্যায় উৎপাদনে ব্যাঘাত, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা ও তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশ যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে বাংলাদেশের সম্ভাবনা
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বড় সম্ভাবনার জায়গা হলো বাংলাদেশ। ডিজিটাল প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে দেশের আর্থিক ও ব্যাংকিং সিস্টেমের পরিবর্তন এবং শিল্প কারখানায় উৎপাদনে বড় ধরনের পরিবর্তন এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। কিছুটা সীমাবদ্ধতা থাকার পরও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কারনে বড় ধরনের সুফল ভোগ করবে বাংলাদেশ।
১। জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশে^র অষ্টম বৃহত্তম দেশ। বাংলাদেশে তরুন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৩০% যা বর্তমানে দেশের মোট জনশক্তি তথা মানবসম্পদের ৬৬ শতাংশ এবং সেটা ২০৩০ সাল নাগাদ ৭০ শতাংশে দাড়াবে। বাংলাদেশের জন্য ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের সুফল ভোগ করার এটাই সব থেকে বড় হাতিয়ার। জ্ঞান ভিত্তিক এই শিল্প বিপ্লবে প্রাকৃতিক সম্পদের চেয়ে দক্ষ মানবসম্পদই হবে মূল্যবান। যদি এই বৃহৎ জনসংখ্যাকে ফোরআইআরের (৪ওজ) জন্য একটি দক্ষ কর্মশক্তিতে রূপান্তর করা যায়, তাহলে এটি আমাদের চলমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নকে আরও শক্তিশালী করবে।
সুতরাং চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুযোগ কাজে লাগাতে হলে আমাদের প্রধানতম লক্ষ্য হতে হবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব উপযোগী সুদক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি আর এজন্য প্রয়োজন শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। আমাদের নীতিনির্ধারকদের উচিত চতুর্থ শিল্পবিপ্লব-সম্পর্কিত গবেষণা ও উদ্ভাবনকে অগ্রাধিকার দিয়ে শিক্ষানীতি পুনর্বিবেচনা করা এবং প্রাথমিক পাঠ্যক্রম থেকেই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা যাতে বৈশ্বিক পর্যায়ে আমরা একটি প্রতিযোগিতামূলক, উদ্ভাবনী ও দক্ষ দেশ হিসেবে টিকে থাকতে পারি।
২। দেশে বর্তমানে সাড়ে ৬ লাখের বেশী তরুণ-তরুণী অনলাইনে কাজ করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করছে। অনলাইন প্লাটর্ফমকে পুজি করে কর্মসংস্থানকারীদের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গী করতে দেশের সাবমেরিন ক্যাবলের সক্ষমতাকে আরো বাড়াতে হবে। পাশাপাশি দেশের নির্মিত ও নির্মানাধীন হাইটেক পার্কগুলোকে অগ্রনী ভূমিকা রাখতে হবে। সারা দেশে সাশ্রয়ী মূল্যে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ব্যবস্থা করতে হবে।
৩। প্রচুর বাংলাদেশী শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি বিভিন্ন গবেষণায় নিয়োজিত আছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে দেশেই তাদের জন্য তৈরি হবে নতুন সব সম্ভাবনা। এলক্ষ্যে দেশে কাজ করার ব্যাপারে তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। গবেষণার ক্ষেত্রে বাজেট বাড়ানোর পাশাপাশি উচ্চ শিক্ষার সর্ব স্তরে শিল্পের সঙ্গে শিক্ষার্থী সংযোগ বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে শিক্ষানবিশ কার্যক্রম বাধ্যতামূলক করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের ডিগ্রি অর্জনের পাশাপাশি বাস্তব জীবনের কার্যক্রম সম্পর্কে হাতে কলমে শিখতে পারে।
৪। ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২৫৫৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) ক্যাটাগরি থেকে বাংলাদেশকে উন্নীত করার একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুযোগ সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে দেশের জিডিপির আকার আজকের ২২৫ বিলিয়ন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০৪১ সাল নাগাদ ২ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলারে উপনীত হতে পারে।
৫। উৎপাদন তথা শিল্প চিরাচরিতভাবে উৎপাদনের জন্য শ্রমের উপর নির্ভর করে এসেছে। ডিজিটাল বিপ্লবের ফলে আরো অধিক হারে দক্ষ মানুষের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধির পাশাপাশি বিশেষায়িত পেশার চাহিদার বৃদ্ধি পাবে। শিল্পের অভুতপূর্ব উন্নয়নের ফলশ্রুতিতে দেশের মানুষের সামগ্রিক জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটবে। অটোমেশনের প্রভাবে কর্মক্ষেত্রে উৎপাদন শিল্পে ঝুঁকি হ্রাস পাবে। অনেক কঠিন ও দুরূহ কাজ মানুষের পরিবর্তে যন্ত্রের সাহায্যে করা সম্ভব হবে। উৎপাদন শিল্পে নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির কারণে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে।
৬। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে অভাবনীয় পরিবর্তন সাধিত হবে। চিকিৎসা খাতে ন্যানোটেকনোলজি, রবোটিক সার্জারি, ওয়ারলেস ব্রেইন সেন্সর, আর্টিফিশিয়াল অর্গান, প্রিছিসন মেডিসিন, টেলিহেলথসহ বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার অনেক জটিল ও দুরূহ রোগের সহজ ও সু-চিকিৎসা নিশ্চিত করবে।
লেখক : বিশেষ পুলিশ সুপার (ছাত্র-শ্রম)
এসবি, মালিবাগ, ঢাকা।
0 Comments