
পীযূষ কুমার ভট্টাচার্য্য
কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) চিরকালীন। তিনি বিংশ শতাব্দির উপনিবেশ শৃঙ্খলিত উপমহাদেশের বাংলাভাষী অধ্যুষিত এলাকায় আবির্ভূত হন প্রবল পরাক্রমশালী বিদ্রোহীর ভূমিকায়। সেই সময় ভারতবর্ষে পরাধীনতার বেড়িতে চলছে ব্রিটিশ রাজ্যের দুঃশাসন। নজরুলের কণ্ঠে চলছে আপসহীনতার সুর। তিনি অন্যায়, অসত্য, অসুন্দর, সামন্তপ্রথা, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবিরত লড়াই করেছেন। কাজী নজরুল ইসলামের অধ্যবসায় তাঁকে এক মহামানবে পরিণত করে। পাশাপাশি তাঁর সৃষ্টি নিয়ে নিপীড়িত বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ান। তিনি পথ নির্দেশক হিসেবে শৃঙ্খলিত সমাজে সংগ্রামী ও দেশপ্রেমের চেতনার মশাল জ্বালাতে পেরেছেন। একজন প্রকৃত লেখকের মূল অভিযাত্রায় থাকে দর্শন। কাজী নজরুল ইসলামের দর্শন মহামানবের মুক্তি। সেই মুক্তির দর্শনকে ধারণ করে নজরুল এগিয়ে যান। তিনি ৭ জানুয়ারি ১৯২৩ সালে রবিবার দুপুর বেলা কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে বসে এক অপূর্ব লেখা লেখেন। লেখাটির শিরোনাম ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ এক প্রতিবাদী অভিভাষণের মহত্তম দলিল। নজরুলের মানস ঔদার্যের ঋদ্ধ প্রকাশ রাজবন্দীর জবানবন্দী।
নজরুল তাঁর জেল জীবনে লেখা প্রবন্ধ রাজবন্দীর জবানবন্দীতে বিদ্রোহের বাণী প্রবলভাবে উচ্চারণ করেছেন। তাঁর বিদ্রোহের অগ্নিবাণী ছিল প্রবল প্রভাবশালী ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে। এখানে উল্লেখ্য, তিনি ব্রিটিশ রাজশক্তির রোষাণলে পড়েন তাঁর প্রতিবাদী রচনা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতার জন্যে। কবিতাটি ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার প্রথম বর্ষের দ্বাদশ সংখ্যায় ১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়। নজরুল কবিতাটি লেখেন ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকার পূজা সংখ্যায় ছাপানোর জন্যে। আনন্দবাজার পত্রিকা কর্র্তৃপক্ষ এটা ছাপাতে রাজি হননি। কারণ পত্রিকাটি ছাপাতে সাহস পায়নি। তাই কবিতাটি ধূমকেতু পত্রিকায় প্রকাশ করেন। উল্লেখ্য আনন্দময়ীর আগমনে কবিতায় যে রাজদ্রোহ প্রকাশ পায় এই সময় অন্য কারো রচনায় এত তীব্র ক্ষোভ ছিল না। সেই সময় ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তিত আইনের বিরুদ্ধে, প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে, সংস্কার ও শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে সীমাহীন ক্ষোভ ও তীব্র ঘৃণা ফেটে পড়ে। নজরুলের সেই সময়ে লেখা প্রত্যেক কবিতা, গান ও সম্পাদকীয় বক্তব্যে তার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। এ কথা বলা যায় আনন্দময়ীর আগমনে কবিতায় ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ। তাই কবিতাটির জন্ম শাসকবর্গকে নিশ্চয়ই স্বস্তি দেয়নি। আনন্দময়ীর আগমনে কবিতায় কবি ঘুমন্ত দেবীকে সমাজের অপশক্তিকে দূর করার বাসনায় উদাত্ত আহ্বান জানান। নজরুল মনে করেন দুর্গা অতীতকালে অপশক্তি অসুরকে পরাভূত করেন। সমকালীন সমাজে অসুর ও অপশক্তিকে নস্যাৎ করার জন্যে দুর্গা ছাড়া কোনো পথ নেই। নজরুল ঘুমন্ত দেবীকে সংগ্রামের পথে এগিয়ে আসার উদাত্ত আহ্বান জানান আনন্দময়ীর আগমনে কবিতার মাধ্যমে। নিষ্ঠুর ব্রিটিশ রাজশক্তি যথাযথ বুঝতে পারেন তাদের কটাক্ষ করে রূপক অর্থে নজরুল আনন্দময়ীর আগমনে কবিতাটি লিখেছেন। সেই সময় সংগঠিত রাজনৈতিক ঘটনাগুলো নজরুলের রচনায় এসেছে পুরাণ, প্রতীক, উপমা, উদাহরণ হিসেবে। এছাড়া এসেছে রূপকের পোশাকে এক অভিনব প্রতিবাদে। তিনি মেধায় ও কর্মে তৎকালীন সমাজে রীতিমত আলোড়ন তুলেছিলেন। আনন্দময়ীর আগমনে কবিতায় ‘মা’-এর কাছে সন্তানের এক প্রার্থনা ছিল। নজরুলের ওপর ব্রিটিশ রাজশক্তি ক্ষিপ্ত হয়। তাঁকে ২৩ নভেম্বর ১৯২২ সালে কুমিল্লা থেকে পুলিশ গ্রেফতার করে। তিনি জেল থেকে মুক্তি পান ১৫ ডিসেম্বর ১৯২৩ সালে। আনন্দময়ীর আগমনে কবিতার কিছু অংশ তুলে ধরা হলো:
আর কতকাল থাক্বি বেটী মাটির ঢেলার মূর্ত্তি আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি-চাঁড়াল।
দেব- শিশুদের র্মাছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভূ-ভারত আজ কশাইখানা,-আস্বি কখন সর্ব্বনাশী?
দেব-সেনা আজ টান্ছে ঘানি তেপান্তরের দীপান্তরে,
রণাঙ্গনে নাম্বে কে আর তুই না এলে কৃপাণ ধ’রে?
বিষ্ণু নিজে বন্দী আজি ছয়-বছরী ফন্দী-কারায়,
চক্র তাঁহার চরকা বুঝি ভ–হাতে শক্তি হারায়।১
সেই সময় ‘বিদ্রোহী’ ও ‘ধূমকেতু’-এর সাথে আনন্দময়ীর আগমনে বেশ একটা লক্ষ্য করার মতো পার্থক্য রয়েছে। বিদ্রোহী ও ধূমকেতু-এর বিদ্রোহ প্রকাশ সবযুগের এবং সবদেশের। কিন্তু আনন্দময়ীর আগমনে শুধু ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ উচ্চারণ। এখানে কবি সংগ্রামী জাতিকে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পরার জন্য উৎসাহ যুগিয়েছেন। নজরুলের সেই প্রচেষ্টা বিফলে যায়নি। পাশাপাশি ধূমকেতু পত্রিকায় সেই সময়ের বিপ্লবীদের প্রেরণা যোগায়। নজরুলের লেখা ব্রিটিশ সরকার খুব ভালোভাবে আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন। এটা যে তাদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ উচ্চারণ সেটা অনুধাবন করতে পারেন। ব্রিটিশ রাজশক্তি বুঝেছিলেন বলে নজরুল গ্রেপ্তার হন। নজরুল গ্রেপ্তার হওয়ার পরে স্বাভাবিকভাবে বিচার কাজ চলছিল। কিন্তু রাজবন্দীর জবানবন্দী বিচার কাজকে ত্বরান্বিত করে। তাই ১৯২৩ সালের ১৬ জানুয়ারি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহো কর্তৃক ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪-ক ধারা অনুযায়ী ‘ধূমকেতু’ রাজদ্রোহ মামলায় নজরুল সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। বিচারক সুইনহো একজন কবি। নজরুল তাঁর বিচারক কবি সুইনহোর উদ্দেশ্যে এ আত্মকথামূলক প্রবন্ধটি তুলে ধরেন। তাঁর প্রতিবাদের একটি লিখিত উচ্চারণ ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’। এই সৃষ্টির প্রত্যেকটি কথাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি কথার মধ্যে ফুটে ওঠে প্রতিবাদ ও দর্শন। নজরুল দৃঢ়চিত্তে প্রকাশ করেন তিনি পরাধীনতায় আর বসবাস করতে চান না। তাই তাঁকে রাজবিদ্রোহী করে রাজ কারাগারে বন্দী করা হয়। ধূমকেতু-এর শিখায় রাজমুকুট নড়বড়ে হয়ে ওঠে। রাজার হাতে রাজদ- রইলেও সত্যের হাতে ন্যায়দণ্ড। রাজকর্মচারী রাজার হাতে রয়েছে। কিন্তু তাঁর হাতে রয়েছে সকল রাজার রাজা, সকল বিচারকের বিচারক, আদি অনন্তকাল ধরে সত্য এবং জাগ্রত-তিনি হলেন সৃষ্টিকর্তা। এই সৃষ্টিকর্তার কাছে রাজা, প্রজা, ধনী, গরিব, সুখী, দুঃখী সকলেই সমান। নজরুলের জবানবন্দীর উক্তিগুলো অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন:
‘আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী! তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দী এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত। একধারে রাজার মুকুট; আর ধারে ধূমকেতুর শিখা। একজন রাজা, হাতে রাজদণ্ড; আর জন সত্য, হাতে ন্যায়দ-। রাজার পক্ষে-নিযুক্ত রাজবেতনভোগী রাজকর্মচারী। আমার পক্ষে-সকল রাজার রাজা, সকল বিচারকের বিচারক, আদি অন্তকাল ধ’রে সত্য-জাগ্রত ভগবান। আমার বিচারককে কেহ নিযুক্ত করে নাই। এ-মহাবিচারকের দৃষ্টিতে রাজা-প্রজা, ধনী-নির্ধন, সুখী-দুঃখী সকলে সমান। এঁর সিংহাসনে রাজার মুকুট আর ভিখারির একতারা পাশাপাশি স্থান পায়। এঁর আইন-ন্যায়, ধর্ম। সে-আইন কোন বিজেতা মানব কোন বিজিত বিশিষ্ট জাতির জন্য তৈরী করে নাই। সে-আইন বিশ্ব-মানবের সত্য উপলব্ধি হতে সৃষ্ট; সে-আইন সার্বজনীন সত্যের, সে-আইন সার্বভৌমিক ভগবানের। রাজার পক্ষে-পরমাণু পরিমাণ খ–সৃষ্টি; আমার পক্ষে-আদি অন্তহীন অখ- স্রষ্টা।’২
নজরুলের রাজবন্দীর জবানবন্দী তাঁর নির্ভীক তূর্যবাদন এ কথা অনস্বীকার্য। সত্য-ন্যায় চেতনার অনুসারী এক স্মারক বক্তব্য হিসেবে মানব ইতিহাসে চিহ্নিত। রাজবন্দীর জবানবন্দীতে বিদ্রোহী চেতনার এবং সংগ্রামী মনোভাবের এক অপরাজেয় আশাবাদের বহিঃপ্রকাশ প্রতিটি শব্দে এবং বাক্যে ফুটে উঠেছে। নজরুল নির্দ্বিধায় ব্রিটিশকে সবসময় ‘অন্যায়কারী’ হিসেবে মনে করতেন। তিনি বিচারককে এক অনুগ্রহপ্রার্থী বেতনভুক্ত মানবসন্তান হিসেবে আখ্যায়িত করেন। নজরুল ছিলেন ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী এক সৈনিক। স্বাধীনতাকামী প্রত্যয়দীপ্ত সৈনিকের মানস ঐতিহ্যের ঋদ্ধ প্রকাশ রাজবন্দীর জবানবন্দী। তাঁর এই জবানবন্দীতে মিথের ব্যবহার মানবতাবোধের অন্তর্নিহিত বহিঃপ্রকাশ। তিনি এখানে পুরাণের ব্যবহার করেন ন্যায়ের প্রতীক হিসেবে। রাজার পক্ষে নিযুক্ত আছে রাজকর্মচারী। নজরুলের পেছনে আছেন আদি অনন্তকাল ধরে ভগবান। তিনি মনে করেন রাজার পেছনে আছেন ক্ষুদ্র মানুষ। আর আমার সাথে আছেন ‘রুদ্র’। এই রাজবন্দী কবির সাথে রুদ্র দেবতা শিব জড়িয়ে আছেন। তিনি অনুধাবন করতেন ব্রিটিশ রাজশক্তি ধ্বংস হবেই হবে। তারপরে গড়ে উঠবে এক নতুন বিশ্ব। তাঁর প্রতিবাদী চেতনা আপস নয়। সেটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর নজরুলের কবিমানসের বলিষ্ঠ প্রকাশ জীবের দেবতা শিবরূপী সত্তা। তাঁর জবানবন্দীতে ‘অমৃতের পুত্র আমি’ এই দাবি প্রস্ফুটিত। তিনি এখানে ‘স্বয়ং রুদ্র ভগবান’-এর কথা বলেন। এখানে ‘রুদ্র’ মিথটি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। সত্য প্রকাশের স্বতঃস্ফূর্ততা তাঁর মধ্যে প্রবল ছিল। আদালতে বিচারকের উদ্দেশ্যে অন্তরের অভিপ্সাকে স্ফুরিত করতে পেরেছেন। নজরুল সবসময় হৃদয়ে লালন করতেন তৎকালীন ভারতকে ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে মুক্ত করতে হবে। নজরুল নীতিগত দিক থেকে কখনও বিচ্যুত হননি। তাঁর মধ্যে সবসময় অপরিসীম মানসিক শক্তি ছিল। তিনি কখনই ভেদাভেদের এই
পৃথিবী চাননি। সবসময়ই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকে মানব ধর্মের প্রতিফলন দেখতে চেয়েছেন। নজরুলের আদালতে দাঁড়িয়ে দেওয়া রাজবন্দীর জবানবন্দী তাঁর আত্মবিশ্বাসী অন্তরের বহিঃপ্রকাশ। অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এমন ভাষায় আর কোনো বাঙ্গালি কবি প্রতিবাদ জানিয়েছেন বলে এখনো শোনা যায়নি। তাই তিনি দৃঢ়তার সাথে উচ্চারণ করেন:
‘আমি জানি এবং দেখেছি-আজ এই আদালতে আসামীর কাঠগড়ায় একা আমি দাঁড়িয়ে নেই, আমার পশ্চাতে স্বয়ং সত্যসুন্দর ভগবানও দাঁড়িয়ে। যুগে যুগে তিনি এমনি নীরবে তাঁর রাজবন্দী সত্য-সৈনিকের পশ্চাতে এসে দ-ায়মান হন। রাজনিযুক্ত বিচারক সত্য বিচারক হতে পারে না। এমনি বিচার-প্রহসন করে যেদিন খ্রিস্টকে ক্রুশ বিদ্ধ করা হল, গান্ধীকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হল, সেদিনও ভগবান এমনি নীরবে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁদের পশ্চাতে। বিচারক কিন্তু তাঁকে দেখতে পায়নি, তার আর ভগবানের মধ্যে তখন সম্রাট দাঁড়িয়ে ছিলেন, সম্রাটের ভয়ে তার বিবেক, তার দৃষ্টি অন্ধ হয়ে গেছিল। নইলে সে তার ঐ বিচারাসনে ভয়ে বিস্ময়ে র্থর্থ করে কেঁপে উঠত, নীল হয়ে যেত, তার বিচারাসন সমেত সে পুড়ে ছাই হয়ে যেত।’৩
নজরুল রাজবন্দীর জবানবন্দীতে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেন তাঁর কোন ভয় নাই, দুঃখ নাই। যেহেতু ভগবান তাঁর সাথে আছেন। তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন তাঁর অসমাপ্ত কাজ অন্যের দ্বারা সমাপ্ত হবে। নজরুলের হাতের ধূমকেতু আর সৃষ্টিকর্তার হাতের অগ্নি-মশাল এক হয়ে অন্যায়-অত্যাচার দূর হবে। তিনি বিশ্বাস করতেন তাঁর সারথি সৃষ্টিকর্তা। নজরুল রাজবন্দীর জবানবন্দীতে বলিষ্ঠভাবে উচ্চারণ করেন:
‘আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি-মশাল হয়ে অন্যায়-অত্যাচারকে দগ্ধ করবে। আমার বহ্নি-এরোপ্লেনের সারথি হবেন এবার স্বয়ং রুদ্র ভগবান। অতএব, মাভৈঃ, ভয় নাই। কারাগারে আমার বন্দিনী মায়ের আঁধার-শান্ত কোল এ অকৃতী পুত্রকে ডাক দিয়েছে। পরাধীন অনাথিনী জননীর বুকে এ হতভাগ্যের স্থান হবে কিনা জানি না, যদি হয় বিচারককে অশ্রু-সিক্ত ধন্যবাদ দিব। আবার বলছি, আমার ভয় নাই, দুঃখ নাই। আমি ‘অমৃতস্য পুত্রঃ’। আমি জানি- “ঐ অত্যাচারীর সত্য পীড়ন/আছে তার আছে ক্ষয়;/ সেই সত্য আমার ভাগ্য-বিধাতা/ যার হাতে শুধু রয়”।’৪
এই স্বল্প পরিসরের লেখায় রাজবন্দীর জবানবন্দীর কিছু অংশ এক নজরে দেখার জন্যে সবিনয়ে তুলে ধরা হলো:
১. একজন রাজা হাতে রাজদ-, আর জন সত্য হাতে ন্যায়দ-।
২. রাজার পক্ষেÑনিযুক্ত রাজবেতনভোগী রাজকর্মচারী। আমার পক্ষে-সকল রাজার রাজা, সকল বিচারকের বিচারক, আদি অন্তকাল ধরে সত্যÑজাগ্রত ভগবান।
৩. রাজার পেছনে ক্ষুদ্র, আমার পেছনে রুদ্র।
৪. রাজার পক্ষে যিনি, তাঁর লক্ষ্য স্বার্থ, লাভ অর্থ; আমার পক্ষে যিনি তাঁর লক্ষ্য সত্য, লাভ পরমানন্দ।
৫. রাজার বাণী বুদ্বুদ, আমার বাণী সীমাহারা সমুদ্র্।
৬. নির্বোধ মানুষের অহঙ্কারের অন্ত নাই।
৭. অহঙ্কার একদিন চোখের জলে ডুববেই ডুববে।
৮. উৎপীড়িত আর্ত বিশ্ববাসীর পক্ষে আমি সত্য তরবারি।
৯. আমি মর, কিন্তু আমার বিধাতা অমর।
১০. দোষ আমারও নয়, আমার বীণারও নয়; দোষ তাঁর যিনি আমার কণ্ঠ দিয়ে তাঁর বীণা বাজান। সুতরাং রাজবিদ্রোহী আমি নই; প্রধান রাজবিদ্রোহী সেই বীণা-বাদক ভগবান।
১১. আজ ভারত পরাধীন। তার অধিবাসীবৃন্দ দাস। এটা নির্জলা সত্য। কিন্তু দাসকে দাস বললে, অন্যায়কে অন্যায় বললে এ রাজত্বে তা হবে রাজদ্রোহ।
১২. আমার কণ্ঠে ঐ উৎপীড়িত নিখিল-নীরব ক্রন্দসীর সম্মিলিত সরব প্রকাশ।
১৩. আমি যে কবি, আমার আত্মা যে সত্যদৃষ্টা ঋষির আত্মা।
১৪. আমি এবারকার প্রলয় ঘোষণার সর্বপ্রথম আঘাতপ্রাপ্ত সৈনিক মনে করে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করেছি।৫
নজরুলের আদালতে রায় হওয়ার পরে তাঁর বন্ধুরা বিমর্ষ হয়ে পড়েন। সাহিত্য যে স্বাধীনতার প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে এর জ্বলন্ত উদাহরণ রাজবন্দীর জবানবন্দী। নজরুলের মানসিক শক্তি ছিল অত্যন্ত প্রবল। তাই তিনি সেসময় তাঁর বন্ধুদের সান্ত¡না দিতে পেরেছিলেন। এ প্রসঙ্গে একটা প্রাসঙ্গিক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে:
‘রায়ের পর নজরুলের উকিল বিচারককে অনুরোধ জানান কারাগারে কবিকে বিশেষ শ্রেণীর মর্যাদা দানের জন্যে, বিচারক উত্তরে জানান যে তার কোন প্রয়োজন নেই। কেননা রাজনৈতিক বন্দীদের এমনিতেই বিশেষ শ্রেণীর কয়েদী হিসেবে গণ্য করা হয়। রায় শোনার জন্যে আদালতে বেশ ভীড় হয়েছিল। নজরুলকে যখন আদালত থেকে জেলে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তার বন্ধুরা বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন আর নজরুল তাদের সান্তনা দিয়ে বলেছিলেন ‘‘একটি বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে, হয়তো এ কারাবাসের প্রয়োজন ছিল’’।’৬
নজরুলের রায়ের পরে ধূমকেতু পত্রিকার ১৩ মাঘ, ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ৩২তম সংখ্যায় নজরুলের রাজবন্দীর জবানবন্দী প্রকাশ পায়। ধূমকেতু পত্রিকার এই সংখ্যায় রাজবন্দীর জবানবন্দী ছাড়াও তাঁর একটি ছবি, ‘ধূমকেতুর গ্রহণ’ শিরোনামে নজরুলের দন্ডাদেশের সংবাদ এবং ‘কাজী নজরুল’ শিরোনামে নজরুলের পরিচিতি প্রকাশিত হয়। সাড়া জাগানো ধূমকেতু পত্রিকায় নজরুলের রাজবন্দীর জবানবন্দী প্রকাশের মধ্য দিয়ে এই পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া আরও কয়েকটি পত্রিকায় রাজবন্দীর জবানবন্দী প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য:
১৩২৯ মাঘের (জানুয়ারি ১৯২৩) প্রবর্তক, ১৩২৯ ফাল্গুনের (ফেব্রুয়ারি ১৯২৩) উপাসনা এবং ১৩২৯ (ফেব্রুয়ারি ১৯২৩) ফাল্গুনের সহচর প্রভৃতি সাময়িকপত্রে প্রকাশিত হয়। ধূমকেতুর মামলায় এই ‘জবানবন্দী’ আদালতে দাখিল করা হয়েছিল। কিন্তু তা সা¤্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ রাজের বিচার ব্যবস্থাকে টলাতে পারেনি। আদালতের রায়ে নজরুলের এক বছর মেয়াদি কারাদ- ঘোষিত হয়। পুস্তিকাকারে জবানবন্দীর দুটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। কবির নতুনতম প্রতিকৃতি-সংবলিত দ্বিতীয় সংস্করণের দাম ছিল দুই আনা।৭
মানব প্রেমিক নজরুল কুসংস্কারাছন্ন কিছু মানুষের রোষাণলে পরলেও কখনো অন্যায়ের প্রতিবাদ থেকে পিছিয়ে থাকেননি। তিনি বিদ্রোহ যেমন করেছেন, তেমনি অর্থনৈতিক মুক্তি, সুষমসমাজ প্রতিষ্ঠা করা তাঁর এক উদ্দেশ্য ছিল। উদাহরণ হিসেবে:
‘নজরুলের প্রতিবাদ, বিদ্রোহ যেমন সার্বিক সামাজিক শোষণের বিরুদ্ধে তেমনি অর্থনৈতিক মুক্তি, সুষমসমাজ প্রতিষ্ঠা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। নজরুল ছিলেন মানবপ্রেমিক। তাই সাম্যবাদের চেতনা সর্বস্তরে জাগানোর চেষ্টা করেছেন। গণমানুষের মুক্তির জন্য তাঁর বলিষ্ঠ উচ্চারণ তাকে রুশো ভল্টেয়্যার, ম্যাক্সিম গোর্কি, আলবেয়ার কামু, জ্যঁ পল সার্ত্রে প্রমুখের সমপর্যায়ের মর্যাদায় অভিসিক্ত করা যায়। যুগে যুগে কালে কালে বিভিন্ন দেশের শিল্পীরা স্বদেশকে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করার জন্য ঔপনিবেশিক দুঃশাসন ও স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা থেকে স্বদেশকে মুক্ত রাখতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছেন। নজরুলের জবানবন্দী তাঁর সাহসী উচ্চারণে ঋদ্ধ। কবি নিজেকে আগুনের মশালের সাথে তুলনা করেছেন।’৮
নজরুল তাঁর রাজবন্দীর জবানবন্দী প্রবন্ধে নিজেকে ‘সত্য’ বাহকরূপে চিন্তা করেন। তিনি বিশ্বাস করেন সত্যকে প্রকাশ করার জন্যে কারও সহযোগিতার দরকার নেই। তিনি নিজেকেই সত্য প্রকাশের যন্ত্র মনে করেন। কেউ এই সত্য প্রকাশের যন্ত্রকে প্রতিহত করতে পারে, আবার বিনাশও করতে পারে। কিন্তু সত্য বাণী চিরন্তন, তিনি মনে করতেন ‘আমি মর, কিন্তু আমার বিধাতা অমর’। তিনি তাঁর এই রচনায় শিবের কথা প্রকাশ করেছেন। এটা তাঁর কবি মানসের প্রকাশ। নজরুল এই প্রবন্ধে ‘মিথ’ এর ব্যবহার করেন। যেমন:
‘অমৃতের পুত্র আমি’ এ উদ্ধৃতিতে তিনি নিজেকে অমৃতের পুত্র বলে দাবি করেছেন। ‘এবার স্বয়ং রুদ্র ভগবান’ এতে রুদ্র ভগবানের কথা বলেছেন। ‘রুদ্র’ মিথটি এ নিবন্ধে বিশেষভাবে উল্লিখিত হয়েছে।’৯
নজরুল এমনই এক কবি যিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে এদেশের নিপীড়িত মানুষের আশাআকাক্সক্ষা। বাস্তবায়ন করার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সে সময় ব্রিটিশ রাজশক্তির অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা রাখেন। তাঁর লেখায় মানুষের হতাশা-গ্লানি, নৈরাজ্য, বৈষম্য দূর করা, অন্যায়ের বিরুদ্ধাচারণ বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরেন। তাই তিনি মানবতা ও অধিকার বঞ্চিত মানুষের কবি হয়ে ওঠেন। তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বৈপ্লবিক পথ ধারণ করেন। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে:
‘নজরুলের সৃজনধর্মী বিদ্রোহের বাণী বাংলার সর্বত্র ঘোষিত হয় নির্ভীক কণ্ঠে। নজরুল আপোসহীন সংগ্রাম ঘোষণা করেছিলেন সকল প্রকার সামাজিক বিভেদ, বিধি-নিষেধ, অর্থনৈতিক নিপীড়ন ও রাজনৈতিক পাশবিকতার বিরুদ্ধে। নজরুলের পূর্বে আর কোনো সাহিত্যিক বিদেশী শাসনের নাগপাশ থেকে দেশের পূর্ণাঙ্গ মুক্তির দাবি ঘোষণা করেননি।’১০
নজরুলের লেখা রাজবন্দীর জবানবন্দী এক দ্রোহের প্রবল অনুভূতি। তাঁর বাণী রাজ বিচারে রাজদ্রোহী কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়। তাঁর এই বাণী ন্যায়ের মূর্ত প্রতীক। নজরুল মনে করতেন পরাধীন দেশে বিচারক মোটেও স্বাধীন নন। রাষ্ট্র ক্ষমতাকে ব্রিটিশ রাজ তাদের শক্তিতে কলুষিত করেছিলেন। নজরুল মনে প্রাণে অনুভব করতেন, তিনি সৃষ্টিকর্তার প্রেম লাভে সমর্থ।
নজরুলের রাজবন্দীর জবানবন্দী এক প্রতিবাদী উচ্চারণের লিখিত দলিল। এই রাজবন্দীর জবানবন্দীতে সংগ্রামী চেতনার প্রতিফলন প্রতিটি শব্দে ফুটে ওঠে। তিনি সেইদিন আদালতে দাঁড়িয়ে রাজবন্দীর জবানবন্দীতে কথিত রাজদ্রোহের অপরাধে অপমান, লাঞ্ছনা, বিদ্রƒপ এবং আঘাতের বিবরণ প্রকাশ করে মিথ্যা অত্যাচার, শোষণের দিন ফুরিয়ে যাওয়ার বার্তাটি বিচারকের কানে বলিষ্ঠকণ্ঠে পৌঁছে দেন। রাজবন্দীর জবানবন্দীতে দার্শনিকের জ্ঞান প্রস্ফুটিত। সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ রাজবন্দীর জবানবন্দী। নজরুল মানবজাতির জন্যে সারাজীবন এক দীপ জ্বেলে গেছেন।
তথ্যসূত্র:
১. নজরুলের ধূমকেতু, সংগ্রহ ও সম্পাদনা, সেলিনা বাহার জামান, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা, দ্বিতীয় প্রকাশ, জুন ২০১৩, পৃ. ১৫৩
২. কাজী নজরুল ইসলাম, নজরুলের প্রবন্ধ-সমগ্র, সম্পাদনা, মুহম্মদ নূরুল হুদা ও রশিদুন্ নবী, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা, ষষ্ঠ মুদ্রণ, ডিসেম্বর ২০১৪, পৃ. ৭৫
৩. ঐ, পৃ. ৭৭
৪. ঐ, পৃ. ৮০
৫. জহিরুল হক, সক্রেটিস ও নজরুলের জবানবন্দী, নজরুল ইন্সটিটিউট পত্রিকা : তেত্রিশতম সংকলন, সম্পাদক, মো. আব্দুর রাজ্জাক ভূঞা, জানুয়ারি ২০১৭, পৃ. ৫৯-৬০
৬. রফিকুল ইসলাম, কাজী নজরুল ইসলাম : জীবন ও সৃজন, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা, প্রথম মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারি ২০১২, পৃ. ১৩১
৭. মাহবুবুল হক, নজরুল তারিখ অভিধান, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, জুন ২০১০, পৃ. ৫৯
৮. শিল্পী খানম, নজরুলের রাজবন্দীর জবানবন্দী, নজরুল ইন্সটিটিউট পত্রিকা : একত্রিশতম সংকলন, সম্পাদক, ইকরাম আহমেদ, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ, পৃ. ১৩৩
৯. তাহা ইয়াসিন, নজরুলের জীবনবোধ ও চিন্তাধারা, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা, মে ২০১৩, পৃ. ৪৭৪
১০. পারভীন আক্তার জেমী, নজরুল সাহিত্যে বিপ্লবী চেতনা, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, জুন ২০১০, পৃ. ৩২-৩৩
লেখক : নজরুল গবেষক।