ওয়ার্কপ্লেস কাউন্সেলিং আধুনিক কর্মী ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিজ্ঞানমনষ্ক অনুধ্যান। কর্মক্ষেত্রে কর্মজীবী মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও দাম্পত্য এবং তার কর্মস্থলের দিনান্তিক সমস্যাসমূহ সমাধানের লক্ষে পেশাদার পরামর্শদাতার পরিকল্পিত সেবাদান কার্যক্রমকে ‘ওয়ার্কপ্লেস কাউন্সেলিং’ বলা যেতে পারে। অর্থাৎ ওয়ার্কপ্লেস কাউন্সেলিং হচ্ছে এমন একটি কার্যকরী ও প্রতিরোধমূলক কর্মী ব্যবস্থাপনা কৌশল যেখানে কর্মস্থলে কর্মজীবী মানুষের মানসিক, ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও দাম্পত্য কিংবা আবেগীয় এবং কর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট সমস্যাসমূহ পেশাদার পরামর্শদাতা কর্তৃক পরিকল্পিত উপায়ে সমাধান বির্নিদেশ করা হয়।
ওয়ার্কপ্লেস কাউন্সেলিং এর মৌল উদ্দেশ্য হচ্ছে কর্মজীবী মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানো, কর্মীর আত্মমর্যাদাবোধ, আত্মসম্মান ও আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলা, নিজের উপর আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা এবং নিজের উপর আরোপিত কর্ম সম্পাদনে সক্ষম করে তোলা। কর্মজীবীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলা এবং কর্মক্ষেত্রে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুত করে তোলা। এ ধরনের কাউন্সেলিং হতাশ ও বিপদগ্রস্ত এবং ভগ্নদশা কর্মজীবীকে পুরোপুরি সক্ষম একজন কর্মস্পৃহ, কর্মোদ্দীপ্ত ও প্রাণবন্ত কর্মীতে পরিণত করে।
নানা কারণে কর্মক্ষেত্রে একজন কর্মজীবীর পারফর্ম্যান্স বা কর্মক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। এক্ষেত্রে কর্ম ও কর্মস্থল সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো হতে পারেঃ কর্মস্থলের দ্বান্দ্বিক পরিবেশ, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য ও একদেশদর্শী আচরণের শিকার হওয়া কর্মস্থলে যৌন হয়রানী শিকার হওয়া, গ্রহণ ক্ষমতার অতিরিক্ত কর্মভার আরোপ, কর্মে উচ্চমাত্রার চাপ, কর্মের অনিশ্চয়তা, প্রত্যাশার তুলনায় নিম্নমানের কর্মলাভ, বিভাগীয় শৃঙ্খলামূলক শাস্তি, দীর্ঘকালীন নিম্নমানের পদায়ন, সময়ানুপাতিক পদোন্নতি না পাওয়া, উত্তম কাজের স্বীকৃতির অভাব, একঘেয়ে ও বিরক্তিকর কাজ ইত্যাদি। এছাড়া কর্মজীবীর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়, যেমনঃ পারিবারিক ও দাম্পত্য দ্বন্দ্ব-কলহ, বিষন্নতা, উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, নিদ্রাহীনতা (ইনসোমনিয়া), শারিরিক অক্ষমতা ও স্থায়ী রোগবালাই, আকস্মিক ও অত্যাসন্ন কোনো বিপদ কিংবা দুরারোগ্য কোনো ব্যাধি ইত্যাদি বিষয়গুলোও কর্মক্ষেত্রে কর্মজীবীর কর্ম, আচরণ, সম্পর্ক ও কর্মক্ষমতায় দেখা দিতে পারে নানান অসঙ্গতি। এতে কর্মস্পৃহা, কর্মে মনোযোগ, মেধা ও ধীশক্তি হ্রাস পায়। কর্মক্ষেত্রে আন্তঃব্যক্তিক মিথস্ত্রিয়া ও আচরণে ভারসাম্য বিনষ্ট হয়। কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিতির হার বৃদ্ধি পায়, কর্মসম্পাদনের সময়সীমা (ডেডলাইন) অতিক্রান্ত হয়, কর্মের নি¤œমান প্রদর্শিত হয় এবং কর্মে পৌনঃপুনিক ভুল হয় এবং ভুলে যাওয়ার প্রবনতা দেখা দেয়। সর্বোপরি কর্মক্ষেত্রে কর্মজীবীর কর্মসাধন ক্ষমতা ও কর্মোৎপাদন হ্রাস পায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেশাদার সমাজকর্মীদের জাতীয় সংগঠন ‘ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব সোশ্যাল ওর্য়ার্কাস’ (এনএএসডব্লিউ) কর্তৃক পরিচালিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় প্রকাশ পায়, সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে প্রায় ১৮% কর্মজীবী মানুষ মানসিকভাবে সমস্যাগ্রস্ত। ফলে একজন সুস্থ কর্মজীবী অপেক্ষা একজন সমস্যাগ্রস্ত কর্মজীবীর কর্মক্ষমতা প্রায় ২৫% কম। যে কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্যই তা অদৃশ্যমান এক বিরাট ক্ষতি। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ১৬.০৫% প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ মানসিকভাবে সমস্যাগ্রস্ত। যার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।
২০০৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মানসিক স্বাস্থ্য নীতিমালা গ্রহণ করা হয়েছে। তাছাড়া সরকার শত বছরের পুরনো ১৯১২ সালের পাগল আইনকে সংশোধন করে ২০১৮ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য আইন প্রনয়ণ করেছে। মানসিকভাবে অসুস্থ সকল মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এবং মানবাধিকারের প্রতি মর্যাদা ও সম্মান বজায় রেখে মানসিক অসুস্থতার চিকিৎসা সেবা প্রদানের সকল ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উক্ত আইনে বলা হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিকেও উক্ত আইনে সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
বাংলাদেশে সরকারী পর্যায়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের এডুকেশন এন্ড কাউন্সেলিং সাইন্স ও ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগসহ কয়েকটি সরকারী হাসপাতাল, বিশ^বিদ্যালয় ও কতিপয় বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত, দাম্পত্য, পারিবারিক ও গ্রুপ সাইকিয়েট্রিক কাউন্সেলিং সেবা প্রদানের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সরকারী ও বেসরকারী কর্মক্ষেত্রে একজন কর্মজীবী মানুষের মানসিক ও পেশাগত স্বাস্থ্যের (অকুপেশনাল হেল্থ) জন্য কাউন্সেলিং সেবা তেমন চোখে পড়ে না। তবে বাংলাদেশে বৃহৎ এনজিওগুলোর মধ্যে ব্র্যাক এ ক্ষেত্রে এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। ‘মন খুলে কথা বলা’ শীর্ষক কর্মসূচীর মাধ্যমে ব্র্যাক তিন জন পেশাদার মনোচিকিৎসাবিদ নিয়োগ করে কর্মস্থলে কর্মীদের মানসিক ও পেশাগত সমস্যার চিকিৎসা সেবা চালু করেছে।
পাশর্^বর্তী দেশ ভারতসহ উন্নত বিশে^র প্রায় সকল দেশে সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে মানসিক ও পেশাগত স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে কর্মক্ষেত্রে কাউন্সেলিং সেবা চালু রেখেছে। এক্ষেত্রে উন্নত বিশে^র ন্যায় বাংলাদেশেও প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়সহ বৃহৎ সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে ‘এ্যাম্পøয়ী এসিসট্যান্ট প্রোগ্রাম’ (ইএপি) বা কর্মী সহায়তা কর্মসূচীর আওতায় ওয়ার্কপ্লেস কাউন্সেলিং কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে। এই ধরনের কর্মসূচী ব্যক্তিগত উপস্থিতিতে কিংবা দুরালাপনীর মাধ্যমেও প্রদান করা যেতে পারে। ফলে একজন কর্মজীবী তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও দাম্পত্য সমস্যা কিংবা কর্মক্ষেত্র সংশ্লিষ্ট যে কোনো সমস্যার কথা পেশাদার পরামর্শদাতার নিকট খোলামেলা বর্ণনা করতে পারেন।
পরামর্শদাতা নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে তার পেশাগত জ্ঞান, উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতার আলোকে সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির পদসোপান, ধর্ম, বর্ণ ও
সংস্কৃতি নির্বিশেষে তার ব্যক্তিগত ও কর্মস্থল সংশ্লিষ্ট গোপনীয়তা বজায় রেখে সমস্যা সমাধানের জন্য উপযুক্ত পরামর্শ (কাউন্সেলিং) ও নির্দেশনা (গাইডেন্স) প্রদান করবেন।
বর্তমান সরকারের বহুমুখী প্রশাসনিক উন্নয়নের অংশ হিসেবে জনসেবার মানোন্নয়নে ওয়ার্কপ্লেস কাউন্সেলিংকে একটি প্রতিফলদায়ক কর্মী ব্যবস্থাপনা কৌশল হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। এর জন্যে সরকার কর্তৃক গৃহীত জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য নীতিমালা ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য আইনের আলোকে কর্মক্ষেত্রে মানসিক ও পেশাগত স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে স্বীকৃতি ও গুরুত্ব দিয়ে একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে বৃহৎ সরকারী ও বেসরকারী কর্মীঘন প্রতিষ্ঠানে এবং বৃহৎ এনজিও ও বৃহৎ কর্পোরেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ওয়ার্কপ্লেস কাউন্সেলিং সেবা চালু করা যেতে পারে। তাছাড়া বিভিন্ন সার্ভিসের পেশাগত প্রশিক্ষণে ওয়ার্কপ্লেস কাউন্সেলিং ও গাইডেন্সকে অর্ন্তভুক্ত করা যেতে পারে। এ ধরনের কর্মসূচীর ফলে একদিকে যেমন কর্মজীবীর দৈহিক, মানসিক ও সামাজিক কল্যাণ বয়ে আনবে, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানে কর্মে অনুপস্থিতির হার ও কমর্বিমুখতা হ্রাস পাবে। ফলে প্রতিষ্ঠানের কর্মোৎপাদন ক্ষমতা ও মুনাফা বৃদ্ধি পাবে এবং জাতীয় অর্থনীতিতেও ইতিবাচক অবদান রাখবে। তাই জনসেবার মানোন্নয়নে অন্যতম কৌশল হতে পারে ‘ওয়ার্কপ্লেস কাউন্সেলিং’।
লেখক : অতিরিক্ত পুলিশ সুপার
(স্টাফ অফিসার টু অ্যাডিশনাল আইজি)
বাংলাদেশ পুলিশ, সিআইডি, ঢাকা
0 Comments