ডিটেকটিভ রিপোর্ট
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না। সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে রাখা যায় না। আজ শুধু বাংলাদেশ নয়, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। তাঁর ত্যাগের মহিমায় বাংলাদেশকে চিনে নিয়েছে বিশ্ব। মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা মুজিববর্ষ পালনের সুযোগ পেয়েছি। এ যে আমাদের জীবনে কত বড় পাওয়া, তা ভাষায় বোঝাতে পারব না। আমি গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই দেশবাসীর প্রতি-যারা আমার দল, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে, পর পর তিনবার সরকার পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে মুজিববর্ষ উদযাপনের সুযোগ করে দিয়েছে।’
১৭ মার্চ ২০২০ রাত ৮টায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘জন্মশতবার্ষিকী’র বছরব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন অনুষ্ঠান উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ রাত ৮টায় টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণ একযোগে রেডিও ও টিভিতে প্রচারিত হয়।
ভাষণের শুরুতেই সবাইকে মুজিববর্ষের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শুভেচ্ছা জানান বিশ্ববাসীকে, দেশে ও দেশের বাইরে অবস্থানরত বাংলাদেশের সব নাগরিককে। ছোট বোন শেখ রেহানার পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সব বয়সের ও শ্রেণি-পেশার মানুষকে কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।
ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ১৫ই আগস্টের শহীদদের। স্মরণ করেন জাতীয় চার নেতা এবং মুক্তিযুদ্ধের সব শহীদকে। মহান মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত মা-বোন ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। সশ্রদ্ধ সালাম জানান দেশের সাহসী সন্তান একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসজনিত উদ্ভূত পরিস্থিতিতে উদ্বোধন অনুষ্ঠানে কিছুটা পরিবর্তন আনতে হয়েছে। তবে বছরব্যাপী নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে আমরা মুজিববর্ষ উদযাপন করব।’ একই কারণে বিদেশি অতিথিদের সফর স্থগিত করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভুটানের মহামান্য রাজা জিগমে খেসার ন্যামগাল ওয়াংচুক, নেপালের মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভলারি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এবং ওআইসির মহাসচিব ইউসেফ বিন আহমাদ আল-ওথাইমিনসহ বেশ কয়েকজন বিদেশি শুভাকাঙ্খী ভিডিও বার্তা পাঠিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। আমি তাঁদের ব্যক্তিগতভাবে এবং বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।’
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘আজ (মঙ্গলবার) ১৭ মার্চ। ১৯২০ সালের আজকের দিনে এই বাংলায় জন্ম নিয়েছিলেন এক মহাপুরুষ। তিনি আমার পিতা, শেখ মুজিবুর রহমান।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বাংলাদেশ নামের এই দেশটি তিনি উপহার দিয়েছেন। দিয়েছেন বাঙালিকে একটি জাতি হিসেবে আত্মপরিচয়ের মর্যাদা। তাইতো তিনি আমাদের জাতির পিতা। দুঃখী মানুষকে ক্ষুধা-দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিতে নিজের জীবনের সব সুখ-আরাম বিসর্জন দিয়ে তিনি সংগ্রাম করেছেন আজীবন। বারবার কারারুদ্ধ হয়েছেন। মানুষের দুঃখ-কষ্ট তাঁকে ব্যথিত করত। অধিকারহারা দুঃখী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে তিনি দ্বিধা করেননি। এই বঙ্গভূমির বঙ্গসন্তানদের একান্ত আপনজন হয়ে উঠেছিলেন-তাই তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘আজ (মঙ্গলবার) থেকে শুরু হয়ে ২০২১ সালের ২৬শে মার্চ পর্যন্ত মুজিববর্ষ উদযাপন করা হবে। ২০২১ সালে উদযাপিত হবে আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিভিন্ন বন্ধুপ্রতিম দেশ, ইউনেসকো, ওআইসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা মুজিববর্ষ উদযাপনে অংশীদার হয়েছে।’ এ জন্য তিনি দেশ ও বিদেশের সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই মানুষের দুঃখ-কষ্টে ব্যথিত হতেন জাতির পিতা। অকাতরে বিলিয়ে দিতেন তাঁর জামাকাপড়, বই, ছাতা। যার যখন যা প্রয়োজন মনে করতেন, তাকে নিজের জিনিস দিয়ে দিতেন। নিজের খাবারও তিনি ভাগ করে খেতেন। দুর্ভিক্ষের সময় গোলার ধান বিলিয়ে দিতেন। মানুষের জন্য কিছু করতে পারার মধ্যেই তিনি আনন্দ পেতেন। নিজের জীবনের কোনো চাওয়া-পাওয়া ছিল না। বাংলাদেশের মানুষের উন্নত, সুন্দর জীবন নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন তিনি। তাঁর সে ত্যাগ বৃথা যায়নি।’ জাতির জনকের এই মহানুভবতার বর্ণনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজকে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে মর্যাদার আসনে আসীন। আমাদের আরো এগিয়ে যেতে হবে। গড়তে হবে জাতির পিতার ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।’
শেখ হাসিনা তাঁর এই ভাষণে দেশের শিশু-কিশোর ও তরুণসমাজের প্রতি বিশেষ আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘তোমরা দেশকে এবং দেশের মানুষকে ভালোবাসবে। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতা। স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে চলার উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে তোমাদের নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। ঠিক যেভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের মানুষকে ভালোবেসেছিলেন, সেভাবেই ভালোবাসতে হবে। তাঁর আদর্শে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘পিতা, ঘাতকের নির্মম বুলেট কেড়ে নিয়েছে তোমাকে। তোমার দেহ রক্তাক্ত করেছে। তোমার নাম বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে চেষ্টা করেছে, কিন্তু ওরা পারেনি। ঘাতকরা বুঝতে পারেনি, তোমার রক্ত ৩২ নম্বর বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে ছড়িয়ে গেছে সারা বাংলাদেশে। জন্ম দিয়েছে কোটি কোটি মুজিবের। তাই আজ জেগে উঠেছে বাংলাদেশের মানুষ সত্যের অন্বেষণে।’ ভাষণের এ সময় আবেগ আপ্লত হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি জাতির পিতাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘পিতা, তোমার কাছে আমাদের অঙ্গীকার, তোমার স্বপ্নের সোনার বাংলা আমরা গড়বই। আর সেদিন বেশি দূরে নয়। তুমি ঘুমিয়ে আছ টুঙ্গিপাড়ার সবুজ ছায়াঘেরা মাটিতে পিতামাতার কোলের কাছে। তুমি ঘুমাও পিতা শান্তিতে। তোমার বাংলাদেশ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। আমরা জেগে রইব তোমার আদর্শ বুকে নিয়ে। জেগে থাকবে এ দেশের মানুষÑপ্রজন্মের পর প্রজন্ম। তোমার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশে। তোমার দেওয়া পতাকা সমুন্নত থাকবে চিরদিন।’
ভাষণের শেষ পর্যায়ে তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতার লাইন উদ্ধৃত করে বলেন, ‘তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শকতি/তোমার সেবার মহৎ প্রয়াস সহিবারে দাও ভকতি।’
0 Comments