মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে মিথ্যা স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে অভিযুক্তদের সাজা প্রদান নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে ব্রিটিশ সরকার ১৯৯০ সালে আইনজীবী, পুলিশ, শিক্ষাবিদ ও অপরাধ বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে একটি কমিশন গঠন করে। কমিশনের প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে আসামীদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একটি কৌশল বা মডেল প্রস্তুত করা হয়। ব্যাপক গবেষণা ও অনুশীলনের ভিত্তিতে গৃহীত এ মডেলটির নাম দেয়া হয়েছিল হল পিস (PEACE) মডেল যা বর্তমানে ব্রিটিশ পুলিশের কাছে অবশ্য অনুসরণীয়। পিস মডেলটি একাধারে অভিযুক্ত, সাক্ষী ও সাধারণ তথ্যদানকারীদের উপর সমানভাবে প্রয়োগ করা যায়। অন্যান্য পদ্ধতিগুলোর মতো এ মডেলে সন্দিগ্ধকে মানসিক বা শারীরিকভাবে চাপ প্রয়োগ বা নির্যাতন করার প্রয়োজন পড়ে না। এজন্য যুক্তরাজ্যের সীমানা পেরিয়ে পিস পডেল এখন অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের নিউজিল্যান্ড, ইউরোপের নরওয়ে, উত্তর আয়ারল্যান্ড এবং উত্তর আমেরিকার কানাডা এমনিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত চর্চিত হচ্ছে। অনেক উন্নত দেশ তাদের বিদ্যমান জিজ্ঞাসাবাদ কৌশলে পিস মডেলের উপাদানসমূহ অন্তর্ভুক্ত করেছে। পিস মডেল নিম্নবর্ণিত পাঁচটি পৃথক পৃথক ধাপে পরিচালিত হয়। যেমন,
১. পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি (Preparation & Planning),
২. নিযুক্তকরণ ও ব্যাখ্যা করণ (Engage & Explain),
৩. বাধাহীন বর্ণনা (Accounts),
৪. আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি (Closure) এবং
৫. মূল্যায়ন (Evaluate)।
এ পাঁচটি ধাপের ইংরেজি শব্দের অদ্যাক্ষরগুলো নিয়ে এ মডেলের নাম দেয়া হয়েছে PEACE মডেল।
পিস মডেল জিজ্ঞাসাবাদের অন্যান্য মডেলগুলো থেকে বহুলাংশে পৃথক। এখানে স্বীকারোক্তির জন্য অভিযুক্তকে পীড়াপীড়ি করা হয়না। এমনকি এ মডেলে জিজ্ঞাসাবাদ বা Interrogation শব্দটিও ব্যবহৃত হয় না। সাক্ষী, বাদী, আসামী সবার ক্ষেত্রেই সাক্ষাৎকার শব্দটি ব্যবহার করা হয়। অভিযুক্তের ক্ষেত্রে অনুসন্ধানী সাক্ষাৎকার বা Investigative Interview শব্দ ব্যবহার করা হয়। এ মডেলে একজন তদন্তকারী কর্মকর্তা অভিযুক্তের সামনে একজন পত্রিকার রিপোর্টারের মতো আচরণ করে। অভিযুক্তকে তার কথা বাধাহীনভাবে উপস্থাপন করতে দেয়া হয়। যদি সাক্ষাৎকারগ্রহণকারীর কোন বিষয় পরিষ্কার করা বা দ্বন্দ্ব নিরসনের প্রয়োজন হয় তবে সেটা অভিযুক্তকে প্রশ্নের মাধ্যমে সুরাহা করা হয়। অভিযুক্ত তার বর্ণিত গল্প বা ভাষ্যের মধ্যে যে অসংগতি ও বৈপরিত্য তৈরি করে তদন্তকারীদের মূল কৌশল সেখানেই নিহিত থাকে। এগুলো পরিষ্কার করা বা ব্যাখ্যার মাধ্যমেই অভিযুক্তের প্রতিরোধ শক্তি লোপ পায় ও সে দোষস্বীকার করে।
অন্যান্য কৌশলগুলোর মতো পিস মডেলে অভিযুক্তের অবাচনিক আচরণ যেমন, রক্তচাপ বৃদ্ধি, শ্বাস-প্রশ্বাসের অস্বাভাবিক ওঠানামা, শরীরের ঘাম ছোটা কিংবা গা চুলকানো, মাথা নাড়া ইত্যাদি শারীরিক ভঙ্গির নির্দেশনা বা অনুমান গুরুত্ব পায়না। কারণ এ মডেলের প্রবক্তারা মনে করেন, মিথ্যা বলা বা সত্যগোপনের সাথে অভিযুক্তের দৈহিক আচরণ পরিবর্তনের কোন সম্পর্ক নেই। যা হোক, এ অধ্যায়ে আমরা পিস মডেল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব। আলোচনার শুরুতেই পিস মডেলের একটি ফ্লোচার্ট সংযুক্ত করা হল।
১. পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি
পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি গ্রহণ যে কোন কাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি সঠিক হলেই পরবর্তী পর্বগুলো কার্যকরী হবে। তাই এ পর্বে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের যেমন অধিক সময় ব্যয় করতে হবে তেমনি তাদের পেশাগত দক্ষতাও প্রদর্শন করতে হবে। এ পর্বে একজন তদন্তকারী কর্মকর্তাকে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে-
- একটি যুতসই সাক্ষাৎকার-পরিকল্পনা প্রস্তুত করা,
- অভিযুক্ত তথা সাক্ষাৎকারদাতা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা,
- প্রয়োজনীয় লজিস্টিকস সংগ্রহ করা।
সাক্ষাৎকার পরিকল্পনায় নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হতে পারে-
- এত দিন পর্যন্ত পরিচালিত তদন্তকার্যক্রম গভীরভাবে পর্যালোচনা করা,
- প্রাপ্ত আলামতগুলো পর্যালোচনা করা,
- সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্যসমূহ ঠিক করা।
ঘটনার তদন্তকে মাথায় রেখেই সাক্ষাৎকার পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে হবে। সাক্ষাৎকারে প্রাপ্ত তথ্যগুলো কিভাবে ইতোমধ্যে প্রাপ্ত তথ্যগুলোকে প্রমাণিত, অপ্রমাণিত বা শক্তিশালী করবে সে বিষয়গুলো সতর্কতার সাথে বিবেচনা করতে হবে। এ সংক্রান্তে নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হবে-
- কোন কোন ব্যক্তির সাক্ষাৎকারগ্রহণ করা হবে এবং তা কোন ক্রমানুযায়ী করা হবে, অর্থাৎ কার সাক্ষাৎকার আগে ও কারটা পরে নিতে হবে?
- কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির সাক্ষাৎকার বা মতামত কেন জরুরি?
- এ মুহূর্তে তদন্তের জন্য কোন কোন তথ্য প্রয়োজন?
- সাক্ষাৎকারটি কি এখনই গ্রহণ করা প্রয়োজন, না, আরো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-প্রমাণ প্রাপ্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করা হবে?
সাক্ষাৎকারগ্রহণের পূর্বে অভিযুক্ত বা সাক্ষাৎকারদাতা সম্পর্কে নিম্নলিখিত তথ্যগুলো জানা জরুরি-
- বয়স,
- লিঙ্গ ও যৌনাভ্যাস,
- সাংস্কৃতিক পরিচয়,
- ধর্মীয় বিশ্বাস,
- পারিবারিক অবস্থা,
- শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ,
- পুলিশের সাথে পূর্ববর্তী মিথস্ক্রিয়া
বাস্তব কর্মকান্ডঃ সাক্ষাৎকার পর্বে সফল হতে হলে একজন সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকে কতিপয় বাস্তব কর্মকান্ড পরিচালনা বা অনুশীলন করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ এর ফলে তারা অপরাধ, অপরাধী, অপরাধ স্থল ও তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে বাস্তব ধারণা লাভ করবেন যা তাদের সাক্ষাৎকার পর্ব অধিকতর সাফল্যের সাথে সমাপ্ত করতে সহায়তা করবে। এগুলো হতে পারে-
- অপরাধ স্থল পরিদর্শন করা,
- প্রয়োজনীয় স্থানে তল্লাশি চালান,
- সাক্ষাৎকারের স্থান নির্ধারণ করা,
- একাধিক সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী হলে কার কি ভূমিকা হবে তার নির্ধারণ করা,
- সাক্ষাৎকারের সময় ও ব্যপ্তি নির্ধারণ করা,
- প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, যেমন, ক্যামেরা, খাতাকলম, রেকর্ডার, ভিডিও ইত্যাদির ব্যবস্থা করা,
- আলামত ও প্রদর্শনীসমূহ পর্যবেক্ষণ করা,
- অপরাধকর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞানার্জন করা, ইত্যাদি।
গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর মামলাগুলোর অভিযুক্ত ও সাক্ষীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় তদন্তকারী কর্মকর্তাদের অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। এজন্য এসব ক্ষেত্রে একটি লিখিত সাক্ষাৎকার পরিকল্পনা তৈরি করা জরুরি। সাক্ষাৎকার পরিকল্পনা সাক্ষাৎকারগ্রহণকারীদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে সাক্ষাৎকারকে অধিকতর পেশাদার করে তোলে। লিখিত পরিকল্পনায় নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে-
- অভিযুক্তের পুলিশ হেফাজতে থাকার মেয়াদ, (তদন্তকারীদের হেফাজতের মেয়াদ ও সাক্ষাৎকারদাতার উপর তার প্রভাব সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে)
- নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোন কোন বিষয়গুলোর উপর সাক্ষাৎকার নেয়া হবে এবং তা কতক্ষণ পর্যন্ত বা কোন পর্যন্ত গ্রহণ করা হবে। (বিষয়টি সাক্ষাৎকারদাতা অভিযুক্ত না সাক্ষী তার উপর নির্ভর করবে)
- কোন কোন বিষয়গুলো আলোচিত অপরাধ প্রমাণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ,
- যেসব বিষয় বা পয়েন্ট অপরাধীর অপরাধে জড়িত হওয়ার জন্য অযুহাত সৃষ্টি করে,
- আলামত বা প্রদর্শনীগুলোর বর্ণনা,
- যেসব বিষয় বা বস্তু অভিযুক্তের অপরাধের সম্পৃক্ততা নির্দেশ করে,
- অপরাধীকে শনাক্ত করার ক্ষেত্রে এতক্ষণ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণসমূহ
- অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়, যেমন, অপরাধী মন, অপরাধ সংক্রান্ত কর্ম, অপরাধ ইচ্ছা ইত্যাদি,
- বিবৃতি প্রস্তুত করা, বিশষ সতর্কতা, বিরূপ সিদ্ধান্ত, প্রণিধানযোগ্য মন্তব্য বা নীরবতা।
কোন সাক্ষাৎকারে একাধিক সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী হলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ করতে হবে-
- সাক্ষাৎকারে নেতুত্ব কে দিবেন,
- কে নোট গ্রহণ করবেন,
- কে কখন ও কোন পর্যায়ে কথা বলবেন, ইত্যাদি।
২. নিযুক্তকরণ ও ব্যাখ্যা করণ
এ পর্বের প্রথম পদক্ষেপই হল, অভিযুক্ত বা সাক্ষীকে আলোচনায় নিয়ে আসা। বিষয়টি খুবই দুরূহ। যদি সাক্ষী বা অভিযুক্ত প্রথমবার পুলিশের সংস্পর্শে আসেন, বিষয়টি তখন আরো বেশি কঠিন হয়। এজন্য সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকে একজন মনোযোগী শ্রোতা হতে হবে। সাক্ষীকে মনোযোগসহ শুনলেই তিনি নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন ও সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর সাথে তার সুসম্পর্ক তৈরি হয়। সাক্ষাৎকারের সূচনা কিভাবে হবে তাও পূর্বপরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করা উচিৎ। সাক্ষাৎকারের কারণ বা প্রয়োজনীয়তাও পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে। এক্ষেত্রে তদন্তকারীগণ বলতে পারেন-
- আপনাকে সাক্ষাৎকারের জন্য এখানে আনা হয়েছে কারণ আপনাকে (অপরাধের নাম) এর জন্য গ্রেফতার করা হয়েছে,
- আপনি (অপরাধের নাম) এর ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন বলেই আপনাকে এ সাক্ষাৎকারে আহব্বান করা হয়েছে।
এরপরও সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী নানাভাবে পরীক্ষা করে দেখবেন, প্রশ্ন করে নিশ্চিত হবেন যে সাক্ষী বা অভিযুক্ত সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্য সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছেন।
সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্যাবলীঃ সাক্ষাৎকার শুরুর পূর্বেই তদন্তকারীগণ সাক্ষাৎকারদাতা বা সাক্ষীর কাছে সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্যগুলো পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করবেন। এ জন্য তাদের সাক্ষাৎকারের একটি রূপরেখা বা রুট ম্যাপ দেয়া যেতে পারে। সাক্ষাৎকার দাতাকে একটি তালিকা সরবরাহ করে তাকে বলতে হবে যে আমরা আপনার সাথে এসব বিষয়ে কথা বলতে চাই। অধিকন্তু এ সবের বাইরেও যদি কোন প্রাসঙ্গিক বিষয় আসে তবে সেগুলো নিয়েও আমরা আলোচনা করব।
সাক্ষাৎকার চলাকালে তদন্তকারীগণ যদি নোট নিতে চান তবে সাক্ষাৎকারদাতাকে তাও খোলাখুলি বলতে হবে। তাদের ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে যে নোটগ্রহণ কেন জরুরি। অভিযুক্ত হলে তাকে বোঝাতে হবে যদিও তদন্তকারীগণ নির্দিষ্ট কিছু বিষয় পরিষ্কার করতে চান তবুও অভিযুক্তের উচিৎ বিষয়টি সম্পূণরূপে তাদের কাছে তুলে ধরা। কারণ এর ফলে অভিযুক্ত তাদের নিজের অবস্থান তুলে ধরে তা সীমাবদ্ধতা তদন্তকারীদের বোঝাতে পারবেন। জিজ্ঞাসাবাদকারী অভিযুক্ত বা সাক্ষীকে আশ্বস্ত করবেন যে তিনি তার কথা বাধাহীনভাবে বলতে পারবেন, তাকে কোনভাবেই বাধা দেয়া বা থামিয়ে দেয়া হবে না। তাই তিনি তার নিজের মতো করে পূর্ণ ঘটনা তুলে ধরবেন।
৪. বাধাহীন বর্ণনা
এ পর্বে জিজ্ঞাসাবাদকারী অভিযুক্ত বা সাক্ষীকে আলোচিত ঘটনা তার মতো করে বর্ণনা করতে বলবেন। এ পর্বে অভিযুক্ত বা সাক্ষীর সাথে অন্তরঙ্গতা তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাধাহীন বর্ণনার পরে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী বর্ণনায় কোন বিষয় অস্পষ্ট থাকলে প্রশ্নের মাধ্যমে তা স্পষ্ট করার চেষ্টা করবেন। কোন বিষয়ে বৈপরিত্য থাকলে তা নিরসনের চেষ্টা করবে।
বাধাহীনভাবে উত্তর দিতে বা বর্ণনা দিতে পারে এমন ধরনের প্রশ্ন করার মাধ্যমে এ পর্ব শুরু হতে পারে। যেমন, সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী বলতে পারেন, বলুন, আপনি ঘটনা সম্পর্কে কি জানেন। অথবা আপনি যা দেখেছেন, যা শুনেছেন ও যা বুঝেছেন আমাকে বিস্তারিত বলুন। সাক্ষী যখন তার বর্ণনা শুরু করবেন, তদন্তকারী আন্তরিকতার সাথে তা শুনবেন ও বর্ণনাকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবেন। তদন্তকারী সে ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত কাজগুলো করতে পারেন-
সাক্ষীর প্রতি কতিপয় অবাচনিক আচরণ বা শারীরিক ভঙ্গির মাধ্যমে তাকে উৎসাহিত করা,
সাক্ষীকে বর্ণনার মধ্যে বিরতি দেয়ার অনুমতি দেয়া যাতে তিনি তার স্মৃতি হাতড়িয়ে প্রকৃত ঘটনা তুলে আনতে পারেন,
হাঁ, হা!, বলুন, চালিয়ে যান, তারপর ইত্যাদি বলার মাধ্যমে সাক্ষীকে তার বর্ণনা শেষ পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করা।
নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলোর মাধ্যমে সাক্ষীর বর্ণনাকে বিস্তৃত ও পরিষ্কার করা যেতে পারে, যেমন-
- বর্ণনাকে সুবিধাজনক শিরোনামে ভাগ করা যেতে পারে,
- উন্মুক্ত বা বদ্ধ প্রশ্নের মাধ্যমে সাক্ষীর বর্ণনাকে পরিষ্কার করা যেতে পারে,
- পরিকল্পনায় থাকা গুরুত্বপূর্ণ যেসব প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি সেগুলোর দিকে সাক্ষীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে।
সাক্ষীর প্রতি প্রশ্নঃ সাক্ষীকে প্রশ্ন করার মাধ্যমে পরিকল্পনায় থাকা বিষয়গুলো যেমন পরিষ্কার করা যায়, তেমনি এখন পর্যন্ত আলোচিত হয়নি, এমন বিষয়গুলোর বর্ণনাও সংগ্রহ করা যায়। তবে প্রশ্নের ধরন হবে অতি সাধারণ ও বোধগম্য। দুর্বোধ্য কোন প্রশ্ন করা যাবে না। জড়ানো প্রশ্ন বা বিব্রতকর কোন প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, সাক্ষী প্রসিকিউশনে সহায়তা করার জন্যই পুলিশের কাছে সাক্ষাৎকার দিতে আসেন। কোন কোন সাক্ষীকে সমন দেয়া হলেও অধিকাংশ সাক্ষী স্বেচ্ছায় পুলিশের কাছে এসে সাক্ষ্য দেয়। তাই তাদের মনে ভীতি সঞ্চার করতে পারে, তদন্তকারীগণ এমন কোন আচরণ করবেন না। তাদের ফৌজদারি অপরাধে জড়িত করতে পারে কিংবা ভবিষ্যতে তাদের সমস্যা হতে পারে এমন ধরনের কোন আলোচনাই সাক্ষাৎকার চলাকালে করা যাবে না। প্রশ্ন সাধারণত পাঁচ প্রকারের হয়,
- খোলা প্রশ্ন,
- কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন,
- বিকল্প নির্বাচনী বা চাপানো প্রশ্ন,
- বহু নির্বাচনী প্রশ্ন ও
- নির্দেশক প্রশ্ন।
সাক্ষাৎকারের বর্ণনায় উন্মুক্ত বা খোলা প্রশ্নই বেশি উপযোগী। তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অন্য প্রকার প্রশ্নগুলোও জরুরি হয়ে পড়ে।
খোলা প্রশ্নের উদাহরণ-
- ঘটনাটি সম্পর্কে আমাদের বলুন,
- ঘটনাটি আমাদের কাছে বর্ণনা করুন,
- বিষয়টি আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করবেন কি?
সাক্ষাৎকারের শুরুতেই খোলা বা উন্মুক্ত প্রশ্ন করা প্রয়োজন। কারণ এতে সাক্ষী বাধাহীনভাবে তার নিজের মতো করে ঘটনার বর্ণনা দিতে পারেন। খোলা প্রশ্নের উত্তর বা বর্ণনাকালীন সাক্ষীকে কোনভাবেই থামানো বা বিরক্ত করা যাবে না।
মাঝে মাঝে কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন জরুরি হয়ে পড়ে। এ ধরনের প্রশ্ন সাক্ষাৎকারদানকারীকে সাক্ষাৎকারের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। তবে অসুবিধা হল, এটা সাক্ষীর বর্ণনাকে সংকুচিতও করতে পারে। নিম্নলিখিত কারণে কাঠামোবদ্ধ কখনও কখনও জরুরি হয়ে পড়ে, যথা-
- উন্মুক্ত বা খোলা প্রশ্নের বর্ণনায় যেসব বিষয় বলা হয়নি সেগুলোর বর্ণনা দিতে এ ধরনের প্রশ্ন করা যেতে পারে,
- খোলা প্রশ্নের বর্ণনায় প্রাপ্ত কোন তথ্যকে আরো বেশি পরিষ্কার করার জন্য এ ধরনের প্রশ্ন ব্যবহৃত হতে পারে,
- খোলা প্রশ্নের বর্ণনায় প্রাপ্ত তথ্যকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষেত্রেও এ ধরনের প্রশ্ন ব্যবহৃত হতে পারে।
কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নের কয়েকটি উদাহরণ হল,
- কে কোন অংশ করল?
- কারা কোন কাজটি করল?
- তিনি কি বললেন?
- তিনি কোথায় থাকেন?
- এটা কখন ঘটেছিল?
বিকল্প নির্বাচনী বা আরোপিত প্রশ্নঃ এ ধরনের প্রশ্নের উত্তরে তদন্তকারীর ছুড়ে মারা দুটো উত্তরের মধ্য থেকে সাক্ষাৎকারদাতাকে যে কোন একটি উত্তর বেছে নিতে হয়। যেমন, তদন্তকারী বলতে পারেন, গাড়িটা কি পাজেরো জিপ ছিল, না, টয়োটা করোলা ছিল? এক্ষেত্রে সাক্ষী পাজেরো বা করোলার মধ্য থেকে যেকোন একটাকে বেছে নিতে বাধ্য হয়।
বহুনির্বাচনী প্রশ্নঃ এ ধরনের প্রশ্ন অনেকটা জড়ানো প্রশ্ন। একই প্রশ্নের একাধিক অংশ থাকে। প্রত্যেক অংশের উত্তর ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আপনার বাড়ি কোথায়, সে দেখতে কেমন এবং সে কোথায় গিয়েছিল? এ ধরনের প্রশ্ন জিজ্ঞাসাবাদে অস্পষ্টতার সৃষ্টি করে। অভিযুক্ত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। তারা বুঝে উঠতে পারেনা কোন প্রশ্ন রেখে কোন প্রশ্নের উত্তর দিবে। অনুসন্ধানী সাক্ষাৎকারে এ ধরনের প্রশ্ন কেবল ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টিই করে না, এতে অভিযুক্ত জিজ্ঞাসাবাদকারীর দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে পারেন। তাই এধরনের প্রশ্ন করা উচিৎ নয়।
উত্তর নির্দেশক প্রশ্নঃ নিজের তৈরি করা উত্তর সাক্ষী বা অভিযুক্তের মুখে তুলে দিতে তা সঠিক বা বেঠিক হিসেবে অভিযুক্তের সত্যায়ন আদায় করার জন্যই মূলত নির্দেশক প্রশ্ন করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, আপনি তো অস্ত্রটি সেলিমকে দিয়েছিলেন, দেননি? এ প্রশ্নের উত্তরে অভিযুক্ত হয় হাঁ বলবে, নয়তো, না। এক্ষেত্রে তার স্বকীয়তা বজায় থাকবে না। যেহেতু এ জাতীয় প্রশ্নে নতুন কোন তথ্য উদ্ঘাটিত হয়না এবং প্রাপ্ত তথ্য প্রদানে সাক্ষীর কোন স্বকীয়তা থাকে না, তাই এ ধরনের প্রশ্নের উত্তরে প্রাপ্ত তথ্য তেমন গুরুত্ব বহন করে না। তাই চরম পর্যায়ে না যাওয়া পর্যন্ত এমন প্রশ্ন না করাই উত্তম।
৪. আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি
সাক্ষাৎকারটি যাতে হঠাৎ করে অনাকাঙ্খিতভাবে শেষ না হয় সেজন্য তা একটি পরিকল্পিত কাঠামোতে নিয়ে আসা দরকার। একাধিক সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী থাকলে সাক্ষাৎকারের
নেতৃত্বদানকারীকে নিশ্চিত করতে হবে যে অন্যান্য সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী সাক্ষাৎকার গ্রহণের সমাপ্তি টানার পূর্বেই যেন তারা তাদের প্রশ্ন করা শেষ করে ফেলেন। শেষ করা পূর্বে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকে সাক্ষাৎকারের একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করতে হবে। সারাংশতে সাক্ষাৎকারদাতা কি কি বলেছেন, কোন কোন বিষয়গুলো সাক্ষী পরিষ্কার করেছেন ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে। সাক্ষী বা সাক্ষাৎকারদাতা তদন্তকারীকে কোন প্রশ্ন করলে সেগুলোরও সঠিক সুরাহা করতে হবে।
এরপর সাক্ষাৎকারের সারাংশকে সাক্ষাৎকারদাতার একটি লিখিত বিবৃতিরূপে প্রস্তুত করবেন। যদি সাক্ষাৎকার সম্পূণরূপে শেষ না হয় কিংবা সাক্ষীকে আরো বেশি পরীক্ষার প্রয়োজন হয়, তবে সেটা তাকে জানিয়ে দিতে হবে। অতঃপর আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করতে হবে।
৫. মূল্যায়ন
সাক্ষাৎকারে সাক্ষী বা অভিযুক্তের কাছ থেকে যেসব তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে নিম্নলিখিত কারণে সেগুলোর মূল্যায়ন করা দরকার পড়ে,
- এ সম্পর্কে আর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা,
- সাক্ষী বা অভিযুক্তের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য প্রমাণগুলো কিভাবে তদন্তের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে,
- সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর কর্মদক্ষতা মূল্যায়নের জন্য।
বাংলাদেশ পিস মডেলের উপযোগিতা
ফৌজদারি জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে বর্তমানে বাংলাদেশে সার্বজনীন অনুসৃত ও রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত কোন জিজ্ঞাসাবাদ মডেল বা পদ্ধতি নেই। তার চেয়েও বড় কথা হল, এখানে জিজ্ঞাসাবাদের উপর সুপরিকল্পিত কোন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও নেই। তদন্ত সংক্রান্ত উচ্চতর কোর্সগুলোতেও জিজ্ঞাসাবাদ সংক্রান্ত মডিউল হয় অনুপস্থিত থাকে নয়তো কোন রকমে দায়সারা গোছের দু একটি সেসনের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ শেষ করা হয়। এখন প্রশ্ন হল, উন্নত দেশের উপযোগী করে প্রস্তুত পিস মডেল বাংলাদেশের জন্য কতটা প্রয়োগযোগ্য? এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পূর্বে আমরা দেখে নিতে চাই পিস মডেল অনুসৃত দেশগুলোর ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার তদন্ত সংক্রান্ত পদ্ধতিগুলোর সাথে বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার সাদৃশ্য ও বৈপরীত্য কতটুকু?
বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় পুলিশের কাছে দেয়া আসামীর দোষস্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু ব্রিটেনসহ ইউরোপ আমেরিকার বিচার ব্যবস্থায় পুলিশের কাছে দেয়া অভিযুক্তের দোষস্বীকারোক্তি যথাযথভাবে গ্রহণ করা হলে আদালতে তা সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে। আদালতে এসম্পর্কে বিরোধী পক্ষ দোষ স্বীকারোক্তি গ্রহণের পদ্ধতিগত ক্রুটি যেমন, স্বীকারোক্তি স্বতস্ফুর্ত না হওয়া, যথাযোগ্য সাক্ষীর উপস্থিতিতে আসামীর সাক্ষ্যগ্রহণ না করা কিংবা অভিযুক্তকে অভিযোগের পরিণাম সম্পর্কে সঠিকভাবে বুঝিয়ে না বলা ইত্যাদি প্রশ্ন তুলতে পারেন। কিন্তু সাধারণভাবে ঐ স্বীকারোক্তির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন না।
কিন্তু বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় যেহেতু পুলিশের কাছে প্রদত্ত দোষস্বীকারোক্তি আদালতে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই সাক্ষাৎকারদাতা অভিযুক্ত হলে এবং তার জবানবন্দি যদি নিজেকে জড়িয়ে স্বীকারোক্তির পর্যায়ে পড়ে তবে তাসিআরপিসির ১৬৪ ধারা অনুসারে রেকর্ড করার জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট উপস্থাপন করতে হয়। অর্থাৎ পিস মডেলের সাক্ষাৎকার বা জিজ্ঞাসাবাদ ব্রিটেনের পুলিশ অফিসারগণ যেভাবে শেষ করতে পারেন, বাংলাদেশের পুলিশ অফিসারগণ সেভাবে শেষ করতে পারবেন না। তাদের চূড়ান্ত বিচারে ম্যাজিস্ট্রেটের শরণাপন্ন হতে হয়। তাই পিস মডেল গ্রহণ করলে তা আমাদের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার সাথে সামজঞ্জস্যপূর্ণ বা কাস্টমাইজড করেই গ্রহণ করতে হবে।
তবে কোন জিজ্ঞাসাবাদ পদ্ধতি গ্রহণের ঘোষণাই যে পুলিশ অফিসারদের রাতারাতি পরঙ্গম করে তুলবে এমন কোন যাদুমন্ত্র পিস মডেলে নেই। এজন্য রাষ্ট্র, বিভাগীয় তৃণমূল পর্যায়ে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে পিস মডেল ব্যবহার করে ব্রিটিশ পুলিশ অফিসারদের সাফল্যের পিছনে নিম্নলিখত কারণগুলো সক্রিয় ছিল,যথা-
- পিস মডেলর ধারণা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহলে গৃহীত হয়েছিল,
- এ পদ্ধতি বাস্তবায়নের জন্য জাতীয়ভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল,
- পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ সমন্বিতভাবে কাজ করেছিল,
- পদ্ধতিটিকে চমৎকার ও বোধগম্য কাঠামোতে বিন্যাস্ত করে একটি সহজবোধ্য শিরোনাম দেয়া হয়েছিল,
- এ পদ্ধতি বাস্তবায়নের সুবিধার জন্য সংসদে আইন প্রণয়নসহ প্রয়োজনীয় গাইডলাইন প্রস্তুত করা হয়েছিল,
- এর জন্য পুলিশ অফিসারদের বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়েছিল
- অভিযুক্তদের পাশাপাশি সাক্ষাৎকারে সাক্ষী ও ভিকটিমদের সমান গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল।
তাই পিস মডেল কেবল গ্রহণ করলেই হবে না, এটা কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয়, রাষ্ট্রীয় ও বিভাগীয় অঙ্গিকারের পাশাপাশি পুলিশ অফিসারদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণও প্রদান করতে হবে। ব্রিটিশ পুলিশ যে প্রক্রিয়ায় পিস মডেল কার্যকর করেছিল অনুরূপ প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে বাংলাদেশেও এ মডেল যথেষ্ঠ সুফল দিবে বলে আশা করা যায়।
লেখক : এআইজি (পিঅ্যান্ডআর-২),
পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, ঢাকা