ডা. আসিফ রহমান
জয়ন্তিকা কখন আসবে বলা জাচ্ছে না আপাতত! না পত্রিকা না, জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস! সিলেট জাচ্ছি! বন্ধুর বিয়ের দাওয়াত! কনে বন্ধুর থেকে তিন বছরের বড়! ভালো লাগায় বিয়ের পর্ব! বন্ধুর বাবা কনের বয়স শুনে বলেছেন,
– এই বিয়া অইলে আই এই গোরের বাত খাইতাম না, ফাহাড়ে ছইলা যাইতাম!
ঝামেলার একশেষ করে ফাইনালি মিলেছে! বন্ধুর নামও মিলন! স্কুল লাইফে আমরা তাকে দৈহিক মিলন বলে খেপাতাম! খুব শক্ত পোক্ত শরীর ছিল ছেলেটার! এখনো তেমন ই আছে! পরে অবশ্য আপত্তিকর নাম হওয়াতে নামটা বাদ দিয়েছি! আমার অনেক কাছের একজন মানুষ! এতগুলোও কাজ পড়ে আছে! রুনুর জ্বর! এই মেয়েটার সঙ্গে পরিচয় অনেক সময়ের! ওর ও যে অসুখ করতে পারে আমি কেন জানি ভুলে গেছি! একদম উচিত হয়নি! আসার সময় যখন বললাম –
-আসি রুনু! দোয়া কোর! ওষুধ মিস করোনা!
-আমি কি করি না করো সেটা তোমার ভাবতে হবে না! ইউ জাস্ট ক্যারি ইওর লাইফ!
-রাগ করে ফেলেছো অলরেডি নাকি করার পথে এখনো?
-তোমার কি ধারণা তুমি আমার লাইফে খুব ইম্পর্ট্যান্ট কেউ? শোন আসিফ, আমার অনেক কাজ আছে! অযথা সময় নষ্ট হচ্ছে, তুমি যাও! এঞ্জয় ইউরসেলফ!
আমি রুনুর কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখলাম! রুনু অন্যদিকে তাকিয়ে রইল! আমি হাত দিয়েই রাখলাম! আমি জানি রুনু চাচ্ছেনা আমি হাত সরিয়ে নিনই! প্রশমন পর্ব শেষ করে উঠলাম!
-এই শোন! ঢ্যাং ঢ্যাং করতে করতে সিলেট যাচ্ছ, জ্যাকেট বা সোয়েটার কিছু নিয়েছ না খুশিতে সেটাও নাও নি?
আমি হালকা হেসে ব্যাগের চেইন খুলে রুনুকে দেখালাম! রুনু নিজে ব্যাগ টেনে নিয়ে দেখল বাকি সব ঠিক আছে কিনা! আমি এসব সময়ে কথা বলা বন্ধ করে দেই!
-শোন! হ্যান্ডওয়াশ কিনে নেবে!
-আচ্ছা নেব!
-গিয়ে কল করবা! আমি এর ভেতর তিনবার কল করব! এর বেশিও না, কম ও না!
-আচ্ছা! আসি রুনু!
এরপর রুনুর হাত ধরে আমি চলে আসি আর এখন বসে আছি কমলাপুরে! জয়ন্তিকার অপেক্ষায়! রাত ৯টা ৩৫! একটু দূরে মাঝারি বয়সের এক লোক অনেকক্ষণ ধরে আমাকে লক্ষ্য করছে! আমার ধারণা গাঁজার ডিলার! আমার চেহারা দেখে অনুমান করার চেষ্টা করছে আমি এসব খাই টাই কিনা! আমি তার দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসি দিলাম! সে কেমন জানি ভড়কে গিয়ে একটা পিলারের পেছনে গিয়ে আবার আমাকে দেখা শুরু করল! এবার কেমন জানি গুইসাপের মতো জিহ্বা বের করে রেখেছে! জিহ্বা লাল! পান খায় তার মানে! কুতসিৎ চাহনি কেমন জানি!
এর ভেতর আলো দেখা গেল! জয়ন্তিকা এসে পড়েছে! সময়মতই আসল প্রায়! কাছে আস্তেই শব্দে কান ঝালাপালা! কুলির দলের মাজায় গামছা বাঁধা শুরু হয়েছে! জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস!!!
আমি রাতের জার্নিতে ঘুমাই না! রাত দেখি! জোনাকি দেখি! একবার এক ডাকাত দলকেও দেখেছি! আজ বইটা হাতে নিয়ে আছি! হ্যাগার্ডের একটা বই! একটু পর উঠে যাব সিটে! ট্রেন আসার পর বেশ কিছু সময় পেরিয়ে গেল, লোকজন কম আজকে! তাই আর দেরি না করে উঠে বসে পড়লাম! জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম গুইসাপ কে কোথাও দেখা জাচ্ছে কিনা! না নেই কোথাও! হতাশ হয়ে চলে যাওয়ার কথা!
গুইসাপের কথা ভাবতে ভাবতে একজন ভদ্রলোক সামনের সিটে বসে পড়লেন!
-হ্যালো! থিস ইস শরীফ আহমেদ!
– আসিফ! আসিফ রহমান! নাইস টু মিট!
-সেইম হিয়ার! সিলেট?
-জী! আপনি?
-সেইম হিয়ার! হাহাহাহ! হাতে বই কার?
-হ্যাগার্ডের! মেরি!
-পড়েছি! পছন্দের লেখক আমার!
ভদ্রলোকের কথা শুনে মনে হল, বেশ হাসি-খুশি, চটপটে! মনে মনে ভেবে ভালো লাগল যে জার্নিটা তাও কথায় কথায় যাবে! সিদ্ধ পটলের মত কেউ হলে তেমন ভালো লাগত না! সিদ্ধ পটল শ্রেণির সঙ্গ কাম্য নয়! এর ভেতর আরো কিছু লোকজন জমা হয়ে গেছে বগিতে! চাকা নড়ছে! আমার কেন জানি ট্রেনের চাকা নড়লে আনন্দ হয়! রাত হলে সেটা একটু বেশি হয়! এখন হচ্ছে! শরীফ সাহেব হাতে বার্গার নিয়ে খাচ্ছেন! আমাকে সাধলেন! আসলেই ভদ্রলোক!
আমাদের পাশেই এক নব দম্পতি সম্ভবত! ছেলেটা গান গাইছে হাল্কা গলায়! মেয়েটা মুগ্ধ চোখে দেখছে! মেয়েরা বিয়ের পরের কয়েকটা দিন মুগ্ধতায় কাটায়! রুনু কাটাবে? উচিত তো বটেই!
-মি. আসিফ!
-জী, বলুন! 🙂
– কাজে যাচ্ছেন?
-না, দাওয়াত! বন্ধুর বিয়ে!
-ও ফ্যান্টাস্টিক! আপনাদের বয়সের এই অকেশনগুলো বেশ মজার! আমার সময়ের কথা মনে পড়ে যায়! যদিও আমার এখন ৪০ ছুই ছুই!
-দেখলে কিন্তু মনে হয় না! সানগ্লাস যেটা ঝুলিয়ে রেখেছেন সেটা পড়লে আরও পাঁচ বছর এমনিই কমে যাবে!
-হাহহহাহাআহ দ্যটস ইওর কাইন্ডনেস!
-আপনি যাচ্ছেন? কোনো কাজে অর…
-না না! আমি প্রতি বছর এই সময়টায় যাই!
-কারণ কি বলা যাবে?
শরীফ সাহেব ঘড়ি দেখলেন!
-এখন ১১টা প্রায়! বই পড়তে আপনার সময় হবে?
-পড়ে নেব পরে, আপনি বলুন! 🙂
– আমি এই কাজ করি গত ১৩ বছর যাবৎ! প্রতি বছর এই সময়ে আমি সিলেট যাই! মাজার জিয়ারত করি! তারপর জাফলং এর উদ্দেশ্যে রওনা করি! জাফলং-এর কিছু আগে গাড়ি থেকে নেমে পড়ি! সেখানে একটা চা বাগান আছে আর একটা রিসোর্ট! আমি সেখানে রাত কাটাই আর পথের দিকে তাকিয়ে থাকি!
-কেন? ? ?
– আমার বিয়ের তিন বছরে মাথায় আমার ওয়াইফ পরপারে চলে যান! আমাদের একটা ছেলে ছিল! আমি তাকে নিয়ে গুছিয়ে নেওয়া শুরু করেছিলাম! অসম্ভব কষ্ট হচ্ছিল আমার সব কিছু মেনে নিতে! শুধু ছেলেটার জন্য নতুন পৃথিবীর কাছে যেতে চেয়েছিলাম! তার নানাবাড়ি ছিল সিলেট! ওকে নিয়ে জাফলং যাচ্ছিলাম! পথে গাড়ি খারাপ হয়, আমি ওকে গাড়িতে বসিয়ে সামনে আগাই যে কিছু পাই কিনা! ফিরে এসে ওকেই পেলাম না আর! অনেক খুঁজেছি জানেন! পাই নি! এরপর প্রতি বছর আমি যাই, আমার বিশ্বাস আমি খুঁজে পাব ওকে! বলেন তো পাব না?
-আমি মন-প্রাণ দিয়ে চাই আপনি খুঁজে পান! সত্যি চাই!
-থ্যাঙ্কস! আপনি আসলে ভালো মানুষ!
– আপনি ঘুম দিতে পারেন একটু! অনেক কাজ পড়ে আছে আপনার!
-কারেক্ট! আই শুড স্লিপ! আই শুড স্লিপ!
এই বলে শরিফ সাহেব একটা কমলা রঙের কম্বল বের করে কাত হলেন! আমি বইএ ডুবলাম! অনেকক্ষণ পরে তাকালাম ভালো করে বাইরের দিকে! বাইরে ঠাণ্ডা বাড়ছে! সঙ্গে হাল্কা ঝির ঝির বৃষ্টি! কুয়াশা জমাট হচ্ছে না! দূরে পরিষ্কার দেখা যায়! টিলা চোখে পড়ছে! আর কিছু অজানা আলো! মনে হয় একটু পর ভোর হবে! ট্রেন হুইসেল দিচ্ছে ঘন ঘন! আমি নামার প্রস্তুতি নিচ্ছি! বেশ জলদি ই এলাম মনে হলো! মিলনের তো থাকার কথা বলেছি!
ট্রেন থেমে যাওয়ার পর শরীফ সাহেবকে ঘুম থেকে জাগালাম! ভদ্রলোক হুড়মুড করে উঠলেন!!
-এসে গেছি নাকি! বাহ!
-জী! চলেন নামি!
ট্রেন থেকে যখন নামলাম, চারদিকে আবছা আলো! মিলন মাফলার গলায় এগিয়ে এল! জড়ায় ধরলাম!
-কিরে শালা! কেমন আছিস?
-ভাল রে! কিন্তু একটু নার্ভাস বিয়ে নিয়ে, বাসায় চল, তোর সঙ্গে অনেক আলাপ আছে আমার!
পেছন থেকে ডাক শুনে ফিরে তাকালাম!
-আসিফ সাহেব!
– এই যে শরীফ সাহেব, চলে যাচ্ছেন নাকি?
-ইয়া! টাইম টু গো! প্লেজার টু মিট ইউ! ইউ আর এ নাইছ ম্যান!
– সেইম টু ইউ! প্লিজ কাম মিট অ্যাগেইন!
-দেখা হবে আশা করি! অনেক কাজ বাকি আসিফ সাহেব! এখন যেতে হবে!
এই বলে ভদ্রলোক হ্যান্ডশেক করে ঘুরে হাটা শুরু করলেন!
মিলন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল –
-কিরে! তুই এেক কীভাবে চিনিস?
-ট্রেইনে পরিচয়! কেন?
-এ তো এখানকার! শরীফ পাগল বলে সবাই একে! রেগুলার ট্রেইনে যাতায়াত করে! আসে আর যায়! কেউ কিছু বলে না! বেচারা ছোটবেলায় মা কে হারায়! একদিন জাফলং যাচ্ছিল, গাড়ি খারাপ হওয়াতে তার বাবা লোক ডাকতে গিয়ে আর ফিরে নাই! এরপর থেকেই এমন হয়ে যায় সে আস্ত আস্তে!
– কিন্তু আমাকে তো বলল সে তার ছেলেকে হারায় ফেলসে!
– সে নিজেকে তার বাবার জায়গায় কল্পনা করে! এ এক অদ্ভুত কেইস! এখন চল!
আমি মিলনের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করি! শরীফ সাহেব চলে যাচ্ছেন! এরকম অদ্ভুত মানুষ এই প্রথম দেখলাম! মানুষ কী বিচিত্র তাই না? এই লোকটা বাকি জীবন এভাবেই কাটিয়ে দেবে! জীবন আমাদের কতকিছু শেখায়, দেখায়! কেন জানি রুনুর কথা মনে পড়ছে! রুনু কল করেছিল! আমি ধরিনি! রুনু এতে রাগ করবে না জানি! এটা বিচিত্র সুন্দর একটা ব্যাপার! এরকম সব বিচিত্র সুন্দর নিয়ে আমাদের বসবাস! দিনের আলো বাড়ছে … পূণভূমির আলো!
লেখক : এমবিবিএস, ডিএমইউ (এডভান্স), সিসিডি, (বারডেম)।
0 Comments