মোঃ নুরুল আলম
[ইতিহাসের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করার পর, বঙ্গবন্ধুর নশ্বর দেহ দাফনের জন্য গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় নেয়া হয়। তখন গোপালগঞ্জের এসডিপিও-র দায়িত্ব পালন করছিলেন বঙ্গবন্ধুরই পছন্দ করা মোঃ নুরুল আলম। বঙ্গবন্ধুর দাফনের বিস্তারিত ঘটনাবলি নিয়ে তিনি “বঙ্গবন্ধুর দাফন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ” নামে একটি বই লিখেছেন। উক্ত গ্রন্থ থেকে বঙ্গবন্ধুর দাফনের অংশটুকু সংক্ষিপ্তকারে তুলে ধরা হলো।- সম্পাদক]
১৫ আগস্ট শুক্রবার ১৯৭৫ ভোর ছয়টা-সাড়েছয়টায় গোপালগঞ্জ থানার ওসি’র টেলিফোন পেয়ে রেডিও অন করতেই ইথারে ভেসে আসে “আমি মেজর ডালিম বলছি-স্বৈরাচারী মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। পরিবারের সকলকে হত্যা করা হয়েছে। মন্ত্রীদের হত্যা করা হয়েছে। দেশে মার্শাল ‘ল’ জারি হয়েছে। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের সামরিক আইনে বিচার করা হবে ইত্যাদি।” এ খবরে সকলে হতভম্ব, কিংকর্তব্যবিমূঢ় এবং স্তব্ধ। সার্কেল ইন্সপেক্টর এবং সদর থানার ওসি টেলিফোনে যোগাযোগ করলে তাঁদেরকে পুলিশ লাইনে আসতে বলে দ্রুত পোশাক পরে বাসা হতে কাছারিপাড়া ইমার্জেন্সি পুলিশ লাইনে রওয়ানা দেই। রাস্তাঘাট ফাঁকা। রিক্সা সাইকেল নেই। লোকজন প্রাণভয়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছে। শহরের পরিবেশ ও পারি-পার্শিক অবস্থা থমথমে। রাজনীতিবিদ, চাকুরীজীবী, ছাত্র-শ্রমিক, ধনী-গরীব, কামার-কুমার, জেলে সকলেই নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত। পুলিশ লাইনে গিয়ে উপস্থিত বিভিন্ন পদের ৫০/৫৫ জন পুলিশ অফিসারকে কোঁত (অস্ত্রাগার) হতে অস্ত্রগুলি নিয়ে পুরা পোশাকে দ্রুত প্রস্তুত হতে বলি। যদি কোন বিপদ আসে তা যেন সাথে সাথে মোকাবেলা করা যায়। পুলিশ লাইনে যাবার পর আমার বার বার মনে হচ্ছিল যশোর বা খুলনা থেকে আর্মিরা বঙ্গবন্ধুর আত্মীয় এবং অনুসারীদের গ্রেফতার বা মেরে ফেলার জন্য এখানে আসবে। পুলিশ লাইন হতে ওয়্যারলেসে থানা এবং ক্যাম্পকে মেসেজ দেই, সকলে যেন নিজেদের অস্ত্রগুলি নিয়ে ষ্ট্যান্ডটু (অপারেশনাবস্থায়) থাকে এবং নিজেদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য যে ব্যবস্থা নেয়া দরকার তা গ্রহণ করে।
আমার অফিস ও বাসাটি ছিল শহরের খুবই ঘনবসতিপূর্ণ সাহাপাড়া এলাকার মাঝখানে। শহরের কেন্দ্র চৌরঙ্গী লঞ্চ ঘাট হতে বাম দিকে কাপড়ের বাজারের সরু রাস্তা দিয়ে যাওয়া-আসা করতে হয়। ঐ রাস্তাটি একটা রিক্সা চলাচলের মত চওড়া ছিল। তাই আমি হেঁটে আসা যাওয়া করতাম। লাইনে যাবার সময় লক্ষ্য করি স্থানীয় লোকজন ঘরের আঙ্গিনায়, দোকানের সামনে জড়ো হয়ে রেডিওর খবর শুনছে। কোন সাড়া শব্দ নেই। অনেক দূর পর্যন্ত রেডিওর ঘোষণা শোনা যাচ্ছে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। শহরের প্রাধান রাস্তা ও চৌরঙ্গী জনমানব শূন্য। সাইকেল বা রিক্সা কিছুই চলাচল করছে না। ঘাটে কোন যাত্রী নেই। যাত্রীর জন্য কোন হাঁক ডাকও নেই। লঞ্চগুলো ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। এ যেন এক স্তব্ধ জনপদ। গোপালগঞ্জ শহরটি মধুমতি নদী, কাটা খাল, ভেন্নাবাড়ী খাল ও জলাশয় বেষ্টিত। কাটা খালের পাড় দিয়ে চৌরঙ্গী হতে বেত গ্রাম পর্যন্ত একটি মাত্র রাস্তা। যার দৈর্ঘ্য হবে দেড় দুই কিলোমিটার, শুধুমাত্র রিক্সা চলাচলের উপযোগী।
ইতিমধ্যে ম্যাজিস্ট্রেট লুৎফর রহমান চৌধুরী, ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল কাদের, প্রবেশনাল ম্যাজিস্ট্রেট হাসানুজ্জামান, পুলিশ পরিদর্শক শেখ আব্দুর রহমান, শেখ ইছাক ফকির, সদর থানার ওসি আবুল কালাম, জনতা ব্যাংক অফিসার হাবিবুর রহমান এবং আর কিছু সিভিল অফিসার ও কলেজ শিক্ষক পুলিশ লাইনে এসে হাজির হয়েছেন। সকলেই আতংকিত এবং নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। সকলের সাথে আলোচনা করে ঠিক হয় লাইনের পুলিশদের ৫ ভাগে ভাগ করে ৪ ভাগকে লাইনের ৪ কোণায় বাংকার খনন করে তার ভিতর সকলের নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত রাখতে হবে। বাকি ১ ভাগকে ব্যারাকে স্ট্যান্ডবাই রাখতে হবে। সকাল হতে শহর ও আশ-পাশের লোকজন বাসাবাড়ি ফেলে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে চলে যাচ্ছে। পুলিশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখে শহরের লোকজন আরও ভীত হয়ে যে যেদিকে পারে দুর্গম এলাকায় বা নৌকা করে পরিবার নিয়ে জীবন বাঁচাতে হাওরে বাওরে চলে যাচ্ছে। টিএসআইকে (শহর দারোগা) এলাকার অবস্থা জেনে আসার নির্দেশ দিলে সে কাছারিপাড়া, থানাপাড়া, ব্যাংকপাড়া ইত্যাদি এলাকা ঘুরে এসে জানায় শহরের সব লোকজন বাড়ী-ঘর, গরু-বাছুর, হাঁস-মুরগী, ইত্যাদি ফেলে জীবন নিয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে অনেকে চলেও গেছে। থানার ওসি ও টিএসআই এর তত্ত্ববধানে থানার সাইকেলধারী সিপাই দিয়ে শহর এলাকায় সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা করা হয়। ফোর্সের সাথে দুপুর ও রাতের খাবার ব্যবস্থা হল। রাত ১১টার দিকে থানার ও লাইনের সকলকে সার্বক্ষণিক সতর্ক থাকার কথা বলে বাসায় ফিরে যাই।
এই মর্মান্তিক ঘটনার পর হতে টেলিফোন ও পুলিশ বেতারের মাধ্যমে ঢাকা ও ফরিদপুরের অবস্থা জানার চেষ্টা করি। ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক ফয়েজুর রাজ্জাক, পুলিশ সুপার এজহারুল হক নব নির্বাচিত জেলা গর্ভনরদের ট্রেনিং কর্মসূচীতে সহযোগী ষ্টাফ হিসেবে অংশ নিতে আগেই ঢাকা চলে গেছেন। বহুবার তাঁদের সাথে যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিচিত কর্মকর্তা এবং শহরের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি টেলিফোনে জানতে চেয়েছেন বাড়ীতে থাকা নিরাপদ কিনা? আর্মি আসার কোন খবর আছে কিনা ইত্যাদি। উত্তরে বলেছি আর্মি আসার কোন খবর পাইনি। আসলে লঞ্চে বা হেলিকপ্টারে আসবে। দুর থেকে দেখা যাবে। তখন যা ভাল মনে করেন করবেন। এখন যার যার বাসায় থাকেন যাতে বাড়ী ঘরের মালামাল চুরিডাকাতি বা লুটপাট হতে না পারে। আমাকে অনেকে পরামর্শ দিলেন পালিয়ে যেতে। বলেছেন আপনি বঙ্গবন্ধুর লোক আর্মি আসলে আমাকে গুলি করবে। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় ছিলাম। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর মামা খান সাহেব শেখ মোশাররফ হোসেন ও তাঁর স্ত্রীর পরামর্শ আমাকে খুবই আতংকতি করেছিল। তবুও আমি সকলকে আশ্বস্ত করে বলেছি পুলিশের দিক হতে কোন ভয় নেই। আপনাদের সম্পদ ও বাড়ী ঘরের নিরাপত্তায় পুলিশ তৎপর আছে। অসুবিধা মনে করলে জানাবেন। আর্মি আসার খবর পেলে তাও জানাবেন। আর আমরা জানতে পারলে সকলকে জানানোর চেষ্টা করব।
ভবিষ্যতে আরও কি ভয়াবহ ঘটনা অপেক্ষা করছে, তার চিন্তা এবং নিজেকে কিভাবে নিরাপদ রাখব তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। গোপালগঞ্জের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গসহ বঙ্গবন্ধুর নিকট আত্মীয়দের অনেকেই যারা আমার উপর আস্থাবান ছিলেন টেলিফোনে অথবা কারও মাধ্যমে জানতে চায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, খুলনা ইত্যাদি বড় বড় শহরে প্রতিবাদ প্রতিরোধের কোন খবর পুলিশ বেতারের মাধ্যমে পাওয়া গেছে কিনা? রক্ষী বাহিনীর ভূমিকা কি ইত্যাদি। সন্ধ্যার দিকে পুলিশের ওয়্যারলেস অপারেটর এসে খবর দিল মানিকগঞ্জ এর মহকুমা পুলিশ অফিসার আমাদের ব্যাচমেট সুকুমার দত্তকে পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হল সম্ভবত ভয়ে অথবা প্রতিবাদে অন্যত্র চলে গেছে। আমি আরও নার্ভাস ফিল করছিলাম। কিন্তু কাউকেও বোঝার সুযোগ দিচ্ছি না।
১৬ আগস্ট শনিবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে টেলিফোন বেজে উঠে। ফোন ধরার সাথে সাথে শোনা যায় “বঙ্গভবন থেকে মেজর মুনিব বলছি। শোনেন এসডিপিও সাহেব থানার পাশে আমাদের বাড়ি। ওখানে আমার বাবা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার মুখলেসুর রহমান মা ভাইবোনদের নিয়ে থাকেন। তাঁদের প্রতি খেয়াল রাখবেন। যাতে কোন অসুবিধা না হয়। আপনার কথা বাবার নিকট শুনেছি নির্ভয়ে কাজ করেন। কোন অসুবিধা হলে জানাবেন। টেলিফোন নাম্বার নোট করেন। দু’টি টেলিফোন নাম্বার দিয়ে বললেন আমি এখানে ডিউটি অফিসারকে বলে রাখছি আপনার টেলিফোন আসলে আমাকে জানাবে। ঠিক আছে?” আমি জী স্যার বলতেই টেলিফোন রেখে দিলেন। বঙ্গভবন থেকে টেলিফোন এসেছে শুনে খুবই ভয় পেয়ে ছিলাম। পরে আলাপ শুনে ভয় অনেকটা কেটে যায়। থানার ওসিকে মেজর সাহেবের বাড়ি পাঠালাম বঙ্গভবন হতে টেলিফোনের খবর দিতে এবং বাড়ির খবরাখবর জেনে আসতে।
অল্পক্ষণের মধ্যেই আবার ঢাকা হতে টেলিফোন। এবার অপর প্রান্ত হতে বললেন “আমি ঢাকার এসপি আব্দুস সালাম বলছি। আপনি এসডিপিও বলছে? জী বলতেই তিনি জানালেন দুপুরের মধ্যে হেলিকপ্টারে করে শেখ মুজিবের লাশ টুঙ্গিপাড়া যাবে। বাবা মার কবরের পাশে তাঁর লাশ দাফন করতে হবে। হেলিকপ্টার নামার ব্যবস্তা করবেন। বড় করে কবর খনন করে রাখবেন। যাতে কবরের মধ্যে কফিনসহ লাশ রেখে তাড়াতাড়ি মাটি দেয়া যায়। ১৫ মিনিটের মধ্যে লাশ কবর দিয়ে হেলিকপ্টার ফিরে আসবে। হেলিকপ্টার নামানো, লাশ কবর দেয়া এবং ঐ লাশ যাতে কবর হতে কেহ উঠায়ে নিতে না পারে তার জন্যে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। গোপালগঞ্জ পুলিশ লাইন এবং নিকটস্থ থানা/ফাঁড়ি হতে পুলিশ এনে টুঙ্গিপাড়ায় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। যাতে করে আর্মিরা লাশ তাড়াতাড়ি দাফন করে নিরাপদে ঢাকায় চলে আসতে পারে।” আমি জানতে চাইলাম স্যার কয়টা কবর খনন করতে হবে? প্রশ্ন শুনে তিনি রেগে গিয়ে বললেন “অত প্রশ্নের জবাব দিতে পারবনা। আপনি অফিসার না? যেটা ভাল বুঝেন করেন” বলে টেলিফোন কেটে দিলেন। টেলিফোন পেয়ে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়লাম। কারণ ঢাকার এসপি ছিলেন বীর বিক্রম মাহবুব উদ্দিন আহমদ। সালাম সাহেব কে, যিনি নিজেকে এসপি পরিচয় দিলেন।
সাথে সাথে গোপালগঞ্জ টেলিফোন এক্সচেঞ্জের অপারেটকে ঢাকার পুলিশ কন্ট্রোল রুমে কানেকশন দিতে বলি। অল্প সময়ের মধ্যে কথা হল কন্ট্রোল রুমের অফিসারের সাথে। ডিউটি অফিসার জানালেন মাহবুব সাহেব আর এসপি নেই। এখন ঢাকার পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালন করছেন সিটি এসপি আব্দুস সালাম। সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোনে পুলিশ লাইনের ইমারজেন্সি ফোর্সের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর শেখ মোঃ ইছাক ফকিরকে বলি লাইনের সব ফোর্সকে অস্ত্রগুলি দিয়ে এবং দুপুরের খাবার খাইয়ে টুঙ্গিপাড়া প্রেরণের জন্য রেডি করতে। সার্কেল ইন্সপেক্টর শেখ আব্দুর রহমানকে আমার অফিসে আসার নির্দেশ দিয়ে পুলিশ বেতারের মাধ্যমে টুঙ্গিপাড়া থানায় যোগাযোগের জন্য তাড়াতাড়ি পায়ে হেঁটে গোপালগঞ্জ সদর থানায় চলে যাই। পুলিশ বেতারে টুঙ্গিপাড়া থানার ওসি আব্দুল জলিল শেখের সাথে কথা হয়। তাকে ঢাকার নির্দেশ অনুযায়ী দ্রুততার সাথে ব্যবস্থা নিতে বলি। পাশের বাঁশবাড়িয়া পুলিশ ক্যাম্প ও থানার পুলিশ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ও ডাক বাংলার সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশও দেই। তাকে আরও জানানো হল গোপালগঞ্জ হতে রিজার্ভ পুলিশ লঞ্চযোগে মধুমতি নদী দিয়ে পাঠানো হচ্ছে। আমিও স্পীডবোটে করে অল্প সময়ের মধ্যে চলে আসছি।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে টুঙ্গিপাড়ার চারদিকে অথৈই পানি। সেই সময়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ীতে লঞ্চ, স্পীড বোট বা নৌকা ছাড়া যাওয়া সম্ভব ছিলনা। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর উত্তর পূর্ব কোণায় ও শেখ সায়রা খাতুন রেডক্রস হাসপাতালের পূর্ব দিকে একটা বিশাল দিঘী খনন করে পূর্ব দিকের পাড়কে বড় আকারের মাঠের মত করে ভরাট করা হয়। ঐ মাঠের উত্তর দিকে দোতলা ডাক বাংলো নির্মাণ করা হয় এবং ডাক বাংলোর দক্ষিণ আঙ্গিনায় হেলিকপ্টার নামানোর ব্যবস্থা রাখা হয়। দিঘীর পশ্চিম পাড়ে সদ্য প্রতিষ্ঠিত টুঙ্গিপাড়া থানার টিনসেড অফিস ঘর এবং উত্তর পারে সিকিউরিটি ফোর্সের থাকার সেড তৈরি হয়। দিঘীর দক্ষিণ পাড় দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি, শেখ সায়রা খাতুন হাসপাতাল ও টুঙ্গিপাড়া গ্রামে যাওয়া আসার রাস্তা।
অফিসে ফিরে এসে এসডিও’র দায়িত্বে থাকা লুৎফর রহমান চৌধুরীকে ঢাকা থেকে পাওয়া নির্দেশাবলীর বিষয়ে অবগত করি এবং আমাদের সাথে টুঙ্গিপাড়া যেতে অনুরোধ করি। এসডিও সাহেবের সাথে গত দু’দিন ধরে যোগাযোগ হচ্ছেনা বলেও তাঁকে জানাই। সম্ভব হলে তাঁর সাথে যোগাযোগ করে বিষয়টি জানাতে বলি। এছাড়া টুঙ্গিপাড়ায় ফোর্স পাঠানোর জন্য এসডিও’র লঞ্চ চাইলে তিনি তার ব্যবস্থা করে দেন। অফিসে উপস্থিত পরিদর্শক শেখ আব্দুর রহমানকে গৃহীত সকল ব্যবস্থা জানিয়ে বলি তাড়াতাড়ি লাইনে গিয়ে সেন্ট্রি ডিউটি রেখে বাকি সকল ফোর্সকে এসডিও’র লঞ্চে করে টুঙ্গিপাড়া পাঠানোর ব্যবস্থা করতে। আমার স্পীডবোট চালক কনস্টেবল আব্দুস সাত্তারকে জ্বালানি নিয়ে বোট রেডি করতে বলে টুঙ্গিপাড়া যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম।
এসময় ঢাকা হতে এসডিও বদিউর রহমানের ফোন আসে। তিনি বললেন টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর লাশ নেয়ার বিষয়টি জানেন কি? আমি জানি বলাতে তিনি বলেন লুৎফর রহমানকে আমার পক্ষে সব ব্যবস্থা করতে বলেছি। যে কোন প্রয়োজন মোকাবিলায় সে সাধ্যমত ব্যবস্থা নিবে। আমি তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে লুৎফর রহমানকে টুঙ্গিপাড়া পাঠানোর প্রস্তাব করতে তিনি জানান লুৎফর সকাল থেকে অসুস্থ তাই যেতে পারবেনা বলেছে। ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল কাদের আপনার সঙ্গে যাবে। তাঁকে সাথে নিয়ে যান। রেডি হয়ে অফিসে আসলেই দেখি ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল কাদের, ইন্সপেক্টর শেখ আব্দুর রহমান, ইন্সপেক্টর শেখ ইছাক ফকির আমার সাথে টুঙ্গিপাড়া যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে এসেছে। ইন্সপেক্টরদ্বয় আরও জানালেন এসডিও সাহেবের লঞ্চে করে দু’জন সুবেদারের কমান্ডে ৪০ জন ফোর্স টুঙ্গিপাড়া রওয়ানা করে দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটসহ তারা আমার সাথে যাবার জন্য এসেছে। আমরা তাড়াতাড়ি দু’জন অস্ত্রধারী কনস্টেবল নিয়ে থানার ঘাট হতে স্পীডবোটে করে টুঙ্গিপাড়া যাত্রা করি। ঢাকার পুলিশ কন্ট্রোল রুম হতে টেলিফোন আসার পর দুঃচিন্তা, উৎকণ্ঠা এবং হতাশায় কিছুটা ছেদ পড়ে। দায়িত্ব বোধ ও কর্তব্য পালনে উজ্জীবিত হই। হয়ত বঙ্গবন্ধুকে শেষ দেখার সুযোগ হবে? বুকে সাহস এনে মনকে শক্ত করে ভাবলাম বাবা-মা, ভাই-বোনকে ছেড়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতা যুদ্ধে গিয়েছিলাম মৃত্যুকে নিশ্চিত জেনে। এখন না হয় সে মৃত্যু আসন্ন। নেতাকে ঠিকমত মাটি দেবার ব্যবস্থা করতেই হবে ভিতরে ভিতরে ভীষণ সাহসী হয়ে উঠলাম এই ভেবে, নেতাকে শেষ বার দেখার সুযোগ হবে।
যাত্রার সময় সকাল সাড়ে নয়টা পৌনে দশটা হবে। তাড়াতাড়ি পৌঁছার জন্য কিছুটা সোজা পথে ভেন্নাবাড়ীর ভিতর দিয়ে বর্ণী বাওর হয়ে টুঙ্গিপাড়া যাচ্ছিলাম। এ মহাবিপদের সময় স্পীডবোটে বসে অনেক ভাবনা চিন্তা ও আলাপ আলোচনা হচ্ছিল। বিশেষ করে কবর দেয়ার সময় লাশের মুখ দেখা যাবে কিনা? যদি মুখ দেখা না যায় তাহলে বঙ্গবন্ধুর বাবা মার কবরের পাশে কাকে কবর দেয়া হল, তার কোন সাক্ষী থাকবেনা ইত্যাদি। আবার লাশের মুখ দেখতে চাইলে কফিন বহনকারী ঘাতকের দল ক্ষিপ্ত হয়ে কি করে তাও অনুমান করা যাচ্ছে না। তবে ম্যাজিস্ট্রেট এবং ইন্সপেক্টরদের মত হল, যে করেই হউক লাশের মুখ দেখার ব্যবস্থা করতে হবে। আমারও প্রবল ইচ্ছা কাকে সমাহিত করা হচ্ছে তা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় জাতি এবং ইতিহাসবেত্তাদের কাছে কবর নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে। বিভিন্ন রকমের আলোচনা হচ্ছে। তবে সব কথা বার্তা হচ্ছে আমাদের চার অফিসারের মধ্যে নীচুস্বরে এবং সতর্কতার সাথে। আলাপ হচ্ছে ২৯ ফুট লম্বা স্পীড বোটের মাঝখানে বসে, যেন ড্রাইভার বা অস্ত্রধারী সিপাইরা না শুনে। ভয়ছিল শুনলে আবার পরবর্তীতে বিপদ হতে পারে। আলাপের মধ্যে শেখ আবদুর রহমান প্রশ্ন করেন স্যার ঢাকায় কি রাষ্ট্রপতির জানাজা হয়েছে? আমি বলি সে রকম কোন কথা ঢাকার এসপি বলেননি। গভীরভাবে চিন্তা করতে থাকলাম সম্ভবত জানাজা হয়নি। মনে হল যদি জানাজার ব্যবস্থা করা যায় তাহলে মুখ দেখা সম্ভব ও সহজ হবে। কারণ জানাজার সময় কফিনের ডালা খোলা যাবে। ম্যাজিস্ট্রেট কাদের সাহেব বললেন এ কাজ সহজ না। লাশ নিয়ে আসা আর্মিরা কখনই কফিনের ডালা খোলা এবং জানাজার নামাজ পড়ার অনুমতি দেবে না। কারো কথায় সন্দেহ হলে উল্টো অ্যাকশন হতে পারে। সকলের মনের মধ্যে জীবনের ভয়। যারা দেশের রাষ্ট্রপতিকে পরিবার ও আত্মীয়স্বজনসহ হত্যা করতে পারে তারা যে কোন সময় যে কোন চরম ব্যবস্থা নিতে পারে।
আমরা যখন টুঙ্গিপাড়া পৌঁছালাম তখন সময় ১১টার পর হবে। থানার ঘাটে স্পীডবোট হতে নেমে ওসি’র কাছে কবর খননের অগ্রগতি জেনে ডাকবাংলোর সামনে হেলিকপ্টার অবতরণ স্থলে যাই। হেলিপ্যাড ও কবরস্থান এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা কিভাবে করতে হবে তা পুলিশ ইন্সপেক্টরদ্বয় ও থানা ওসিকে বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে দেই। ইতোমধ্যে নিকটস্থ বাঁশবাড়িয়া পুলিশ ক্যাম্পের সকল ফোর্স এসে গেছে। তাদেরকে হেলিপ্যাড ও ডাকবাংলোর চারিদিকে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়। থানার ফোর্স ও অফিসার বঙ্গবন্ধুর বাড়ি এবং কবরস্থানের নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে। ডাকবাংলোর নীচ তলায় সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় শাখা।
১৬ আগস্ট। মেঘডাঙ্গা রোদের অগ্নিঝরা দুপুর। টুঙ্গিপাড়া যেন হিমশীতল পরিবেশে পিনপতন নিস্তব্ধতায় অপেক্ষা করছে তারই কোলেপিঠে বড় হওয়া বাংলা মায়ের দামাল ছেলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গভীর ¯স্নেহে তার বুকে আশ্রয় দিতে। কয়েকজন ব্যাংক কর্মচারী, ৪জন কফিন বহনকারী, কবরের পাশে ৪/৫ জন কবর খননকারী ও পুলিশ ছাড়া সেদিন সমগ্র টুঙ্গিপাড়া এলাকা জনমানব শূন্য ছিল। রাস্তাঘাট, বাড়ির আঙ্গিনা, নদীরঘাট, পুকুরপাড় কোথাও লোকজনের চলাচলের সাড়াশব্দ নেই। দোকানপাট, বাড়ীঘর হাসপতালসহ সব কিছুর দরজা জানালা বন্ধ। ছোট ছোট ছেলেমেয়ারা পর্যন্ত ঘরের বাহিরে নেই। এ যেন এক মৃত জনপদ। দুপুর সাড়ে ১২টা হয়ে গেছে। তখনও গোপালগঞ্জ হতে প্রেরিত রিজার্ভ পুলিশ আসেনি। চরম উৎকণ্ঠা ও অস্থিরতার মধ্যে সময় যাচ্ছে। এ সময় ইন্সপেক্টর ইছাক ফকির এসে জানায় কবর খনন শেষ হয়েছে। কবরসহ পুরা টুঙ্গিপাড়া এলাকায় পুলিশ পাহাড়া আছে। কবর খননকারীরা চলে যেতে চাইলে তিনি তাদের সেখানে থাকার জন্য বলে এসেছেন। তিনি গ্রাম ঘুরে দেখেছেন। কোথাও লোকজন নেই। ফলে নিরাপত্তার ঝুঁকিও নেই। রাস্তাঘাট ফাঁকা। লোকজন প্রাণভয়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নদী-নালা, ডোবা ইত্যাদির পানিতে নেমে মাথার উপর কচুরিপানা বা জঙ্গলের আড়ালে লুকিয়ে প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত।
দুপুর দেড়টা হবে হঠাৎ হেলিকপ্টারের আওয়াজ। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে টুঙ্গিপাড়ার আকাশে হেলিকপ্টার দেখা গেল। হেলিপ্যাডের পাশে উঁচু গাছের ডালে লম্বা বাঁশের সাথে সাদা পতাকা বেঁধে দেয়া আছে। টুঙ্গিপাড়া এলাকায় হেলিকপ্টারটি ৩ বার চক্কর দিয়ে হেলিপ্যাডের উপর এসে মাটি হতে ৩০/৪০ ফুট উপরে সোজা হয়ে থমকে দাঁড়ায়। একজন আর্মি অফিসার হেলিকপ্টারের জানালা দিয়ে মাথা বের করে আমাদের সাথে কথা বলতে চাইলে আমি ডাকবাংলার বারান্দা হতে নেমে হেলিকপ্টারের কাছাকাছি গেলে তিনি আমার পরিচয় জানতে চান। আমি নিজেকে এসডিপিও পরিচয় দিলে তিনি উপর হতে উচ্চস্বরে বলেন SDO! Why are you in unifrom? আমি বলি এসডিও না। আমি মহকুমা পুলিশ অফিসার এসডিপিও। তিনি জানতে চান হেলিপ্যাড ও আশেপাশের এলাকা নিরাপদ কিনা? আমি জানাই পুরা টুঙ্গিপাড়া এলাকা সিকিউরড আছে। তিনি আবার প্রশ্ন করেন কতজন পুলিশ নিরাপত্তা দায়িত্বে আছে? আমি তাকে বলি টুঙ্গিপাড়া থানা ও বাঁশবাড়িয়া ক্যাম্পের সকল পুলিশ নিরাপত্তা দায়িত্বে নিয়োজিত আছে এবং গোপালগঞ্জ হতে লঞ্চে করে রিজার্ভ পুলিশ আসতেছে। তিনি হঠাৎ রেগে গিয়ে চিৎকার করে বলেন রিজার্ভ পুলিশ আসতে দেরি কেন? Bloody man-you are good for nothing, security is not full proof. Dead body could be snatched? তখন আমি বলি স্যার মধুমতি নদী হয়ে ফোর্স আসতে একটু দেরি হচ্ছে। আমি একজন ম্যাজিস্ট্রেটসহ স্পীডবোটে করে বাওরের মধ্য দিয়ে এখানে এসে পুরা এলাকা সিকিউর করেছি। আমি দৃঢ়তার সাথে বলি স্যার সিকিউরিটির কোন অসুবিধা হলে সে দায়িত্ব আমার। মিছিল করে লোক এসে লাশ ছিনতাই করলে কি করবেন? আমি দৃঢ়ভাবে বলি স্যার আমি বেঁচে থাকতে তা হতে দেবনা। যদি হয় আমাকে শাস্তি দিবেন। আপনারা নির্ভয়ে নামতে পারেন।
নিরাপত্তার অসুবিধা হবেনা শুনে হেলিকপ্টার মাটিতে অবতরণ করে। সাথে সাথে হেলিকপ্টারের দরজা খুলে অফিসার ও সৈনিকরা লাফিয়ে পড়ে হেলিপ্যাড ও ডাকবাংলোর চারিদিকে মাটিতে শুয়ে লাইং পজিশনে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে। লাশ নিয়ে আসা সৈনিক দলের কমান্ডার ছিলেন একজন মেজর। তিনি দৌড়ে ডাকবাংলার বারান্দায় গিয়ে অপেক্ষমাণ ম্যাজিস্ট্রেট, ব্যাংক কর্মচারী ও লাশ বহনকারী সিভিল লোকদের দিতে পিস্তল তাক করে চিৎকার করে উঠে Who are those bustard? They may snatch the dead body? ধমক খেয়ে ভয়ে সকলে ডাকবাংলার পিছনে কলা বাগানের ভিতর দিয়ে বিলের কাঁধ সমান পানিতে নেমে সাঁতরিয়ে গ্রামের দিকে চলে যায়। আমি পিছনে পিছনে দৌড়ে গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুর কাদের ও ব্যাংক কর্মচারীদের পরিচয় দিলে তিনি ম্যাজিস্ট্রেটকে ধমকায়ে বলেন Why are you running? হেলিকপ্টারের নিকট এসে মেজর আবারও আমাকে বলেন লাশ ছিনতাই বা কবর থেকে উঠিয়ে নেয়ার সম্ভাবনা নেইতো? এ ধরনের কোন ঘটনার সম্ভাবনা নেই মর্মে অভয় দিলে মেজর সাহেব হেলিকপ্টার হতে লাশ নামিয়ে তাড়াতাড়ি কবরস্থানে নেয়ার হুকুম দেন। লাশের কফিন নামিয়ে কবরস্থানে নেয়ার জন্য যাদের রাখা হয়েছিল, তারা মেজর সাহেবের ধমক খেয়ে বিলের পানি সাঁতরিয়ে পালিয়ে গেছে। কফিন নামানোর জন্য হেলিকপ্টারের পিছনের দরজা খুলে দেয়া হয়। আমি নিজেই কফিন নামানোর জন্য হেলিকপ্টারের উপর উঠে যাই। পরিদর্শক শেখ আব্দুর রহমান ও আমার সাথের ২ জন কনস্টবল মিলে কফিন বাক্সটি সামান্যতম নড়াতে ব্যর্থ হলে কপ্টারের কাছে দাড়ানো স্পীডবোট চালক আব্দুস সাত্তারকেও হেলিকপ্টার থেকে কফিন নামাতে বলি। হেলিকপ্টারের পাহারায় থাকা আর্মি হাবিলদারও কফিন নামাতে সহযোগিতা করে। এখানে উল্লেখ এসেছিল মেজর কাজী হায়দার আলীর কমান্ডে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন (যিনি ৭ নভেম্বর সেনা অভ্যূত্থানে নিহত) ১জন হাবিলদার ও ১০ জন সৈনিক। এছাড়া হেলিকপ্টারে ছিল ২জন পাইলট। তারা হেলিকপ্টার হতে নীচে নামেনি। ফ্লাইট লেঃ শমসের আলী হেলিকপ্টার চালিয়ে এসেছিলেন (আর্মি অফিসার ও পাইলটের নাম পরে জানা গেছে)।
বরফভর্তি কফিনের ওজন অত্যাধিক বেশি ছিল বিধায় হেলিকপ্টার হতে কফিন নামাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। ব্যাংকের ভিতর হতে বের হয়ে আসা ২/৩ জন ব্যাংক কর্মচারী, পুলিশ কনস্টেবল, স্পীবোট ড্রাইভারসহ সকলে মিলে ধরাধরি করে কফিন বাক্সটি বহু কষ্টে হেলিকপ্টারের নিকট থেকে রাস্তায় আনা হয়। কিন্তু এ ক’জন লোকের পক্ষে কফিনটি কাঁধে বহন করে সামনে নেয়া সম্ভব ছিলনা। আর্মির হাবিলদার ৬ জন সৈনিক নিয়ে রাস্তায় এসে ১০/১২ গজ দুরুত্ব রেখে অন গার্ড অবস্থায় ২ জন ২ জন করে কফিনের আগে পিছে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে। বাকী ৪ জন সৈনিক হেলিকপ্টারের নিরাপত্তার জন্য হেলিপ্যাডে থেকে যায়। কফিনটি ধরাধরি করে মাটি হতে উঠিয়ে অল্প অল্প করে সামনে নেয়ার চেষ্টা চলে। কয়েক কদম করে যাবার পর পর কফিন মাটিতে রেখে বিশ্রাম নিতে হচ্ছে। অবস্থা দেখে থানার ওসি কফিন বহনে আরও লোক সংগ্রহের জন্য শেখ সায়েরা খাতুন রেডক্রস হাসপাতালের পিছনের পাড়ার দিকে দৌড়ে যায়। এসময় ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন উচ্চ স্বরে বলে উঠে SDPO! Where is your carrier? You have no Bloody IQ? Who made you officer? তখন আমি বলি স্যার কফিন বহন করার লোকেরা ধমক খেয়ে পানি সাঁতরিয়ে পালিয়ে গেছে। সে তখন আমাকে ধমক দিয়ে বলে You are talketive. Don’t talk. Proceed on. এভাবে ১০০/১৫০ গজ পথ সামনে অগ্রসর হলে ওসি ৪/৫ জন লোক নিয়ে আসে। এবারের ১০/১২ জন লোক কফিন কাঁঠে নিয়ে আস্তে আস্তে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে এগুতে থাকে।
ডাকবাংলা এবং বঙ্গবন্ধুর বাড়ির মাঝখানে একটি ছোট খাল। তার উপর দিয়ে পারাপারের জন্য কাঠের ব্রীজ। কফিন নিয়ে ব্রীজ পার হবার সময় মনের মধ্যে সারা দিনের সঞ্চিত সাহস নিয়ে মেজর হায়দারকে জিজ্ঞাসা করি “ স্যার ঢাকায় কি রাষ্ট্রপতির জানাজা হয়েছে? না এখানে ব্যবস্থা করতে হবে? তিনি বিদ্যুৎ বেগে উল্টা ঘুরে বলে উঠেন what? আমি ভীষণ ভয় পেয়ে চুপ করে থাকি। ২/৪ কদম যাওয়ার পর তিনি ব্রীজের উপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং আমার চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করেন কি বলেছেন? এবার আমি কিছুটা সহজ হওয়ার ভাব করে বলি স্যার আপনার কমান্ডে দেশের রাষ্ট্রপতির দাফন হচ্ছে। বিষয়টি ইতিহাসের অংশ হবে। তাই জানতে চেয়েছি জানাজা হয়েছে কিনা? মেজর একটু চিন্তা করে I don’t know বলে আবার কফিনের সাথে হাঁটতে থাকেন। কয়েক পা সামনে গিয়ে ব্রীজ হতে নামার সময় বলেন SDPO, All right call a Moulavi for Janaja.
আমি সাথে সাথে ওসি আব্দুল জলিলকে জানাজার জন্য ইমাম খুঁজে আনতে বলি। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাছাকাছি গেলে আমি আবার মেজর হায়দারের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি, স্যার লাশের কি গোসল হয়েছে? একথা শুনে তিনি ভীষণভাবে রেগে যান এবং উচ্চস্বরে বলেন Bloody is it out of Islam? All rubbish. আর কথা না বাড়িয়ে কফিনের সাথে চুপচাপ হেঁটে হেঁটে কবরস্থানের পাশে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির আঙ্গিনায় উপস্থিত হই। সেখানে কবর খননকারী ৪/৫ জন লোক অপেক্ষামান ছিল। ঐ লোকগোলোসহ সকলে মিলে ধরাধরি করে কফিনটি উঠানে নামানো হয়। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি বা আশ পাশের বাড়িতে কোন লোকজন ছিল না। সবাই অন্যত্র সরে গেছে। এমনকি বঙ্গবন্ধুর বাড়ির বহুদিনের পুরানো চাকর বৈকুন্ঠ পর্যন্ত লাশ আনার খবর পেয়ে পালিয়ে গেছে। টুঙ্গিপাড়ার উপর হেলিকপ্টারের চক্কর দেখে টুঙ্গিপাড়া, পাটগাতি, গেমাডাঙ্গা প্রভৃতি গ্রামের লোকজন জীবনের ভয়ে দ্রুত পানিতে নেমে কচুরিপানার নিচে মাথা লুকিয়ে অথবা গোপন জায়গায় চলে গেছে।
উপস্থিত লোকজনদের কফিনের ডালা খোলার জন্য বললে তারা পাশের বাড়ি ও গোয়ালঘর খুঁজে কাঁচি এবং হাত কোদাল সংগ্রহ করে তার কোণা দিয়ে কফিন বাক্সের ডালা খুলে মাটিতে রাখে। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গিয়েই মেজর হায়দার কবরের পাশে যান এবং খননকৃত কবর দেখে বলেন Grave is all right. তারপর তিনি আমাকে বলেন শেখ সাহেবের পরিবারের সদস্য বা নিকট আত্মীয় কাউকে ডাকেন। তাঁর নিকট আমরা লাশ বুঝিয়ে দেব। বাড়ির ভিতর লোক পাঠানো হল বঙ্গবন্ধুর আত্মীয় খুঁজে আনার জন্য। সকলে ধরাধরি করে কফিনের ভিতর হতে লাশ বের করে ডালার উপর রাখে। কফিনের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ বঙ্গবন্ধুর রক্ত ও বরফের পানিতে ভর্তি ছিল। মরদেহ পানিতে প্রায় ডোবা অবস্থায় ছিল। তাই কফিন বাক্সটির ওজন বেশী ছিল। মরদেহ পেচানো সাদা কাপড় খুলতেই দেখা যায় সাদা থান কাপড়ের একটি লম্বা টুকরার উপর মরদেহ রেখে পায়ের দিক হতে কাপড়টি মাথার দিকে এনে মুচড়িয়ে গিট দিয়ে রেখেছে। গিট খুলে মুখ বের করতেই দেখা গেল বঙ্গবন্ধু যেন চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে আছেন।
সার্কেল ইন্সপেক্টর আব্দুর রহমান বাড়ির ভিতর হতে ২টি বেঞ্চ এনে গাছ তলায় আর্মি অফিসারদের বসার ব্যবস্থা করেন। তিনি আমার কাছে এসে জানতে চান কাফনের কাপড় আনার জন্য সাইকেল দিয়ে পাটগাতি বাজারে লোক পাঠাবে কিনা? আমি ইংগিতে পাঠাতে বলে উপস্থিত লোকজনকে মরদেহ গোসলের ব্যবস্থা করতে বলি। গোসল করানোর জন্য চাপকল হতে পানি আনতে গোয়ালঘরের ভিতর রাখা গরুর খইল-ভূষি খাবার বালতি ব্যবহার করতে হয়। বঙ্গবন্ধুর পরনের সাদা পাঞ্জাবী, গেঞ্জি ও লুঙ্গি ভিজে শরীরের সাথে আটসাট হয়ে লেগে আছে। পাঞ্জাবী ও গেঞ্জি শরীর হতে বের করা যাচ্ছিলনা। কেটে বের কারার জন্য চাকু বা ব্লেডের ব্যবস্থা করা যায় কিনা জানতে চাইলে উপস্থিত একজন বলেন ব্রীজের পাশের দোকানে ব্লেড পাওয়া যেতে পারে। কবর খননকারীদের কেহ একজন অল্পক্ষণের মধ্যেই ঐ দোকানা হতে ১টি ব্লেড ও ১টি কাপড় কাচার ৫৭০ সাবান নিয়ে আসেন এবং বলেন দোকানে গায়ে মাখার কোন সাবান নেই।
এ সময়ে নিরাপত্তা ইনচার্জ ইন্সপেক্টর ইছাক ফকির এসে জানায় গোপালগঞ্জ থেকে লঞ্চ যোগে আসা ফোর্স পৌঁছে গেছে। তাদেরকে শেখবাড়ী, কাজীবাড়ী, টুঙ্গিপাড়া ও হাসপাতালের সামনে পিছনে দুই স্তরে নিরাপত্তা দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়োজিত করা হয়েছে। ওসি জলিল পাশের গিমাডাঙ্গা মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা আব্দুল হালিম প্রকাশ একজন মৌলভীসহ আরও ২ জনকে সাথে নিয়ে উপস্থিত হয়ে মেজর সাহেবকে জানায় ইনিই জানাজার নামাজ পড়াবেন। আমি মৌলভী সাহেবকে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী লাশের গোসল দিতে বলি। খোলা উঠান, কোন খাটিয়া বা চৌকি নেই যার উপর লাশ রেখে গোসল হবে। লাশ আড়াল করার জন্য কোন পর্দারও ব্যবস্থা নেই। গরু ঘরের মাচা হতে ২টি হোগলার চাটাই এনে লাশের এক পাশ আড়াল করা হয়।
মৌলভী সাহেবকে ব্লেড দিয়ে শরীর থেকে পাঞ্জাবী কেটে লাশ বের করার জন্য বললে তিনি ব্লেড হাতে নিয়ে কাঁপতে থাকেন। ভয়ে তিনি ভীষণভাবে নার্ভাস ছিলেন। ব্লেড দিয়ে পাঞ্জাবী ও গেঞ্জি কেটে শরীর হতে বের করার চেষ্টা করছেন। কিন্ত হাতসহ সারা শরীর কাঁপনির জন্য ঠিকমত ব্লেড ধরতে পারছিলেন না। সবাই নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর ভীত সন্ত্রস্থ চোখে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। অবস্থা বেগতিক দেখে আমি কিছুটা সাহস করে মৌলভীর হাত থেকে ব্লেড নিয়ে বঙ্গবন্ধুর পরনের পাঞ্জাবী-গেঞ্জি বুক ও পেটের উপর দিয়ে লমম্বালম্বিভাবে কেটে দিলে পাঞ্জাবী-গেঞ্জি শরীর হতে বের করে আনা সম্ভব হয়। দেখা গেল বঙ্গবন্ধুর বুক গুলিতে ঝঁঝরা হয়ে গেছে। ঘাড়ের পিছনের দিকের মাংস নেই। হয়ত গুলিতে উড়ে গেছে। ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল পাশের আঙ্গুল হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে সামান্য চামড়ার সাথে ঝুলে আছে। পায়ের গোড়ালির রগ কাটা। লাশ শক্ত না হওয়ার জন্য হয়ত রগটি কেটে দিয়েছে।
সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। সবাই যেন শোকে ও ভয়ে পাথর হয়ে গেছে। পাঞ্জাবীর পকেটে চশমার ১টি ভাঙ্গা অংশ এবং তামাকের পাইপের ১টি অংশ পাওয়া গেছে। বঙ্গবন্ধুকে যে অবস্থায় আর্মিরা গুলি করে মেরেছে সে অবস্থায় সাদা থান কাপড় পেঁচিয়ে কাঠের তৈরি কফিন বাক্সে রেখেছে। কফিন বাক্সের ভিতরে শক্ত পলিথিন বিছিয়ে তার উপর বরফ দিয়ে মরদেহ রেখে চারিদিকে আরও বরফ দিয়ে পলিথিন পেঁচিয়ে বেঁধে দিয়েছে। যাতে মরদেহ হতে রক্ত বা বরফগলা পানি কফিনের বাহিরে আসতে না পারে। লাশের গোসলের কাজ দ্রুততার সাথে চলছে। কাফনের কাপড় আনার জন্য যে লোকটি পাটগাতি বাজারে গিয়েছিল সে এখনও ফিরে আসেনি। আর্মি ক্যাপ্টেন এবং হাবিলদার করবস্থানসহ বাড়ির চারিদিকে অস্থিরভাবে ঘুরাঘুরি করছে এবং কোনখানে লোকজন জড়ো হচ্ছে কিনা তা দেখছে। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন লাশের পাশে এসে বলনে গোসল শেষ হয়েছে। তাড়াতাড়ি Dead Body কবরে নিয়ে আসেন মাটি দিয়ে আমরা এখনই চলে যাব।
এ কথা শুনে আমি মেজরের কাছে গিয়ে অনুরোধ করি স্যার পাটগাতি বাজার হতে কাফনের কাপড় নিয়ে লোকটি এখনও আসেনি। আর ভিজা কাপড় কেটে কাফন তেরি করা যাবে না। তিনি বলেন কাটার দরকার নেই ঐ কাপড় দিয়ে লাশ এখনই কবর দিয়ে দেন। আমাদের সময় নেই। এ কথা শুনে লাশ পেঁচিয়ে আনা ভিজা রক্তাক্ত কাপড়টিকে কেটে কাফন তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছিল। এ সময় ইন্সপেক্টর আব্দুর রহমান গোসলের স্থানে এসে বলেন শেখ সায়রা খাতুন রেডক্রস হাতপাতালে রিলিফের কিছু সাদা শাড়ী আছে। ভিজা কাপড়ের চেয়ে ঐ শাড়ী কেটে কাফন তৈরি সহজ হবে। আমি আবার মেজরে কাছে গিয়ে হাসপাতালে রক্ষিত রিলিফের শাড়ী কেটে কাফন বানানোর প্রস্তাব করলে তিনি রাগান্বিত হয়ে উচ্চস্বরে বলেন, ‘‘I have no objection. You can bring any thing you like. But you are to complete this Bloody Burial business quickly. We have no time.’’ তখন আমি সার্কেল ইন্সপেক্টরকে তাড়াতাড়ি শাড়ী এনে কাফন তৈরি করে লাশ কবর দেয়ার জন্য রেডি করতে বলি। ইতিমধ্যে মরদেহ গ্রহণের জন্য শেখ আব্দুল মান্নান প্রকাশ পনু শেখ নামের একজনকে পাড়া থেকে খুঁজে এনে বঙ্গবন্ধুর জ্ঞাতি মামা পরিচয় দিয়ে মেজর সাহেবের সামনে হাজির করা হয়েছে। মেজর সাহেব তাঁর নিকট হতে ‘‘শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ বুঝে পেয়েছে মর্মে লিখিত নিয়ে মরদেহ হস্তান্তর করলেন। হস্তান্তর কাগজে সাক্ষী হিসেবে দস্তখত নিলেন গোপালগঞ্জ হতে আসা প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল কাদের ও টুঙ্গিপাড়া থানার ওসি আব্দুল জলিল শেখের’’।
রেডক্রস হাসপাতাল হতে আনা সাদা দুটি শাড়ীর লাল পাড় কেটে বঙ্গবন্ধুর শরীরের মাপে কাফন তৈরি করে মরদেহে পরিয়ে দেয়া হয়। তারপর সকলে মিলে কফিনের ডালাসহ মরদেহ ধরাধরি করে কবরের পাশে আনে। বাড়ির চারিদিকে ঘুরে ঘুরে নিরাপত্তা ডিউটি তদারকি করছিলেন ইন্সপেক্টর শেখ ইছাক ফকির। তিনি জানালেন টুঙ্গিপাড়া ও আশপাশের কয়েকজন লোক জানাজার নামাজ আদায় করতে চায়। এ ব্যাপারে মেজরের অনুমতি চাইলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন এবং উচ্চস্বরে বলেন ‘‘Bloodyl you could not secure the area properly. People moving around & you are inviting them for Janaja. They may snatch the dead body? All stupid. Put the dead body in the grave right now. OK’’? অবস্থা বেগতিক দেখে মৌলভী সাহেব লাশের সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ে আল্লাহু আকবার- আল্লাহু আকবার আওয়াজ করতে ছিলেন। উপস্থিত সকলে অর্থাৎ কবর খননকারী, মরদেহ বহনকারী, ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ মিলে ২০/২৫ জন জানাজার জন্য দাঁড়িয়ে যায়। মৌলভী সাহেব তিন কাতার করে দাঁড়াতে বললে আমি ২/৩ জনকে সাথে নিয়ে পিছনে আর একটি কাতার করে দাঁড়িয়ে যাই এবং ইমাম সাহেবকে জানাজার নামাজ শুরু করতে বলি। নামাজ শেষে দো’আ পড়তে দ্রুত লাশ কবরে শুইয়ে দেয়া হয়।
এই সময় একজন মহিলা বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দক্ষিণ দিকের কোণায় দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে কেঁদে কেঁদে লাশ দেখার কথা বলতে থাকে। ঐ সময় ফরিদপুরের এএসপি (সদর) আনোয়ারুল ইকবাল কবরস্থানে এসে উপস্থিত হয় এবং লাশের মুখ দেখতে চায়। আমি পিছনে দাঁড়ানো মেজরকে ক্রন্দরত মহিলা শেখ সাহেবের আত্মীয় পরিচয় দেই এবং কবরের ভিতর লাশের মুখ খুলে দেখানোর অনুমতি চাইলে তিনি সম্মতি দেন। তারপর ঐ মহিলা ও এএসপিকে কবরের পাড়ে দাঁড় করিয়ে কবরের ভিতর লাশের মুখ খুলে দেখানো হয়। তারপর খুবই দ্রুততার সাথে মাটি দেয়ার কাজ শেষ করতে হয়। কবরের মাটি পাড়ের সমান হলেই আর্মিরা উইথড্র সংকেত দিয়ে হেলিপ্টারের দিকে রওনা দেয়। যাবার সময় মেজর হায়দার আমাকে বলে ‘‘Look SDPO কবর হতে লাশ তুলে কেউ যেন মিছিল করতে না পারে। ডবল লাইনে সিকিউরিটি রাখবেন, লাশ ডিকম্পোজ না হওয়া পর্যন্ত’’। আমি পরিদর্শক ইছাক ফকিরকে কবরস্থানে রেখে আর্মিদের বিদায় দেযার জন্য হেলিপ্যাডে যাই। হেলিকপ্টারে অবস্থানরত পাইলটদ্বয় লাশ স্কটকারীদের আসতে দেখে হেলিকপ্টারের সুইচ অন করে এবঙ স্কটকারীরা দৌড়ে দৌড়ে গিয়ে হেলিকপ্টারে আরোহন করলে হেকিপ্টারটি আকাশে উড়ে যায়।
সময় তখন বিকাল সাড়ে ৩টা-৪টার মত হতে পারে। হেলিকপ্টার চলে যাবার পর আমি ক্লন্তি অনুভব করি। শরীর যেন অবশ হয়ে আসছিল। আমি ও ম্যাজিস্ট্রেট আবার কবরে পাড়ে যাই। অল্পক্ষণ আগেই বাঙালি জাতির জনক, মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, দেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের দাফন শেষ হয়েছে ইতিহাস কাঁপানো এ করুন এবং মর্মান্তিক ঘটনার শেষ পর্বে কবরের পাড়ে পরিবারের কোন সদস্য বা নিকট আত্মীয় এমনকি পাড়া পরশী কেউই উপস্থিত নেই। নেই কোন সুহৃদ-শুভাকাঙ্খী চোখের জল ফেলে স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে দুহাত তুলে আল্লাহর কাছে মাগফেরাত প্রার্থনার। অথচ তরবারি বিহীন যে বীরের হুঙ্কারে প্রতিটি বাঙালি শিরা উপশিরায় রক্তকণাগুলো টগবগ করত, যাঁর আঙ্গুলের ইশারায় সাগরের ঢেউয়ের মত গণজোয়ার ফুলে ফেঁপে উঠত, যাঁর আহবানে রক্তঝরা মার্চে মাতৃভূমিকে হায়েনা মুক্ত করার জন্য আমার মত হাজার হাজার যুবক অস্ত্র হাতে নিয়েছিল।
মহাকালের সেই শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে কল্পনাতীত অবজ্ঞা অবহেলায় নরবে নিভৃতে ছায়া সুশীতল টুঙ্গিপাড়ার মাটিতে মৃত্যুর শান্তি ছায়ায়র চিরনিদ্রার শুয়ে যেতে হল। চোখের পানি আর ধরে রাখা গেল না। বেশ কিছু সময় বাকরুদ্ধ ছিলাম। কণ্ঠ দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছিলনা। ম্যাজিস্ট্রেট কাদের সাহেব গোপালগঞ্জ ফিরে যাবার তাগাদা দিলে সম্বিত ফিরে পাই। কবরের চারপাশে আপাতত বাঁশ দিয়ে হলেও বেষ্টনী দিতে হবে। যাকে কোন পশুপাখী কবরের ক্ষতি করতে না পারে। অবশ্য ইতিমধ্যে থানার ওসি’র নির্দেশে কবরে চতুর্দিকে বাঁশের খুঁটি পূঁতার কাজ শুরু হয়ে গেছে। আমি কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়ায়ে অপলক দৃষ্টিতে কবরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে মনে সূরা ফাতেহা ও এখলাছ শরীফ পাঠ করে জাতির জনকের আত্মার মাগফেরাত কামনা করলাম করুনাময় আল্লাহর কাছে। তারপর ওসি’র তত্ত্বাবধানে ১ জন সুবেদার, ২ জন হাবিলদার , ২০ জন কনস্টবলকে কবর ও বাড়ির নিরাপত্তার দায়িত্বে রেখে বাকী ফোর্সকে স্ব স্ব ইউনিটে ফিরে যাবার নির্দেশ দিয়ে গোপালগঞ্জের পথে রওয়ানা দিলাম।
(মোঃ নুরুল আলমের “বঙ্গবন্ধুর দাফন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ” গ্রন্থ থেকে নেয়া)
লেখক : তৎকালীন মহকুমা পুলিশ অফিসার, সাবেক অ্যাডিশনাল আইজি।