আমরা জানি ডায়াবেটিস কে বহুমূত্র রোগ বলা হয়। এটি এমন একটি রোগ যা আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাসের সাথে অনেকাংশে নির্ভরশীল। কিন্তু ডায়াবেটিক ডায়েট মানে এই না যে, আপনি আপনার প্রিয় খাবারগুলো থেকে বিরত থাকবেন। প্রথম কথা হল, আপনাকে বুদ্ধিদীপ্তভাবে খাবার বাছাই করে নিতে হবে। আসুন জেনে রাখি ডায়াবেটিস এর খাবারের তালিকায় আপনি কি কম খাবেন কি খাবার ইচ্ছা খুশী মতো খেতে পারবেন।
১. শক্তি প্রদানকারী খাদ্য (ক্যালরি হিসেবে) : প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ২৫-৩০ কিলোক্যালরি/প্রতিদিন। যাদের দৈহিক স্থূলতা আছে (বিএমআই ২৫-এর বেশি) তাদের জন্য ৩৫ কিলোক্যালরির কম।
২. শর্করা জাতীয় খাদ্য: মোট শক্তির ৫৫%-৬০% শর্করা থেকে আসতে হবে। এর প্রধান উৎস হতে পারে ভাত, রুটি, ডাল, মাছ-মাংস ও শিম ইত্যাদি। পরিশোধিত শর্করা যেমন- চিনি, মধু, ময়দা, গুড়, মিছরি, বেকারির তৈরি বিভিন্ন রকম খাদ্যদ্রব্য-পাউরুটি, কেক, বিস্কিট ইত্যাদি ও তেলে ভাজা খাবার-যতটা সম্ভব ত্যাগ করতে হবে।
৩. আমিষ জাতীয় খাদ্য: প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ৮ গ্রাম করে আমিষ প্রতিদিন খেতে হবে। গর্ভধারণ ও বাচ্চাকে স্তন্যদানের সময় এর পরিমাণ কিছুটা বাড়াতে হবে (১২ গ্রাম/কেজি/দিন)। মাছ সবচেয়ে ভাল। তারপর মাংশ (বিশেষত মুরগির। দই ও দুধ খাবেন নিয়মিত। লাল মাংশ (গরু, খাসির মাংশ) বর্জন করাই উত্তম।
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যে আমিষ জাতীয় খাদ্য ও উপাদান সমূহ সবচেয়ে কম ঝুকিপূর্ণ।
৪. চর্বি জাতীয় খাদ্য: প্রতিদিনের মোট প্রয়োজনীয় ক্যালরির ২০%-২৫% চর্বি থেকে আসলে ভাল। এর উৎস হতে পারে রান্নার তেল, ঘি, ডিম ইত্যাদি। তবে অসমসত্ব চর্বি (আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট) খাবার দিকে বেশি আগ্রহ থাকতে হবে। রান্নার তেল ও মাখন মিলিয়ে একজন ডায়াবেটিস রোগী মাসে ৭৫০ গ্রাম তেল খাবেন। বাদাম তেল, শর্ষের তেল ও সয়াবিন তেল-সব ধরনের তেলই মিলিয়ে মিশিয়ে খেতে হবে। সপ্তাহে ৩-৪ চামচ ঘি খাওয়া যেতে পারে।
ডায়াবেটিস রোগীদের মাটির নিচের খাবারের বিধি-নিষেধ সম্পর্কিত কিছু কুসংস্কার প্রচলিত আছে। এক্ষেত্রে জেনে রাখা ভাল, খাদ্যদ্রব্যটি মাটির উপরের বা নিচের তা বিবেচ্য বিষয় নয়, এর ক্যালরি মান ও আঁশ কতটুকু আছে সেটাই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আবার অনেকের মধ্যে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণার কারণে এমন বদ্ধমূল বিশ্বাস আছে যে, ডায়াবেটিস হোক আর যাই হোক, মধু সব সময়ই উপকারী তবে খুব বেশি মধু খাওয়া ঠিক হবেনা। হঠাৎ যদি কোন সময় এক চামচ খেয়েও ফেলেন, তার জন্য তাকে ২ কাপ ভাত বা একটি রুটি কম খেতে হবে পরবর্তী খাবারের সময়।
ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য গ্রহণ বিবেচনা করতে গিয়ে খাদ্য উপাদানের মতো খাদ্যগ্রহণের সময়ও গুরুত্বপূর্ণ। তাদের প্রতিদিনের মোট খাদ্যদ্রব্যকে কমপক্ষে ৫ ভাগে ভাগ করে খেতে হবে। কোন এক সময় যদি খাদ্যগ্রহণে দীর্ঘ বিরতি পড়ে যায় তবে হাইপোগাইসিমিয়া দেখা দিতে পারে। আবার যারা মনে করেন যে একবার বেশি খেয়ে ফেললে পরে তা কম খেয়ে ঠিক করে নেবেন তাও ঠিক হবে না। এটি তার জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে উভয় ক্ষেত্রেই। কেউ কেউ আবার মিষ্টান্ন খেয়ে ফেলে পরবর্তী ডোজের ওষুধ হয়ত একটু বেশি খেয়ে সমতা আনতে চেষ্টা করেন। এটি একটি ভয়াবহ কাজ হবে।
ইচ্ছে মতো খাওয়া যাবে
নিচের তালিকার খাদ্যদ্রব্যগুলো ডায়াবেটিস রোগীরা কোনো প্রকার ক্যালরি হিসেব ছাড়াই খেতে পারবেন। ডায়াবেটিস রোগী তার রুচি ও অভ্যাস মতো এর যেকোন এক একটি খাবার প্রতিদিনই খেতে পারবেন।
* চা বা কফি (চিনি ছাড়া)
* মসলা (ধনে, জিরা, হলুদ, মরিচ, আদা , রসুন, পেঁয়াজ ইত্যাদি)।
* খাবারের সুগন্ধ (ভেনিলা, স্ট্রবেরি)
* শাকসবজি (পালং শাক, লাল শাক, পুঁই শাক, কলমি শাক, ডাঁটা শাক, কচু শাক, লাউ শাক, কুমড়ো শাক, পাট শাক, হেলেঞ্চা শাক, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, ওলকপি, টমেটো, কাঁচা পেঁপেঁ, শশা, খিরা, উচ্ছে, করলা, ঝিঙা, ধুন্ধল, চাল কুমড়া, ডাঁটা, লাউ, সজনে, বেগুন, মরিচ, কলার মোচা ইত্যাদি)।
* ফল (কালো জাম, লেবু, আমড়া, বাতাবি লেবু, কামরাঙ্গা, বাঙ্গি, জামরুল, আমলকি, কচি ডাবের পানি ইত্যাদি)।
* আচার (মিষ্টি ছাড়া)
* শর্করা বিহীন মিষ্টি
* শর্করা বিহীন মিষ্টি খাবার-সুকরোল, স্যাকারিন ইত্যাদি।
হিসাব মতো নিয়মিত খাওয়া যাবে
* ফল : আম- ছোট ১টি আমের অর্ধেক (৩০ গ্রাম), পাকা পেয়ারা ১টি (বড়)
লিচু – ৬ টি (বড়)
আতা ফল- ১ টি (৩০ গ্রাম)
কাঁঠাল- মাঝারি ৩ কোয়া (৫০ গ্রাম)
কমলা- ১ টি মাঝারি (৬০ গ্রাম)
আপেল- ১ টি, মাঝারি (৪০ গ্রাম)
মাল্টা- ১ টি মাঝারি (৫০ গ্রাম)
পাকা পেঁপে- ৩.৫/২/০.৫ মাপের ১টি
পাকা কলা- ১ টির অর্ধেক
নারিকেল- ২ চামচ কোরানো (৬ গ্রাম)
মিষ্টি কুল- মাঝারি ৬ টি (২৫ গ্রাম)
তরমুজ- মাঝারি ১ টুকরা (৪০ গ্রাম)
কেশর আলু- মাঝারি ১ টি (৩০ গ্রাম)
পাকা বেল- আধা কাপ (৩০ গ্রাম)
প্রতিদিন এসব ফলের যেকোন ১ টি উল্লেখিত পরিমাণে খাওয়া যাবে। তবে একাধিক ফল একদিনে খাওয়া উচিত হবে না।
ডায়াবেটিস রোগীদের খাওয়া নিষেধ
(অথবা খুবই সামান্য খাওয়া যাবে)
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খাদ্যাভাসের ব্যাপারে যথেষ্ট শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হয়। আগের আলোচনায় আমরা উল্লেখ করেছি কি কি খাদ্যদ্রব্য যেকোন পরিমাণে খাওয়া যাবে এবং কি কি খাদ্যদ্রব্য পরিমিত পরিমাণে খাওয়া যাবে। এবার ডায়াবেটিস রোগীদের কি কি খাবার খাওয়া উচিত হবে না তা উল্লেখ করছি।
* চিনি : চিনি দিয়ে তৈরি খাবার যেমন, কেক, পেস্ট্রি, জ্যাম, জেলি, মিষ্টান্ন, ক্ষীর, পায়েস, মিষ্টি দধি, পুডিং, হালুয়া, মিষ্টি বিস্কিট, কোমল পানীয় ; কোকাকোলা -স্প্রাইট – ফান্টা – সেভেনআপ – পেপসি – মিরিন্ডা – আরসি কোলা – ইউরো লেমন – ইউরোকোলা – ফিজআপ – ভার্জিন, এ জাতীয় পানীয় এবং বাজারজাতকৃত ফলের রস ইত্যাদি (তবে ডায়েট পানীয় খাওয়া যেতে পারে)।
* গুড়, * গ্লুকোজ, * রস, * মিছরি, * মধু
তবে অসুস্থ হয়ে পড়লে অথবা নিয়মিত খাদ্য খেতে না পারলে প্রতিবেলায় ১ কাপ দুধ- বার্লি বা দুধ-সাগু, ফলের রস বা ডাবের পানি খাওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে সত্বর ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন। কোনভাবেই দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার চেষ্টা করবেন না।
বিনিময় খাদ্য তালিকা ব্যবহার পদ্ধতি
যেসব খাদ্যদ্রব্য শরীরে কাজে লাগার পদ্ধতি একই রকম সেগুলোর একটি খাদ্যদ্রব্য বদল করে অন্যটি পরিমাণ ঠিক রেখে খাওয়া যেতে পারে। এ হিসেবে খাবারকে ৭টি ভাগে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে একটির পরিবর্তে সমতুল্য আর একটি খাবার বেছে নিলে খাদ্য মানের তেমন কোন পরিবর্তন হবে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি আপনার সকালের নাস্তায় আটার ৩টি রুটি (৯০ গ্রাম) নির্দেশিত থাকে তবে আপনি শস্য জাতীয় অন্য খাদ্য তালিকা ৩ টুকরা পাউরুটি বা ৬ কাপ মুড়ি বা ২টি আটার রুটি ১টি মিষ্টি আলু ইত্যাদি নির্বাচন করতে পারেন। যদি আপনার জন্য ৩০ গ্রাম মাছ বরাদ্দ করা হয়, তবে ৩০ গ্রাম মাছ, মাংস বা আমিষ জাতীয় অন্য কোন খাদ্যও খেতে পারেন। এভাবে বিনিময় খাদ্য তালিকা ব্যবহার করলে খাবারে বৈচিত্র্য আসবে এবং ডায়াবেটিসও নিয়ন্ত্রণে থাকবে। সময়মতো ও পরিমাণমতো খাবার খাওয়াই ডায়াবেটিস রোগের প্রধান চিকিৎসা।
ডায়াবেটিক রোগীর দৈনিক
বিভিন্ন বেলার খাদ্য গ্রহণের
সময় ও খাদ্য তালিকা
একজন স্বাভাবিক দৈহিক ওজনের জটিলতাবিহীন ডায়াবেটিস রোগীর একদিনের খাদ্য তালিকার নমুনা নিচে দেয়া হলঃ
সকাল (৮ টা থেকে ৯টা)
আটার রুটি – ৪ টি, ছোট, পাতলা (প্রতিটি ৩০ গ্রাম বা মোট ১২০ গ্রাম)
ডিম – ১ টি
শাক সবজি- ইচ্ছেমত খাওয়া যাবে (পালং শাক, লাল শাক, পুঁই শাক, কলমি শাক, ডাঁটা শাক, কচু শাক, লাউ শাক, কুমড়ো শাক, পাট শাক, হেলেঞ্চা শাক, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, ওলকপি, টমেটো, কাঁচা পেঁপেঁ, শশা, খিরা, উচ্ছে, করলা, ঝিঙা, ধুন্ধল, চাল কুমড়া, ডাঁটা, লাউ, সজনে, বেগুন, মরিচ, কলার মোচা ইত্যাদি)।
ফল ইচ্ছেমত খাওয়া যাবে (কালো জাম, লেবু, আমড়া, বাতাবি লেবু, কামরাঙ্গা, বাঙ্গি, জামরুল, দেশি পেয়ারা, দেশি কুল, আমলকি ইত্যাদি)
সকাল (১১ টা থেকে ১১.৩০ মিনিট)
বিস্কিট / মুড়ি – ৩০ গ্রাম
ফল – ১টি ছোট আমের অর্ধেক / ১টি বড় পাকা পেয়ারা/৩টি মাঝারি আকারের কাঁঠালের কোয়া/১টি মাঝারি আকারের আপেল/১টি মাঝারি আকারের কমলা/পাকা পেঁপেঁ ৬০ গ্রাম।
দুপুর (১ টা থেকে ২ টা)
ভাত- ৪ কাপ (৩৬০ গ্রাম)
মাছ / মাংস- ২ টুকরা (৬০ গ্রাম)
ডাল – দেড় কাপ, মাঝারি ঘন (২৫ গ্রাম)
শাক সবজি – ইচ্ছেমত খাওয়া যাবে (পালং শাক, লাল শাক, পুঁই শাক, কলমি শাক, ডাঁটা শাক, কচু শাক, লাউ শাক, কুমড়ো শাক, পাট শাক, হেলেঞ্চা শাক, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, ওলকপি, টমেটো, কাঁচা পেঁপেঁ, শশা, খিরা, উচ্ছে, করলা, ঝিঙা, ধুন্ধল, চাল কুমড়া, ডাঁটা, লাউ, সজনে, বেগুন, মরিচ, কলার মোচা ইত্যাদি)।
ফল ইচ্ছেমত খাওয়া যাবে (কালো জাম, লেবু, আমড়া, বাতাবি লেবু, কামরাঙ্গা, বাঙ্গি, জামরুল, দেশি পেয়ারা, দেশি কুল, আমলকি ইত্যাদি)
বিকাল (৫টা থেকে ৬ টা)
দুধ – ১কাপ (১২০ মিলিলিটার) / ডাল বা চিনে বাদাম (৩০ গ্রাম)
রাত্রি (৮ টা থেকে ৮.৩০ মিনিট)
আটার রুটি – ৪ টি, ছোট, পাতলা (১২০ গ্রাম)
মাছ / মাংস ১ টুকরা (৩০ গ্রাম)
ডাল – দেড় কাপ, মাঝারি ঘন (২৫ গ্রাম)
শাক সবজি – ইচ্ছেমত খাওয়া যাবে (পালং শাক, লাল শাক, পুঁই শাক, কলমি শাক, ডাঁটা শাক, কচু শাক, লাউ শাক, কুমড়ো শাক, পাট শাক, হেলেঞ্চা শাক, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, ওলকপি, টমেটো, কাঁচা পেঁপেঁ, শশা, খিরা, উচ্ছে, করলা, ঝিঙা, ধুন্ধল, চাল কুমড়া, ডাঁটা, লাউ, সজনে, বেগুন, মরিচ, কলার মোচা ইত্যাদি)।
রান্নার জন্যে তেল – ৩০ মিলিলিটার
সারা দিনের ক্যালরি – ১৮০০ -১৯০০
শর্করা – ২৭০ গ্রাম
আমিষ – ৭০ গ্রাম
স্নেহ বা চর্বি – ৫০ গ্রাম
উপরের তালিকার যেকোন খাদ্য দ্রব্যের পরিবর্তে বিনিময় খাদ্য তালিকা থেকে অন্য খাদ্য দ্রব্য বেছে নেয়া যেতে পারে।
লেখক : চিকিৎসক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব
মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়