মোঃ আবু জাফর
কাগজটা হাতে নিয়ে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে দেখলো এসআই রাহাত। মাত্র ৫ দিন আগে সে এই থানায় যোগদান করেছে। জেলায় যোগদান করেছে ১১ দিন আগে। সবেমাত্র প্রশিক্ষণ ও শিক্ষানবিশ শেষ করেছে। এটাই তার প্রথম পোস্টিং। নতুন চাকরি বিধায় পুলিশ সুপার স্যার কাজ শেখার সুবিধা ও সবদিক বিবেচনা করে একটু নিরিবিলি দেখে এ থানায় পোস্টিং দেন এসআই রাহাতকে। থানায় যোগদান করার আগেই একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাই নয়, একজন অভিভাবক হিসেবে পুলিশ সুপার সাহেব তাকে সব ধরনের আদেশ উপদেশ ও দিক নির্দেশনা দিয়ে থানায় পাঠান। শুধু এখানেই শেষ নয়, থানার ওসিকে টেলিফোনে বলে দেন নতুন অফিসার হিসেবে রাহাতের দিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখার জন্য। আর প্রথম দিকে জটিল কোনো কাজ না দেওয়ার জন্যও বিশেষভাবে বলে দেন।
সেই মোতাবেক ওসি স্যার তাকে এই ৫ দিনে তেমন কোনো কাজই দেননি। শুধু থানার ভিতরে বসে অফিসের কাজকর্ম ও এলাকা সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা নিতে বলেন। সেভাবেই রাহাত এ কয় দিনে অফিসের বেশ কিছু কাজ ও এলাকা সম্পর্কে একটা ভালো ধারণাই নিয়েছে। রাহাতের জন্য সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হলো থানার সবাই এত আন্তরিকভাবে তাকে সাহায্য করছে যে, সবাইকে আপন ভাইয়ের মতো ও সম্পূর্ণ থানাটাকে একটা পরিবারের মতো মনে হচ্ছে রাহাতের কাছে। সবচেয়ে জুনিয়র বলে কোনো এসআই বা স্বয়ং ওসি সাহেবও কখনও তাকে হেয় চোখে দেখেনি। বরং তাকে সব ব্যাপারে সহযোগিতা করছে। প্রতিদিন অন্তত একবার ওসি সাহেব তাকে তার রুমে ডেকে কোনো সমস্যা আছে কিনা বা খাওয়া দাওয়া ছাড়াও অন্য কোনো অসুবিধা আছে কিনা তা জিজ্ঞাসা করেছে ও খোঁজখবর নিয়েছে। আজ যে কাগজটি তার হাতে এসেছে এটি একটি চাকরির ভেরিফিকেশন। নাম ঠিকানা ও অন্যান্য তথ্যাবলী সব পড়ার পরে ওসি সাহেবের “এসআই রাহাত তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা নিন” লেখাটি কয়েকবার পড়ে। তার চাকরি জীবনে তদন্ত করার জন্য এটাই প্রথম কোনো ভেরিফিকেশন। মনে মনে বেশ পুলক অনুভব করে রাহাত। তারপর ভেরিফিকেশনে উল্লিখিত একটি মোবাইল নম্বর পেয়ে ফোন করে নাম ঠিকানা যাচাই করে সেই সাথে উল্লিখিত ঠিকানায় যাওয়া আসার রাস্তাও ভালোভাবে জেনে নেয়। পরের দিন বিকেলের দিকে সরেজমিনে গিয়ে দেখে আসবে বলেও জানিয়ে দেয়। স্থানীয় দুই একজন গণ্যমান্য ব্যক্তিকেও হাজির থাকতে বলে রাহাত। সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র যেমন সকল শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেটের সত্যায়িত কপি ও এক কপি চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট রাখতে বলে। পরের দিন রাহাত গিয়ে যথাসময় ঐ বাড়িতে হাজির হয়। অবশ্য বাড়িতে পৌঁছার আগেই গোপনে বিস্তারিত বিষয় লোকজনের মুখ থেকে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে জেনে নেয়। বাড়িতে গিয়ে অবাক হয় রাহাত। অন্তত ৩০-৩৫ জন লোক উঠানে বসে আছে। এছাড়া আরও ১৫-২০ জন তাদেরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ কয়েকটি ছোট ছোট ছেলেমেয়েও আছে। রাহাত বুঝতে পারে পুলিশ সম্পর্কে এ এলাকার মানুষের মনে এখনও একটা কৌতূহল বিদ্যমান আছে। রাহাতকে দেখতে পেয়ে সবাই তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নির্দিষ্ট চেয়ারে বসায়। তারপর নানা রকম কথাবার্তা চলে। রাহাতকে বিভিন্ন ধরনের খাদ্য ও পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন করে তারা।
রাহাত বুঝতে পারে লোকগুলো অসম্ভব গরিব। এতটাই গরিব যে, তাকে যে আদর আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে তাতেও হয়ত ঐ পরিবারটির দুই এক দিন অর্ধাহারে বা সম্পূর্ণ অনাহারে কাটাতে হতে পারে। মানুষগুলোর জন্য বুকের মাঝে গভীর একটা কষ্ট ও মমতা বোধ করতে থাকে রাহাত। আবার তার গর্বও হয়। মনে হয় এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানোর ও তাদের উপকার করার ক্ষমতা আল্লাহ তাকে দান করেছেন। পুলিশের চাকরি না হলে সারা জীবনের জন্য এত মহৎ কাজ সে কোনোভাবেই করার সুযোগ পেত না। যা কিছু জানার ও কাগজপত্র যা দরকার সবই রাহাত জেনে ও বুঝে নেয়। এবার বিদায়ের পালা। সবাইকে বলে রাহাত বিদায় নিতে চাইলে একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি রাহাতকে একটু পাশে নিরিবিলি জায়গায় ডেকে নিয়ে যায়। সেখানে একজন বৃদ্ধাকে দেখতে পায় রাহাত। বয়স ৬০ বছরের বেশিই হবে হয়ত। কঙ্কালসার এই শরীরে কতদিন পেটভরে খেতে পায়নি কে জানে। নানা রকম রোগ যন্ত্রণায় ভুগছে বলেও এক মুহূর্তেই রাহাত বুঝতে পারে। সে কান্না জড়িত কন্ঠে রাহাতকে বলে- “বাবা আপনি আমার ছেলের মতো। একটু ভালোভাবে রিপোর্ট দিবেন। আমার ছেলের চাকরিটা যেন হয়। আপনার জন্য আমি সারা জীবন দোয়া করবো বাবা। ওর বাবা নাই। সংসারে আমার এই একটি মাত্র ছেলে। ওর চাকরিটা হলে শেষ বয়সে আমি একটু শান্তি পাব আর পেট ভরে কয়টা ভাত খেয়ে মরতে পারব বাবা।” এই বলে সে রাহাতের হাতে কয়েকটি দশ টাকার ও বিশ টাকার নোট তুলে দেয়। বার বার বলে- “আমার ইচ্ছা থাকলেও এর চেয়ে বেশি আর একটি টাকাও আপনার হাতে তুলে দিতে পারলাম না।”
এই ঘটনাটির জন্য রাহাত একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। আর যে অবস্থার মধ্য দিয়ে পরিবারটি টিকে আছে সেখানে যেটুকু খাবার মুখে দিয়েছে সেটুকুও না খেতে পারলে ভালো হতো। রাহাত বুঝিয়ে শুনিয়ে যতই টাকাগুলো বৃদ্ধা মহিলার হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ততই সে আরও জোর করে রাহাতের হাতে দেওয়ার চেষ্টা করে আর বলে যে, কম দিলাম বলে রাগ করবেন না বাবা। আমাকে কয়েকজন বলেছে আপনাকে খুশি করতে না পারলে আমার ছেলেটার চাকরি হবে না। এতক্ষণে জোর করে টাকা দিতে চাওয়ার বিষয়টি রাহাতের কাছ স্পষ্ট হয়। এবার রাহাত একটু অন্য সুরে কথা বলে। রাহাত বলে, তাহলে এত কম কেন দিলেন। ইচ্ছে করলেই তো আপনি এর চেয়ে অনেক বেশি কিছু দিতে পারেন। এ কয়টা টাকাতো দুই এক দিনেই ফুরিয়ে যাবে। তারচেয়ে এমন কিছু দিন যা দিয়ে অনেক দিন চলা যাবে। এবার বৃদ্ধা ম্লান মুখে বলে “বাবা আর কোনো কিছু দেওয়ার মতো সামর্থ্য আমার নাই। আর অনেক দিন চলার মতো করে আপনাকে দেওয়ার মতো কিইবা আমার আছে। আল্লাহ তো আমাকে সে ভাগ্য দেন নাই।”
এবার রাহাত বলে- ঠিক আছে। তাহলে টাকাটা হাতে নেন। এবার আমি আমার পছন্দমতো দামি একটা জিনিস নিয়ে নেব। দেখি কিভাবে নাই বলে ফিরিয়ে দেন। ঘটনার আকস্মিকতায় আর রাহাতের বলার ধরনে সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। রাহাত আর বিলম্ব না করে বৃদ্ধার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে ও পায়ের কাছে বসে বলে, মায়ের মতো ঐ হাতটা আমার মাথায় রেখে একটু দোয়া করে দেন। এত বড় একটা জিনিস থাকতে কেন যে সামান্য কয়টা টাকা নিয়ে এত জোর জবরদস্তি করছেন বুঝি না। হঠাৎ সবাই অবাক হয়ে যায়। এ কি কথা! এমন কথা যে তারা কেউই আশাও করেনি। সকলের চোখে আনন্দ অশ্রু ঝরে পরে। সবাই রাহাতের দিকে তাকিয়ে আছে। বৃদ্ধা এবার আর স্থির থাকতে পারে না। হাউমাউ করে কান্না করে রাহাতের মাথাটা বুকে টেনে নেয়। বলে “আজ থেকে আমার দুটি সন্তান। আপনাকে আমি আমার বুকের মাঝে সন্তান স্নেহে জায়গা দিলাম বাবা।” এবার রাহাত সবাইর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে থানার দিকে হাঁটা শুরু করে। উপস্থিত লোকজন দলবেঁধে রাহাতকে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। তারপর একসময় রাহাত আরও দূরে চলে যায়। তবুও লোকগুলো পিছন থেকে রাহাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। যতক্ষণ রাহাতকে দেখা যায় ততক্ষণ একটি লোকও দৃষ্টি ফেরায় না। আর কিছুক্ষণ পরেই সন্ধ্যা নেমে আসবে। আকাশে কোথাও এক টুকরা মেঘ নাই। খুব সুন্দর একটা নরম উজ্জ্বল আলো চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। রাহাত হাঁটছে আর ভাবছে, আহ! কি সুন্দর আর শান্ত সবুজ বাংলার এই গ্রামগুলো। কি উদার আর সহজ সরল গ্রাম বাংলার প্রতিটি মানুষ। থানা এখনও অনেকটা দূরে। রাহাত আরও জোরে হাঁটতে থাকে। অনেকটা পথ তাকে অতিক্রম করতে হবে। নিজেই নিজেকে বলে- আরও জোরে, আরো জোরে রাহাত।
লেখক : ইন্সপেক্টর, স্কুল অব ইন্টেলিজেন্স
স্পেশাল ব্রাঞ্চ, উত্তরা, ঢাকা
0 Comments