বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাহার আকন্দ বিপিএম (বার), পিপিএম (বার)
তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে তাহের উদ্দিন ঠাকুর তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর ভাষায় দুর্নীতিপরায়ণ বলে কথিত জনাব কোরবান আলীকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রী করে তাঁর উপরে দেওয়ায় বঙ্গবন্ধুর উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন, যা তাঁর স্বীকারোক্তিতে প্রকাশ পায়।
উপরে বর্ণিত বিভিন্ন ব্যক্তিগত কারণে আসামি খন্দকার মোশতাক আহাম্মদ, মাহাবুবুল আলম চাষী, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, জিয়াউর রহমান, ফারুক, রশিদ, জোবায়দা রশিদ, ডালিম, নূর, বজলুল হুদা, আজিজ পাশা, রাশেদ চৌধুরী, শাহারিয়ার গং- তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর কাছের আত্মীয় আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও ফজলুল হক মণির প্রতি বিক্ষুব্ধ হন। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আশাপ্রদ না থাকায় তার বিভিন্নভাবে সেনাবাহিনীর ভেতরে বিভিন্ন প্রকার যেমন- রক্ষী বাহিনী গঠন, বাকশাল গঠন, পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া, গভর্নর সিষ্টেম চালু করা ইত্যাদি বিষয়ে সেনাবাহিনীর অন্যদের ভেতর অপ-প্রচার চালিয়ে ও কিছুসংখ্যক সৈনিকের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টিপূর্বক বিভিন্ন প্রকার কুপরামর্শ প্রদান করে শেখ মুজিবর রহমান তাঁর পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের হত্যা করে, সরকার পরিবর্তনপূর্বক খন্দকার মোশতাককে প্রেসিডেন্ট করার হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
অন্যদিকে খন্দকার আব্দুর রশীদ মার্চের পরে ইন্ডিয়া থেকে ট্রেনিং শেষে দেশে ফিরে আসেন। তার পোস্টিং হয়েছিল যশোর গানারী স্কুল ইন্সট্রাক্টর হিসেবে। ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে মেজর রশিদ ও মেজর ফারুক যোগসাজশ করে আব্দুর রশিদের ওই বদলী বাতিল করে ঢাকায় থাকার ব্যবস্থা করেন। এই সময় আসামিদ্বয় পরস্পর যোগসাজশে তৎকালীন সরকার উৎখাতসহ শেখ মুজিবুর রহমান ও তার আত্মীয়-স্বজনদের হত্যা করার জন্য ষড়যন্ত্র করেন। এর মধ্যে আসামি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান যিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের লগ্ন থেকেই ক্ষমতা লিপ্সু ছিলেন, তাছাড়া স্বাধীনতার পর একই কোর্সমেট এবং বাই নাম্বারে সিনিয়র হওয়া সত্বেও তাকে সেনা প্রধান না করে মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে সেনা প্রধান করায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তৎকালীন সরকারের প্রতি তিনি অসন্তুষ্ট ও বিক্ষুব্ধ ছিলেন এবং সেই কারণে তিনি বিভিন্নভাবে বঙ্গবন্ধু ও তার সরকারের বিরুদ্ধে সুকৌশলে অপপ্রচার চালান, যেমন তিনি মাঝে মাঝে চুপিসারে রাতের বেলায় ল্যান্সারের টু আই,সি, মেজর ফারুক এবং আর্টিলার সি,ও মেজর রশীদের বাসায় তার বেগমসহ যাতায়ত এবং উস্কানিমূলক বক্তব্য দিতেন। তাদেরকে সরকার তথা শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কিছু করতে উৎসাহিত করেন। মেজর জেনারেল জিয়া সরকার পরিবর্তন করতে গিয়া শেখ মুজিবকে শেষ করে দেওয়ার পরামর্শ দেন এবং তাহার পূর্বে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সন্ধান করার পরামর্শ দেন।
তাছাড়া জিয়াউর রহমান নিজেই খন্দকার মোশতাক আহাম্মদের অফিসে হাজির হয়ে এই ষড়যন্ত্র বিষয়ে সত্বর কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রস্তাব করেন। মেজর রশিদ, শাহারিয়ার, নূর, পাশা, বজলুল হুদা, ডালিম, রাশেদ চৌধুরী, মেজর মহিউদ্দিন (আর্টিলারি) ঘটনার কিছুদিন আগে থেকেই শাহারিয়ারের শেরী এন্টারপ্রাইজ তেজগাঁও, তাহার বাসা ইত্যাদি স্থানে একত্র হয়ে তৎকালীন সরকার উৎখাত এবং শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবার ও আত্মীয় স্বজনদের হত্যা করার ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা করেন। এই সমস্ত ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনার আর্টিলারি, ল্যান্সার এ কর্মরত এবং কিছু চাকুরীচ্যুত অফিসারদের এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করেন। অফিসার ছাড়াও কিছু জে,সি,ও এবং এন,সি,ও এই কাজে উদ্বুদ্ধ করেন। ষড়যন্ত্র মোতাবেক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ঘটনার এক মাস আগে থেকে মাসে দুই বৃহস্পতিবারে ল্যান্সার ও সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারির নাইট ট্রেনিং-এর প্রোগ্রাম চালাতে থাকেন। তাদের এই উদ্দেশ্য বিনা বাধায় সফল করার লক্ষ্যে মেজর ডালিম, ক্যাপ্টেন হুদা, মেজর পাশাদের এক সময়ের কমান্ডের অধীন কুমিল্লাসহ প্রথম ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট এর একটি ব্যাটারীর একজন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে মাসের ১৫ দিন আগে অর্থাৎ ১লা আগস্ট/৭৫ বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গণভবনে গার্ড ডিউটিতে নিয়োজিত করার ব্যবস্থা করেন। উল্লেখ্য যে এই গার্ডের জে,সি,ও এবং এন,সি,ও দের মধ্যে অনেকেই আগে থেকেই ডালিম, বজলুল হুদা, পাশাদের প্রতি অনুগত ও সহানুভূতিশীল ছিলেন। তাদের মধ্যে ধৃত আসামি অনারারি ক্যাপ্টেন আঃ ওয়াহাব জোয়ারদার ও নাঃ ইউনুছ আলী উল্লেখ্যযোগ্য। মার্চ/এপ্রিল মাসের দিকে আসামি বজলুল হুদা ও ডালিম প্রথম ফিল্ড রেজিমেন্টে যান এবং আসামি ইউনুসের উপস্থিতিতে শেখ মুজিবকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন। এইভাবে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে ১৯৭৫ সালের তৎকালীন সরকার উৎখাতসহ শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনকে হত্যার পরিকল্পনা নেয়।
তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক ঘটনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে ১২-০৮-১৯৭৫ইং তারিখ রাতে আনুমানিক ১২.৩০ মিনিটের সময় মেজর ফারুক ও মেজর রশিদ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ১৪-০৮-১৯৭৫ ইং তারিখ দিবাগত রাতে নাইট ট্রেনিং-এর উছিলায় মেজর ফারুক তাহের প্রথম বেঙ্গল ল্যান্সার মেজর রশিদ তার ২ ফিল্ড আর্টিলারীকে নতুন এয়ারপোর্ট এলাকায় সমবেত করেন। নাইট ট্রেনিং প্রোগ্রামে এম্যুনিশন না দেওয়ার বিধান না থাকা সত্বেও অন্যায় উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার লক্ষ্যে বে-আইনীভাবে ফাস্ট লাইন এম্যুনিশন সঙ্গে নেন। অন্যদিকে মেজর রশিদ চাকুরীচ্যুত মেজর ডালিম, মেজর রাশেদ চৌধুরী, মেজর নূর, অবসরপ্রাপ্ত মেজর শাহারিয়ার অন্য ইউনিটে কর্মরত ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা, মেজর পাশা, ক্যাপ্টেন মাজেদকে মধ্যরাতে তার কথিত ট্রেনিং স্থল নতুন এয়ারপোর্ট এলাকায় সমবেত হয়ার জন্য বলে দেন, সেই মোতাবেক তারা রাত ১২টার পরে নতুন এয়ারপোর্ট ২ফিল্ড আর্টিলারির ট্যাকটিক্যাল হেডকোয়ার্টার এ সমবেত হন। আনুমানিক রাত ২টার দিকে মেজর রশিদ তার সঙ্গীয় অফিসার মেজর মহিউদ্দিন (আর্টিলারি) মেজর জোবায়ের, ক্যাপ্টেন জাহাংগীর, লেঃ হাসান, রশিদের পছন্দমতো জে,সি,ও এবং উপরে বর্ণিত চাকুরীচ্যুত ও অবসরপ্রাপ্তদের সঙ্গে করে মেজর ফারুকের প্রথম বেঙ্গল ল্যান্সার হেডকোয়ার্টার স্কোয়াড্রনে যান। সেখানে মেজর ফারুক তার ল্যান্সারের মেজর মহিউদ্দিন, মেজর আহাম্মদ শরফুল হোসেন, লেঃ কিসমত, লেঃ নাজমুল হোসেন আনসার, ক্যাপ্টেন নকিব রিসালদার সরোয়ার, রিসালদার সামসুল হক, দফাদার বারী, দফাদার মারফত আলী শাহ, এল,ডি, আবুল হসেন মৃধা, এল,ডি আলী হোসেন ও অন্যদেরসহ তার ইউনিটে কথিত ট্রেনিং শেষ হবার পরও অসৎ উদ্দেশ্যে সমবেত হয়ে অপেক্ষা করতে ছিলেন।
তারা সবাই একত্র হবার পর মেজর ফারুক সবাইকে উদ্দেশ করে বে-আইনিভাবে সরকার উৎখাত ও শেখ মুজিবসহ তার পরিবার আত্মীয়-স্বজনদের হত্যা করার উদ্দেশ্যও বাস্তবায়নে পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা প্রকাশ করে। সেই মোতাবেক বিভিন্ন জনকে বিভিন্ন স্থানে দায়িত্ব বণ্টন করে দেয়। অপরপক্ষে হত্যাকা- ঘটানোর উদ্দেশ্যে সবাইকে তার ইউনিটের কোত থেকে প্রয়োজনীয় এম্যূনেশান সরবরাহ করে। চাকুরিচ্যূত ও অবসরপ্রাপ্ত কিছু অফিসার এই কর্মকা-ে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে অবৈধভাবে ইউনিফর্ম পরে ও এম্যুনেশন সংগ্রহ করে। সমবেত অফিসার ও ফোর্সদের মোটামুটি চারভাগে ভাগ করে এবং চারটি এলাকায় ডিপলয় করে। যথাক্রমে নতুন এয়ারপোর্ট, সংসদ ভবনসহ মীরপুর রোড থেকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের প্রেসিডেন্টের বাড়ি, শেখ ফজলুল হক মণির বাড়িসহ পিলখানা এলাকা এবং মিন্টু রোড ও বেতার ভবন এলাকা। প্রেসিডেন্টের বাড়িতে মেজর মুহিউদ্দিন (ল্যানসার), মেজর নুর, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদাগণকে সঙ্গীয় ফোর্সসহ সরাসরি অপারেশনের দায়িত্ব দেয়া হয়। মেজর মহিউদ্দিন (আর্টিলারি) কে একটি গান ও সঙ্গীয় ফোর্সসহ লেকের পাশে মাঠে অবস্থান নেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়। মেজর মুহিউদ্দিন (ল্যানসার), মেজর নুর, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও তাদের সঙ্গীয় ফোর্স ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডে প্রেসিডেন্টের বাড়িতে আক্রমণ চালায়। বাড়িতে উপস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বেগম ফজিলাতুন্নেছা, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ নাসের, রোজি জামাল, সুলতানা কামাল, শেখ রাসেল এবং পুলিশের এস আই সিদ্দিকুর রহমানকে হত্যা করে। তাছাড়া বাদী মুহিতুল ইসলাম, চাকর সেলিম, পুলিশের ডি এস পি নুরুল ইসলামদের হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করে মারাত্মক জখম করে। মেজর মহিউদ্দিন আর্টিলারি এলাকায় ভীতি সন্ত্রাস সৃষ্টির জন্য তার গান থেকে আর্টিলারির গোলা ছুড়ে। দুটি গোলা মোহাম্মদপুর এলাকার শেরশাহসুরী রোড এবং শাহজাহান রোডে পড়ে। সেখানে কামানের গুলিবিদ্ধ হয়ে নয়জন নিহত হয় এবং কয়েকজন আহত হয়। ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা সরাসরি শেখ কামালকে এবং মেজর নুর বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে। অন্যরা বাকিদের গুলি করে। মেজর আজিজ পাশা ঘটনাস্থলে আসে এবং হত্যাকান্ডে অংশগ্রহণ করে। সুবেদার মেজর আবদুল ওয়াহাব জোয়ারদার ঘটনার আগ মুহূর্তে ঘটনাস্থলে তার প্রথম ফিল্ড আর্টিলারি গার্ড ডিউটিতে নিয়োজিত ফোর্সদের বদলানোর অজুহাতে ক্লোজ করে নিয়ে যায়। ঘটনার পর সুবেদার মেজর ওয়াহাব জোয়ারর্দার, নাঃ ইউনুসসহ প্রেসিডেন্টর বাড়ির মূল্যবান মালামাল লুটপাট করে নিয়ে যায়। এই অপারেশনে সহযোগিতা করার জন্য বজলুল হুদা ওয়াহাব জোয়াদারকে সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে পুরষ্কারস্বরূপ অনারারী লেঃ পদে পদোন্নতির র্যাংক পরিয়ে দেয়। আসামি রিসালদার মুসলেহউদ্দীন তার সঙ্গীয় দফাদার মারফত আলী শাহ, এলডি আবুল হাসেম মৃধা এবং এলডি ক্লার্ক আলী হোসেন ও সঙ্গীয় ফোর্সসহ ধানমন্ডি শেখ ফজলুল হক মণির বাড়িতে অপারেশনের দায়িত্ব ছিল। সেই মোতাবেক সে শেখ ফজলুল হক মণির বাড়িতে আক্রমণ করে শেখ ফজলুল হক মণি ও তার স্ত্রীকে গুলি করে হত্যা করে। এই হত্যাকা- শেষে প্রেসিডেন্টের বাড়িতে আসে এবং প্রেসিডেন্টের বাড়ির হত্যাকান্ডে অংশগ্রহণ করে। প্রেসিডন্টের বাড়ির সংবাদ পেয়ে লেঃ কর্নেল জামিল প্রতিরোধ করার জন্য আসলে পথিমধ্যে মিরপুর রোডে তাকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। আসামি মেজর শরিফুল হক ডালিম, মেজর শাহরিয়ার, মেজর রাশেদ চৌঃ, মেজর আজিজ পাশা, ক্যাপ্টেন মাজেদ, ক্যাপ্টেন নুরুল হক অন্যরা মিন্টু রোডের মন্ত্রী পাড়া, বেতার ভবন এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। তারা প্রথমে মিন্টু রোডস্থ মন্ত্রী আঃ রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে সশস্র আক্রমণ চালিয়ে মন্ত্রী আঃ রব সেরনিয়াবাতসহ বাড়িতে উপস্থিত অ্যাডঃ শহীদ সেরনিয়াবাত, বেবী সেরনিয়াবাত, আরিফ সেরনিয়াবাত, বাবু সেরনিয়াবাত, লক্ষ্মীর মা (কাজেরবুয়া), কাজের ছেলে পটকা, আঃ নাইম খান ওরফে রিন্টুকে গুলি করে হত্যা করে। হত্যার উদ্দেশ্যে আমেনা বেগম, আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ, বিউটি সেরনিয়াবাত, রিনা সেরনিয়াবাত, রফিকুল ইসলাম, ললিত দাস ও গোলাম মাহমুদগণকে গুলি করে গুরুতর জখম করে। হত্যাকা- ঘটানোর সঙ্গে সঙ্গেই আসামি মেজর শরিফুল হক ডালিম বেতার ভবনে যায় এবং বেতারে ঘোষণা দেয়, ‘স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে, খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে।’ মেজর ফারুক রহমান নিজে সঙ্গীয় মেজর শরফুল হোসেন, লেঃ কিশমত, লেঃ নাজমুল হোসেন আনসারসহ ট্যাংক বাহিনী নিয়ে রক্ষীবাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য রক্ষীবাহিনী সদর দপ্তর এলাকা এবং সাভার রক্ষীবাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য মিরপুর রোড এলাকায় ট্যাংক মোতায়েন করে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডে প্রেসিডেন্টের বাড়িতে নিজে ট্যাংকসহ যায় এবং হত্যাকান্ডের সফলতা প্রত্যক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। ধানমন্ডি থেকে ট্যাংকসহ বেতার ভবনে যায়। ঘটনার পর পরই মেজর রশিদ সশস্র অবস্থায় ৪৬ ব্রিগেডের ডাইরেক্টর অপারেশন জি এস ১ লেঃ কর্নেল আমিন আহমেদ চৌঃ, ব্রিগেড মেজর হাফিজ উদ্দিন ও ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিলের বাসায় যায়। তাদের ঘটনা অবহিত করে। তারা যাতে রিএ্যাক্ট না করে সেজন্য হুমকি দেয়। সেখান থেকে মেজর রশিদ খন্দকার মোশতাকের বাসায় যায়। খন্দকার মোশতাক সঙ্গে সঙ্গেই তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে বিষয়টি অবহিত করে এবং বেতার ভবনে আসার জন্য নির্দেশ দেয়। খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও মেজর রশিদ বেতার ভবনে আসে। তাহের উদ্দিন ঠাকুরও বেতার ভবনে আসে। খন্দকার মোশতাক ও তাহের উদ্দিন ঠাকুর যৌথভাবে মোশতাক আহমেদ কতৃক প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা গ্রহণের ভাষণ রেডিওতে প্রচারের জন্য রেকর্ড করে ও প্রচার করে। এরই মধ্যে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তিন বাহিনী প্রধানকে খন্দকার মোশতাক সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করার জন্য মেজর ডালিম মাউন্টেড জিপ ও সঙ্গীয় ফোর্সসহ সেনা সদরে যায়। সেনাবাহিনী প্রধানকে ঘটনা অবহিত করে, ভীতি প্রদর্শন করে। সেনা প্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ, বিমান বাহিনী প্রধান ও নৌবাহিনী প্রধানকে টেলিফোনে ঘটনা জানায় এবং ৪৬ ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে আসার জন্য বলে। মেজর ডালিম এবং মেজর রশিদ মেজর জেঃ শফিউল্লাহ, মেজর জেঃ জিয়াউর রহমানসহ ৪৬ ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসে যায়। সঙ্গে সঙ্গে অন্য দুই বাহিনী প্রধান এবং সিজিএস খালেদ মোশাররফ সেখানে আসেন। সেখান সবাই উপস্থিত সবাই বেতার ভবনে যায়। বেতার ভবনে খন্দকার মোশতাক আহমেদের সহযোগিতায় তাহের উদ্দিন ঠাকুর, বাহিনী প্রধানদের আনুগত্য ঘোষণাপত্র তৈরি করে সঙ্গে সঙ্গে রেডিওতে প্রচার করা হয়।
অতঃপর খন্দকার মোশতাক সদল বলে বঙ্গভবনে যায় এবং জুমার নামাজের পর প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করে। ঘটনায় জড়িত আর্মি অফিসার এবং জোবায়দা রশিদ (মেজর রশিদের স্ত্রী) ও ওই সময় বঙ্গভবনে উপস্থিত থেকে শপথ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের এক-দুদিনের মধ্যেই মেজর জেঃ জিয়াউর রহমানকে সেনা প্রধান করার সিদ্ধান্ত হয়। সেনা প্রধান মেঃ জেঃ শফিউল্লাহকে অবসর দেয়া হয় এবং জেনারেল জিয়াকে সেনাপ্রধান করা হয়। অন্যদিকে জেঃ শফিউল্লাহকে রাষ্ট্রদূত করে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আবার ৩ নভেম্বর জেলহত্যার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেলহত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িতদের বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরির ব্যবস্থা করা হয়।
বিচার কার্যক্রম
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাটির তদন্ত দ্রুত সমাপ্ত করার জোর তগিদ ছিল। যে কারণে মামলা তদন্তের সময় রাত-দিন কাজ করতে হয়েছে এবং অনেক সহকর্মির সহায়তা নিতে হয়েছে। বিভিন্ন জেলার অফিসারদেরও সহযোগিতা নিতে হয়েছে। মাত্র ১০০ দিনের মধ্যে তদন্ত সমাপ্ত করে ২০ জন জড়িত ব্যক্তিকে বিচারে সোপর্দ করা হয়। খন্দকার মোশতাকসহ কয়েকজন মারা যাওয়ায় তাদের বিচারে সোপর্দ করা হয় নি। মামলায় প্রায় ৪৬ প্রকার জব্দকৃত মালামাল আলামত হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করা হয়। এই মামলার ঘটনায় জড়িত থাকার কথা বলে গ্রানাডা টেলিভিশনে মেজর ফারুক ও মেজর রশিদ স্বীকারোক্তি দিয়েছিল। তাদের সেই জবানবন্দিও সংগ্রহ করা হয়। সেনাবাহিনী এবং ডিজিএফআইয়ের বহু গোপন নথি পর্যালোচনা করা হয় এবং জব্দ করা হয়। এই মামলার অন্যতম আসামি বজলুল হুদা থাইল্যান্ডে পালিয়ে ছিল এবং মার্কেটে চুরি করে ধরা পড়ে। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য তদন্তকারীকে কয়েকবার থাইল্যান্ডের আদালতে সাক্ষ্য দিতে হয়েছে। ১৫-০১-৯৭ তাং চার্জশিট হয়। দীর্ঘদিন বিচার শেষে ০৮-১১-৯৮ তাং দায়রা জজ আদালতে মামলার রায় হয়। দীর্ঘদিন বিচারের পর জজ আদালতে বিচারক গোলাম রসুল ‘মামলায় ১৫ জনকে ফাঁসির আদেশ দেন। আসামি জোবায়দা রশিদকে হাইকোর্ট বিচারের আওতামুক্ত রাখার আদেশ দেয়ায় বাকি ১৯ জনের বিচার হয়। জজ আদালত চারজনকে খালাস দেন। হাইকোর্টে রায় হয় ১৪-১২-২০০০ তারিখ সুপ্রিম কোর্ট সর্বশেষ ১৫ জনের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখে ১৯-১১-২০০৯ তারিখ ইতিমধ্যে গত ২৮-০১-২০১০ তারিখ থেকে রায় কার্যকর শুরু হয়ে ইতিমধ্যে ছয়জনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। একজন বিদেশে মারা গেছে। বাকি পাঁচজন বিদেশে পলাতক। তারমধ্যে একজন আমেরিকায়, একজন কানাডাতে আছে। তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। বাকিরা বিভিন্ন দেশে পালিয়ে আছে। এই মামলার ঘটনায় ২১ বছর পর মামলা রুজু হয়। এই সময়ের মধ্যে বহু সাক্ষী ও আলামত স্বাভাবিকভাবে নষ্ট হয়েছে। আবার বহু আলামত ও নথি ইচ্ছাকৃত নষ্ট করা হয়েছে। তদন্তকারীকে বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সিআইডি মামলাটি আন্তরিকতা ও কঠিন ধৈর্যের সঙ্গে সফলভাবে তদন্ত ও বিচার কাজ স¤পন্ন করেছে। জাতি কলঙ্ক মুক্ত হয়েছে।
লেখক: অতি: ডি,আই,জি (অব)
0 Comments