সারফুদ্দিন আহমেদ
ভদ্রলোকের বাংলায় যাকে বলে ছিদ্রান্বেষণ, লোকাল বাংলায় তার নাম ‘ফুটো খোঁজা’। এই ছিদ্রান্বেষণ আর পিএনপিসি (পরনিন্দা পরচর্চা) বরাবরই বিরাট আমোদ-আল্লাদের জিনিস। ঘরে-বাইরে-পার্কে-বাজারে-ফুটপাতে সবখানেই সার পানি ছাড়াই গিবত আর পিএনপিসির বাম্পার ফলন হয়। ব্যক্তি বিশেষ তো বটেই, অনেক পেশাদার সম্প্রদায়ও পিএনপিসি থেকে রেহাই পায় না। করোনাভাইরাসের চেয়ে এই পিএনপিসি ভাইরাস মারাত্মক। করোনার টিকা আছে। কিন্তু পিএনপিসির ভ্যাকসিন আজও আবিষ্কৃত হয়নি। আর এই ভাইরাসের সবচেয়ে বড় শিকার হলো পুলিশ।
লেখা বাহুল্য হলেও বলা দরকার, কী একটা অজানা ‘ঐতিহাসিক’ কারণে ‘পুলিশ’ শব্দটা শুনলেই সমাজের কিছু মানুষের পিএনপিসির খাহেশাত বেড়ে যায়। এই লোকদের কাছে পুলিশের কমবেশি আড়াই লাখ সদস্যের সামগ্রিক কাজ কোনো বড় ঘটনা না। আড়াই লাখ সদস্যের সমন্বিত বিরাট বিরাট অর্জন কোনো ঘটনা না। সেই আড়াই লাখ সদস্যের মধ্যে যে ‘আড়াইজন’ সম্পূর্ণ ব্যক্তি পর্যায়ের অনিয়ম অপরাধে জড়িয়ে পড়ে সেই অপরাধই হচ্ছে তাঁদের কাছে বড় ঘটনা। সেই অপরাধের দায় গোটা বাহিনীর ঘাড়ে চাপিয়ে পরনিন্দা, পরচর্চার মধ্যেই যেন তাদের পাশবিক সুখ উপভোগের সবচেয়ে বড় সুযোগ নিহিত।
প্যারাডক্স হলো পুলিশ প্রসঙ্গ উঠলেই নিন্দা-মন্দ গাওয়া এই কিসিমের লোকেরা বিপদে পড়ার পর প্রথমেই যাঁদের কাছে ছোটেন তাঁরা হলেন পুলিশ। বিপদ থেকে পুলিশ যখন তাদের উদ্ধার করে, বিপদ যখন কেটে যায়, তখন তাঁরা বলেন, ‘পুলিশ তার ডিউটি করেছে, এ আর এমন কী?’
তাদের এই কথায় অন্যায্য কিছু নেই। পুলিশ তার কর্তব্য করবে এবং কারও ধন্যবাদ পাওয়ার আশা না করেই তারা তা করবে। কিন্তু সমস্যা হলো, যে অপরাধ অনিয়মের ভাগীদার পুলিশ বাহিনী নয়, যে নিন্দা সমষ্টিগতভাবে পুলিশ বাহিনীর প্রাপ্য নয়, সেই নিন্দাই বছরের পর বছর পুলিশের গায়ে ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে। আর যাঁরা ছুড়ছেন, তাঁরা হলেন পুলিশেরই উপকার নেওয়া ‘পিএনপিসি আক্রান্ত’ মানুষ।
দক্ষিণবঙ্গে একটা প্রবাদ খুব চালু আছে। ‘যারে নেন্দো, তারে পেন্দো’। মানে, যাঁর নামে দুর্নাম-বদনাম রটিয়ে বেড়াও, শেষমেশ তাঁর কাছেই সাহায্যের জন্য হাত পাততে হয়।
যেহেতু মনের মধ্যে আগে থেকেই পুলিশ সম্পর্কে খারাপ ধারণা বাসা বেঁধে আছে, সেহেতু সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে খানিক উনিশ-বিশ হলো। এই নিন্দুকেরা তখন ব্রিটিশ আমল থেকে এ পর্যন্ত পুলিশের কী কী ভুল আর কী কী খারাপ দিক আছে সব উগরানো শুরু করেন। তাঁরা নিজেরাই তখন প্রশ্ন করেন, দেশে তো আরও বহু সংস্থা, বহু প্রতিষ্ঠান আছে। তাঁদের বিষয়ে তো এত অভিযোগ ওঠে না!
যাঁদের কাছে এই প্রশ্নের সদুত্তর নেই, তারা বলবেন কথা তো ঠিক। আরও তো কত সরকারি কর্মী আছে, তাদের তো গড়ে হরিবোলে সমালোচনা করা হয় না।
পুলিশ বাহিনীতে যাঁরা যোগ দেন, তাঁরা আসমান থেকে নামেন না। তাঁরা দেশের সাধারণ পরিবার থেকে যাওয়া মানুষ। সুশৃঙ্খল বাহিনীর মধ্যে থেকেও সেই হাজার হাজার মানুষের মধ্য থেকে দু-একজন শৃঙ্খলার ব্যত্যয় ঘটান। আর সেই বিচ্ছিন্ন দু-একজনের অনিয়ম দিয়ে আড়াই লাখ মানুষের বাহিনীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর মধ্যে পৈশাচিক আনন্দ খোঁজা মানুষের সুস্থতা নিঃসন্দেহে প্রশ্নবিদ্ধ।
ধারণা করি, পুলিশ সম্পর্কে এই নেতিবাচক ধারণা বা ভাষ্য প্রতিষ্ঠার পেছনে অন্যদের পাশাপাশি লেখকদেরও বড় অংশ কাজ করেছে। রাজশেখর বসু ‘শিবলাল’ নামক লেখায় লিখেছেন, ‘পুলিশের হাসি দুর্লভ’। ‘কমলাকান্তের জল্পনা’তে প্রমথনাথ বিশী লিখেছেন, ‘পুলিশ ও লোকাল ট্রেন কদাচ সময়মতো আসে’। খোদ রবীন্দ্রনাথ ‘ছোট ও বড়’ নামক লেখায় লিখেছেন, ‘পুলিশ একবার যে চারায় অল্পমাত্র দাঁত বসাইয়াছে সে চারায় কোনো কালে ফুলও ফোটে না, ফলও ধরে না। উহার লালায় বিষ আছে।’
এই ধরনের বহু উদ্ধৃতি দেওয়া যাবে, যা এই একুশ শতকের আধুনিক জনবান্ধব পুলিশ বাহিনীর শত শত মহান উদ্যোগ ও শত শত আত্মত্যাগের মহিমার বিকাশের গতিকে শ্লথ করে রেখেছে।
ব্রিটিশ আমলে পুলিশ সদস্যদের ব্যবহার করে জোর করে খাজনা আদায় করা হতো। সে সময়ের সেই বদনামের রেশ বহুদিন ছিল। সেই রেশ ধরে শিল্প-সাহিত্যে পুলিশকে একটি নেতিবাচক ভাষ্যে দাঁড় করানোর চেষ্টা হয়েছে।
কিন্তু সেই ভাষ্য এখন আর টিকছে না। এই সময়ে বাংলাদেশ পুলিশ যে কোনো অর্থেই জনবান্ধব ও জনঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ৯৯৯ জাতীয় জরুরি সেবার বদৌলতে প্রতিদিন যে পরিমাণ মানুষ উপকৃত হচ্ছে, শুধু সেটাকেই বিবেচনায় আনলে পুলিশের ‘ফুটো খোঁজার’ প্রবণতা কোনো বিবেচনাসম্পন্ন মানুষের থাকার কথা না।
কিন্তু সে কিসিমের লোক আগেও ছিল। এখনো আছে। হয়তো ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু বাংলাদেশ পুলিশ তার দীর্ঘ যাত্রাপথ পাড়ি দিয়ে আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, সেখানে ছিদ্রান্বেষী পিএনপিসি আক্রান্ত মানুষেরা অচিরেই বিলীয়মান প্রজাতিভুক্ত হয়ে যাবে বলে মনে হয়।
লেখক ও সাংবাদিক