অমিতাভ চৌধুরী
বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশ আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। ষড়ঋতুর এই দেশে প্রতিটি ঋতু আমাদের দেহ ও মনকে স্পর্শ করে যায়। প্রবল গ্রীষ্মের পরে শীতের আগমনের মাঝে আসে শরৎকাল। বর্ষার পরেই শরতের আগমন আমাদের মনে এক রোমাঞ্চকর ভাব নিয়ে আসে। আমরা ঢাকের বাদ্য শুনতে পাই। ঢাক, কাঁসর যতই উচ্চকিত হতে থাকে, ততই ঘনিয়ে আসে দুর্গেশনন্দিনী মা দুর্গার আগমনকাল। গ্রীষ্মের প্রবল দাবদাহ, নানা ধরনের ব্যাধি-সবকিছুকে নিরাময় করে দেবী দুর্গার আগমন ঘটে। গ্রামবাংলা মুখরিত হয় নানা ধরনের আনুষ্ঠানিকতায়। পূজামন্ডপ একেবারেই নতুন সাজে সজ্জিত হয়, সন্ধ্যায় আরতিতে এক বর্ণাঢ্য আয়োজনে আবালবৃদ্ধবনিতা যুক্ত হয়ে যায়। হিন্দুর সর্বপ্রধান এবং সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। আনন্দময়ী দুর্গতিনাশিনী মা দুর্গার আগমন বার্তায় চরাচর আনন্দমুখর হয়ে ওঠে।
ঢাকে যেই পড়লো কাঠি,
হয়ে যায় জমজমাটি;
আলোরই খুশির রঙে সব।
ধুনুচি নাচের তালে,
নাচে মন সাতসকালে;
আমাদের এ দুর্গোৎসব।
শারদীয় দুর্গাপূজার প্রধান আবেদন হলো ‘দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন’, অর্থাৎ সব অশুভ শক্তির নির্মূল করার জন্যই পৃথিবীতে প্রতি বছর দুবার দেবী দুর্গার আগমন প্রাচীনকাল থেকে হয়ে আসছে। বছরের চৈত্র মাসে বসন্তকালে বাসন্তী দেবী নামে পৃথিবীতে আবিভূর্ত হন, যা হিন্দু সম্প্রদায় বাসন্তী পূজা হিসেবে আরাধনা করে থাকেন। কিন্তু বাসন্তী পূজার ব্যাপকতা শরৎকালের আশ্বিন-কার্তিক মাসে অনুষ্ঠিত দুর্গাপূজার মতো আবেদন ও জাঁকজমকপূর্ণ হয় না। হিন্দু পুরাণে আছে রামচন্দু রাক্ষস রাজা রাবণকে বধ করার জন্য আশ্বিন মাসে মা দুর্গার আরাধনা করেছিলেন তখন থেকেই দুর্গাপূজার প্রচলন শুরু হয়। স্বাধীনতার পর সারাদেশের পূজার সংখ্যা ছিল চার-পাঁচ হাজারের মতো। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পূজার সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এবছর সারা দেশে প্রায় ৩২ হাজার পূজা অনুষ্ঠিত হবে।
বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মতে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির বিজয়ে মা দুর্গার মর্ত্যে আবির্ভাব। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে দেবী দুর্গা পরম ভক্তিময়। তাঁর এক রূপ অসুরবিনাশী, আরেক রূপ মমতাময়ী মাতার। তিনি অশুভর প্রতীক অসুরদের দলপতি মহিষাসুরকে বধ করে দেবকুলকে রক্ষা করেছিলেন। আমাদের বিশ্বাস, এর মধ্য দিয়ে অন্যায়- অশুভর বিপরীতে ন্যায় ও শুভশক্তির জয় হয়েছিল। তিনি কেবল সৌন্দর্য-মমতা-সৃজনের আধারই নন, অসহায় ও নিপীড়িতের আশ্রয় দানকারী বলেও গণ্য হন।
মহিষাসুর হিন্দুপুরাণে বর্ণিত আসুরিক ও পাশবিক শক্তিতে বলীয়ান একটি চরিত্র মহাশক্তিধর এই অসুরশক্তি দেবতাদের দূরীভূত করে দেবলোক দখল করে নেয়। চন্ডীতে বর্ণিত মহিষাসুরমর্দিনী হলেন আদ্যাশক্তি মহামায়া। দেবকুলের একত্র তেজরশ্মির আলোকপুঞ্জ থেকে আবির্ভূত হন এক দেবীমূর্তি।
সব দেবতার অস্ত্রে সুসজ্জিত এই দেবীমূর্তি দশভুজা দুর্গা মহিষাসুর বধ করে দেবলোক পুনরুদ্ধার করেন।
পূজার আনন্দ ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীতে তুঙ্গে উঠে যায়। দশমীতে বিসর্জনের বিষাদ নেমে আসে। বিসর্জন শেষে মা দুর্গার বিদায়ের পরে জনজীবনে এক নতুন প্রেরণা নিয়ে দিন শুরু হয়।
দুর্গাপূজায় যেহেতু সব ধর্মের মানুষের পরোক্ষ অংশগ্রহণ থাকে, তাই এটি পরিচিত হয় শারদীয় উৎসব হিসেবে। যেসব বাঙালির উৎসবে অসাম্প্রদায়িকতা খুঁজে পাওয়া যায়, তার মধ্যে দুর্গাপূজা অন্যতম।
বাঙালি সমাজে সেই প্রাচীনকাল থেকেই দুর্গাপূজাকে সর্বজনীন করার প্রচেষ্টা ছিল। যে কারণে বারবার একটি শব্দ উচ্চারিত হয়, তা হলো সর্বজনীন। সর্বজনীন বলতে শুধু যে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বোঝায় না, তা আয়োজনের মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়। হিন্দু সম্প্রদায় দেবীপক্ষের সূচনায় মা দুর্গাকে আবাহন জানায়। লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ ও স্বামী শিবকে নিয়ে সপরিবারে কৈলাস থেকে মা আসেন মর্ত্যলোকে তাঁর পিত্রালয়ে। পঞ্জিকামতে, দেবীপক্ষের পাঁচ দিন পর মায়ের অকালবোধন।
ত্রেতাযুগে শ্রীরামচন্দু রাবণ বধের জন্য অকালে দেবী দুর্গার পূজা করেছিলেন শরৎকালে। সনাতন শাস্ত্র অনুসারে দেবী দুর্গা দুর্গতিনাশিনী। সব দুঃখ-কষ্টের বিনাশকারিণী। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ও সমাজ থেকে অশুভশক্তি বিনাশ করে শুভশক্তি প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে অকালবোধনে দশভুজা মা দুর্গার পূজা করে আশ্বিন বা কার্তিকের শুক্লপক্ষে। বাঙালি যেভাবে দুর্গা পূজাকে আত্মস্থ তথা জীবনের অঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করেছে, তেমনভাবে আর কেউ করতে পারেনি। মাতৃরূপে বা শক্তিরূপে মা দুর্গা যেমন বাঙালির অন্তর জুড়ে বিরাজ করছেন, তেমনি কন্যারূপে উমা বাঙালির সংসারে এক অভূতপূর্ব আবেগের সঞ্চার করেছে। কথিত আছে, গিরিরাজ হিমালয় ও তাঁর স্ত্রী মেনকা কন্যা উমা বা পার্বতীকে বিয়ের পর কৈলাসে শিবের ঘরে পাঠিয়েছিলেন। বৎসারান্তরে সেই কন্যাকে দেখার জন্য মা মেনকার ব্যাকুল প্রার্থনা যেন প্রতিটি বাঙালি পরিবারের সর্বজনীন প্রার্থনায় পরিণত। ঘরের মেয়ে ঘরে আসবে- তাই বাঙালি হিন্দুর ঘরে ঘরে দেখা দেয় আনন্দের শিহরণ। আমাদের এই দুঃখ-দৈন্যের ঘরে শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়ে আসবে মাত্র চার দিনের জন্য-তাই আর সমস্ত দুঃখ ভুলে ঘরে ঘরে আনন্দের পসরা সাজায়, নতুন জামা-কাপড় পরে দুঃখকে বিদায় দিয়ে আনন্দময় হয়ে ওঠে বাংলার আকাশ- বাতাস। এভাবে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে সামাজিক উৎসবে পরিণত করার ঘটনা পৃথিবীতে আর কোথাও পাওয়া যাবে না। মা দুর্গাকে বরণ করে নেওয়ার জন্য বাঙালির আগমনী সংগীত আমাদের জীবনপ্রবাহে মিশে যাওয়া এক অবিচ্ছেদ্য ধারা। এর তাৎপর্য হৃদয় দিয়ে, গভীর বোধ দিয়ে অনুভব করতে হয়। ধর্মীয় অনুশাসন ও বিশ্বাসের বাইরের এ বোধ। এটাই চিরন্তন মানবিক মূল্যবোধ।
ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী বছরে দুই বার দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। শরতে শারদীয় দুর্গাপূজা আর বসন্তে হয় বাসন্তী পূজা। মেধামুনির আশ্রমে রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য কর্তৃক প্রথম প্রতিমার পূজাই বাসন্তী পূজা নামে অবিহিত। আর শ্রী রামচন্দু রাবণ বধ করে সীতা উদ্ধারের জন্য দক্ষিণায়নে শরৎকালে ১০৮টি নীল পদ্মে পূজিত হন দেবী। রামচন্দু দেবতাদের শয়নকালে দেবীকে নিদুা থেকে জাগ্রত করে পূজা করেছিলেন বলে এটি অকাল বোধন নামে পরিচিত। শরৎকালে রামচন্দেুর এই পূজাই আমাদের শারদ উৎসব হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। যা এখন অবধি চলমান।
বাঙালি হিন্দুদের মাঝে কবে এই পূজার প্রচলন তার তথ্যানুসন্ধানে জানা যায় যে, মোঘল সম্রাট আকবরের সুবেদার রাজা কংস নারায়ণ রায় বাংলার দেওয়ান ছিলেন। তিনি পন্ডিত রমেশ শাস্ত্রীর পরামর্শে মহাযজ্ঞ না করে দুর্গাপূজা করেছিলেন। ব্যক্তিগত পূজায় যখন সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার সীমিত হয়ে পড়ে তখনই প্রয়োজন হয়ে পড়ে সার্বজনীন পূজা আয়োজনের। ১৭৯০ সালে হুগলী জেলায় ১২ জন বন্ধুর প্রচেষ্টায় প্রথম বারোয়ারি পূজার আয়োজন। তারপর থেকেই এই পূজা পরিণত হয় সার্বজনীন উৎসবে।
এবছরে ১১ অক্টোবর ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে দুর্গাপূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। এরপর ১২ অক্টোবর সপ্তমী। মহাষ্টমীর পূজা ১৩ অক্টোবর (বুধবার)। নবমী পড়েছে বৃহস্পতিবার (১৪ অক্টোবর)। ১৫ অক্টোবর উদযাপিত হবে বিজয়া দশমী। এবারও শিশির ভেজা দুর্বাঘাসের ওপর ঝরে পড়া বকুল ফুল কুড়ানোর সময়টাতে মাতৃবন্দনায় মিলিত হবেন মাতৃভক্ত সবাই। ইতোমধ্যে শিল্পীদের দক্ষ হাতের ছোঁয়ায় পূর্ণরূপে ফুটে উঠেছে দৃষ্টিনন্দন অধিকাংশ প্রতিমা। সারা দেশে চলছে প্রতিমা গড়ার কাজ। এ কাজে খুবই ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রতিমা শিল্পীরা।
মৃৎশিল্পী জানিয়েছেন, দেবী দুর্গা আসছেন অন্ধকার আচ্ছন্ন পৃথিবীকে আলোকিত করতে। ঢাক, ঢোল, শঙ্খধয়নি আর উলুধয়নি দিয়ে দেবীদুর্গাকে বরণ করে নেওয়ার অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন ভক্তরা। নিজেদের মনের মতো করে প্রতিমার নকশায় নিজেকে সেরা শিল্পী হিসেবে তুলে ধরতে দিন-রাত পরিশ্রম করে ব্যস্ত সময় পার করছেন কর্মরত মৃৎশিল্পীরা। প্রতি বছরের মতো এবারও ধর্মীয় প্রথা অনুযায়ী ১১ অক্টোবর থেকে শারদীয় দুর্গোৎসবের আয়োজন চলবে।
প্রতিবার পূজামন্ডপে পূজারীদের মায়ের কাছে ব্যক্তিগত সুখ-সমৃদ্ধি চাওয়া-পাওয়া প্রত্যাশা থাকলেও এবার সব চাওয়া পরিণত হয়েছে করোনা সংকট থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রার্থনায়।
দেশ ও জাতির সমৃদ্ধি কামনার পাশাপাশি বাঙালির জীবনে আবার যেনো সব উৎসবের আমেজ ফিরে আসে, বন্দিজীবন থেকে পৃথিবীর সব মানুষ যেনো মুক্তির আলোতে ফিরে আসে-মা দুর্গতিনাশিনীর কাছে এমন প্রার্থনা ছিলো সবার। সবাই মিলে নিরুপদুবে ইচ্ছে মতো পূজার আনন্দে শামিল হতে পারলে উৎসব তার প্রকৃত তাৎপর্য ফিরে পাবে। আর এখান থেকেই নতুন করে আগামী এক বছর চলার শক্তি ও পাথেয় সংগ্রহ করে মানুষ আবার নতুন করে জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে। সংসারের সব অসুরকে হারিয়ে নতুন এক উজ্জ্বল, উচ্ছ্বল জীবনবোধে উদ্বেল হয়ে শুরু হবে নতুন করে পথ চলা।
সত্যি বলতে, বর্তমান সময়ে পৃথিবীতে করোনা নামক মহামারি পুরো বিশ্বকে কিছুটা হলেও থামিয়ে দিয়েছে। মা দুর্গার আগমনে মহামারিসহ সব ধরনের অনাচার ধুয়ে-মুছে যাক- এটাই কামনা। মায়ের আগমনের মধ্য দিয়ে আমাদের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন আরো দৃঢ় হোক এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হোক। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট থাকুক এবং শুভ শক্তির জয় হোক।
পাঁচদিনব্যাপী এই উৎসব শেষে এবছর দেবী দুর্গা দোলায় চড়ে বিদায় নেবেন মর্ত্য থেকে তখন ভক্তকুল বিসর্জনের মাধ্যমে দুর্গতিনাশিনীকে শ্রদ্ধাভরে এগিয়ে দেবেন কৈলাশের পথে আর বলবেন, ‘আসছে বছর, আবার হবে।’
লেখক : উপ-পুলিশ পরিদর্শক, ঢাকা রেঞ্জ অফিস ও
সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য, ডিটেকটিভ।
0 Comments