মোছাঃ ফরিদা ইয়াসমিন
॥২॥
ধর্ষক (২৫-৪০)
পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার এই সমাজে পুরুষকে পরিবারের তথা সমাজে হতে হবে বলশালী, নিপীড়ক নির্যাতনকারী, হুকুমদাতা, কর্তা, একচ্ছত্র অধিপতি, পৈশাচিক বলে বলীয়ান এবং একই সাথে অন্যায়ভাবে সুবিধাভোগী। কোন সমাজে যখন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কোন একটি নির্দিষ্ট লৈঙ্গিক পরিচয়ের মানুষকে অসম সুবিধা এবং সম্মান ভোগ করার রীতি অত্যন্ত যত্ন সহকারে লালন করা হয় তখন ঐ লৈঙ্গিক পরিচয়ের অধিকারী ব্যক্তি কখনো সচেতনভাবে, কখনো কখনো মজ্জাগতভাবে (mindsetting) পাশবিক মানসিকতার আচরণ করে। যোগ্যতা এবং ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা মানুষের পাশবিক আচরণের (lower instincts) নগ্ন বহিঃপ্রকাশকে উৎসাহিত করে। ফলশ্রুতিতে যে সকল নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোতে কায়িক শ্রম উপাজর্নের একমাত্র উৎস সেখানে পুরুষ কর্তৃক পরিবারের বিভিন্ন বয়সের নারীরা, অনেক ক্ষেত্রে দূরের কর্মক্ষেত্রে স্বামীর অবস্থানের কারণে কিংবা একাকীত্বের সুযোগ নিয়ে শ^শুরবাড়ির লোকজন, প্রতিবেশী-ভাড়াটে বা ভার্চুয়াল জগতের বন্ধু কর্তৃক সম্মতি বা অসম্মতিতে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে দিনের পর দিন। এজন্য অনেকের সংসারে অশান্তি ও বিচ্ছেদ দেখা দিচ্ছে। এই ধরণের ধর্ষক মোটামুটি নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সব পরিবারে ও সমাজেই দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে অল্প বয়সী মেয়ের সাথে এই বয়সী পুরুষের বিবাহের পর স্বামী কর্তৃক ধর্ষণের দাসত্বে নারীটি দিনাতিপাত করে। প্রান্তিক ও নিম্নবিত্ত পরিবারের নারীদের মধ্যে এ ঘটনা বেশী হয়।
ধর্ষক (৪০-তদুর্ধ্ব)
ধর্ষকগণ সাধারণত কোমলমতি শিশু, অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে, কোন কোন ক্ষেত্রে উঠতি বয়সী ছেলে শিশুকে সুগার বা হানি ড্যাডির মতো আচরণ করে প্রলোভনে ফেলে তাদের অজান্তে ধর্ষণ বা যৌন হয়রানি করে বিকৃত লালসা চরিতার্থ করে। এই ধর্ষক সব শ্রেণী-পেশা-ধর্ম-বর্ণ-অবস্থানের মধ্যে বিরাজমান। এরা জীবন-যৌবনের সংকটে অথবা কোন মানসিক টানা-পোড়নে অথবা শারীরবৃত্তির কোন সংকটে নতুনত্বের আস্বাদনে এ ধরণের কর্মকান্ডে অতিসহজেই লিপ্ত হয়। অথবা একঘেয়েমি জীবনের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে, কেউ বা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে হতাশাগ্রস্থ হয়ে, বিত্ত-বৈভবের বিলাসিতায় পুনরায় নতুন যৌবনের মোহে, মাদকাসক্ত হয়ে অথবা হাতের মুঠোয় নিত্য-নতুন ঝলকানো ভার্চুয়াল জগতে নেশাগ্রস্থ হয়ে বাস্তবে তার প্রতিফলনেরর জন্য প্রতিবেশী, গৃহকর্মী, নাতি-নাতনী, ভাগ্নি, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, ক্লাব বা বার ড্যান্সারদের বা ম্যাসেসপার্লার এর নারী কর্মীকে বিভিন্ন প্রলোভনের মাধ্যমে কব্জা করে বিকৃত যৌনাচার চালায়। এ ধরণের নিপীড়নকারী পূর্ব-পরিকল্পিত ইচ্ছা ও তাৎক্ষণিক সুযোগ দুটোকেই কাজে লাগায়। মামলা পরিসংখ্যানে দেখা গেছে অনেকে উচ্চবিত্ত, নামকরা সামাজিক ও পারিবারিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিও ধর্ষক হয়ে আইনের কাঠগড়ায় দন্ডিত হতে। এই ধরণের ধর্ষকের পাশে কোন পারিবারিক সাপোর্ট থাকে না। স্ত্রী-পুত্র-কন্যারাও মুখ ফিরিয়ে নেয়। কোন কোন ক্ষেত্রে ধর্ষিত নারী বা শিশুও ভয়ে মুখ খোলে না। আর ঘটনা ঘটলেও ধর্ষক কিভাবে যেন মীমাংসা করে ফেলে। আবার মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবারের আংকেল, নানা-দাদা-সৎ বাবা এ কাজে লিপ্ত হয়। উদাহরণস্বরূপ: ১০ বৎসর বয়সী আপন নাতনীকে ধর্ষণ করার পর মামলা হলে তিনি আত্মহত্যা করে ফেলেন। অনেক সময় এই বয়সীদের গ্রেফতার করলে দেখা যায় জীবনে হয়তো তিনি প্রথমবার এই জঘন্য কাজটি করেছেন; কেন করেছেন তা বুঝতেই পারছেন না, আবার অনুশোচনাও থাকে না। এ ধরণের ধর্ষকরূপী নিপীড়নকারীর রোষানলে যে শিশু বা নারী পতিত হয়, পরবর্তীতে তার মনো-দৈহিক অবস্থা ভয়ংকররূপ ধারণ করে।
সব বয়সের বিকারগ্রস্থ ও নেশাগ্রস্ত ধর্ষক
এই ধরণের ধর্ষক সব বয়সী নারী ও শিশুদের টার্গেট করে অভিশপ্ত কাজটি করে থাকে। যখন তাদের মধ্যে বিকার বা নেশা চাপে তখন ওঁৎ পেতে শিকারের সন্ধানে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। হঠাৎ একাচলা নারী ও শিশুকে অন্ধকার ঝোপের আড়ালে, পতিত বিল্ডিং, ফসলের ক্ষেতে, রেল বা বাসস্ট্যান্ডের পতিত ওয়াগন বা খুপড়ির মধ্যে যেখানেই সুযোগ পায় সংগোপনে মুখ চেপে ধরে বা রুমালের সাথে নিস্তেজকারী ঔষধ মিশিয়ে মুখ বন্ধ করে ঐ স্থানে নিয়ে গিয়ে লালসা মেটায়। কেউ আবার জোর করে জুস বা কোল্ডডিংসের মধ্যে নেশা জাতীয় দ্রব্য মিশিয়ে খাইয়ে নিস্তেজ করে অভিশপ্ত ঘটনাটি ঘটায়। ঝাঁড়-ফুকের নামে কবিরাজ বা কথিত পীর-দরবেশ নারীদের বশীকরণ করে যৌন হয়রানী করে থাকে। অনেক কবিরাজ-পীর নারীদের শ্লীলতাহানির মাধ্যমে কব্জা করে অন্যদের দ্বারা জোরপূর্বক দেহ-ব্যবসা চালায়। যেসব মেয়েরা দমননীতির মাধ্যমে দেহ ব্যবসা করতে বাধ্য হয় তা এক রকম ধর্ষণের নামান্তর এবং আইনের সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত হয়। বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়, এই ঝলমলে শহরেও সন্ধ্যার পর অভিজাত এলাকার ব্যস্ততম একটা সড়ক থেকে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের একজন শিক্ষার্থীকে একটা কুরুচিপূর্ণ নেশাগ্রস্ত লোক দ্বারা সংলগ্ন ঝোপে ধর্ষণ করার বিষয়টি কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। আবার বিভিন্ন রেলস্টেশনের পরিত্যক্ত ওয়াগনে বা নির্মাণাধীন কোন ভবনে অসহায় প্রতিবন্ধী নারী ও শিশুকে নিয়ে দলগতভাবে ধর্ষণ অমানুষতা ও অমানবিকতারই নামান্তর। ছুটিরদিনে বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে যাওয়া নারী ও শিশুরা ঢাকায় পাশ্ববর্তী এলাকা, যেমন-বাউনিয়া, মিরপুর বেড়ীবাঁধ, বালুরমাঠ, দিয়াবাড়ি বা কোন নির্জন দর্শনীয় স্থানে কিংবা নৌ-ভ্রমণে গিয়েও অভিশপ্ত দলগত ধর্ষণের শিকার হতে হয়।
দীর্ঘদিনের পেশাগত অভিজ্ঞতায় শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের শিকার নারী ও শিশু আমাদের নিকট আসলে প্রথমে যে জিনিসটি আমি লক্ষ্য করেছি তা হলো অপরাধবোধে ভোগা বা নিজেকে দোষারোপ করা। বিশেষ করে নারীটি বলে কেন আমার এটা হলো। আমি হয়তো তার সাথে সম্পর্ক না করলে, ওখানে না গেলে এমনটি হতো না। অথবা কেন সে আমার সাথে এমনটি করলো, তাকে তো বিশ্বাস করেছিলাম। বিশেষ করে ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের শিকার বেশীরভাগ ভূক্তভোগী (Survivors) (কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া) আপনজন বা কাছের লোক দ্বারাই পরিচিত পরিবেশে নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন। এমনকি কোন কোমলমতি শিশুও যদি পরিচিতজনদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, যদি শিশুটি বোধসম্পন্ন না হয়-তাহলে পরিবারের লোকজন শিশুটিকেই দোষারোপ করতে থাকে। বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে রাখে যাতে অন্য কেউ জানতে না পারে এবং সামাজিকভাবে যেন হেয় প্রতিপন্ন না হয়। কিন্তু ধামাচাপা দিতে দিতে উক্ত নারী বা শিশুটির পরবর্তী জীবনের পরিনতি কি হয় তা কেউ বুঝতে পারে না। পরিবারের লোকজন একঘরে হওয়ার যন্ত্রনায় ধুঁকে ধুঁকে নিষ্পেশিত হয়। কোন পরিবার বা এই বোঝা বহন করতে না পেরে নৃশংসতার শিকার নারী বা শিশুটির উপস্থিতি কামনা করে না। অনেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যান বা পরিবার ঠেলে তাকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেয়। সামাজিকভাবে কলঙ্কিত হওয়ার ভয়ে আমাদের কাছে আগত নৃশংসতার শিকার নারী বা শিশুটিকে তার পরিবার ফিরিয়ে নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছিলেন। পরিবার বঞ্চিত বা পারিবারিক সেবার অধিকারহীন কিছু নারী বা শিশুর অভিজ্ঞতায় আমাদের অনেক তথ্য-উপাত্ত আছে। অনেকসময় মানসিক টানাপোড়নের বোঝা বহন করতে না পেরে আতœহননের দিকে নিজেকে ঠেলে দিয়ে যাপিত জীবনের ঝামেলা মেটায়। উদাহরণস্বরূপ: রেল লাইনের উপর থেকে আত্মহত্যার হাত থেকে উদ্ধারকৃত নারী আমাদের কাছে বিলাপ করে বলেন, “কেন আপনারা আমাকে বাঁচালেন, আমার এ জীবনের কোন মূল্য নেই। আমি বাঁচতে চাই না।”
কত যৌন নিপীড়নের শিকার নারী আমার কাছে চুপিসারে দেখা করতে এসেছিল-শুধু মানসিক যাতনা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য। তার মনের গহীনে এমনি ক্ষত হয়েছিল যে বলার জায়গাটুকুও তার ছিল না। পরিবারসহ অন্য কারো নিকট প্রকাশের আস্থা পায়নি। নিজেই আমার অফিসের দরজা বন্ধ করে ঝরঝর করে কেঁদেছিল। তাকে আমি কাঁদতে দিয়েছিলাম-ভাঙতে দিয়েছিলাম। আমাকে জড়িয়ে যে কথাগুলো বলেছিল-তার সারাংশ হলো-‘ঐ ধরণের মুহুর্ত তাকে এতটাই বিপর্যস্থ করেছিল যে-সে সময়ে যা করা উচিত ছিলো তা করতে পারেনি।’ দীর্ঘদিন সে ট্রমা বহন করতে করতে তার ভেতর প্রতিশোধের বিশাল ক্ষোভ জন্মেছিল। তার চোখের সামনে দিব্বি ঐ নোংরা লোকটি চলাফেরা করতো ভালোমানুষ সেজে। সবাই জানতো সে একজন ফেরেস্তার মত সাধু লোক। পরের উপকার করে বেড়ানো জনদরদী সমাজসেবক। সে আরো বলেছিল, “তাকে আঘাত করতে চাইলে জানি সে আহত হবে না; কারণ তার ভেতর অপরাধবোধের কোন ছায়া নেই।” নিম্নবিত্ত পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থী মেয়েটি অসহায়ত্বের জন্য আংকেলরূপী এক ব্যক্তির নিকট থেকে পড়ালেখার খরচ নিতে নিতে মানসিক ও আর্থিকভাবে নির্ভরশীল হতে থাকে। একপর্যায়ে সচ্ছল আংকেলের দুরভিসন্ধি বুঝতে পারে। পড়াশোনা ও উচ্চাকাংখার মাঝপথে হঠ্যাৎ তরুণীটি বুঝতে পারে সে আংকেলের রোষানলে পড়েছে। প্রথমে তরুণীটি বয়সের অনভিজ্ঞতার জন্য বুঝে উঠতে পারে না কিভাবে মোহগ্রস্থ হয়েছে। পরিবারসহ তাকে সহযোগিতার নামান্তরে আংকেলটির ভেতরের নোংরামী তার জন্য উৎপীড়িনের চরম আকার ধারণ করে। আংকেলের নেশা ও খেয়ালের দাসত্বের শিকার তরুণীটি পরিবারের অসচ্ছলতা ও অসহায়ত্বের কথা ভেবে সহ্য করতে করতে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে। পরে আমাদের আশ্রয়ে সেই সম্পর্কের পরিসমাপ্তি ঘটায়। তবে ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে পরবর্তীতে সে কিভাবে আত্মীকরণ হয়েছে তার খবর কতজনই বা রাখছে।
(চলবে)
লেখক : উপ-পুলিশ কমিশনার
(প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড এন্ড ইন্টারনাল ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন)
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, ঢাকা।
0 Comments