মোছাঃ ফরিদা ইয়াসমিন
ধর্ষণ শুধুমাত্র কোন নারীর দৈহিক নির্যাতন এবং যৌন নিপীড়ন নয় ধর্ষণ হচ্ছে একজন নারীর মনুষ্যত্বকে ভূলুন্ঠিত করা, নারীর মনোজাগতিক সৌন্দর্যকে ক্ষতবিক্ষত করা; ধর্ষণ হচ্ছে নারীকে কালিমাপূর্ণ অন্ধকুপে নিক্ষেপ করা যেখানে সে শুধু আধার দেখতে পায় চারিদিকে। ধর্ষণ হলো প্রতিক্রিয়াশীল সমাজব্যবস্থায় নারীকে কলঙ্কিত করা। তাকে সমাজবিচ্ছিন্ন ও জীবনবিচ্ছিন্ন করা; ধর্ষণ হলো সারাজীবন এই নির্যাতনের নারকীয় ঘটনার জন্য নারীর আত্মগ্লানিতে ভোগা। ধর্ষণ হলো নারীকে সবচেয়ে জঘন্যতম উপায়ে জৈবিকভাবে জীবিত রেখে নৃশংসভাবে হত্যা করা।
সমাজ, সভ্যতা আর সংসারে নারী-পুরুষের উপস্থিতি একে অন্যের পরিপূরক। শুধু পুরুষ বিহীন সমাজ যেমন অসম্ভব, তেমনি নারীবিহীন সমাজ-সংসার অসম্ভব ও অবাস্তব। যেখানে একটা নারী বা শিশু সমাজ, সভ্যতা ও সংসারের ধারক ও বাহক সেখানে সেই নারী বা শিশুটি ঘরের চার দেয়ালে বা চারপাশের মধ্যে তার আপনজন বা প্রতিবেশী বা পরিচিতজন বা অপরিচিতজনের দ্বারা ধর্ষণ নামক ঘটনার শিকার হচ্ছে। ধর্ষণকে শুধু আইন-আদালত-মানবতা দিয়ে ঠেকানো যাচ্ছে না। কেননা ধর্ষক ব্যক্তিটি কোন না কোন পরিবারের ভাই-স্বামী-সন্তান বা আপনজন যারা নারী বা শিশুর জীবনের প্রতি হুমকীস্বরূপ। আবার অভিশপ্ত সাময়িক মোহ বা বিকৃতির জন্য ঘরের প্রিয় ব্যক্তিটিই ধর্ষণকারী হয়ে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন ও বিচারে সর্বোচ্চ কঠোর শাস্তি নিয়ে বিপন্ন জীবনযাপন বা মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হচ্ছে। তারপরও ধর্ষণ নামক জঘণ্য ঘটনাটি বন্ধ হচ্ছে না। কোন কোন ক্ষেত্রেসমাজ-সংসারে নারীকে এখনও পূর্ণ একজন মানুষ হিসেবে দেখা হচ্ছে না। নারীকে কখনও অর্ধ মানবী বা দেবী রূপ দিয়ে ভোগের সামগ্রী মনে করা হচ্ছে, আবার কখনো দানবী ভেবে পুড়ে-পুতে মারা হচ্ছে। এ থেকে আমরা বলতে পারি নারীর অস্তিত্ব আদৌ এই সমাজ-সংসারে থাকার দরকার আছে কি-না?
যেভাবেই জন্ম হোক অপরাধ অপরাধই। প্রতিটি অপরাধই জঘন্য। আমাদের দন্ডবিধিতে সাধারণত দু’ধরণের অপরাধের কথা বলা আছে মনুষ্য দেহ ও সম্পত্তি সম্পর্কিত অপরাধ। কিন্তু ধর্ষণ হচ্ছে দেহ ও সম্পত্তির মাঝামাঝি ফিকশনে মিশ্রিত এমন একটি নিকৃষ্ট লোমহর্ষক বিকৃতিপূর্ণ মনো-দৈহিক-সামাজিক অপরাধ যা মধ্যযুগীয় বর্বর সামাজিক প্রেক্ষাপটকে মনে করিয়ে দেয় যেখানে ধর্ষণ করে বিকারগ্রস্তদের উল্লাস করতে দেখা যায় ‘ধর্ষণে সেঞ্চুরীকৃত’। এর অর্থ তাদের মধ্যে এক বিকৃত উন্মাদনা কাজ করছে। ছোট্ট শিশুরা ঘরে-বাহিরে পরিচিত-অপরিচিত পুরুষের বিকৃত লালসার শিকারসহ খুন হচ্ছে। প্রতিবন্ধী নারী-শিশুদের প্রতিবন্ধিতার সুযোগ নিয়ে ধর্ষণ করা হচ্ছে। একা দিনে বা রাতে বিচরণকারী নারী-শিশুকে ধর্ষণ করা হচ্ছে। কোন ধর্ষণের ঘটনা পূর্ব-পরিকল্পিত, কোনটা ওত পেতে থাকা, কোনটা একা। আবার কোনটা সংঘবদ্ধভাবে ঘটানো হচ্ছে। কখনো নারী-শিশুর একা চলা, কখনো দুর্বলতা, অসহায়ত্ব ও সরলতার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে ধর্ষণকারীরা। প্রেমের প্রস্তাবে রাজী না হলে প্রতিশোধের বশবর্তী হয়ে ফাঁদ পেতে ধর্ষণ করছে বখাটেরা। আবার সুযোগ বা অনুকুল পরিবেশ তৈরি করে, প্রেমের অভিনয় করে, কিংবা একসঙ্গে বেড়াতে গিয়ে কমবয়সী মেয়েদের ধর্ষণ করে ভিডিও ধারণ করে তাকে কব্জায় নিয়ে বারংবার ধর্ষণ করা হচ্ছে। এ ধরণের ধর্ষণের ঘটনা পূর্ব-পরিকল্পিত ও সংঘবদ্ধতারই প্রতিফলন। কোন ধর্ষণের ঘটনা ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়ে নারী বা শিশুটির জীবন-সংহারে বাধ্য করা হচ্ছে। আজকে নারী শিক্ষা, উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে দেশ যখন উন্নতির সোপানে ধাবমান সেখানে ধর্ষণের মতো অবদমিত ঘটনায় দেশের সঠিক উন্নয়ন বার বার হোঁচট খাচ্ছে নররূপী কিছু বিকৃত পশুর দ্বারা।
কিছু ধর্ষণের ঘটনাকে আমরা বিচ্ছিন্ন বলছি। কিন্তু কোন ঘটনাই বিচ্ছিন্ন নয় যদি সেই ধর্ষণের ঘটনা পরিকল্পিতভাবে আপনজনদের দ্বারা দীর্ঘদিন ধরে হয় কিংবা সংঘবদ্ধ দল যখন বিকৃত ইচ্ছা চরিতার্থ করে উল্লাস প্রকাশ করে, তাদের মধ্যে যখন জানাজানি হওয়ার পরও নূন্যতম অনুতাপের নেশমাত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রচলিত আইন-প্রথা-নৈতিকতা-ধর্ম-রোগ-শোক-জন্ম-মৃত্যু-পাপ-পূণ্যের প্রতি কোন দ্বিধা বা ভয় কাজ করে না। কোন কোন ঘটনায় আমরা দারুণভাবে মর্মাহত ও হতাশাগ্রস্থ হয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও সন্তানের চিন্তায় ভীত হচ্ছি। আবার কেউ কেউ আইন হাতে তুলে নিয়ে ধর্ষকদের গুলি করে মেরে ফেলার পরামর্শ দিচ্ছেÑযদিও তা আইনগতভাবে অগ্রহণযোগ্য।
যে ধরণের ধর্ষণের ঘটনাই ঘটুক না কেন সব কিছুতে সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের অবক্ষয় ধষর্ণের একটি বড় কারণ। পারিবারিক সচেতনতার অভাব এক্ষেত্রে বেশী ভূমিকা রাখে। নিম্ন শ্রেণী বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষার অভাব, মাদকাশক্তি, বেআইনী কর্মকান্ডে লিপ্ত হওয়া তথা সম্পৃক্ততা, অপসংস্কৃতির প্রভাব, পরিচ্ছন্ন পরিবেশের অনুপস্থিতি, সভ্য সমাজের বিপরীতে কুরুচিপূর্ণ ভিডিওর সহজলভ্যতা, উন্মূল বা শেকড়হীন হওয়ায় ঐ জনগোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক সম্পর্কের প্রতি সঠিক দৃষ্ঠিভঙ্গির অভাব। কিন্তু কিছু কিছু রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ তার যৌনকাঙ্খা পূরণের জন্য বিকৃত যৌনাচার করে। প্রান্তিক পরিবার গুলোতে সৎ বাবা, ভাই বা অনেক সময় নিজ বাবা কর্তৃক ধর্ষিতা হচ্ছে মেয়েরা। মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষক দ্বারা শিশু বা ছাত্রী ধর্ষিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দ্বারা ছাত্রী যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। তথাকথিত প্রেমিকের প্রতি বিশ্বস্ততা অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের প্রান্তিক এবং উচ্চবিত্ত কিশোরী মেয়েদের প্রতারণার শিকার করে। এক্ষেত্রে মোবাইলে খুব সহজেই মেয়েটির ভিডিও ধারণ করা হয় এবং পারিবারিক, সামাজিক বদমানের ভয়ে মেয়েটিকে বার বার প্রতারণার শিকার হতে হয়।
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল এবং জনবহুল দেশে বিভিন্ন জাতি-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী-পেশার লোক বসবাস করে। কিন্তু এদেশে বসবাসকারী বিপুল জনসংখ্যার মধ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত, পারিবারিক অনেক ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও সকল শ্রেণীর নারী-শিশুকে যৌন হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। ধর্ষণ সামগ্রিকভাবে অত্যন্ত গর্হিত ও শাস্তিমূলক অপরাধ। ধর্ষণের মতো একটি অপরাধ কেন বাংলাদেশে হচ্ছে সে ব্যাপারে সঠিক আলোকপাত করতে ধর্ষকের মনো-জাগতিক বিশ্লেষণ অত্যন্ত জরুরী। ধর্ষকের বয়স, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থা, আর্থিক অবস্থা প্রভৃতি বিষয় দেখাও সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে বয়স ও ধরণ ভিত্তিক ধর্ষকের কিছু উদাহরণ আলোচনা করা হলো:
ধষর্ক-(১৩-১৭ বছর)
মামলা পর্যালোচনায় দেখা গেছে যেসব ধর্ষক অপ্রাপ্তবয়স্ক, তারা বস্তিতে বসবাসকারী নিম্নআয়ের পরিবারের অন্তর্ভূক্ত; কিংবা উচ্চবিত্ত পরিবারের অতি বিলাসিতায় উচ্ছন্নে যাওয়া সন্তান। নিম্নশ্রেণীর প্রতিটি পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ জীবনের তাগিদে ঘরের বাহিরে কাজ করে কিন্তু তাদের শিশু সন্তানকে হেফাজত দেবার অভিভাবক বা সামজিক অবস্থা কোনটাই তাদের থাকে না। ফলে ৩-১০ বছরের কন্যাশিশুরা এবং তদুর্ধ্ব কিশোরী মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হয় অপ্রাপ্তবয়স্ক প্রতিবেশী ধর্ষক দ্বারা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধর্ষিতা মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে পড়ে সেটি আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় অত্যন্ত ভয়াবহ। এক্ষেত্রে বাদী ও বিবাদী পক্ষের সকলেই নিম্নআয়ের লোক যেমন বস্তিবাসী, কাজের বুয়া, বাদাম-চানাচুর বিক্রেতা কিংবা গার্মেন্টস কর্মী। এ ধরণের পরিবারে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বহুবিবাহ হয়ে থাকে। প্রায়শঃই মহিলারা সামাজিক নিরাত্তার জন্য সন্তানসহ ২য় বা ৩য় বারের মতো বিয়ে করে এবং ৪-৫ জন ছেলেমেয়েসহ একই রুমে মানবেতর জীবন যাপন করে। আবার অর্থ-বিত্তের চাহিদার পরিসমাপ্তিতে গা ভাসানো পরিবারের সন্তান পারিবারিক অনুশাসন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। উচ্চবিত্তশালী পরিবারের অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরী-তরুণীরাও অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর বা তরুণ বন্ধু কর্তৃক খোলামেলাভাবে মেলামেশা করার জন্যও অকালে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। যখনই বিপদে পড়ে তখনই অনেকে আইনের আশ্রয় নিয়ে ধর্ষণের মামলা করে। কিছু ক্ষেত্রে উচ্চবিত্তশালী পরিবারের নারী-পুরুষের মধ্যে অবাধ মেলামেশার জন্য পরিবারের ভাঙ্গন দেখা দেয়। তখন বিচ্ছেদপূর্ণ পরিবারের সন্তানরা অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে বিপথগামী হয়ে পড়ে। এরা হতাশাগ্রস্থ হতে হতে বর্তমানকেই জীবনের সর্বসুখ মনে করে। তাদের বয়স, মন ও চাওয়া-পাওয়া সবকিছুকে ভেঙ্গে-চুরে দিতে চায়। অবাধ মেলামেশা তাদের কাছে নিছক ফ্যান্টাসী। উপরন্তু ইন্টারনেটে অশ্লীল ভিডিওর সহজলভ্যতা এবং মাদকাসক্তি অপ্রাপ্ত বয়স্ক ধর্ষক এর সংখ্যা বৃদ্ধিতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে।
ধর্ষক (১৮-২৫ বছর)
তথাকথিত প্রেমের সর্ম্পক কিশোরী-তরুণীদের নানা প্রলোভনে প্রলুব্ধ করে। সস্তা ও কুরুচিপূর্ণ বাংলা ছায়াছবিতে যেভাবে রিক্সা-ভ্যানচালক, সিএনজিচালক, বস্তির ছেলেকে প্রেমিক এবং নায়ক হিসেবে উপস্থাপন করা হয় সেটাতে অল্প বয়সী ছেলে মেয়েরা (নিম্নআয়ের পরিবারভূক্ত) খুব সহজেই সামাজিক বাধা নিষেধ অতিক্রমে স্বপ্রণোদিত হয়। বিভিন্ন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা ঠিক একইভাবে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে এ ধরণের অপসংস্কৃতির চর্চা করে ফলে অনেক ক্ষেত্রেই অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণ এবং গর্ভপাত এর ঘটনা ঘটছে। অবাধ যৌনাচর বা ভুল যৌনসঙ্গীকে বেছে নেয়া স্বাধীনতার চর্চা বলে ভুল করছে এ প্রজন্মের অনেকেই। আমাদের সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক প্রতিক্রিয়াকে লালন করে আসছে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। সেই সংস্কৃতির মূল থেকে উৎপাটিত হয়ে যখন নতুন প্রজন্ম বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, তখন তার অনভিজ্ঞতা তাকে ভুল পথে চালিত করে। মানুষের মনো-জাগতিক ক্রিয়া অত্যন্ত জটিল এবং কোন ক্ষেত্রে একই ধরণের ঘটনাবলীর জন্য সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন রকম। তাই পারিবারিক বন্ধন এবং সুকুমার বৃত্তির চর্চার কোন বিকল্প পন্থা এ প্রজন্মের জন্য নেই।
লেখক : উপ-পুলিশ কমিশনার
(প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড এন্ড ইন্টারনাল ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন)
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, ঢাকা।
0 Comments