মো. আব্দুল বাতেন, বিপিএম, পিপিএম,
ভারতবর্ষের বিখ্যাত রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন চাণক্য। তাঁকে অনেকে কৌটিল্য বলেও জানে। পণ্ডিত চাণক্য রাজা চন্দ্রগুপ্তকে রাজ্য শাসন, অর্থনীতি, কূটনীতিতে পরামর্শ দিতেন। তাঁর মেধা-প্রজ্ঞা ছিল সর্বজনবিদিত। রাজার এক ঘনিষ্ঠ সভাসদ ছিলেন, যিনি প্রায়ই কলম হারিয়ে ফেলতেন। একপর্যায়ে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন। একদিন তিনি দেখা করলেন চাণক্যের সঙ্গে। খুলে বললেন সমস্যা। চাণক্য সভাসদকে সামর্থ্য অনুযায়ী একটি দামি কলম কিনতে পরামর্শ দিলেন। সভাসদ হীরকখচিত মূল্যবান একটি কলম কিনলেন। প্রায় ছয় মাস কেটে গেল। একদিন চাণক্য সভাসদকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আগের মতোই কলম হারান?’ আশ্চর্য, তিনি কলমটি হারাননি! চাণক্য সভাসদকে বললেন, আসলে তাঁর আচরণে কোনো সমস্যা ছিল না। কলমটি যেহেতু দামি, তাই তিনি এর প্রতি খুব যত্নশীল ছিলেন।
আমরাও ঠিক তেমনই। যে জিনিসকে বেশি মূল্যবান বা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, তার প্রতি বেশি যত্নশীল হই। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে আমরা কোন জিনিস মূল্যবান, তা উপলব্ধি করতে পারি না। চাণক্য বলেছেন, মানবজীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো সময়।
আমাদের প্রত্যেকের কাছে একটি ‘টাইম মেশিন’ আছে। যার বোতাম চেপে আমরা কখনো হারাই সোনালি অতীতে, কখনো ডানা মেলি ভবিষ্যতের স্বপ্নে। স্মৃতি-স্বপ্নের দোলাচল আমাদের কখনো কাঁদায়, কখনো হাসায়।
১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি। আমার শৈশবকাল। আগাম বন্যায় তলিয়ে যায় ফসলের খেত। এমনিতেই আকালের বছর, তার ওপর বন্যায় ফসলহানি। মানুষ চোখে শর্ষে ফুল দেখতে থাকে। আব্দুস সামাদ আজাদ তখন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিপরিষদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। খবর এল তিনি আসছেন। মানুষ আশায় বুক বাঁধে, নিশ্চয়ই নেতা কিছু করবেন। তার চেয়েও বড় খবর, তিনি আসবেন হেলিকপ্টারে!
সকাল থেকে স্কুলের মাঠ লোকে লোকারণ্য। মাঠের মাঝখানে চুন দিয়ে একটি বৃত্ত আঁকা হয়েছে। ওখানেই নাকি হেলিকপ্টার নামবে। আমার মতো অনেকের উদ্দেশ্য হেলিকপ্টার দেখা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। দূরের আকাশে শকুন বা চিল দেখেও জনতার চিৎকার, ওই হেলিকপ্টার আসছে! তারপর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! প্রথমে দূর আকাশে একটি বিন্দুর মতো। তারপর আস্তে আস্তে বড় হয়। সঙ্গে ভীষণ শব্দ। একসময় সে স্থির হয় মাঠের ওপরে। ধীরে ধীরে নেমে আসে। ঝড়ের মতো বাতাস চারদিকে। লোকজন মন্ত্রীকে নিয়ে যায় জনসভাস্থলে। আমরা রইলাম হেলিকপ্টার দেখার জন্য। যাওয়ার সময় আড়াল না হওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে ছিলাম হেলিকপ্টারের দিকে।
আমাদের বাড়িতে রাতের খাবার শেষে আব্বার নেতৃত্বে প্রায়ই পারিবারিক আড্ডা বসত। একদিন মা চুপচাপ সবার কথা শুনছিলেন। তারপর হঠাৎ আবেগী কণ্ঠে বললেন, ‘কেমন মা এমন সন্তানের জন্ম দিয়েছে, যাকে দেখতে হাজার মানুষের ভীড়। ধন্য সে মা, স্বার্থক মায়ের জীবন।’ আমি তখন ছোট। মায়ের কথার মর্মার্থ বুঝিনি। কিন্তু বড় হয়ে ভেবে অবাক হই, অক্ষরজ্ঞানহীন একজন মায়ের অন্তরে এত স্বপ্নের বসবাস! মা গত হয়েছেন এক যুগের বেশি। তিনি সন্তানদের প্রতি সন্তুষ্টি নিয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। সন্তানদের জন্য এটি অনেক বড় পাওয়া।
আমার জন্ম গ্রামে। আমাকে শহুরে আলো-বাতাসে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই। বয়সে আমার চেয়ে দেড়-দুই বছরের বড়। লেখাপড়ায় আমার এক ক্লাস ওপরে। কিন্তু প্রতিভা, জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেচনায় আমার চেয়ে ঢের এগিয়ে। রাজধানীতে তিনি একাই যাওয়া-আসা করতেন। বাড়ি ফিরলে তাঁর কাছে ঢাকার গল্প শুনতাম। বাড়িতে আমাদের লজিং মাস্টার থাকলেও তাঁর কাছে আলাদা করে পড়ার হিসাব দিতে হতো। অবাধ্য হলে বিভিন্ন শাস্তি। অন্যদিকে আমার প্রতি তাঁর দায়িত্ববোধের কমতি ছিল না। আমি তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। থাকি বাদশাগঞ্জ হাইস্কুলের বোর্ডিং হোস্টেলে। একদিন হোস্টেলে তিনি হাজির। ‘তোর লেখাপড়া এখানে ভালো হচ্ছে না। ভালো লেখাপড়ার জন্য চাই প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ। আমার সঙ্গে যেতে হবে তোকে।’ আমি ভীষণ খুশি। তাঁর প্রস্তাব আমার কাছে স্বপ্নের মতো। স্কুল থেকে টিসি নিয়ে শুরু হলো নতুন যাত্রা। মোহনগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে যেতে হবে ভৈরব। নতুন স্কুলের নাম ‘কাদির বক্স পাইলট হাইস্কুল’। শত বছরের পুরোনো নামকরা স্কুল।
বিস্ময়-উত্তেজনা নিয়ে প্রতীক্ষা। কখন পৌঁছাব গন্তব্যে। প্রথম দর্শনে দেখলাম, নতুন স্কুলের আঙিনা ও পরিবেশ অনেক আধুনিক। হারিকেনের পরিবর্তে বিজলি বাতির আলোয় পড়ালেখা। পাকা রাস্তাঘাট, বড় বড় দালানকোঠা। সবকিছুই আমায় মুগ্ধ করে।
ইতিমধ্যে ক্লাসের কিছু ছেলের সঙ্গে আমার একটু একটু ভাব জমতে শুরু করে। স্কুল আঙিনার বাইরে আইসক্রিম, ঝালমুড়ি ও ফুসকা খেতে গেলে তাদের সঙ্গে নিতাম। ক্লাসে শিক্ষকেরা পড়া ধরলে ভালোই উত্তর দিতাম।
একসময় ক্লাসের দানিছ ও জামিলের সঙ্গে আমার বেশ সখ্য হয়। জামিল অতিশয় ভদ্র, নিরীহ গোবেচারা স্বভাবের। দানিছ একেবারে উল্টো। চালাক, কর্কশভাষী, মেজাজি, নেতা নেতা ভাব। একদিন বিকেলে স্কুলমাঠে একা হাঁটছি। পেছন থেকে জামিল এসে আস্তে করে আমার হাত চেপে ধরে। ‘তোমার সাথে কিছু গোপন কথা আছে।’ আমতা-আমতা করে বলতে থাকে, ‘আমি ক্লাসের শিলাকে (ছদ্মনাম) ভালোবাসি। কিন্তু তাকে বলতে পারছি না। কিছু একটা করতে পারবে?’ আমি অবাক। ঠিক তখনই মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি চাপল। বললাম, চিন্তা কোরো না। ব্যবস্থা একটা হবে। দানিছের সঙ্গে বিশদ আলাপ। সেও আমার সঙ্গে একমত। জামিলকে নিয়ে খেলতে হবে। জামিলের করণীয় সম্পর্কে দানিছ প্রাথমিক জ্ঞান দিল। বলল, ‘খরচাপাতি আছে, পারবে তো?’ জামিলের উত্তর, ‘কী লাগবে বলো? খরচাপাতি নিয়ে ভাবতে হবে না।’ জামিলের প্রাথমিক কাজ গোপনে শিলাকে প্রেমপত্র লেখা। পৌঁছানোর ব্যবস্থা আমরা করব। জামিল রাত জেগে চিঠি লেখে। সকাল হতেই আমার রুমের দরজায় কড়া। ‘দোস্ত, দানিছকে আমার খুব একটা বিশ্বাস হয় না। এই নাও চিঠি। গোপনীয়তা বজায় রেখো।’ আমি ও দানিছ ভুল বানানে লেখা চিঠির ভাষা আর বর্ণনা পড়ে হেসে কুটিকুটি। জামিলকে আশ্বস্থ করি। চিঠি পৌঁছে যাবে। যথাসময়ে উত্তরও পাবে। জামিলের উত্তেজনা বেড়ে যায়। ‘উত্তর আসবে তো? কত দিন লাগবে? যদি শিলার মা-বাবা জেনে যায়!’ জামিলের অস্থিরতা আমাদের জন্য যন্ত্রণায় পরিণত হয়। বাধ্য হয়ে দানিছ তার দূরসম্পর্কের এক বোনকে দিয়ে চিঠির উত্তর লিখিয়ে আনে। খামে ভরে চিঠি জামিলের হাতে দেওয়ার আগে আরেক দফা খাবারদাবার। চিঠি পেয়ে জামিলের আনন্দ দেখে কে! তবে কোথায় বসে পড়বে, তা নিয়ে তার টেনশন।
বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা। জামিল দৌড়ে স্কুলের বারান্দায় যায়। জানালা দিয়ে ক্লাসরুমে ঢোকে। ঠিক তখনই আফতাব উদ্দিন স্যার বারান্দা দিয়ে শিক্ষক ডরমিটরিতে যাচ্ছিলেন। কারও ক্লাসরুমে প্রবেশের দৃশ্য স্যারের নজরে পড়ে। অবেলায় ক্লাসরুমে কে ঢুকল! আফতাব স্যার দরজায় জোরে কড়া নেড়ে উচ্চ স্বরে বললেন, ‘ভেতরে কে? জলদি বেরিয়ে আয়।’ জামিল দরজা খুলে পালানোর উপক্রম। আফতাব স্যার খপ করে জামিলের বাঁ হাত ধরে ফেলেন। অমনি জামিল চিঠিটি মুখে ঢুকিয়ে চিবোতে শুরু করে। আফতাব স্যার হতবাক। ‘ব্যাপার কী, তুই কাগজ খাচ্ছিস কেন?’ আমি আর দানিছ একটু দূরে দাঁড়িয়ে। এসব দেখে হাসি থামাতে পারছি না। আবার জামিলের জন্য মায়াও হচ্ছিল।
কোনো ব্যাখ্যা দিয়েই আফতাব স্যারকে জামিল সন্তুষ্ট করতে পারছিল না। আসল ঘটনা বের করতে স্যার রীতিমতো তদন্ত শুরু করেন। আমি আর দানিছ প্রধান সাক্ষী। তদন্ত শেষে ফলাফল এল! স্কুলে অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষা চলছিল। জামিল পরের দিনের পরীক্ষায় নকল করার জন্য উত্তর লিখে রাখতে রুমে প্রবেশ করেছিল! ধরা পড়ে নকলের কাগজ চিবিয়ে গিলে ফেলে সে! তদন্তের ফলাফলে জামিল বেশ খুশি। আর যা-ই হোক, তার প্রেমপত্র বিনিময়ের কাহিনি তো কেউ জানল না! তবে জামিলের বড় আফসোস, পুরো চিঠি সে পড়তে পারেনি। ‘প্রিয়তম জামিল’…এটুকু পড়তেই ঘটে বিপত্তি। (নোট: দানিছ বর্তমানে তাঁর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। জামিল কানাডাপ্রবাসী, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখে আছে)
ডিআইজি, রাজশাহী রেঞ্জ, বাংলাদেশ পুলিশ