মোঃ আজিজুল হক স্বপন
ভুলেও ভাবিনি কোনোদিন পারভীনকে এভাবে খুঁজে পাব। তার সাথে শেষ দেখা ছিল আমার ১৯৫২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারির শীতের সকালে। শেষ দিনের স্মৃতিবিজড়িত সকল স্মৃতিপট আজও আমার হৃদয়কে প্রলম্বিত করে। আমি কেবল তার শেষ দিনের চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়েছিলাম। চলুন, পারভীন এর পরিচয়টা দেই। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের কৃতি শিক্ষার্থী ছিলেন। লালমনিরহাট তখন একটি মহকুমা মাত্র; রংপুর সাব-ডিভিশন। রংপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেড়ে ওঠা এই মেধাবী তার লেখাপড়ার প্রত্যেকটি স্তরে মেধার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। তিস্তা নদীর অববাহিকায় বেড়ে ওঠা পারভীন বেগম দেখতে যেমন সুশ্রী তেমনি মেধাবী। স্থানীয় একটি স্কুল থেকে তিনি মেট্রিকুলেশন (বর্তমানে এসএসসি)’তে আর্টস বিভাগ থেকে কৃতিত্বের সাথেই পাশ করেন। তখনকার পারিবারিক প্রথার বাইরে কারুর যাওয়ার সুযোগ ছিল না। গ্রামের কিশোরীদের যখন অতি অল্প বয়সেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হতো, সেখানে পারভীন ছিল এক অতি সাহসীনীর নাম। পারভীন সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান। তার পিতা-মাতা ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজনও চেয়েছিল পারভীনের বিয়ে দিতে। কিন্তু পারভীন ছিল একাধারে প্রতিবাদী এবং মেধাবী। তাইতো শত বাঁধা ভেঙে সে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে শুরু করল। মেট্রিকুলেশন পাশ করার পর পারভীন ভর্তি হয় মজিদা খাতুন সরকারি কলেজে। সেখানেও মেধার স্বাক্ষর রেখে কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন পারভীন। সর্বশেষ পারভীন ঢাকায় পড়তে আসে। ভর্তি হন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইউনিটে। পারভীন বেগম সে সময় প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। বয়স আর কতইবা হবে? ২০ কিংবা ২১। মেধাবী পারভীন অন্যান্যদের মতো বুঝতে পারেন, পাকিস্তানিরা আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়। আর তাইতো তার স্বভাবজাত প্রতিবাদী চেহারা আরেকবার ফুটে ওঠে। এভাবেই পারভীনের প্রতিবাদী চেহারা দেখতে শুরু করে তার অন্যান্য সহপাঠিরা।
পারভীন এর পরিবার সর্বদাই চেয়েছিল সেও তার অন্যান্য বোনদের মতোই সংসারী হোক। কিন্তু পারভীন দৃঢ়চেতা। তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হতে সে বিন্দুমাত্র পিছপা হয়নি। সে সর্বদাই তার পিতা-মাতা ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজনদের উদ্দেশ্য করে বলত বাংলা আমার মুখের ভাষা, এ ভাষায় আমি কথা বলি, পথ চলি এ ভাষা মুখে নিয়ে মৃত্যুকে বরণ করতেও আমি রাজি আছি। পারভীন এর মুখে এরকম কথা শুনে তার পরিবারের সদস্যগণও বেশ ঘাবড়ে গেল। মহাচিন্তায় নিপতিত হয়ে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিল তার বৃদ্ধা ও অসুস্থ্য মা। কিন্তু পারভীনের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে আপন মহিমায় বিভিন্ন স্লোগান, ফেস্টুন, ব্যানার তৈরিতে কাজে লেগে গেলো। তার সময়কার অন্যান্য কিশোরীদেরও সে উৎসাহিত করত। এমনিভাবেই চলে আসে ১৯৫২’র ২১ শে ফেব্রুয়ারি। সেদিন আর সবার মতোই পারভীনও ব্যানার নিয়ে যোগ দেয় মিছিলে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস সেদিন পাকিস্তানি হানাদারদের ছোড়া বুলেট সালাম, রফিক, বরকতদের মতো শহীদ না হলেও হানাদারদের বুলেট পারভীন বেগমকে পঙ্গু করে দেয় আজীবনের মতো।
বায়ান্ন, চুয়ান্ন, ছেষট্টি, ঊনসত্তুর, সত্তর এবং সর্বশেষ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধেও পারভীন নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন অকাতরে। দেশ মাতৃকার জন্য পারভীনের আত্মত্যাগ কখনোই ভুলবার নয়। বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনে পঙ্গুত্ব বরণকারী পারভীন বেগম দমে যাননি। তিনি যা চান তা করে দেখাতে ভীষণ পছন্দ তার। আর তাইতো পঙ্গু হয়েও কখনো দেশ মাতৃকার সেবা করতে ভুলেননি। ১৯৭১ সালে তার আত্মত্যাগ ছিলো আর সতেজ এবং কার্যকরী। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ৪০ বছর কিংবা তার চেয়ে এক দুই বেশি। পারভীন বেগম ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট একটি ভরসার নাম। তিনি ভিক্ষাবৃত্তি করা শুরু করলেন। ভিক্ষাবৃত্তি ছিল সে সময়ে তার একটি ছল মাত্র। যার আড়ালে তিনি পাকিস্তানিদের তথ্য সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করতেন। এভাবেই ৬নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট তিনি হয়ে ওঠেন ভরসার প্রতীক।
সেসময় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে হানাদার পাকিস্তানিদের চরম যুদ্ধ চলছিল। কিন্তু সব সময় বিপাকে ছিল পাকিস্তানিরা। তাদের সকল তথ্য আগেই কেমন করে মুক্তিযোদ্ধারা জেনে যায়, তা খুঁজে বের করতে চেষ্টা শুরু করেন। এ দেশীয় দোসররা এ কারণে শত শত নিরীহ বাঙালিকে আটক করে হানাদারদের হাতে তুলে দেওয়া শুরু করেন। সেদিনের এক ভয়াল রাতের বর্ণনা দেন মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই। তারা বলেন যখন কেউই সামনে দাঁড়াতে সাহস পাচ্ছিলেন না, ঠিক সে সময়ে দৃঢ়চেতা পারভীন বেগম সামনে বের হয়ে আসেন। তিনি বলেন এরা সবাই ভালো লোক। কেউই কোনো খবর মুক্তিযোদ্ধাদের দেয়নি। যত অপরাধ সব আমার আমি দোষী, পারলে আমাকে সাজা দিন, তবুও এদের অহেতুক শাস্তি দিয়েন না। উপস্থিত সবাই স্তব্ধ বনে যায়। পঙ্গু বলে কি? তার মাথার চুল ধরে হ্যাঁচড়ানো শুরু করে দেয় এদেশীয় দোসররা। কিন্তু কখনও উঁহ শব্দটিও তিনি করেননি। সবাইকে ছেড়ে দেওয়ার পর শুধু এক চিলতে হাসি এঁকেছিলেন তার ঠোঁটে। যা সকল অশ্রু ঝড়ানো উপস্থিত জনতা অবলোকন করেছিলেন গভীর মমতায়। সেই যে, নিয়ে গেল আর কেউ তাকে ফিরতে দেখেননি। সবাই ধরেই নিয়েছিলেন তাকে মেরে ফেলা হয়েছে।
কিন্তু লালমনিরহাট ৬ ডিসেম্বর স্বাধীন ঘোষণা হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা যখন বাংলার স্বাধীন পতাকা শহীদ মিনারে টানিয়েছিল, সেদিন শেষ বারের মতো তাকে পতাকা উদ্দেশ্য করে স্যালুট করতে দেখেছে সবাই। সেদিন তিনি হাসতে পারেননি, তার চোখ দুটো হতে সেদিন বৃষ্টির ফোঁটার মতো পানি বেড়িয়ে যেতে দেখেছে উপস্থিত সবাই। পাকিস্তানিরা আমাদের মা-বোনদের ওপর যে অত্যাচার চালিয়েছিল, সেখান হতে পারভীন বেগমও রেহাই পাননি। তাকে নিদারুণ কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল হানাদারদের ক্যাম্পে। দেশ স্বাধীনের কিছুদিন পর রাস্তায় একটি নারীকে পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয় লোকজন। যখন সবাই জানতে পারে যে, ইনিই সেই পারভীন বেগম, ঠিক তারও আগে তিনি ইহ জগতের মায়া ত্যাগ করেছেন। দীর্ঘ কত বছর পর তাকে দেখলাম, তা হিসেব কষতে বসিনি আজ। কিন্তু তাকে এভাবে ফিরে পাব তা কখনও কল্পনাতেও ভাবিনি।
কত মানুষ কেঁদেছে তার মৃত্যুতে তার ইয়ত্তা নেই। এত মেধাবী একজন মানুষ যে কিনা চাইলেই তার জীবনকে আর ১০ জনের মত করে সাজাতে পারত। কিন্তু তিনি তা না করে নির্ঘাত মৃত্যুকে বরণ করেছিলেন আপন মমতায়। তবুও চেয়েছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হোক।
তার সাথে থাকা একজন পুরুষ মুক্তিযোদ্ধা অকপটে স্বীকার করেছেন যে, একজন নারী এমন দৃঢ় মনোবলের হতে পারে যা তাকে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। দেশ স্বাধীন হয়েছে আজ প্রায় ৫০ বছর। কিন্তু কত শত পারভীন যে তাদের সবকিছু দিয়ে এ দেশকে শত্রু মুক্ত করতে অবদান রেখেছে, অভাগা জাতি সেটা মনে রাখেনি আর। তারা পারভীনকেও ভুলে গেছে। তাইতো এ সমাজে বাস করতে ভয় হয়। পারভীন বেগম একজন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু তিনি স্বীকৃতি পাননি। যখন পেপার-পত্রিকায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের খবর পড়ি, তখন আঁতকে উঠি আর মনে করি পারভীন বেগম এর কথা। যে নিজের জীবনকে বিপন্ন করে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর সরবরাহ করত। যে কিনা মুক্তিযোদ্ধাদের একমাত্র ভরসার জায়গা ছিল। সেই পারভীন বেগমকে যখন দেখি কেউ স্বীকৃতি দেয় না, তখন আমার ভয় ও শঙ্কা বেড়ে যায়। আমার কাছে মনে হয়, রাষ্ট্র, সমাজ কিংবা এই সমাজ ব্যবস্থায় শত শত পারভীন এর অবদান অস্বীকার করা, মুক্তিযুদ্ধের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। তিনি চেয়েছিলেন বাংলা ভাষায় কথা বলতে, পথ চলতে, তাইতো নিজেকে নিয়ে কখনও ভাবেননি। ৬নং সেক্টরের প্রতিটি জীবিত মুক্তিযোদ্ধা আজও স্মরণ করেন পারভীন বেগমকে গভীর শ্রদ্ধায়।
পারভীন বেগম ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনে সম্মুখ সারিতে অবস্থান করেছিলেন। তার হাতে ব্যানার ছিলো সেদিনের মিছিলে। হানাদারদের বুলেটেই সে সেদিন পঙ্গুত্ব বরণ করেছিল। কিন্তু সালাম, রফিক, শফিক, বরকতদের নাম জানলেও এ দেশের অনেকেই আজও পারভীন বেগম এর নাম জানে না। পারভীন বেগম আজও পড়ে আছেন নাম না জানা অনেক শহীদের ভিতরে। আজও তার বলে যাওয়া কথাটা আমার হৃদয়কে নাড়া দেয়। বাংলা আমার মুখের ভাষা, এ ভাষায় আমি কথা বলি, পথ চলি এ ভাষা মুখে নিয়ে মৃত্যুকে বরণ করতেও আমি রাজি আছি।
লেখক : উপ-পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র), স্পেশাল ব্রাঞ্চ, মালিবাগ, ঢাকা
0 Comments