ই-পেপার

সৈয়দা আশরাফিজ জাহারীয়া প্রধান

দিল্লি ইউনিভার্সিটি’র একজন প্রফেসরের ক্লাসে শুনেছিলাম যে একবিংশ শতাব্দীতে গ্লোবাল টেনশন তৈরি হবে মূলত Three WWW নিয়ে – Weather, Weapons, Women. মুক্ত বাজার অর্থনীতি, পুঁজিবাদ আর- আধিপত্য বিস্তারের খেলায় প্রথম দুটো তথাকথিত জরুরি অনুষঙ্গ হলেও তৃতীয় W (Womenটি কিন্তু সমাজের বাই- প্রডাক্ট ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ, গ্লোবালাইজেশনের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে পুরুষ নিয়ন্ত্রিত সমাজ নারীকে বরং অনেক বেশি কমোডিটি/পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করতেই বেশি পছন্দ করে, নারীর মেধা ও কর্মক্ষমতাকে উপেক্ষা করেই। এর অবধারিত পরিণতি হলো নারী ও কিশোরীদের প্রতি বৈষম্য, দমন, নিপীড়ন আর সহিংসতা (Kabeer)। আর এই সহিংসতার সংস্কৃতি বৈচিত্র্যময় রূপে গ্রাস করেছে শূন্য থেকে শুরু করে ৯৫ বছরের নারীকে পর্যন্ত। ফলে নারীর চিন্তা, মতামত, সিদ্ধান্তগ্রহণ, উপার্জন, চলাচলের স্বাধীনতা আজ হুমকির সম্মুখীন, যা জাতীয় উন্নয়নকে অনেকাংশেই করছে প্রশ্নবিদ্ধ। 

জাতীয় উন্নয়নের মূল চাবিই হলো আপামর জনগণের কল্যাণ ও সমৃদ্ধি। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশই নারী। জনসংখ্যার এই অর্ধেক অংশকে পিছিয়ে রেখে সার্বিক জাতীয় উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কিন্তু  বাস্তবের ভিন্ন চিত্র কিন্তু কম আশঙ্কার নয়। বাংলাদেশে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে ব্যাপকভাবে। অধস্তন লিঙ্গীয় পরিচয় এবং দারিদ্র্য ও সংখ্যালঘু অবস্থান নারী ও মেয়েদের জন্য শেকড় বিস্তৃত বৈষম্য এবং অন্যায্যতা সৃষ্টি করে। নারীর প্রতি সহিংসতা আজ প্রধান উদ্বেগের বিষয় এবং নারী ও কিশোর-কিশোরীদের নাগরিক এবং অর্থনৈতিক অধিকার চরম লঙ্ঘনের মুখোমুখি হচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশের এসডিজি প্রতিশ্রুতি পূরণে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে (নাজনীন, ২০১৮)। এক্ষেত্রে পুরুষতন্ত্রের চিরাচরিত আগ্রাসী রূপের কারণে নারীরা সর্বদা পুরুষতান্ত্রিক রীতি-নীতির দ্বারা পরিচালিত ও বশীভূত হয় এবং এর প্রভাব পরে, নারীর শিক্ষা, পেশা, আয়, যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে। পুরুষতন্ত্রের এই ঐতিহ্যবাহী শোষক রূপের কারণে, দেশব্যাপী নারীর প্রতি সহিংসতা বিভিন্নভাবে বাড়ছে। কী গ্রামাঞ্চলে, কী নগর জীবনে নারীরা শিক্ষা, আয় এবং পেশার ক্ষেত্রে উন্নতি করতে যথেষ্ট সক্ষমতা অর্জন করতে পারছে না। নারীর জন্য অর্থনৈতিক সম্পদের সীমিত প্রবেশাধিকার, পুরুষ অভিভাবকত্ব এবং নারীর জীবন পছন্দগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক প্রতিষ্ঠানের উপর পুরুষের আধিপত্য, গৃহস্থালির কাজে এবং ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে নারীদের বন্দি করে রাখা, নারীদের জন্য উচ্চ শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকা এবং নারীর প্রতি সহিংসতার অত্যন্ত উচ্চ প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশের লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। নারী ও কিশোরীদের প্রতি লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা সব সমাজেই একটি বড় মানবাধিকার লংঘন।    

মূলত : পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতার মূল কারণ হলো লিঙ্গীয় মতবাদ/বিশ্বাস। এই লিঙ্গীয় মতবাদ আর নারী পুরুষের অসম ক্ষমতা সম্পর্ক থেকেই সংঘটিত হয় নারীর প্রতি সহিংসতা, নির্ধারণ করা হয় পরিবারে এবং সমাজে নারীর নির্ধারিত অবস্থা ও অবস্থান। এভাবে যে সমাজে পুরুষ ও নারীর মধ্যে সমান অধিকার নেই, সেখানে নির্যাতনের হারও বেশি। যতদিন পর্যন্ত পুরুষ ও নারীদের মধ্যে বৈষম্য দূর না হবে, পুরুষদের মানসিকতা না বদলাবে এবং নারীরা পুরুষদের মতো নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে না পারবে, ততদিন পর্যন্ত এ ধরনের নির্যাতন চলতে থাকবে। নারীর ক্ষমতায়নের মতো স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে কাজ করতে নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসনে প্রয়োজনীয় কর্ম ও কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাস্তববাদী হওয়াটা খুবই জরুরি। কেননা, গ্রামীণ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও নগরজীবনের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন।

ছোট ছোট পরিবর্তন যে হয়নি, তা নয়- বিশেষ করে নারীরা সচেতন হয়েছে আগের তুলনায় অনেক বেশি,  অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ, বিভিন্ন স্থানীয় কমিটিতে নেতৃত্ব দান, বিভিন্ন স্থানীয় সভা ও সালিশীতে অংশগ্রহণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ, সামাজিক অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা, বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা গ্রহণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীদের অভাবনীয় ইতিবাচক পরিবর্তন জাতীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে অন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। দেশের সার্বিক উন্নয়ন নারীর ক্ষমতায়নের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই, সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকান্ডে নারীর পছন্দ/ মতামত/ প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেয়া সম্যক জরুরি। এর মাধ্যমে তাদের নিজস্ব সক্ষমতার উন্নয়ন, অন্যান্য অংশীজনের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন ও পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে নারীর প্রয়োজন ও অধিকারের বিষয়টি আমলে আনা হবে; এবং সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে নারীÑপুরুষের ভূমিকা নিয়ে প্রচলিত রীতি-নীতির পরিবর্তন করা সম্ভব হবে।

নারীর ক্ষমতায়নের পূর্বশর্ত হলো বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে নারী পুরুষের সামাজিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ বা জেন্ডার বিশ্লেষণ বাস্তবায়ন করা। সামগ্রিক জেন্ডার বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রান্তিক ও পিছিয়ে থাকা মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি এবং টেকসই উন্নয়ন ও সব কাজের গুণগতমান নিশ্চিত করা একটি পরীক্ষিত ও কার্যকর কৌশল। বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগিদের মাধ্যমে বাস্তবায়িত জেন্ডার বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে নারীদের বর্তমান অবস্থা ও অবস্থানের পরিবর্তন ঘটাতে হলে সমাজে এবং পরিবারে পুরুষদের সহযোগিতা এবং সম্মিলিত উদ্যোগ নিতান্তই প্রয়োজন। বিভিন্ন গবেষণা এটাও সত্য বলে দেখিয়েছে যে পুরুষদের আলাদা রেখে কখনই সমাজ বা পরিবার পর্যায়ে নারীদের কোনো সমস্যাই সমাধান করা সম্ভব নয়। বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসনের পূর্বশর্ত হলো পরিবার সমাজ সর্বক্ষেত্রে নারী পুরুষের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা, সহমর্মিতা, সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ সুসম্পর্ক উন্নয়ন। এসডিজি জেন্ডার ইনডেক্স ২০২২ এর গবেষণা অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক জেন্ডার সমতা আর্জনের সূচকে গত পাঁচ বছরে অনেক পিছিয়ে রয়েছে (এসডিজি জেন্ডার ইনডেক্স ২০২২)। 

জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক সংঘাত এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার সংমিশ্রণের ফলে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। নারী অধিকার এবং লিঙ্গ সমতার প্রতি তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখে, নারীবাদী, একটিভিস্ট এবং সুশীল সমাজ মানবাধিকারের সবচেয়ে ক্রমাগত লঙ্ঘনের অবসান ঘটাতে এই আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে। লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধযোগ্য- এই বার্তাটিকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করবার কাজটি, জনসংখ্যার অর্ধেক অংশ অর্থাৎ পুরুষ ও কিশোররাই করতে পারে। যেহেতু পুরুষ ও কিশোররা জনসংখ্যার অর্ধেকের প্রতিনিধিত্ব করে এবং তারা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের গেট কিপার; সেহেতু তারা লিঙ্গীয় সমতার লক্ষ্য অর্জনে অংশীদার/জোট হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। গৃহকর্মে ন্যায়সঙ্গত কর্ম বিভাজন ও বাচ্চার দেখাশোনায় পুরুষদেও অংশগ্রহণের মাধ্যমে  নারী ও কিশোরীদের সময় বোঝা কমাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এর ফলে নারীরা আয়বর্ধক কর্মকা-, প্রশিক্ষণ, বিভিন্ন পাবলিক ফোরামই শুধু নয় বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিধি, পুষ্টিকর খাবার তৈরি, বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো, স্বাস্থ্য সেবা নেওয়া, দুর্য্যাগে ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ইত্যাদিও জন্য অতিরিক্ত সময় দিতে পারবে। এইপ্রেক্ষিতেই, পুরুষও বালক ও কিশোরদের নারী ও কিশোরী ক্ষমতায়নে সম্পৃক্তকরণের কাজটি পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে। (বাংলাদেশ কান্ট্রি জেন্ডার অ্যাসেসমেন্ট, বিশ্বব্যাংক, ২০২১)।

নারীর ক্ষমতায়নে পুরুষদের সম্পৃক্তকরণের গুরুত্ব হলো যে, আমাদের সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে পুরুষদের সাথে আলোচনার আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোনো প্ল্যাটফর্ম নেই যেখানে তারা নারী-পুরুষের সমতা, নারীর ক্ষমতায়নের গুরুত্ব বা বেনিফিট সম্পর্কে জানতে পারে। এই ক্ষেত্রে পুরুষদের সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গী বা স্টেরিওটাইপগুলো বুঝাটা অতীব জরুরী- নারীর ক্ষমতায়ন বাস্তবায়নে, বেশিরভাগ সময় আমরা পুরুষদের দৃষ্টিকোণ বুঝতে ভুলে যাই, যা প্রথাগত লিঙ্গীয় মানসিতকার পরিবর্তনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত, আমরা দেখতে পাই যে ছেলেরা বা পুরুষরা আমাদের সমাজের একটা প্রভাবশালী অংশ। কিন্তু আমরা ছেলেদের দুর্বলতা এবং সীমাবদ্ধতাগুলো এবং তা মোকাবিলা করার জন্য তাদের মতামত গ্রহণ করতে পারি না। লিঙ্গ সমতার বিষয়ে আলোচনায় পুরুষদের সম্পৃক্তকরণ একটি সহজ কাজ নয়, পাশাপাশি চ্যালেঞ্জিংও। এই বিষয়টি বিবেচনায় রেখে, যে কোনো উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করার আগে পুরুষ ও কিশোরদেও সম্পৃক্ত করার কৌশল গ্রহণ করা উচিত যা প্রকৃতপক্ষে নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়গুলিকে তরান্বিত করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পন্থা (ইউরোপীয়ান ইনস্টিটিউট অফ জেন্ডার ইকুয়ালিটি)। 

ইউনিসেফ-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী পরিবারের নারী-পুরুষের বৈষম্য  দারিদ্র বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। শুধু তাই নয়, যেসব পরিবারে লিঙ্গ/জেন্ডার বৈষম্য বিরাজমান সেসব পরিবারে শিশুরা দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী হয়। সম্প্রতি জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। ইউনিসেফ বিশ্বের ৩০টি দেশে পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারী-পুরুষের ভূমিকা বিশ্লেষণ করে এ ফলাফল পেয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু দক্ষিণ এশিয়ার পরিবারগুলোতে যদি লিঙ্গগত সমতা  নিশ্চিত করা যেত, তবে এ অঞ্চলের এক কোটি ৩০ লাখ শিশু অপুষ্টির হাত থেকে রেহাই পেত। এছাড়া নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা স্থাপন করা গেলে উন্নয়নশীল দেশের দারিদ্র্য কমত এবং শিশুদের স্বাস্থ্যের মান বৃদ্ধি পেত। শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্যর কারণেই নারীর ক্ষমতায়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন বিলম্বিত হচ্ছে। পুরুষ পরিবারের কর্তা হলে স্বাস্থ্য ও খাদ্য বাবদ কম ব্যয় করে। এর ফলে পরিবারের শিশুরা দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী হয়। অথচ মেয়েরা আয় করলে তাদের অর্থের বেশিরভাগটাই খরচ করে পরিবারের খাদ্য কিংবা অন্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পেছনে। অইভরি কোস্ট ও ঘানার উদাহরণ টেনে প্রতিবেদনটিতে এর সত্যতা যাচাই করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশে মেয়েরা পরিবারের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ইস্যুতে গৃহীত সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণ করার অধিকার রাখে না। অথচ এসব দেশে পুরুষের তুলনায় নারী কর্মঘন্টার পরিমাণ বেশি। শুধু গৃহের কাজেই না, চাকরি ক্ষেত্রেও তারা বেশি সময় দেয়। কিন্তু বেতনের ক্ষেত্রে নারীরা বৈষম্যর শিকার হয়।

পৌরষত্বের সংজ্ঞা একমুখী নয় এবং কয়েকটি বাক্যে দেওয়া সম্ভব নয়। পৌরষত্ব পিতৃতান্ত্রিক সমাজ দ্বারা প্রভাবিত পুরুষদের বৈশিষ্ট্য। এটা একেক সমাজে একেক রকম। পৌরষত্ব ধনী, দরিদ্র, ধর্ম, গোষ্ঠী, সংস্কৃতির দ্বারাও প্রভাবিত। বালক থেকে বৃদ্ধরও পৌরষত্ব আছে, তবে বয়স অনুসারে বদলে যায়। পৌরষত্ব পুরুষের চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করে (কামলা ভাসিন)। পুরুষ হওয়া কারণে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের যেসব বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে তাই তার পৌরষত্ব। তিন ধরনের পৌরষত্ব আছে। অনুকরণীয়, প্রভাবহীন ও ক্ষতিকর। আমাদের কাজ করতে হবে ক্ষতিকর পৌরষত্বের বিরুদ্ধে বিশেষ করে যা নারী নির্যাতনে ভূমিকা রাখে। আর কাজে লাগাতে হবে পৌরষত্বের ভালো দিকগুলো বিশেষ করে, যেসব পৌরষত্ব নারী নির্যাতন প্রতিরোধে এবং নারীর ক্ষমতায়নে ভূমিকা রাখে। পৌরষত্বের সব কিছুই খারাপ নয়। কিছু ভালো পৌরষত্ব আছে, কিছু খারাপ, আবার এমন কিছু পৌরষত্ব আছে, যা ভালোও নয় খারাপও নয়। আমাদের সব পৌরষত্বের বিষয়ে কাজ করার প্রয়োজন নেই। শুধু যেসব পৌরষত্ব নারী নির্যাতনে ভূমিকা রাখছে। শুধু সেসব বিষয়ে আচরণ পরিবর্তনের কাজ করতে হবে।

আবেদা সুলতানা পিতৃতন্ত্রকে ক্ষমতার গতিশীলতার একটি সিস্টেম হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন যেখানে নারীদের অধস্তন রাখা হয় এবং একইভাবে, সরকারী ও বেসরকারি সব ধরনের প্রকল্পেই পুরুষদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। (সুলতানা এ, ২০১১)। অতএব, পিতৃতন্ত্রের প্যাটার্নটি বিবেচনা করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। পুরুষত্ব ও পিতৃতন্ত্রের গুণাবলি, নারীর উপর পুরুষের আধিপত্য এবং বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার পরিস্থিতি বিবেচনা করে, নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি এবং কার্যকর ও টেকসই পরিবর্তনের জন্য লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা হ্রাস করার জন্য কিশোর ও পুরুষদের সম্পৃক্ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা হ্রাস করার জন্য কিশোর ও পুরুষদের ধারণা এবং অভ্যাসগুলো পরিবর্তন করার জন্য, জ্ঞান বৃদ্ধি করা এবং বিশেষ চারটি নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর প্রতিফলিত কিশোর ও পুরুষদের মনোভাব পরিবর্তন করা গুরুত্বপূর্ণ: শ্রম, বৈষম্য, ক্ষমতায়ন এবং নারীর প্রতি সহিংসতা। শ্রম বিভাজনের বিষয়টি গৃহস্থালি এবং এটি আয়-উপার্জনের কার্যক্রমে পুরুষ ও নারীদের মধ্যে সামাজিক পার্থক্যের সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ; বৈষম্যের বিষয় হলো শিক্ষা, খাদ্য গ্রহণ এবং অধিকারগুলিতে সমতা, ন্যায্যতার সমাধান এবং নিশ্চিত করা। ক্ষমতায়নের বিষয়টি সম্পত্তি বিভাজন, পরিবারের সম্পদের উপর সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতা এবং নারীদের গতিশীলতা বিষয়টিকে বিবেচনা করে; এবং সবশেষে নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিপাদ্য বিষয়, যেমন: যৌতুক, পারিবারিক সহিংসতা এবং বিবাহ-সম্পর্কিত সহিংসতার মতো বিষয়গুলিতে গুরুত্বারোপ করে (আলী, ২০১৫)। কিশোর এবং পুরুষরা যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ধারক ও বাহক, তাই,  নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা নিয়ে পুরুষরা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে (ইউএনএফপিএ, ২০১৩)।

নারীর ও পুরুষের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হলে পরিবার ও সমাজের কল্যাণ ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত হয়। এই সমৃদ্ধ পথের যাত্রায় পুরুষরা গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তাদের চিন্তা-চেতনা, মতামত, অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ নারীর ক্ষমতায়নের একটি কার্যকর কর্মকৌশল। মূলত নারীর ক্ষমতায়নের পথে পুরুষদের সম্পৃক্তকরণের প্রত্যাশিত আচরণগুলো হলো-

–              তারা ঘরের কাজে অংশগ্রহণ করবে;

–              পরিবারে যৌথভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে;

–              সহিংসতামুক্ত পরিবার গঠনে উদ্বুদ্ধ এবং অগ্রগামী হবে;

অধুনা নারীর ক্ষমতায়নে পুরুষদের সম্পৃক্তকরণের কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে কার্যকর কৌশলগুলো হলো-

১.            পুরুষদের নেটওয়ার্ক গঠন

২.           পুরুষদের লিঙ্গভিত্তিক সমতা এবং ন্যয়সঙ্গত সম্পর্ক সম্বন্ধে ধারণা ও বিশ্বাসকে উন্নত করা,

৩.           যৌথ/পারষ্পারিক সিদ্ধান্ত, গৃহকর্মের দ্বায়িত্ব ভাগ এবং সহিংসতা মুক্ত সম্পর্কে ইতিবাচক বার্তা প্রচার

৪.           নারীর ক্ষমতায়ন সংক্রান্ত কাজগুলো বাস্তবায়নে সহায়তা করা।

৫.           নারী-পুরুষ একে অন্যের পরিপূরক ও সহযোগী- এই মনোভাব তৈরি হবে।

৬.           নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসনে পুরুষদের ইতিবাচক ভূমিকা দৃশ্যমান হবে।

সামাজিক রীতি-নীতির কারণে অধিকাংশ সময়েই পুরুষরা ক্ষমতায়ন বিষয়টিকে শুধু নারীদের বলে বিবেচনা করলেও, কিন্ত অধিকাংশ পুরুষই নারী-পুরুষের সমতায় বিশ্বাস করে এবং খোলাখুলিভাবে নারীর প্রতি সহিংসতাকে নিন্দা করে। তাই, নারী উন্নয়নে এবং নারীর ক্ষমতায়নে পুরুষরা এগিয়ে এলে, নারীরা-

১.            একক বা যৌথ সিদ্ধান্তগ্রহণে সক্ষম হবে

২.           নারীর চলাচলের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে

৩.           ঘরের কাজে নারীর চাপ হ্রাস পাবে এবং নারীরা উৎপাদনমূলক কাজে অংশগ্রহণ করতে পারবে

৪.           প্রচলিত এবং অ-প্রচলিত পেশায় নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাবে

৫.           নারীর প্রতি সহিংসতা, বৈষম্য কমে আসবে

৬.           নারীর সামাজিক নেতৃত্ব বলিষ্ঠ হবে, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে

৭.           নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসনে সরকারের আইনি সেবায় (১০৯, ৯৯৯) নারীর প্রবেশাধিকার নিশ্চিত হবে

৮.           জোট গঠন, সমমনাদের সমর্থন অর্জন

নারী-পুরুষের মধ্যে সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক এবং অংশীদারিত্বের বিকাশ লিঙ্গীয় সমতা বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। একই সময়ে, কিশোর ও পুরুষরা ভবিষ্যতের স্বামী বা বাবা এবং বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমের সম্ভাব্য নেতৃত্ব। তাই, তাদের পরিবর্তিত, ন্যায়সঙ্গত মনোভাব, সংবেদনশীল আচরণ এবং সম্মিলিত উদ্যোগ লিঙ্গ-ভিত্তিক বৈষম্য দূরীকরণ এবং নারীর প্রতি সহিংসতা থেকে মুক্ত ও সুরক্ষিত জাতীয় ভবিষ্যৎ গঠনের মূল চাবিকাঠি।

লেখক : এডভাইজার- জেন্ডার ইকুয়ালিটি এন্ড উইমেন এমপাওয়ামেন্ট, ভয়েজ ফর গ্লোবাল উইমেন লিডারস,

কেয়ার বাংলাদেশ।

ভালো লাগলে শেয়ার করে দিন :)