সোনিয়া রহমান
আজকাল প্রায়ই লক্ষ্য করা যায় যে, অনেকেই নারী অধিকার নিয়ে, নারী-পুরুষের পারস্পারিক সহাবস্থান নিয়ে লিখতে আগ্রহী হন, চান কথা বলতে। যারা লিখতে চান, তারা লিখে বোঝাতে চান তারা সহনশীল এবং সমস্যা সমাধানে আগ্রহী। কিন্তু আমি মনে করি আজকে নারীর অধিকার, দাবী, নারী নির্যাতন রোধ যা কিছু নিয়েই আমি লিখতে চাই বা বলতে চাই না কেন, হোক সে নারী গৃহিণী বা কর্মজীবী, সবার আগে দরকার উন্নত চেতনা। নারীর কাজ করা বা না করার সঙ্গে এই চেতনা সম্পর্কযুক্ত নয়। কুসংস্কার, পুরাতন রীতি-নীতি ও আচরণের পরিবর্তন দরকার, আরো দরকার মানবিক আবেগ ও মানবিকতার জয়। মানবতা হলো নিজের কথা চিন্তা করে অন্যের প্রতি উদার হওয়ার ক্ষমতা। যে মানুষ অন্যের প্রতি উদার হতে পারে না, সে তার নিজের প্রতিও উদার না।
আমরা অনেক সময় ভুলে যাই বা মেনে নিতে পারি না আজ সামনের দিকে আগাতে চাইলে নারী-পুরুষকে একত্রে কাজ করতে হবে। তবে অনেকেই বলে থাকেন, নারী আর পুরুষ সমান হতে পারে না, কারণ নারী দুর্বল। ব্যাপারটা শুধু এই যুগে এসে কেন, অতীতের ক্ষেত্রেও একটা অগ্রহণযোগ্য যুক্তি হিসেব উপস্থাপিত হতে পারে। উর্দু সাহিত্যের লেখক সাদাত হোসেন মান্টোর ‘লাইসেন্স’ নামক গল্পে জনৈক নারীর স্বামী মারা যাওয়ার পর তার ঘোড়ার গাড়ির লাইসেন্স কেড়ে নেওয়া হয়। জীবিকার উপায় হিসেবে তাকে বলা হয় বাজারে বসতে। সভ্যতার মুখোশ পরা এই আমরাই যে বেশ্যাবৃত্তিকে সমর্থন করে ফেলি অজান্তেই এই বোধ কি আমাদের আছে?
একজন মেয়ে যখন বড় হতে শুরু করে, শিক্ষাজীবনে পদার্পণ করে, সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে পরবর্তী অধ্যায় কীভাবে শুরু করবে, তার লক্ষ্য ঠিক করে নেয়। আমি মনে করি এখানে তার চিন্তা-চেতনায় শিক্ষার ভূমিকাই মুখ্য হওয়া উচিত। কিন্তু অনেক বাবা-মা’ই তাদের সে সন্তানটিকে চিন্তা করেন ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দিবেন। এটা যে শুধু গ্রাম পর্যায়ের চিন্তা তা নয়, শহুরে তথাকথিত আধুনিক সমাজেও এ মনোভাব বিদ্যমান। কিন্তু ভালো ছেলে বলতে আমরা কি বুঝি, ভালো ছেলে বা ভালো পুরুষ বা ভালো স্বামীর সংজ্ঞা কি? দেখতে ভালো, ভালো আয় এবং বাড়ি গাড়ি থাকলেই অনেক বাবা-মা তাকে ভালো ছেলে, ভালো পাত্র হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন। কিন্তু একবারও ভাবেন না যেখানে মেয়েটাকে তারা সংসার করতে পাঠিয়েছেন সেখানে তাদের মেয়েটি, তার সন্তানটি কেমন আছেন কিংবা ভাবলেও ‘ মেয়ে মানুষের বিয়ে কয়বার হয়। এক স্বামীর সংসারই করুক যত সেখানে কষ্টে থাকুক। ’ যেখানে পরিবারেই একজন নারীর সময়ে অসময়ে অবমূল্যায়ন হচ্ছে, সে হিসেবে আমি মনে করি পরিবার থেকেই প্রথমে নারীর অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে এবং অবশ্যই সবার আগে মা’কে শিক্ষিত হতে হবে। অন্তত ন্যূনতম শিক্ষাটা তার থাকা দরকার। তবে নারীর প্রতি নির্যাতন শুধু শারীরিকই নয়, মানসিকও। এই মানসিক নির্যাতন নিজের পরিবার এবং শ্বশুরবাড়ি থেকেও একজন নারীকে মুখোমুখি হতে হয় মাঝেমধ্যে।
এখানে আমি আরও কিছু কথা বলতে চাই। নারী কি শুধু পুরুষ দ্বারাই অধিকার বঞ্চিত বা নির্যাতিত হয়? নারী নিজেই কি মাঝেমধ্যে আরেক নারীর সাফল্যের পেছনে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে না? আমি নিজে নারী হয়ে সফলতা পাইনি বলে আরেক নারীর সফলতা দেখে কেন আমি ঈর্ষাপরায়ণ হবো? কেন আমার মধ্যে এই চিন্তা কাজ করবে না যে আমিও সফল হবো, আমিও স্বপ্ন দেখবো এবং সেটা বাস্তবায়নও করবো? তাই আমাদের নারীদেরও দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। হয়তো বাস্তবতার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের প্রতিটা মেয়ে কর্মক্ষেত্রে জড়াতে পারে না বা সুযোগ হয়ে ওঠে না। দৃষ্টিভঙ্গি, পারিবারিক কাঠামো ইত্যাদি নানা কারণই এর পেছনে কাজ করতে পারে। আবার দেখা যায় অনেক শিক্ষিত নারীও আছেন, যারা গৃহিণী হয়েই থাকতে পছন্দ করেন, ঘর দেখাশুনা এবং সন্তানের লালন-পালন করেন। আমি বলছি না এটা খারাপ কিন্তু ঘরে থাকবে বলেই কেন তাদের চিন্তাভাবনা টিভি সিরিয়াল, শাড়ি-গয়নায় আবদ্ধ হয়ে যাবে! চিন্তার সংকীর্ণতা থেকে বের হতে হবে, নিজের সচেতনতা বাড়াতে হবে, যাতে নিজের করণীয় কাজগুলো বুঝে নিতে পারে, দৃষ্টির প্রসারতা বাড়াতে হবে।
নারী জীবনে কতখানি সফল সেটা নিরূপণের মাপকাঠি সময়ই বলে দিবে, বলে দিবে তার কর্ম। শুধু নারী দিবস বলেই একটি নির্দিষ্ট দিনে আমরা নারীদের নিয়ে ভাববো, তাকে সম্মান দিবো তা নয়। আসুন আমরা নারীকে তার যথাযথ সম্মান দিই।
লেখক : ফ্রি ল্যান্স সাংবাদিকও রন্ধনশিল্পী।
0 Comments