মোহাম্মদ আমজাদ হোসাইন
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ প্রায় সম্পন্ন করে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সক্ষমতা পুরো পৃথিবীকে জানান দিয়েছেন। আজকে সমগ্র দেশ, দেশের মানুষ উল্লাসিত ও উচ্ছ্বসিত। ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন পদ্মা সেতু দেশের ফাস্টট্রাকভুক্ত বৃহত্তম উন্নয়ন প্রকল্প। গত ১০ ডিসেম্বর ২০২০ খ্রিঃ বসানো হলো ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পদ্মা সেতুর শেষ স্প্যান। এর মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পেল সেতুর মূল কাঠামো। আমরা প্রবেশ করলাম পৃথিবীর দীর্ঘতম সেতুগুলোর তালিকায়, আর এসবের মাধ্যমেই পদ্মা সেতু করে ফেলেছে বেশ কিছু বিশ^ রেকর্ড। প্রকল্প সূত্র বলছে, সেই বিশ্ব রেকর্ডের সংখ্যা তিনটি। প্রথমটি সেতুর পাইলিং নিয়ে। পদ্মা সেতুর খুঁটির নিচে সর্বোচ্চ ১২২ মিটার গভীরে স্টিলের পাইল বসানো হয়েছে। এসব পাইল তিন মিটার ব্যাসার্ধের আর বিশ্বে এখন পর্যন্ত কোনো সেতুর জন্যই এতো গভীরে পাইলিং এর প্রয়োজন হয়নি। আর এতো মোটা পাইলও বসানো হয়নি। এরপর দ্বিতীয় রের্কডটি হলো, ভূমিকম্পের বিয়ারিং সংক্রান্ত। এই সেতুতে ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিংয়ের সক্ষমতা হচ্ছে ১০ হাজার টন। অর্থাৎ রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পেও টিকে থাকবে পদ্মা সেতু। আর এখনো পর্যন্ত পৃথিবীতে কোনো সেতুতেই এমন সক্ষমতার বিয়ারিং লাগানো হয়নি।
তৃতীয় বিশ্ব রেকর্ডটি নদী শাসন সংক্রান্ত। নদী শাসনে চীনের ঠিকাদার সিনোহাইড্রো করপোরেশনের সঙ্গে ১১০ কোটি মার্কিন ডলারের চুক্তি করেছে বাংলাদেশ এবং এর আগে পৃথিবীতে নদীশাসনে এককভাবে এতো বড় দরপত্র আর কখনোই হয়নি। এছাড়াও পদ্মা সেতুতে পাইলিং ও খুঁটির কিছু অংশে ব্যবহার করা হয়েছে অতি মিহি (মাইক্রোফাইন) সিমেন্ট আর এসব সিমেন্ট আনা হয়েছে সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে এবং এ ধরনের অতি মিহি সিমেন্ট সাধারণত খুব কম স্থাপনাতেই ব্যবহার করা হয় বলে জানিয়েছে সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা। অন্যদিকে নদীর পানি থেকে প্রায় ১৮ মিটার উঁচু পদ্মা সেতুর তলা। ফলে পানির উচ্চতা যতই বাড়–ক না কেন, এর নিচ দিয়ে পাঁচতলার সমান উচ্চতার যে কোনো নৌযান সহজেই চলাচল করতে পারবে। এখন মনে প্রশ্ন জাগতে পারে- সব জায়গায় কেন এমন সমান উচ্চতা? এর মূল কারণ হলো, সেতুর ভেতর দিয়ে থাকা রেললাইন। সড়ক ও রেললাইন একসঙ্গে থাকলে সেতু সাধারণত সমান হয়। না হলে ট্রেন চলাচল বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়াও বিভিন্ন মৌসুমে পদ্মার পানির প্রবাহে পরিবর্তন দেখা যায়। কখনো মাওয়া প্রান্তে কখনো জাজিরা প্রান্তে সরে যায়। আবার কখনো মাঝখান দিয়ে ¯্রােত প্রবাহিত হয়। আর এ জন্যেই নৌযান চলাচলের পথ সব স্থানেই সমান উচ্চতায় রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে, এ তো গেলো রেকর্ড আর খাতা-কলমের হিসাব নিকাশের কথা। কিন্তু পদ্মার সেতু কী আমাদের কাছে শুধু রেকর্ডের কোনো কিছু? না! কারণ, এই সেতুর সাথে জড়িয়ে আছে পদ্মার দুই পাড়ের লাখ লাখ মানুষের আবেগ আর অনেক দিনের লালিত স্বপ্নে! পদ্মা বহুমুখী সেতু হয়তো এ দেশের দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চল, তথা পুরো বাংলাদেশেরই যোগাযোগ ব্যবস্থা বদলে দিবে, বদলে দিবে অর্থনীতি। কিন্তু এসবের বাইরে গিয়েও পদ্মাসেতু নদীর দুই পাড়ের মানুষকে অন্যভাবে আশা জোগাচ্ছে, দেখাচ্ছে নতুন দিনের স্বপ্ন। কারণ এখন আর নদী পার হতে গিয়ে উত্তাল পদ্মার বুকে জীবন দিতে হবে না কাউকে, স্বজনদের কান্নায় ভারী হবে না আকাশ- বাতাস। এখন আর অসুস্থ বাবা-মায়ের অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরিতে বসে থাকতে হবে না। আফসোস করতে হবে না একটুর জন্য বাবা- মাকে বাঁচাতে না পারার! ঘন কুয়াশা বা ঝড়ো আবহাওয়ার জন্য সময়মতো ঢাকায় আসতে না পারায় চাকরির পরীক্ষা মিস হবে না কারো, স্বপ্ন ভাঙবে না কোনো তরুণের। তবে নিজস্ব অর্থায়নে আমাদের মতো একটি দেশের এমন একটি সেতু নির্মাণ করার পথটা কী আসলেই খুব সহজ ছিল? মোটেই না! শুরু থেকেই চলেছে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। উঠেছে দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ। একে একে পিছিয়ে গেছে সব দাতা সংস্থা। কিন্তু তবুও আমরা হাল ছাড়িনি। বুকে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছি আমরাও পারি। যে দেশের মানুষ সামান্য ডিঙি নৌকায় চড়ে উত্তাল পদ্মা পাড়ি দিয়ে ফেলতে পারে, আর যাই হোক তাদেরকে কোনোকিছু থেকে দাবিয়ে রাখা যায় না। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ সেতু দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলাসহ দেশের অন্যান্য এলাকার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হবে। এতে এ অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যেরও প্রসার ঘটবে, শিল্পায়ন হবে ও কর্মসংস্থান বাড়বে। পদ্মা সেতু চালু হলে একসময়ের অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চল রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে। এ সেতু দিয়ে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে ও মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত হবে। মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর দিয়ে নেপাল, ভুটান এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহন সহজ হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পদ্মা সেতু চালু হলে ১ থেকে ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বাড়বে।
চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন লিমিটেড পদ্মা সেতুর মূল কাজ করলেও এর সঙ্গে আরও বহু সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান যুক্ত। বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশ যুক্ত হয়েছে এ মহাকর্মযজ্ঞে। কোনো কোনো দেশ থেকে বিশেষজ্ঞ এসেছেন, কোনো কোনো দেশের যন্ত্রপাতি ও মালামাল ব্যবহৃত হচ্ছে। বিদেশি প্রকৌশলী, প্রযুক্তিবিদ, কারিগর ছাড়াও দেশের ৭০ জন প্রকৌশলী ও পাঁচ হাজার শ্রমিক পদ্মা সেতু নির্মাণকাজে যুক্ত হয়েছেন। এটি কেবল উন্নয়ন প্রকল্প নয়, পুরো জাতির আকাক্সক্ষা ও সক্ষমতার সম্মিলন।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করার ঘোষণা দেন। সে সময় দেশি-বিদেশি অনেক বিশেষজ্ঞ এ প্রকল্পের পরিণতি নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। এরপর ২০১৮ সালকে সময়সীমা ধরে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। সেতুর নকশা সংশোধন, বন্যা, ভাঙনসহ নানা কারণে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি। চলতি বছরের মার্চ মাসে করোনার প্রাদুর্ভাব ঘটলে কাজের গতি আরও মন্থর হয়ে যায়। গত নভেম্বর পর্যন্ত পদ্মা সেতুর কাজের সার্বিক অগ্রগতি ৮২ দশমিক ৫ শতাংশ। মূল সেতুর কাজ এগিয়েছে ৯১ শতাংশ। আর নদীশাসনের কাজ হয়েছে ৭৬ শতাংশ। পদ্মা বহুমুখী সেতু কেবল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতিই বদলে দেবে। আরও বিশদভাবে বলতে গেলে এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সব মিলিয়ে এই সেতু আসলেই দেশের মানুষের স্বপ্নের সেতু হয়ে আর্বিভূত হচ্ছে।
তবে নিজস্ব অর্থায়নে এমন একটি সেতু নির্মাণ করতে যাওয়ার কাজটি সহজ ছিল না। বহু বছর আমাদের যোগাযোগ ছিল নদীনির্ভর। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর সড়ক যোগাযোগ গুরুত্ব পেতে থাকে। এ ক্ষেত্রেও বাধা ছিল নদ-নদী। যেকোনো সড়ক তৈরি করতে গেলেই ছোট-বড় নদী অতিক্রম করতে হতো। অনেক ফেরি চালু ছিল। উত্তরাঞ্চলের মানুষ কখনো ভাবতেই পারেনি সকালে রওনা দিয়ে দুপুরে ঢাকা পৌঁছে যাবে। আবার কাজ শেষ করে সেদিনই ফিরে আসা সম্ভব হবে। ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতুর উদ্বোধন করা হয়। সে সময়েই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগের সুবিধার জন্য পদ্মায় সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়।
১৯৯৮ থেকে ২০০০ এই সময়ে পূর্ব সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয়। এরপর ২০০১ সালে জাপানিদের সহায়তায় সম্ভ্যবতা যাচাই হয়। ২০০৪ সালে জুলাই মাসে জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকার সুপারিশ মেনে মাওয়া-জাজিরার মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ২০০৮ সালে পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করে। মহাজোট সরকার শপথ নিয়েই তাদের নিয়োগ দেয়। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার সেতু করার চূড়ান্ত নকশা করা হয়। নতুন নকশায় নিচে চলবে রেল এবং উপরে মোটরগাড়ি।
কেন দোতলা সেতু হবে? এর সুবিধাই বা কী? এ পথটি ট্রান্স-এশীয় রেলপথের অংশ হবে। তখন যাত্রীবাহী ট্রেন যত চলবে, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি চলবে মালবোঝাই ট্রেন। ডাবল কনটেইনার নিয়ে ছুটে চলবে ট্রেন। পদ্মায় নৌযান চলে অনেক এবং সেটাও বিবেচনায় রাখতে হয়েছে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বাংলাদেশকে সহায়তার অঙ্গীকার করে। বিশ্বব্যাংক বলে, তারা এখানে মূল দাতা হবে। জাইকা ও ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকও ছিল। মূল সেতুর নির্মাণকাজের তদারকি কে করবে এ জন্য প্রস্তাব চাওয়া হয়। এরপরেই পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়াতেই তথাকথিত ঘুষের অভিযোগ ওঠে। বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্যরা বলেছেন- কোনো অনিয়ম হয়নি। তবে বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলারের অঙ্গীকার থেকে সরে যায়। এ ধরনের কাজের শর্ত অনুযায়ী মূল ঋণদাতা চলে গেলে অন্যরাও চলে যায়। কাজেই একে একে এডিবি, জাইকা ও আইডিবিও চলে যায়।
ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন মেনে সেতু ও নদীশাসনের কাজ দেয়া হয়েছে। কাজ তদারক করার আন্তর্জাতিক ঠিকাদার নিযুক্ত হয়েছে। তবে এ ধরনের বড় সেতু করার ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ আছে। প্রথম চ্যালেঞ্জ পদ্মা-যমুনার সম্মিলিত প্রবাহ। প্রতি সেকেন্ডে মাওয়া পয়েন্টে ১ লাখ ৪০ হাজার ঘন মিটার পানি প্রবাহিত হয়। আমাজন নদীর পরেই কোনো নদী দিয়ে এত বেশি পানি প্রবাহিত হয়। এখন নদীর যে তলদেশ, আগামী একশ বছর পর সেটা কেমন থাকবে, ভূমিকম্প প্রতিরোধে কী করা হবে? এগুলো বিবেচনায় রাখতে হয়েছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, আগামী একশ বছরে নদীর তলদেশের ৬২ মিটার পর্যন্ত মাটি সরে যেতে পারে। আরও ৫৮ মিটারসহ মোট ১২০ মিটার গভীরে গিয়ে পাইলিং করতে হচ্ছে। এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আর পদ্মা সেতু একটু বাঁকানো। কাজেই কাজটি আরেকটু কঠিন। এ ছাড়া আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ নদীশাসন। এ কাজেই ব্লকের পাশাপাশি জিয়ো টেক্সটাইলের বস্তা ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
২২ বছরের যাত্রা
১৯৯৮ সালে সরকারের তহবিলে প্রথম এই সেতুর প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ২০০৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত জাপানের সংস্থা জাইকার অর্থায়নে এর সম্ভাব্যতা পুনরায় যাচাই করা হয়। এরপর ২০০৭ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির বৈঠকে (একনেক) প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। এরপর অর্থায়নে এগিয়ে আসে বিশ্বব্যাংক: কিন্তু কিছুদিন পরই বিপত্তি দেখা দেয়। এতে তথাকথিত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সংস্থাটি প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায়। ফলে সেতুর ভবিষ্যৎ শঙ্কায় পড়ে যায়। এরপর সরকার এই সেতু নির্মাণে বিকল্প অর্থায়নের জন্য মালয়েশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে। এক পর্যায়ে বিশ^ব্যাংক পুনরায় ফিরে আসে অর্থায়নের জন্য। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে এর বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন।
প্রকৌশল বিষ্ময়
প্রকৌশলীরা বলেছেন, পদ্মার বুকে সেতু গড়ে তোলার ধারণাটিই ছিল বিস্ময়কর। কেননা পদ্মা নদীর তলের মাটি এতই পরিবর্তনশীল যে, মুহূর্তেই যেকোনো স্থান থেকে যে পরিমাণ মাটি সরে যায় তাতে ২১ তলা উচু ভবনের উচ্চতা সমপরিমাণ গভীরতার খাত তৈরি হয়। এমন একটি স্থানে পাইলিংয়ের মাধ্যমে খুঁটি স্থাপনের মতো বিশাল এক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে পদ্মা সেতুর প্রকৌশলীদের। বিশেষ পদ্ধতিতে শেষ পর্যন্ত পাইলিং করতে হয়েছে। রিকটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে টিকে থাকার মত করে পদ্মা সেতু নির্মাণ হচ্ছে। প্রকৌশলীরা জানান- নদীর পানি থেকে প্রায় ১৮ মিটার উঁচু পদ্মা সেতুর তলা। পানির উচ্চতা যতই বাড়ুক না কেন, এর নিচ দিয়ে পাঁচতলার সমান উচ্চতার যেকোনো নৌযান সহজেই চলাচল করতে পারবে।
যেভাবে কাজ এগিয়েছে
মূল সেতুর কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের নভেম্বরে। পরে কাজ পায় চীনের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রীজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। তাদের সাথে ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকার চুক্তি হয়। চার বছরের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। কাজ শুরুর পরের বছরই মাওয়ায় স্থাপিত নির্মাণ মাঠের বেচিং প্লান্টসহ একাংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ২০১৭ সালে প্রতিটি খুঁটির নিচে মাটি পরীক্ষায় ২২টি খুঁটির নিচে নরম মাটি পাওয়া যায়। তখন নকশা সংশোধনের জন্য প্রয়োজন দেখা দেয়। ফেরিঘাট স্থানান্তরেও সময় লেগে যায়। প্রকল্পের ব্যয় ছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা পরের বছর নকশা চূড়ান্ত অনুমোদন পায়।
২০১১ সালে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে দ্বিতীয় দফা সংশোধনের পর ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের জুনে আবারও ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। গত ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৪ হাজার ১১৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এসব খরচের মধ্যে রয়েছে সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদীশাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পূনর্বাসন ও পরিবেশ, বেতন-ভাতা ইত্যাদি। এ সেতু নির্মাণের ফলে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ হারে জিডিপি বাড়বে বলে সমীক্ষায় ওঠে এসেছে। আর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। মোংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থল বন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দর নগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতু অর্থনীতিতে যেমন প্রভাব ফেলবে তেমনি সহজ হবে মানুষের চলাচলও।
যেসব কাজ চলছে এখন
পদ্মা সেতু প্রকল্পের বেশ কিছু কাজ এখনও হয়নি। সেতুতে রোডওয়ে স্লাব এখনও বসানো শেষ হয়নি। স্লাব বসাতে হবে ২ হাজার ৯১৭ টি এর মধ্যে ১ হাজার ৩৩৩ টি স্থাপন করা হয়েছে। রেলওয়ে স্লাব বসানোর কাজও চলছে। রেললাইনের ২ হাজার ৯৫৯ টি স্লাবের মধ্যে ১ হাজার ৯৪২ টি এর মধ্যেই স্থাপন করা হয়েছে। অর্থাৎ সেতুতে প্রায় তিন কিলোমিটার চার লেনের সড়ক ও চার কিলোমিটার রেললাইন স্থাপনের কাজ শেষ। তবে সব স্লাব বসানো হলেও রেল চালু করা যাবে কিনা তা এখনো স্পষ্ট করে বলছে না কেউ।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পদ্মা সেতু খুলে দেয়ার দিনই মাওয়া থেকে ভাঙা পর্যন্ত রেল চলবে। বাকি অংশ পরে হবে। মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে মোট ৪৮৪ টি গার্ডার স্থাপন করতে হবে। এর মধ্যে ৩২১ টি স্থাপনা করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্রিজের রেলিং, স্ট্রিট ও আর্কিটেকচারাল লাইটিং, গ্যাস ও বিদ্যুৎ লাইন স্থাপন করতে হবে।
সেতু হলে কতটা লাভবান হব আমরা? এই সেতুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রথম কোনো সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। সেতু নির্মিত হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবন পাল্টে যাবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল কৃষিতে উন্নত। এই সেতু হয়ে গেলে তাদের কৃষিপণ্য খুব সহজেই ঢাকায় চলে আসবে। মোংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দরনগরে চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। পুরো দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে। কোনো বিনিয়োগের ১২ শতাংশ রেট অব রিটার্ন হলে সেটি আদর্শ বিবেচনা করা হয়। এই সেতু হলে বছরে বিনিয়োগের ১৯ শতাংশ করে ওঠে আসবে। কৃষি-শিল্প-অর্থনীতি-শিক্ষা-বাণিজ্য- সব ক্ষেত্রেই এই সেতুর বিশাল ভূমিকা থাকবে।
পর্যটনের নতুন সম্ভাবনার করিডোর
পদ্মা সেতুকে ঘিরে পদ্মার দুই পাড়ে সিঙ্গাপুর ও চীনের সাংহাই নগরের আদলে শহর গড়ে তোলা হচ্ছে। নদীর দুই তীরে আধুনিক নগর গড়ে তোলা সম্ভব। তবে সে জন্য এখনই পরিকল্পনায় কাজ চলছে। এই সেতু ঘিরে কী কী হতে পারে, কোথায় শিল্পকারখানা হবে, কোথায় কৃষিজমি হবে-সেসব এখনই বিবেচনা নেয়া হয়েছে। প্রয়োজনে এখানে প্রশাসনিক রাজধানী হতে পারে। এই সেতুকে ঘিরে পর্যটনে যুক্ত হবে নতুন মাত্রা। অনেক আধুনিক মানের হোটেল-রিসোর্ট গড়ে উঠবে। এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ২০৪১ সালে বাংলাদেশ যে উন্নত দেশ হবে, সে ক্ষেত্রেও এই সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সব মিলিয়ে বলা যায়, স্বপ্নের এই সেতুকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ।
পদ্মা সেতু শুধু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অপেক্ষাকৃত বঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে রাজধানী ঢাকা এবং চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক লাইফলাইনের সঙ্গে সংযুক্ত করবে না, এটা পুরো অর্থনীতিকে আক্ষরিক অর্থে একসূত্রে গাঁথার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ও অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে। এটা শুধু যোগাযোগ বা কানেক্টিভিটির দৃষ্টিকোণ থেকে না, এটা ঢাকা থেকে মাওয়া-জাজিরা-ভাঙা-পায়রা-কুয়াকাটা-যশোর-খুলনা-মোংলা পর্যন্ত সুবিস্তৃত একটি ‘ইকোনমিক করিডোর’ হিসেবে দেশের অর্থনীতির দ্বিতীয় সর্বোত্তম লাইফলাইনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে মোটেও সময় নেবে না।
পাল্টে গেছে ঢাকা- মাওয়া মহাসড়ক চিত্র
আমূল পাল্টে গেছে ঢাকা- মাওয়া মহাসড়কের পুরানো ভোগান্তি, ক’দিন আগেও ৩৫ কিলোমিটারের এ পথ পাড়ি দিতে সময় লাগতো কমপক্ষে ২ ঘণ্টা এখন লাগছে মাত্র ৪০ মিনিট। যদিও ৬ লেনের পুরো সুবিধা এখনো সড়কে নিযুক্ত হয়নি। সেটি হলে এ পথ পাড়ি দিতে সময় লাগবে মাত্র ৩০ মিনিট। দেশের প্রথম এ এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধন করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। ক’দিন আগেও জুরাইন, পোস্তগোলা, আব্দুল্লাহপুর আর নিমতলী পয়েন্ট ছিল রীতিমত আতঙ্কের নাম। মাত্র ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সময় লাগতো ২ থেকে আড়াই ঘণ্টা রেল ক্রসিং যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং বাস সিএনজির স্ট্যান্ড ছিল এর কারণ সে সবই এখন অতীত। আমূল পরিবর্তন ঢাকা- মাওয়া মহাসড়কের পুরানো ছবি। এখন জুরাইন থেকে নিমতলীর একই পথ পাড়ি দিতে এখন মাত্র সময় লাগে ৫ থেকে ৭ মিনিট। একটানে যাওয়া যাচ্ছে ঢাকা থেকে মাওয়া আর সর্বোচ্চ ১৫০ কিলোমিটার গতিতে চালানো যাবে গাড়ি কারণ সেভাবে তৈরি হয়েছে দেশের অন্যতম এক্সপ্রেসওয়ে। যা কিনা যুক্ত হবে এশিয়ান হাইওয়ের সাথে। ঢাকা- মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের মোট ব্যয় ১১ হাজার ৩ কোটি টাকা। পুরো সড়কে বড় সেতু আছে ৪টি, ছোট সেতু ২৫টি, ফ্লাইওভার ৫টি, রেল ওয়ান্ডারপাস ১৯টি ও কালভার্ট ৫৪টি। সবই ঝকঝকে নতুন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন- ২০ বছরের ভবিষ্যৎ ট্রাফিক ভলিউম বিবেচনা করেই ডিজাইন করা হয়েছে এই সড়কের। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর ফরিদপুর থেকে ভাঙা পর্যন্ত এ এক্সপ্রেসওয়ের দৈর্ঘ্য হবে ৫৫ কিলোমিটার। ঢাকা মাওয়া মহাসড়ক উদ্বোধনের মধ্যে দিয়ে দেশের সড়ক ব্যবস্থায় নতুনভাবে যুক্ত হতে যাচ্ছে এক্সপ্রেসওয়ে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় এ এক্সপ্রেসওয়ের ব্যয় বেশি হলেও সংশ্লিষ্টরা বলেছেন- এতে সরাসরি উপকৃত হবে দেশের ২১ জেলার মানুষ। আর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আরও সচল হবে শুধু এ সড়কের মাধ্যমে।
নতুন ইকোনমিক করিডোর
শিল্পায়নে দেশীয় এবং বৈদেশিক পুঁজি আকর্ষণে ঢাকা-কুমিল্লা-মিরসরাই-চট্টগ্রাম-আনোয়ারা-মাতারবাড়ী-কক্সবাজার-টেকনাফের মতো আরেকটি আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠতে এই ইকোনমিক করিডোরের এক দশকও লাগবে না। কারণ মোংলা ও পায়রা বন্দর দুটোর সামুদ্রিক যোগাযোগ সুবিধা ২০২২ সালেই পেয়ে যাওয়ার পাশাপাশি নির্মীয়মাণ মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর থেকেও দূরত্বের দিক থেকে এই করিডোর বেশি ‘কস্ট-ইফেক্টিভ’ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। উপরন্তু, আন্তঃদেশীয় অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে যদি ভবিষ্যতে গতি সঞ্চারিত হয়, তাহলে এই করিডোর ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোরের চেয়ে অনেক বেশি সুবিধাজনক বলে বিবেচিত হবে। এমনকি ঢাকামুখী অভিবাসন¯্রােত নিরসনেও উল্লিখিত করিডোর তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখবে।
কূটনৈতিক মর্যাদার মাইলষ্টোন
২০১২ সালের ৩০ জুন বিশ্ব ব্যাংক যখন সেতু নির্মাণে বরাদ্দ ১.২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ বাতিলের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল, বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদদের অনেকেই ওই সিদ্ধান্তকে ‘শাপেবর’ আখ্যা দিয়েছিলেন। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা যে বাংলাদেশের রয়েছে, তা যুক্তিসহকারে ব্যাখ্যা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে এই সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সুধীজনেরা আকুল আহ্বান জানিয়ে ছিলেন গর্বভরে স্মরণ করছি- দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ-পন্ডিতদের সতর্কবাণী এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কটুবাক্যকে উপেক্ষা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংসদে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে সারা বিশ্বকে বিমোহিত করেছিলেন। তাঁর ওই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের আত্মনির্ভর অর্থনীতি বিনির্মাণ ও কূটনৈতিক মর্যাদার ইতিহাসের সবচেয়ে সাহসী মাইলস্টোন হিসেবে ইতোমধ্যেই প্রমাণিত হতে যাচ্ছে।
প্রতিবেদক : এআইজি
(প্ল্যানিং অ্যান্ড রিসার্চ-১)
বাংলাদেশ পুলিশ
0 Comments