মিজানুর রহমান শেলী
শিল্পীরা ছবি আঁকেন ক্যাম্পাসে। আর জেসি আঁকেন শরীরে। জি¦ তাই হয়েছে। রিফাত জেসমিন জেসি এক ‘ভয়ংকর’ গৃহকর্ত্রী। নিজের নিষ্ঠুর মানসিকতার ছাপ এঁকে দিতেন গৃহকর্মীদের শরীরজুড়ে। তার নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিল অনেক গৃহকর্মী। সর্বশেষ এক গৃহকর্মীকে হত্যার পর গুমের অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গতকাল বুধবার পুলিশ তাকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের সুযোগ পেয়েছে। এদিন রিমান্ড শুনানি শেষে ময়মনসিংহ চার নম্বর আমলি আদালতের বিচারক মাহবুবা আক্তার তার এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
গৃহকর্মী সাবিনাকে হত্যার বিষয়ে জেসি কোনো তথ্য দেয়নি। এ জন্য তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হয়। তাকে আদালতে হাজির করে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। ময়মনসিংহ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের চার নম্বর আমলি আদালতের বিচারক মাহবুবা আক্তার তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। সে সময় আদালতে উপস্থিত জেসির মধ্যে কোনো অনুতাপ দেখা যায়নি। বিচারকের সামনেও আভিজাত্য দেখানোর চেষ্টা করেন বলে তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই পুলিশ পরিদর্শক আবুল কাশেম জানান।
পিবিআই ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার গৌতম কুমার বিশ্বাস বলেন, স্বামী স্বীকারোক্তি দিলেও জেসি কোনো তথ্য দিচ্ছিল না। তাই রিমান্ডে আনা হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, এর আগেও বেদেনা নামে গৃহকর্মীকে বাসায় আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে রাস্তার পাশে ফেলে দেওয়া হয়। সে সময় মামলাও হয়েছিল। একটি ক্লুবিহীন মামলার তদন্তে বেরিয়ে এসেছে গৃহকর্ত্রীর ভয়ংকর মানসিকতা।
জেসি যা করেছেন তা মানবতা ইতিহাসের এক জঘন্য অধ্যায়। এই অধ্যায় পৃথিবীতে আর ফিরে আসুক কোনোভাবে তা কাম্য নয়।
পরকীয়ার জন্য স্ত্রী খুন করান স্বামীকে
১৩ বছর বয়সি একমাত্র ছেলে শুভকে নিয়ে জীবিকার সন্ধানে সুদূর নাটোর থেকে সস্ত্রীক চট্টগ্রামে এসেছিলেন দিনমজুর রফিকুল ইসলাম। স্বপ্ন পূরণে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে যে মানুষটি চট্টগ্রামকেই নিরাপদ আশ্রয় মনে করে আঁকড়ে ধরেছিলেন, তিনি কী কখনো ভুলেও ভেবেছিলেন সেই শহর কেড়ে নেবে তার জীবন! সন্তানের ভবিষ্যৎ। কিংবা বুননেই স্বপ্নের মৃত্যু। বেঁচে থাকার স্বপ্ন নিয়ে যেই শহরে আসা, সেখানেই পড়ে থাকে পচনধরা মরদেহ রাস্তার পাশে, ব্রিজের পাশে! যে স্বপ্নের আশায় মানুষের পথচলা, সেই স্বপ্নই কাল হয়ে ওঠে কারো কারো জীবনে!
২০১৯ সালের ৪ ডিসেম্বর রাতে ভাটিয়ারি ইউনিয়নের বিএমএর উত্তর পার্শ্বে হাটহাজারী-সীতাকু- সংযোগ সড়কের পাশ থেকে রফিকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পেটে বুকে ধারালো অস্ত্রের কোপ। রক্তাক্ত দেহ। নিথর রফিক! নিথর একমাত্র সন্তানের স্বপ্নময় ভবিষ্যৎও।
সেই রাতেই নিহত রফিকের স্ত্রী উম্মে সালমা স্বামীর মরদেহ শনাক্ত করতে আসেন সীতাকু- থানায়। বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন স্বামী হারানোর শোক, হঠাৎ প্রিয় মানুষটি নেই ভাবতেই ছেলে শুভর স্বপ্ন ভঙ্গের আতঙ্কে উম্মে সালমার আর্তনাদ আর কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে থানা। ওই রাতে চোখভরা জল শুধু উম্মে সালমার চোখেই গড়ায়নি, গড়িয়েছে ছেলে শুভসহ থানার দায়িত্বরত প্রত্যেক পুলিশ সদস্যের চোখের পানি। নিজে বাদি হয়ে অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করে সীতাকুন্ড থানায় মামলাও করেন তিনি। স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে আসামিদের ধরতে আকুতি করেন পুলিশের কাছেও।
প্রায় নয় মাস কেটে গেলেও হত্যাকান্ডের কোনো কূল-কিনারা করতে পারেনি থানা পুলিশ। অবশেষে নয় মাস পর পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে ২০২০ সালের ১৯ আগস্ট মামলাটি গ্রহণ করে পিবিআই। থানা পুলিশ না পারলেও পিবিআইয়ের অনুসন্ধানে ঠিকই বেরিয়ে আসে দিনমজুর রফিকুল ইসলাম নিহত হওয়ার লোমহর্ষক সেই কাহিনি।
কোনো দুর্ঘটনা নয়, ঘাতক কোনো আগন্তুকও নয়। দিনমজুর সেই রফিকের বুকে ছুরি চালিয়েছিল তারই বন্ধু সাকিব ও ভাড়াটিয়া খুনি এমরান! আর পাশে দাঁড়িয়ে থেকে সেই নির্মম হত্যাকান্ডের ঘটনা তদারকি করেছিলেন তারই স্ত্রী উম্মে সালমা নিজেই!
৪২ বছরের রফিকের সাথে বন্ধুত্ব ছিলো ২০ বছর বয়সি শাকিবুল ইসলাম সাকিবের। রফিকের বাসায় আসা-যাওয়া ছিলো তার। সে সুযোগে শাকিবের সাথে পরকীয়া সম্পর্কে জড়ায় উম্মে সালমা। বিষয়টি জেনে যাওয়ায় রফিককে হত্যার পরিকল্পনা করে শাকিব ও সালমা। ৪০ হাজার টাকায় ভাড়া করেন এমরান নামে একজনকে। পরে তিন জনে মিলে বুকে ছুরি চালিয়ে হত্যা করে রফিককে। এমনি এক হৃদয়বিদারক কাহিনির বর্ণনা করলেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রাম জেলার উপ-পরিদর্শক মো. কামাল আব্বাস। বলেন, ইতোমধ্যে তিন জনকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
কিশোরী উদ্ধার, যুবক গ্রেফতার
কুড়িগ্রাম হতে গাজীপুরে বেড়াতে আসা এক যুবককে মারধর করে তার সঙ্গী এক কিশোরীকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর শুক্রবার অপহৃত কিশোরীকে উদ্ধার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
ঘটনার সঙ্গে জড়িত এক যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতের নাম মোঃ শামীম মিয়া (৩৩)। সে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের পশ্চিম চান্দনা বনরূপা রোড এলাকার কফিল উদ্দিনের বাড়ির ভাড়াটিয়া লাল মিয়ার ছেলে। তাদের গ্রামের বাড়ি জামালপুর জেলা সদর থানার হাই চন্ডা এলাকায়।
কুড়িগ্রাম থেকে গাজীপুরে বেড়াতে আসেন কুড়িগ্রামের রাজীবপুর থানার মরিচাকান্দি এলাকার কোরবান আলীর ছেলে মোঃ মাহিম (১৮) ও একই এলাকার মোহাম্মদ সজীব মিয়ার মেয়ে রিক্তা আক্তার (১৬)। বুধবার রাত আড়াইটার দিকে তারা বাস থেকে গাজীপুরের কোনাবাড়ি এলাকায় নামেন। তারা ব্যাটারিচালিত একটি অটোরিকশায় চড়ে শহরের শিববাড়ি মোড়ের উদ্দেশ্যে যাওয়ার পথে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ের পাশর্^বর্তী গাজীপুর পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি কার্যালয়ের সামনে কয়েক যুবক রিকশার গতিরোধ করে তাদের টাকা পয়সা ছিনিয়ে নেয়। পরে মাহিমকে মারধর করে এবং অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে কিশোরী রিক্তা আক্তারকে অপহরণ করে নিয়ে যায় যুবকরা।
এ ঘটনায় জিএমপি’র বাসন থানায় মামলা দায়ের করা হয়। গাজীপুর পিবিআই পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাকছুদের রহমান জানান, অপহরণের খবর পেয়ে রাতেই পিবিআই অভিযান শুরু করে। শুক্রবার ভোররাতে মহানগরীর সালনা এলাকার একটি বাড়ি থেকে অপহৃত ওই কিশোরীকে উদ্ধার করা হয়। এ সময়ে অপহরণকারীদের দলের সদস্য শামীম মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়।
যুবলীগ নেতার হত্যারহস্য
৭ বছর পর উদঘাটন
দীর্ঘ ৭ বছর পর পাবনার যুবলীগ নেতা রফিকুল ইসলাম লাভলু হত্যাকান্ডের মূল হোতাকে আটক করে হত্যার রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পাবনা ইউনিট। চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকান্ডের মূল হোতা গ্রেপ্তার হলেও সহযোগীরা পলাতক রয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে বলেও জানিয়েছে পুলিশ।
পিবিআই পাবনার পুলিশ সুপার মো. ফজলে এলাহি জানান, পাকশী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও যুবলীগ নেতা লাভলুকে ২০১৪ সালের পহেলা সেপ্টেম্বরে লালন শাহ সেতুর টোল প্লাজার কাছে অজ্ঞাত পরিচয় ৩-৪ জন ছিনতাইকারী রাস্তায় গতিরোধ করে কুপিয়ে হত্যা করে মোটরসাইকেল ও মোবাইল ফোন নিয়ে পালিয়ে যায়।
এ ঘটনায় ঈশ্বরদী থানায় মামলা দায়েরের পর পুলিশ ও সিআইডি তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয়। মামলার বাদী আব্দুর রাজ্জাক অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন দিলে বিজ্ঞ আদালত পিবিআইকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়। দীর্ঘ তদন্ত শেষে পিবিআই তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে হত্যাকা-ের মূল হোতা পলাশ মিয়াকে (৩৪) রাজশাহী জেলার চারঘাট উপজেলার কালারিপারা এলাকা থেকে গ্রেফতারের পর পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে।
ফজলে এলাহি আরও জানান, ‘জিজ্ঞাসাবাদে পলাশ জানায়, নিহত লাভলু ঘটনার দিন রাতে পাকশী লালন শাহ সেতুর টোল পয়েন্টের কাছে পৌঁছালে পলাশ ও তার দলবল রশি ফেলে তাদের গতিরোধ করে তাদের মারধর করে এবং ছুরিকাঘাত করে। এতে লাভলুর মৃত্যু হলেও বেঁচে যান তার সঙ্গে থাকা মোসতাকিন মনোয়ার।
এ ঘটনায় অজ্ঞাত পরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা হলে পিবিআই তদন্ত করে পলাশের নাম জানতে পারে। পরে পলাশকে গ্রেফতারের পর তার কাছ থেকে হত্যাকান্ডের ঘটনার মূল রহস্য উদঘাটন করা হয় এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের নাম জানা যায় বলেও জানান তিনি।
জিজ্ঞাসাবাদ শেষে হত্যাকান্ডের মূল হোতা পলাশ মিয়াকে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে।
পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বিপিএম (বার), পিপিএম বলেন, আমাদের সৌন্দর্য হলো, আমরা মানুষের কথা শুনি। সময় দিয়ে কাজ করি। চেষ্টা করি অনেক পুরনো মামলাকে ডিটেক্ট করার।
লেখক : এসপি, পিবিআই, ঢাকা মেট্রো সাউথ
0 Comments