আ ফ ম নিজাম উদ্দিন পিপিএম (বার)
কমলা, ২৪ বছর বয়স, গায়ের রঙ ‘মায়ের চোখে শ্যামলা’ হলেও প্রসাধনের ব্যবহারে উজ্জ্বল, কানে লম্বা দুল, গলায় ভারী স্বর্ণালী মালা। বড় মালাটি ছোট আর একটি মালাকে ছাপিয়ে গেছে। চোখ দুটো কালো কাজলে আঁকা- ভুরু দুটিতে কালো পেন্সিলের পরশ। ঠোঁট দুটো টকটকে লাল- সেটা লিপস্টিকের কারণে নাকি পানের রসের কারণে, সেটা বোঝা মুশকিল; খোঁপা বাঁধা চুলে গাঁদা ফুল গোঁজা, লাল পাড়ের শাড়িটা সোনালি দ্যুতি ছড়ানো বক্ষাবরণীকে পুরো ঢাকতে না পারলেও তাতে কমলার উচ্ছলতায় লজ্জার স্থান নেই। কমলা একা নয়, তার সঙ্গে আছে আরও পাঁচ সাথি; সবার নেতৃত্বে আছেন মধ্যবয়স্ক একজন, সবাই তাকে ডাকে ‘গুরু মা’।
কমলারা আজ এসেছে বস্তির একটা ঘরে, এখানে আজ সকালেই জন্মেছে একটা মেয়ে। বাচ্চাটা যখন তার মা- বাবার হাত গুরে দাদার কোলে, ঠিক সেই সময় কমলাদের আগমন। দাদির হাত থেকে কমলার গুরু বাচাটিকে নিয়ে কমলার হাতে দেয়, কমলার দলবল ঢোলের তালে নেচে নেচে গাইতে লাগলো-
ঈশ’রে..আই’লা..
বলি ও দিদি লো…
পরীর মতো তোর ঘরে খুকী হয়েছে,
মেয়ের মাসিগণের পিসি-
খবর পেয়েছে;
ঢাক-ঢোল নিয়ে তারা নাচতে এসেছে…
প্রতিবেশীরা ইতোমধ্যে জড়ো হয়ে গেছে, গোল হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলো কমলাদের আনন্দ উচ্ছ্বাস। কমলার কোলে ছোট্ট শিশুটি পরম যত্নে ধরা, মা যেমনভাবে তার সন্তানকে সানন্দে বুকে নেয়, কমলাও তেমনিভাবে শিশুটিকে যেন দুধ খাওয়াচ্ছিলো। নাচ-গানের এক পর্যায়ে এক ঢোলকের কাছ থেকে লাল পাউডার নিয়ে কমলা মেয়েটির কপালে সিঁদুরের মতো এঁকে দেয়। দলের সবাই গাইছিলো-
আমার মাথায় যত চুল আয়ু তত হবে
সেজে গুঁজে সোনার মেয়ে শ্বশুরবাড়ি যাবে
মেয়ের মাসিগণের পিসি-
খবর পেয়েছে;
ঢাক-ঢোল নিয়ে তারা নাচতে এসেছে…
এদিকে যখন গানে নাচে মুখরিত সবাই, কমলার দলের একজন দ্বারে দ্বারে ঘুরছিলো, হাতে তার একটি বাঁশের ঢালা। এক-দু মুঠো চাল দিতে কেউই কার্পণ্য করেনি। সব ঘর ঘুরে সে যখন ফিরে এলো, কমলার গুরু একমুঠো চাল হাতে নিয়ে সযত্নে কয়েকটা ছিটিয়ে দিলো ছেলেটির গায়ে, বাকিটা ছিটালো তার গৃহ প্রাঙ্গণে।
এবার কমলা ছেলেটিকে পরম মমতায় তার মায়ের বুকে তুলে দিলো, ফিরে এলো নতুন সাজে। এ সাজ একজন গর্ভবতী মায়ের, পেটটা ফুলে উঠেছে, অভিব্যক্তিতে সন্তান গর্ভে নেয়া মায়ের কষ্ট। ঢোলের তাল বদলে গিয়ে বেজে উঠলো করুণ সুর, যেন সন্তান প্রসবের বেদনাক্লিষ্ট মায়ের কষ্ট ছড়িয়ে দিচ্ছে আকাশে-বাতাসে। কমলা তখন বৃত্তের মধ্যে। কি দারুণ সেই অভিনয়, চোখে অশ্রু কিন্তু মনে ভয় জয় করার সাহস। শুয়ে পড়লো কমলা, তার দলের দুজন এগিয়ে এলো, যেন ধাত্রী এসেছে নবজাতক’কে পৃথিবীর আলোয় নিয়ে আসতে। কমলার চিৎকার, সে চিৎকার প্রসব বেদনার নিনাদকেও যেন হার মানায়। অবশেষে বেরিয়ে এলো একটি বস্ত, না – সেটা কোনো মানব সন্তান নয়; একটা ছোট বালিশ। কমলার কাছে সেটি একজন সন্তান, সব কষ্ট ভুলে গিয়ে পরম মমতায় তাকে যেন বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে। দলের সবার চোখ ছল- ছল। মা হওয়ার যে একান্ত বাসনা গৃহত্যাগী হওয়ার কারণ হয়েছিলো, আজ যেন সেই ইচ্ছা পূর্ণতা পেলো। ঢোলের বোল আবার নাচের উপলক্ষ হলো, কমলারা চললো গোসল করতে; সঙ্গে গাইছিলো-
আমরা নারীও না, পুরুষও না
করলাম কি রে পাপ
জনম দোষে আমরা হায়রে হইলাম না মা-বাপ;
মরা গাছে তবু হায়রে ফুল ফুটেছে;
বিধি মোদের কোন দোষে হিজড়া করেছে,
ঢাক ঢোল নিয়ে তারা নাচতে এসেছে…
কমলার মনে পড়ে যায় ছোট বেলার কথা। জন্মেছিলো সে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। বাবা নাম রেখেছিলেন ফরহাদ। নামের অর্থের মতোই সে ছিলো বুদ্ধিমান-বিচক্ষণ। পড়া লেখা ভালোই চলছিলো তার স্কুলে। কিন্তু ফরহাদের ভালো লাগতো মেয়েদের সঙ্গে খেলতে। বাকি বন্ধুরা যখন দৌড়াদৌড়ী, কাদা মাখামাখি, ফুটবল-ক্রিকেট নিয়ে মত্ত, ফরহাদের ভালো লাগতো রান্না বান্না, দাড়িয়াবান্ধা এসব নিয়ে খেলতে, ভালো লাগতে নাচতে-গাইতে, সাজতে। তার যৌনাঙ্গ নিয়ে সে খুব বেশি সচেতন না থাকলেও বাবা-মা কিছুটা চিন্তিত ছিলেন। একসময় ফরহাদ বাসায় আবদার করতে লাগলো মেয়েদের মতো সালওয়ার-কামিজ পরবে সে। তার বাবা-মা ভেবেছিলো, এ বুঝি কেবল কৈশোরের বাহানা! বয়স তার ১৭ হতেই বিয়ে দিলো তার বাবার এক বন্ধুর সুন্দরী কন্যার সঙ্গে। বিয়ের পরদিন কন্যা যখন তার বাবার বাড়ি ফিরে গেলো, সেদিনই সে বুঝতে পারলো; সে এই সমাজের বাকি সবার মতো না। সেদিন তার কাছে পরিচিত জগৎ অপরিচিত হয়ে গেলো। বাবা-মা, পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধু বান্ধব সবার কাছে সে যেন হয়ে উঠলো অস্পৃশ্য। ঘর ছাড়তে বাধ্য হলো ফরহাদ।
সেদিন ক্ষুধায়, অপমানে তার চোখের জল শুকিয়ে গেলেও, একটু মমতার ছোঁয়াও পায়নি কারো চোখে। প্রথম রাতে রেলস্টেশনে বসে বসে কাটাতে চাইছিলো, কিন্তু আঁধার হতেই অচেনা পরিবেশ তার জন্য ভীতির কারণ হয়েছিলো। সারা রাত হাঁটতে হাঁটতে সকালে আশ্রয়ের জন্য গিয়েছিলো সহপাঠী এক বন্ধুর বাড়ি; বন্ধুটি তার এক গ্লাস পানির জন্য আকুতিকেও পাত্তা দেয়নি, দুর দুর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলো। লজ্জায় অপমানে ক্ষুধা ভুলে সেদিন ফরহাদ চেয়েছিলো- মাটিটা যেন ফাঁক হয়ে যায়, মৃত্যুদূত যেন তাকে মুক্তি দেয়। ফরহাদ ভুলে গিয়েছিলো সময়, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়েছিলো তার চিন্তা জগতো, বুঝতে পারছিলো না সে কোথায় আছে, কোথায় চলছে। ক্লান্তি-ক্ষুধা আর পাথরের মতো শক্ত হয়ে যাওয়া পা ফসকে গিয়ে কখন-কোথায় সে জ্ঞ্যান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েছিলো, সেটা আজো মনে করতে পারে না।
সম্বিত যখন ফিরে পেয়েছিলো, সেটা ছিলো একটা অচেনা ঘর, ঝুঁকে থাকা মুখগুলো তার সম্পূর্ণ অপরিচিত। কিন্তু তাদের চোখে ছিলো মমতা, একজন সস্নেহে কপালে হাত দিয়ে বলেছিলো, ‘এখন কেমন লাগছে?’। জবাবে কান্নায় ডুকরে উঠলে, তাকে বুকে টেনে নিয়েছিলো সেই অপরিচিত। তাকে অভয় দিয়েছিলো, বলেছিলো- জীবন অনেক বড়।
তারপর সেই মানুষদের সঙ্গে তার পথচলা, একসঙ্গে বসবাস, জীবন যাপন। কে যেন একদিন বলেছিলো, ‘তুমি খুব তাড়াতাড়ি আমাদের হবে’। সে আর এক অভিজ্ঞতা। সেই অমবস্যা রাতে ঠিক কি হয়ছিলো তার সবটা মনে পড়ে না, শুধু প্রচ- যন্ত্রণার অনুভূতিটা স্মৃতির অতল থেকে মাঝে মধ্যেই উঁকি দেয়। তবে এটা খুব ভালো করে মনে আছে, তাকে সে রাতে সাজানো হয়েছিলো তার মনের মতো করে। সচেতন-অচেতন অনুভূতির মধ্যে মনে পড়ে, তাকে কোলে শুইয়ে নিয়ে ছোট্ট শিশুর মতো দুধ খাইয়েছিলো, পাশ থেকে একজন বলে উঠেছিলো- ‘ইনি তোমার গুরু মা, পা ছুঁয়ে প্রণাম করো’। গুরু মা বলেছিলেন, ‘আর কোনো ভয় নেই বাবু, এখন থেকে তুমি আমাদের একজন’। সে রাতেই মৃত্যু হয়েছিলো ফরহাদ’র, জন্ম হয়েছিলো কমলা’র।
লেখক : পুলিশ সুপার, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, ঢাকা।
0 Comments